সাধারণ মানুষের কথাও একটু ভাবুন
Published: 7th, February 2025 GMT
মানুষ কষ্টে আছে। কিন্তু রাজনীতির ডামাডোলে মানুষের কষ্টের কথাগুলো চাপা পড়ে যায়। চারদিকে শুধু সংস্কার আর নির্বাচনের কথা। এর মধ্যে চলছে নানান আন্দোলন ও আবদার। বিশ্ববিদ্যালয় দিতে হবে, চাকরি স্থায়ী করতে হবে, গ্রেড বদলাতে হবে, ক্যাডারে নিতে হবে কিংবা ক্যাডার থেকে বাদ দিতে হবে, মহার্ঘ ভাতা দিতে হবে ইত্যাদি। এসব করতে অনেক টাকার দরকার। সরকারের টাকা নেই। জনগণের কষ্টের রোজগারের টাকা সরকারের টাকা নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। যাঁরা আন্দোলন-আবদার করছেন, তাঁরা কি জানেন না যে এত কিছু চাইলে জনগণের ওপর কত চাপ পড়বে? এমনিতেই তো মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের অবস্থা ত্রাহি মধুসূদন!
দেশে একটা নতুন সরকার এসেছে। একটা গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। আসলে এটা আর সব সরকারের মতোই। কথাবার্তায়, আচার-আচরণে কোনো ফারাক নেই। তাঁদের অনেকেরই এক বা একাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাড়ি আছে। কিন্তু প্রায় সবাই ‘সরকারি’ গাড়ি-বাড়ি’ নিয়েছেন। কাউকে বলতে শুনলাম না, আমার গাড়ি আছে, আমি সরকারি গাড়ি নেব না। এটা বলতে মেরুদণ্ড লাগে, গাটস লাগে। লাল ম্যাটের ওপর দাঁড়িয়ে তাঁরা ফিতা কেটে প্রকল্প উদ্বোধন করছেন, সাংবাদিকদের সামনে কথার তুবড়ি ছোটাচ্ছেন। ১৬ বছর এটা হয়নি, ওটা হয়নি বলে আক্ষেপ করছেন। এভাবে কত দিন যাবে?
অনেক মানুষ এখনো বিশ্বাস করেন, তাঁদের দেখভাল করার জন্য, তাঁদের মুশকিল আসান করতে কয়েক বছর পরপর আসমান থেকে দেবদূতেরা এসে হাজির হন। মন্ত্রীরাও এ রকম। এখন তাঁদের বলা হচ্ছে উপদেষ্টা। পদমর্যাদায় মন্ত্রী। পাকিস্তান আমলে বলা হতো উজির। তাঁরা কি জানেন না, সাধারণ মানুষের সমস্যা কী, প্রয়োজন কী, দাবি কী? তাঁরা তো একসময় ‘সাধারণের’ কাতারেই ছিলেন।
একটা সভ্য সমাজে টিকে থাকতে ও চলাফেরা করতে ন্যূনতম চারটি বিষয় লাগে—স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গণপরিবহন ও নিরাপত্তা (আইনশৃঙ্খলা)। আমাদের দেশে এসব সব সময়ই ছিল অপর্যাপ্ত। এগুলোও এখন ধ্বংসের পথে, ব্যক্তি খাতে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গণপরিবহন এখন আর সামাজিক খাতে নেই। এগুলো মুনাফাখোরদের হাতে চলে গেছে। টাকা থাকলে এসব সেবা কেনা যায়। যাঁর টাকা নেই, তাঁর আল্লাহ ভরসা।
এ দেশের মুনাফাখোরেরা টাকার পেছনে দৌড়ালেও মানের দিকে নজর দেন না। মানসম্পন্ন সেবা দিয়েও যে মুনাফা করা যায়, এটি তাঁরা জানেন না বা মানেন না। যে লুণ্ঠনপ্রক্রিয়া এ দেশে চালু হয়েছিল পাঁচ দশক আগে, এখন তা সর্বব্যাপী। এ দেশে বুর্জোয়া শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। তার বদলে তৈরি হয়েছে লুটেরা শ্রেণি, ‘লুম্পেন বুর্জোয়া’। তাঁরা কলকারখানা, মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, পাহাড়-জলাভূমি সব খেয়ে ফেলেছেন। তারপরও তাঁদের পেট ভরেনি। শহরে পাখি নেই, নিশ্বাস নেওয়ার মতো এতটুকু বাতাস নেই, খাওয়ার মতো এক আঁজলা জল নেই, খেলাধুলার জন্য নেই এক টুকরা মাঠ। সব ছিনতাই হয়ে গেছে।
কত বছর ধরে শুনে আসছি, শহরে মানুষের তুলনায় রাস্তা কম, যানবাহন বেশি। ছোট গাড়িগুলো একজন বা দুজনকে নিয়ে শাঁই করে চলে যায়। অনেক বেশি যাত্রী নিয়ে বড় গাড়ি চলাচল করলে মানুষের সুবিধা বাড়ে। যানজট কম হয়। এত বছরেও সেটির বাস্তবায়ন দেখলাম না। ঢাকা শহরে বিভিন্ন রুটে কয়েক হাজার ডাবলডেকার বাস নামিয়ে দিলে মানুষ আরাম পেত। কিন্তু পাবলিকের টাকায় সোফাসমেত গাড়ি চড়ে যাঁরা পোদ্দারি করেন, সিদ্ধান্ত তো নেন তাঁরা। সে জন্য গণপরিবহনের ব্যবস্থা হয় না। এক রুটের মেট্রোরেল দিয়ে বিগত সরকার যে তেলেসমাতি দেখাল, তার গন্ধ হাতে চেটে আর কত কাল কাটাবে মানুষ!
জননিরাপত্তা নিয়ে কী আর বলব? এক উপদেষ্টা বলেছেন, পুলিশের শতকরা ৮০ ভাগই নাকি ছাত্রলীগের ক্যাডার। তার মানে, জননিরাপত্তা নয়, তাঁদের নেতাকে সুরক্ষা দিতেই তাঁরা বেতন-ভাতা নিতেন। আমরা দেখলাম, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর রাস্তায় ট্রাফিক সামলেছেন ছাত্ররা। অভিজ্ঞতার অভাবে তাঁরা ছিলেন অনেকটা এলোমেলো। প্রশিক্ষণ পেলেই তাঁরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতেন। এই তারুণ্যকে কাজে লাগাতে পারত ইউনূস সরকার। সেটি হয়নি। পুলিশের অনেক লোক পলাতক ছিলেন। অনেকেই ফিরে আসেননি। ওই তরুণদের মধ্য থেকেই এক লাখ সদস্যকে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ দিয়ে পুলিশ বিভাগে নিয়োগ দেওয়া যেত। তাঁদের অনেকেরই ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে। যখন যে কাজটি করতে হয়, তার সিদ্ধান্ত নিতে হয় চটজলদি। একটি বিপ্লবী সরকার থাকলে তা-ই হতো। সিদ্ধান্ত নিতে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগত না। নবিশরাই কালক্ষেপণ করে।
কথাবার্তায় মনে হয়, এই সরকারের প্রধান কাজ হলো অতীতের জঞ্জাল সাফ করা। অর্থাৎ গত ১৬ বছরে যে ময়লা জমেছে, তা পরিষ্কার করা। এখানেও একটা শুভংকরের ফাঁকি আছে। সমস্যাটা ১৬ বছরের নয়, এটি ৫৩ বছরের। শুধু অতীতের জাবর কাটলে তো জীবন চলবে না। তাকাতে হবে সামনের দিকে। আপনারা কাকে ধরবেন, কাকে ডান্ডাবেড়ি পরাবেন, কাকে ঝোলাবেন, সেটি নাহয় চলবে। কিন্তু ১০-২০ হাজার লোককে জেলে ঢোকালে আমাদের কী লাভ? আমরা তো ঘরের কাছের হাসপাতালে চিকিৎসা চাই। শেখ হাসিনা যেমন হাসপাতালে কারফিউ দিয়ে একা একা কাউন্টারে দাঁড়িয়ে ১০ টাকার স্লিপ কেটে ডাক্তার দেখাতেন, সে রকম নয়। হাসপাতালে ডাক্তার-নার্স থাকবেন, যন্ত্রপাতি থাকবে, চাওয়ামাত্র চিকিৎসা পাওয়া যাবে, এ রকম ব্যবস্থা নেই কেন? ওয়ার্ডবয়কে ঘুষ দিয়ে বেড নিতে হয় কেন?
বছরের শুরুতে সন্তানের স্কুলে ভর্তি নিয়ে মা-বাবার ঘুম হারাম হয়ে যায়। বছরের পর বছর কি এমন চলতে থাকবে? দেশের প্রাথমিক শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে। আর আপনারা একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করছেন? বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার যে মান, তাদের বিদেশে তো দূরের কথা, দেশে চাকরি মেলাই ভার। এরা তো অনেকে ঠিকমতো কথাই বলতে পারে না?
দেশে সংস্কার দরকার। এটা আজ নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই দরকার ছিল। কিন্তু আমাদের শাসকেরা শুধু নিজের, পরিবারের আর গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখেছেন, সাধারণ মানুষের কথা ভাবেননি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর পরিবহন সেক্টর তুলে দিয়েছেন প্রাইভেট মাফিয়ার হাতে। একটা উদাহরণ দিই। এ দেশের নেতা, এমপি, মন্ত্রীরা নিজ এলাকায় যথেচ্ছ স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বানিয়েছেন, নিজের কিংবা বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ির নামে। তারপর সেগুলো এমপিওভুক্ত করিয়েছেন। এমপিওভুক্ত হলে সরকারি কোষাগার থেকে শিক্ষকদের জন্য বেতনের টাকা পাওয়া যায়। তো তাঁরা ইচ্ছেমতো তাঁদের আত্মীয়স্বজন ও খিদমতগারদের ওই সব প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়েছেন। এখন তাঁরা অনেকেই দাবি করছেন, তাঁদের প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করতে হবে। এসব দাবি মানার আগে যাচাই করে দেখা দরকার ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্ম-ইতিহাস।
পাঁচ হাজার ডাবলডেকার বাস আমদানি করতে কত টাকা লাগে? কত দিন লাগে? সরকার চাইলে কত কি না পারে। এ দেশে দুষ্টচক্রের মতো পরিবহন মাফিয়া তৈরি হয়েছে। সব সরকার সেগুলো নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থে লালন–পালন করেছে। এই মাফিয়া না ভাঙতে পারলে নতুন পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় কথা হলো পাবলিকের টাকায় গাড়ি, তেল, ড্রাইভার ব্যবহার করতে করতে যাঁরা আকারে-প্রকারে বড় হয়েছেন, তাঁরা কি আদৌ গণপরিবহনের কথা ভাবেন?
আপনারা যথেচ্ছ রাজনীতি করুন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কথাও একটু ভাবুন। মানুষ শুধু ভোটার নয়, আন্দোলনে কামানের খোরাক নয়। দেশ মানেই মানুষ। মানুষের জন্যই রাষ্ট্র, সংবিধান, সরকার। মানুষ একবার খেপে গেলে কেউই রক্ষা পায় না। এটা আমরা দেখেছি একাত্তরের মার্চে, চব্বিশের আগস্টে।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র র জন য করছ ন দরক র বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
তিন জোটের রূপরেখা: ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা
জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জারি করেন সামরিক শাসন। আশির দশকজুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হয়। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বাধীন ‘তিন জোটের রূপরেখা’ ঘোষণা করে ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামো হাজির করে।
ওই রূপরেখায় নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করা হয়। ভবিষ্যতে কেউ যেন এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে না পারে, সে লক্ষ্যে ব্যক্ত করা হয় দৃঢ় সংকল্প।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বই–পরবর্তী নির্বাচনী অভিযাত্রার প্রথম ধাপে তৎকালীন বিএনপি সরকার নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের অঙ্গীকার থেকে সরে আসে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দলীয় সরকারের অধীন একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসে। কিন্তু আন্দোলনের চাপে দেড় মাসের কম সময়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হয় তারা। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনে জেতে আওয়ামী লীগ।
এখানে দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে, দলীয় সরকারের অধীন কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে ওই দলকে কখনো হারানো যায়নি। আবার নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনে আগের সরকার কখনো ক্ষমতায় আসেনি। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে বিএনপি মাত্র দুই মাস ক্ষমতায় টিকতে পেরেছিল। ওই একই কাজ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থেকেছে দীর্ঘ এক যুগ।
তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করা হয়। এ কথা আংশিক সত্য। তবে সেই সঙ্গে রূপরেখা বাস্তবায়নের পদ্ধতিগত ত্রুটির বিষয়টিও এড়ানো যায় না। তিন জোটের রূপরেখায় দেশে ‘স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা’ এবং ‘প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার’ অঙ্গীকার করা হয়েছিল। কোনো দল বা গোষ্ঠী কর্তৃক অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের অবসান ঘটিয়ে সাংবিধানিক পন্থায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল ও হস্তান্তর নিশ্চিত করাও আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠা করাকে তিন জোটের রূপরেখা আন্দোলনের ‘কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু’ হিসেবে নির্ধারণ করেছিল।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর কোনো নির্বাচিত গণপরিষদের অধীনে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উপযোগী সংবিধান গ্রহণ করা হয়নি। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের আরোপিত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) অধীন যাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, ম্যান্ডেট না থাকা সত্ত্বেও তাঁরাই স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। রচিত হয়েছিল একব্যক্তিকেন্দ্রিক ও একদলীয় একটি সংবিধান।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আশির দশকের সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী তিনটি রাজনৈতিক জোট রাষ্ট্র গঠনের এই আদি পাপকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সংসদকে ‘সার্বভৌম’ ধরে ব্যবস্থা পরিবর্তনের ইশতেহার হাজির না করে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানানোকেই ‘গণতন্ত্র’ ধরে নেওয়া হয়েছিল। ফলে স্বৈরাচারের পতন ঘটলেও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল তবিয়তে থেকে গেছে।
আরও পড়ুনসংস্কার, ম্যান্ডেট ও নির্বাচন নিয়ে একের ভেতর দুই ফর্মূলা০৭ জানুয়ারি ২০২৫এই ঐতিহাসিক গলদের খেসারত আজতক বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে। নব্বইয়ের নাগরিক অভ্যুত্থানের পর একটি গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজন করে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা হলে হয়তো আওয়ামী ফ্যাসিবাদের কবলে জাতিকে পড়তে হতো না। তিন জোটের রূপরেখায় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হয়েছিল। পূর্ণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারও ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক না হলে স্রেফ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না, রাজনৈতিক দলগুলো এই সরল সত্য উপলব্ধি করতে পারেনি।
তিন জোটের রূপরেখায় আরও কিছু তাৎপর্যপূর্ণ দফা ছিল। যেমন ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যেকোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের প্রতিরোধ করা হবে।’ সেগুলোর কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি।
একদিকে বলা হয়েছে, এরশাদবিরোধী ওই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ‘সার্বভৌম সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করা। আবার অন্যদিকে ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি’র কথা বলা হয়েছে। এ দুই ধারণা পরস্পরবিরোধী। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংসদ নয়, কেবল ও কেবলমাত্র জনগণ সার্বভৌম হতে পারে। সংসদ, সরকার, এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত সার্বভৌম জনগণের অধীন। সংবিধানের আমূল পরিবর্তন বা বড় সংশোধনীর জন্য গণপরিষদ গঠন করা একটা রেওয়াজ। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদকে সংবিধান পরিবর্তনের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের দলিল জনগণের প্রতিনিধিরা পরিবর্তন করতে পারেন কি না, এমন প্রশ্ন এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
গণ-অভিপ্রায়ই সংবিধান এবং সংবিধানই প্রজাতন্ত্রের ‘সর্বোচ্চ আইন’। তার মানে, সংবিধানের যা কিছু গণ-অভিপ্রায়ের বিপরীতে অবস্থান নেয়, তা-ই অসাংবিধানিক, তথা বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণে আমরা বলেছি, ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানই সাংবিধানিক, বিদ্যমান সংবিধান অসাংবিধানিক।রূপরেখায় একটা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনৈতিক বিষয় হলো, ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে।’ অর্থাৎ গণসার্বভৌমত্বই সাংবিধানিক শাসনের ভিত্তি। কোনো সরকার ও রাষ্ট্র যদি নিজেকে সার্বভৌম দাবি করে গণ-অভিপ্রায়ের বিপরীতে দাঁড়ায় এবং যদি সংবিধান তাদের দোহাই হয়, তাহলে খোদ ওই সংবিধানই অসাংবিধানিকতায় রূপ নেয়। তখন একে বাতিল করাই সাংবিধানিক বিষয়ে পরিণত হয়। এই বিবেচনায় চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সাংবিধানিক, বিদ্যমান বাহাত্তরের সংবিধান অসাংবিধানিক।
রূপরেখার আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এক. জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসন। দুই. মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সব আইন বাতিল করা। এর কোনোটাই অর্জন করা যায়নি। কারণ, সংসদকে সার্বভৌম ক্ষমতা দেওয়ার ফলে সংসদ যেমন ইচ্ছা তেমন আইন প্রণয়ন করতে পেরেছে। এমনকি মৌলিক অধিকারবিরোধী আইন প্রণয়ন করতেও বেগ পেতে হয়নি। তেমন পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগ জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষায় কোনো ভূমিকা নিতে পারেনি। নির্বাহী বিভাগ, তথা বিভাগপ্রধানের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয়েছে। ফলে এমনকি সংসদের সার্বভৌমত্বও পুরোপুরি কায়েম করা সম্ভব হয়নি।
গণ-অভ্যুত্থানকে বলা হয় পুরোনো স্বৈরাচারী এবং নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যবর্তী ক্রান্তিকাল। গণ-অভ্যুত্থানের পর সংবিধান সভার (গণপরিষদ) নির্বাচন আয়োজন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নই রেওয়াজ। অর্থাৎ বাহাত্তর সালে প্রণীত বিতর্কিত স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধান বাতিল করে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা উচিত ছিল। এর জন্য প্রয়োজন ছিল গণপরিষদ নির্বাচন। তা না করে রাজনৈতিক দলগুলো গণ-অভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি সরকার পরিবর্তন, তথা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে সংকুচিত করেছিল। এর মাশুল এখনো বাংলাদেশ দিয়ে যাচ্ছে।
গণ-অভিপ্রায়ই সংবিধান এবং সংবিধানই প্রজাতন্ত্রের ‘সর্বোচ্চ আইন’। তার মানে, সংবিধানের যা কিছু গণ-অভিপ্রায়ের বিপরীতে অবস্থান নেয়, তা-ই অসাংবিধানিক, তথা বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণে আমরা বলেছি, ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানই সাংবিধানিক, বিদ্যমান সংবিধান অসাংবিধানিক।
নব্বইয়ের পর দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ পর আরও একটি গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এ অভ্যুত্থানকে পুরোনো ভুলের হাত থেকে রক্ষা করা দরকার। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক। বাহাত্তরের সংবিধান এ স্বৈরতান্ত্রিকতার মূল জ্বালানি সরবরাহ করে। কাজেই স্বৈরতন্ত্রের উৎস এ সংবিধানকে বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করাই হবে গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী রোডম্যাপ। এ জন্য বিদ্যমান সংবিধানের অধীন সংসদ নির্বাচন নয়; প্রয়োজন নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজন করা। সংবিধান প্রণয়ন শেষে ওই গণপরিষদই আইনসভায় রূপ নেবে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান স্রেফ সরকার পরিবর্তন নয়। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার দোহাই দিয়ে নব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা হবে গণ-অভ্যুত্থানকে বেহাত করার শামিল। ফ্যাসিবাদীব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করার ঐতিহাসিক মওকা আমাদের সামনে হাজির। এ সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না।
● সারোয়ার তুষার লেখক ও চিন্তক; যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি