ফিওদর দস্তয়েভস্কির [১১ নভেম্বর ১৮২১–৯ ফেব্রুয়ারি ১৮৮১] ডেমনস, দ্য ডেভিলস বা দ্য পসেসড নামেও পরিচিত একটি জনপ্রিয় উপন্যাস। এই উপন্যাসটি রাজনৈতিক চরমপন্থা, নৈতিক বিশৃঙ্খলা এবং উনিশ শতকের রাশিয়ায় নিহিলিজমের উত্থান নিয়ে একটি শক্তিশালী অনুসন্ধান হিসেবে আলোড়িত।
রাশিয়ান ভাষায় Бесы (Bésy) নামে প্রকাশিত এই উপন্যাসটি কেবল সাহিত্যের একটি মাইলফলক নয়; বরং তা ঐতিহাসিক, দার্শনিক এবং রাজনৈতিক অন্তর্দর্শনের এক অসাধারণ নিদর্শন। দস্তয়েভস্কি এমন একটি সময়ে এই মাস্টারপিসটি রচনা করেন, যখন রাশিয়া নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল সামাজিক অবক্ষয়, চরমপন্থি বিপ্লবী আন্দোলন এবং নিহিলিজমের উত্থানে। এই উপন্যাসে দস্তয়েভস্কি চরমপন্থার মানসিক ও নৈতিক পরিণতি তুলে ধরে দেখিয়েছেন, কীভাবে এ ধরনের মতাদর্শ ব্যক্তি ও সমাজকে নৈতিক শূন্যতায় নিমজ্জিত করে।
উপন্যাসটির প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন একদিকে নিহিলিজমের বিপজ্জনক শূন্যতাকে উন্মোচিত করে এবং অন্যদিকে মানবিক মূল্যবোধ, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও নৈতিকতার চিরন্তন শক্তির প্রতি গভীর প্রত্যয় তুলে ধরে। লেখক জোসেফ ফ্রাঙ্ক, দস্তয়েভস্কির জীবনীকার, এই উপন্যাস সম্পর্কে বলেন: “a novel of ideas, a stark warning against the dangers of ideology when it replaces the moral center of human life.
প্রকৃতপক্ষে, ১৮৬০-এর দশকে রাশিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা বেড়ে যাচ্ছিল পরিণতভাবে। এটি ছিল মূলত দুটি প্রধান মতাদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ– একটি ছিল সমাজতান্ত্রিক ও বিপ্লবী ভাবধারা– যারা রাশিয়ান সমাজের গভীর পরিবর্তন চেয়েছিলেন এবং অন্যটি ছিল প্রাচীন রাশিয়ান কর্তৃত্ব এবং অটোক্রেসি– যারা রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বজায় রাখার পক্ষে সোচ্চার। এই দুটি গোষ্ঠীই রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্য দায়ী ছিল এবং সমাজে চরমপন্থি আন্দোলনের উত্থান ঘটিয়েছিল। নিহিলিজম এই সময়ে একটি জনপ্রিয় ও বিপ্লবী দর্শন হয়ে ওঠে। নিহিলিজম বিশ্বাস করত যে, পুরোনো রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামো এবং মূল্যবোধগুলো পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে নতুন একটি সমাজ গড়ে তোলা উচিত। বিশেষভাবে, নিকোলাই চেরনিশেভস্কি ও সেরগেই নেচায়েভ ছিলেন সেই সময়ের প্রধান বিপ্লবী চিন্তাবিদ, যারা সমাজতান্ত্রিক এবং নিহিলিস্ট দৃষ্টিভঙ্গি প্রচার করছিলেন।
কিন্তু দস্তয়েভস্কি রাজনৈতিক চরমপন্থা এবং নিহিলিজমের এই প্রবণতার– দুয়েরই বিরুদ্ধে ছিলেন। তাঁর মতে, সমাজে এক বিপজ্জনক পথ অবলম্বন করা হচ্ছিল, যেখানে নৈতিকতা, ধর্ম এবং মানবিক মূল্যবোধের কোনো স্থান ছিল না। ডেমনস উপন্যাসে তিনি চরমপন্থি বিপ্লবীদের চরিত্রের মাধ্যমে একে অপরের প্রতি বিশ্বাসহীনতা, সহিংসতা এবং সমাজের জন্য ক্ষতিকর পরিণতির ধারণা তুলে ধরেন। এ ক্ষেত্রে ডেমনস-এ তাঁর শিল্পভাষা: “এই পৃথিবীর মানুষরা শেষ পর্যন্ত কী? তারা এমন মানুষ, যারা বিশ্বাস করে যে ক্ষমতা, বিজয় এবং স্বার্থই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং তারা এটি অর্জন করতে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে।”
দস্তয়েভস্কির ‘ডেমনস’ উপন্যাসটি প্রথম রাশিয়ান মেসেঞ্জার পত্রিকায় ১৮৭১-৭২ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত এবং পরে ১৮৭৩ সালে বই হিসেবে প্রকাশিত হয়। যার সম্পাদনা করেছিলেন মিখাইল কাটকভ। বহু ভাষায় এর অনুবাদ, বিশেষ করে ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, স্প্যানিশ, বাংলা এবং জাপানি, যা উপন্যাসটিকে একটি বৈশ্বিক ক্ল্যাসিক সাহিত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। কনস্ট্যান্স গার্নেটের ইংরেজি অনুবাদ এখনও সবচেয়ে বেশি পঠিত সংস্করণ। এর মানব মনস্তত্ত্ব, সামাজিক সমস্যা এবং নৈতিক সংকটের চিরন্তন প্রশ্নগুলোর অনুসন্ধান, সব যুগের পাঠকদের জন্য প্রাসঙ্গিক এবং ক্ল্যাসিক। এ প্রসঙ্গে ইতালীয় লেখক এবং ঔপন্যাসিক ইতালো কালভিনো বলেন: “একটি ক্ল্যাসিক হলো একটি বই; যা কখনোই বলতে থাকা শেষ করে না, যা বলার থাকে তা বলে চলে।”
নেহিলিজম মূলত লাতিন শব্দ নিহিল থেকে এসেছে, যার মানে “কিছুই নয়”, একটি দার্শনিক বিশ্বাস; যা জীবনকে অতি প্রাকৃতিক, নৈতিক বা উদ্দেশ্যহীন বলে মনে করে। নেহিলিস্টরা সার্বিক সত্য, নৈতিক মূল্যবোধ এবং জীবনযাপনের উদ্দেশ্য অস্বীকার করে প্রতিনিয়ত। তাদের মতে, জীবন এবং পৃথিবী সম্পর্কে ঐতিহ্যগত ধারণাগুলো কেবল মানুষের কল্পনা। নেহিলিজমের উৎপত্তি আধুনিক যুগের শুরুতে হলেও এটি উনিশ শতকে বিশেষভাবে রাশিয়াতে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। কালক্রমে এটি রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ওঠে। সাহিত্যেও রয়েছে এর প্রভাব প্রত্যয়। ফলে ‘নেহিলিজম’ শব্দটি প্রথম ১৮৬০-এর দশকে রুশ লেখক ইভান তুরগেনেভ তাঁর উপন্যাস ‘ফাদার্স অ্যান্ড সন্স’-এ ব্যবহার করেন। তুরগেনেভের বাজারভ চরিত্রটি সব ধরনের কর্তৃত্ব এবং প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস অস্বীকার করে, যা নেহিলিজমের মূল ধারণারই প্রতিফলন। পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার একাধিক দার্শনিক ও লেখক নেহিলিজমের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন, তবে দস্তয়েভস্কি তাঁর রচনায় এই মতবাদকে গভীরভাবে পরীক্ষা করেন। দস্তয়েভস্কি গবেষক জোসেফ ফ্রাঙ্ক বলেন: ‘ডেমনস’-এ দস্তয়েভস্কি তাঁর ভবিষ্যদর্শী দৃষ্টি দিয়ে দেখিয়েছেন, নিহিলিজম এবং এর সৃষ্টি করা নৈতিক শূন্যতার কী বিপর্যয়কর প্রভাব সৃষ্টি করে সমাজে।
দস্তয়েভস্কির ডেমনস নিহিলিজমকে কেবল একটি বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থান হিসেবে নয়, বরং একটি ক্ষয়কারী শক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছে; যা সমাজের ভিত্তিসমূহকে অস্থিতিশীল করে। নিহিলিজম, যা ধর্মীয় ও নৈতিক নীতির প্রত্যাখ্যান এবং জীবনকে স্বাভাবিকভাবে অর্থহীন হিসেবে বিশ্বাস করে, উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যে বিশেষ করে পিটার ভারখোভেনস্কি ও নিকোলাই স্তাভরোগিনের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এই চরিত্রগুলো তাদের বিপ্লবী লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য মানুষকে প্রভাবিত এবং ধ্বংস করে, এবং এটি নিহিলিজমের যে অস্তিত্বমূলক ও নৈতিক শূন্যতা সৃষ্টি করে, তার প্রকাশ।
প্রকৃত অর্থে পিটার ভারখোভেনস্কি নিহিলিজমের অস্থির এবং বিপ্লবী চরিত্র হিসেবে, বিপ্লবের উদ্দেশ্যে সমাজকে ধ্বংস করতে প্রস্তুত। আবার অন্যদিকে নিকোলাই স্তাভরোগিন একজন নৈতিকভাবে অস্পষ্ট চরিত্র, যে কিনা নিহিলিজমের অনুসরণ করে নিজের অস্তিত্বের মানে হারিয়ে ফেলে। তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিহিলিজমের ধ্বংসাত্মক পরিণতি হিসেবে প্রতিফলিত হয়। দস্তয়েভস্কি দেখিয়েছেন “যে জীবনে বাঁচার কারণ আছে, সে যে কোনো পরিস্থিতিতেই সহ্য করতে পারে,” দস্তয়েভস্কি অপ্রত্যক্ষভাবে নিটশের ধারণা প্রতিফলিত করেছেন, স্তাভরোগিনের শূন্যতার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, যদি জীবনে কোনো কারণ না থাকে, তবে সেই জীবন দুঃসহ হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে ক্যামুস বলেন: “দস্তয়েভস্কি, বিশেষ করে Demons-এ দেখিয়েছেন কীভাবে চরম পর্যায়ে পৌঁছানো ধারণাগুলো ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। তিনি আদর্শগত উগ্রতার ভয়াবহতা অনেক আগেই উপলব্ধি করেছিলেন।”
ফিওদর দস্তয়েভস্কির ‘ডেমনস’ উপন্যাসে কিছু গোপন তথ্য এবং সাহিত্যিক টুইস্ট রয়েছে, যা এর গভীরতা আরও সমৃদ্ধ করে। উপন্যাসটি গভীর দার্শনিক ও রাজনৈতিক বার্তা বহন করলেও এর নেপথ্যে কিছু গোপন প্রেরণা এবং টুইস্ট পাঠকদের বিস্মিত করে। বিশেষত ‘ডেমনস’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় ঘটনাগুলোর একটি ছিল শাতোভের হত্যাকাণ্ড। এটি বাস্তব জীবনের একটি ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত, যেখানে সের্গেই নেচায়েভ নামক একজন চরমপন্থি বিপ্লবী তাঁরই দলের এক সদস্য ইভানভকে হত্যা করে। নেচায়েভের চরমপন্থি মতাদর্শ এবং তাঁর দ্বারা সংগঠিত নৃশংস কাজ দস্তয়েভস্কিকে এতটাই আলোড়িত করে যে, তিনি এটি তাঁর উপন্যাসে অন্তর্ভুক্ত করেন– এটি নেচায়েভের চরমপন্থি দর্শনের একটি প্রতিফলন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ক ক শ ন যত ব স কর শ ষ কর র জন য ড মনস র একট
এছাড়াও পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেলেন গুলশান আরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হবে দাফন
নাটক ও সিনেমার পরিচিত মুখ অভিনেত্রী গুলশান আরা আহমেদ মারা গেছেন। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে মৃত্যু হয়েছে তার।
তার মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছন পরিচালক এম রাহিম। তিনি জানান, শ্রদ্ধেয় শুলশান আরা আহমেদ আজ আজ সকালে ইন্তেকাল করেছেন। জংলি আপনার সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি। আপনি আজীবন আমাদের পরিবারেরই একজন হয়ে থাকবেন।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক পোস্ট দিয়ে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পরিচালক কাজল আরেফিন অমি। পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমাদের গুলশান আরা আহমেদ আপা আপা আজ সকাল ৬:৪০-এ ইন্তেকাল করেছেন।’
অমি আরও লিখেছেন, ‘ব্যাচেলর পয়েন্টে উনি কাবিলার আম্মা, নোয়াখালীর চেয়ারম্যান চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আপনাকে আমরা মিস করবো আপা। আল্লাহ পাক ওনাকে জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে, জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুক। আমিন।’
জানা গেছে, হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক করেছিলেন অভিনেত্রী। দ্রুতই লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। তবে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। গুলশান আরা আহমেদের ফেসবুক আইডি থেকে মাঝরাতে লেখা হয়, ‘আমার আম্মু গুলশান আরা আহমেদ আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে আছেন, হার্ট অ্যাটাক এবং হার্ট ফেইলিউরের জন্য। আপনার সবাই আমার মায়ের জন্য দোয়া করবেন।’
পরে শোনা যায় মৃত্যুর খবর, অর্থাৎ লাইফ সাপোর্ট থেকে আর ফেরানো যায়নি তাকে। ভোরে তাঁর মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অভিনেত্রীকে দাফন করা হবে। অভিনেত্রীর বোনের ছেলে অভিনেতা আর এ রাহুল জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছেন অভিনেত্রী। তার লাশ দেশে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
গুলশান আরা ২০০২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একজন তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে টিভি নাটকে যাত্রা শুরু করেন। তবে নিজেকে একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন। সেই ইচ্ছা থেকেই গুলশান আরা প্রথম অভিনয় করেন প্রয়াত এনায়েত করিম পরিচালিত ‘কদম আলী মাস্তান’ চলচ্চিত্রে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দর্শকদের উপহার দিয়েছেন ‘চরিত্র’, ‘ডনগিরি’, ‘ভালোবাসা আজকাল’, ‘পোড়ামন’ এর মতো জনপ্রিয় সব ছবি।