জীবনে কিছু কিছু দিন আসে যখন মানুষ কেবল নিজে বেঁচে থাকতে চায় না। সে তখন সবার হতে চায়। মনে হয় তার জীবনের সব ভালো কাজ সব মানুষের হোক। মহৎ অর্জনের সুখ সবার অনুভববেদ্য হোক। আমার জীবনের এ রকম একটি দিন ২২ জানুয়ারি (২০২৫)।

সেদিন ছিল নিউইয়র্কের শীতের সকাল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ গ্রহণ করেছেন। তাঁর ঘোষিত অভিবাসী নিয়মের কঠোরতায় অনেকেরই আতঙ্কের জীবন শুরু হয়েছে। সবাই জানেন, নতুন অভিবাসীদের জীবনে থাকে সংগ্রাম ও নিরন্তর টিকে থাকার লড়াই। আবার পুরোনো হলেও পরিশ্রমের দিন কিন্তু শেষ হয় না। প্রবাস জীবনেও আসে দুঃখের পাশে ব্যক্তিগত অর্জনের নানা সুখাবেশ। তবে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় যেখানে মুখ্য, সেখানে সাংস্কৃতিক পরিসরে সম্মিলিত জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো খুবই গুরুত্ববহ। 

বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা বাঙালি জাতি আমেরিকায় শত ফুলের মালা গেঁথেছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সংগ্রামমুখর জীবনে। এখানে বৈচিত্র্যের মাঝে আছে ঐক্য, সংকটের মাঝে আছে সম্প্রীতি, বিভেদের মাঝে আছে সহিষ্ণুতা। এজন্য ২২ জানুয়ারি সম্মিলিত বাঙালি জীবনে আনন্দের বারতা নিয়ে এসেছে। ১৪ এপ্রিল ‘বাংলা নববর্ষ’-এর স্বীকৃতি লাভের জন্য একাধিক সিনেটরকে প্রস্তাব প্রদান এবং সিনেট সভায় উত্থাপনের নেপথ্যে কৃতিত্ব আমার হলেও অর্জনের আনন্দ সকলের। 

২.

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মেধাবী বাঙালি ও খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব অনেক আগে থেকেই আমেরিকায় পরিচিত। ১৯ শতকের শেষের দিকে বাংলাদেশি অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে আসতে শুরু করে। বিশ্বখ্যাত স্থপতি এফ আর খান, সেতার বাদক আলী আকবর খান, লেখক রুমানা আলম, কবি শহীদ কাদরী, সাহিত্যিক ঝুম্পা লাহিড়ী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা এনায়েতুর রহিম, বিজ্ঞানী দেবব্রত বসু, মূলধারার লেখক অমিতাভ ঘোষ, বিজ্ঞানী ইকবাল কাদির, ইউটিউবের কো-প্রতিষ্ঠাতা জাওয়াদ করিম, সারাবিশ্বের যুবসমাজকে বিনা ফি-তে অঙ্ক শেখানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘খান একাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সালমান খান, ইন্টেলের চেয়ারপারসন বিজ্ঞানী ওমর ইশরাকের মতো বাঙালিরা বহু জাতিগোষ্ঠীর আমেরিকায় বাংলা ও বাঙালিদের পরিচিতিকে মহিমান্বিত করেছেন। নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালিরা বিশ্বের রাজধানী খ্যাত এই সিটি তথা স্টেটে বাঙালি সংস্কৃতির ফল্গুধারা বিকাশের নিরন্তর প্রয়াস চালাচ্ছেন।  

বর্তমান বাঙালিরা বাংলা বছরের প্রথম দিন ‘পহেলা বৈশাখ’ ঘটা করে উদ্‌যাপন করছেন টাইমস স্কয়ারসহ নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন বছরের প্রথম দিন তথা পহেলা বৈশাখ বরণে এখন হাজারো নারী-পুরুষের সাথে নতুন প্রজন্মের বাঙালিরাও উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। বাংলাদেশ, ভারত এবং আমেরিকার শতাধিক সংগঠনের শিল্পী-কলাকুশলীরা হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালি সংস্কৃতির জয়গান করেন। পাশাপাশি মেধা আর শ্রমের বিনিয়োগ ঘটিয়ে নিউইয়র্ক স্টেট তথা আমেরিকার উন্নয়নেও বাঙালিরা অবদান রেখে চলেছেন। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আরও গৌরব আর অহংকারের সাথে উদ্ভাসিত করতে নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটর লুইস সেপুলভেদা ১৫ জানুয়ারি সিনেটে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন ‘১৪ এপ্রিলকে নিউইয়র্কে বাংলা নববর্ষ’-এর স্বীকৃতি প্রদানের জন্য।  

২৩৪ নম্বরের এই রেজল্যুশন (Memorializing Governor Kathy Hochul to proclaim April 14, 2025, as Bangla New Year Day in the State of New York) ২২ জানুয়ারি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে। অর্থাৎ আসছে ১৪ এপ্রিল ঘটা করে উদযাপিত হবে ‘বাংলা নববর্ষ’ এবং তা স্টেট, সিটি, কুইন্স, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কস বরো-সহ সব পর্যায়ে এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণে আর কোনো বাধা থাকবে না। এ ধরনের একটি ঘোষণাপত্র শিগগিরই স্টেট গভর্নর ক্যাথি হোকুল বিতরণ করবেন। উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও হিসেবে আমি এমন একটি রেজল্যুশনের জন্য স্টেট সিনেটর লুইস সেপুলভেদাসহ একাধিক সিনেটরের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম এবং পাস হওয়া রেজল্যুশনেও তা উল্লেখ রয়েছে।

ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সিদ্ধান্ত অনুসারে সংবাদপত্রে পরিবেশিত মূল বক্তব্য হলো এ রকম– ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে ১৪ এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আলবেনিতে গভর্নর অফিস বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় এই উৎসবকে উদ্‌যাপন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিউইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ৩২ স্টেট সিনেট লুইস সেপুলভেদার প্রস্তাবে অঙ্গরাজ্যের আইনসভার অধিবেশনে ২২ জানুয়ারি আইনপ্রণেতারা সর্বসম্মতিক্রমে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গভর্নর ক্যাথি হোকুল ২৩৪ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করেন। ঘোষণাটি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেটের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে।

ওই ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়, ১৪ এপ্রিল, অর্থাৎ বাংলা বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে বাংলা নববর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই অঙ্গরাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি হিসেবে এবং এই রাজ্যে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি দৃঢ় করার লক্ষ্যেই এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। বাংলা নববর্ষের ইতিহাস বর্ণনা করে এতে আরও বলা হয়, ভারতের মোগল সাম্রাজ্যে পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনের সূচনা হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন কৃষিপ্রধান দেশে, যেমন– লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একই সময়ে নববর্ষ উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে। বাংলা ভাষায় কথা বলেন– এমন অভিবাসীর কথা উল্লেখ করে ঘোষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক অভিবাসী এ রাজ্যে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছেন। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন। এদের অর্ধেকই নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা। পহেলা বৈশাখ বাঙালির জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ঘোষণায় বলা হয়, প্রতিবছরই বিপুল সমারোহে দিনটি উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে। ২০২২ সাল থেকে দিবসটি নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে।

৩. গত বছর (২০২৪) ১০ সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল ১৪৩১ বঙ্গাব্দকে। তার আগের বছর (২০২৩) শত কণ্ঠে বর্ষবরণ উদ্‌যাপন হয়েছিল। উদ্বোধন অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও কণ্ঠে কণ্ঠে বর্ষবরণের মহোৎসব আমাদের এক মোহনায় সমবেত করেছিল। গত দু’বছরে মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে কেবল মহড়া পরিচালনার মুহূর্তগুলো সংগীত আয়োজক মহিতোষ তালুকদার তাপসের সঙ্গে শিল্পীবৃন্দসহ সাধারণ মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা ছিল অভিনব, অনন্য। প্রতিদিনের মহড়ায় গানের সঙ্গে প্রাণের বন্যা যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ২০২৩ সালে নিউইয়র্কের শত আলোকিত মানুষের অংশগ্রহণে বর্ষবরণের প্রথম মহড়া দেখে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি অভিভূত হয়েছিলেন। মহড়াতে অসংখ্য মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয়। বৈশাখী আয়োজনে ছিল পাপেট শো, যাত্রাপালা, পুঁথিগান, কবির লড়াই, বায়োস্কোপসহ হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির উপস্থাপনা।

লেখাবাহুল্য, টাইমস স্কয়ারে বাংলা নববর্ষ বরণের এই যাত্রায় এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড সেক্রেটারি তোফাজ্জল লিটন ও সহযাত্রী শিবলী সাদেক, সৌম্যব্রত দাসগুপ্ত, নূরুল বাতেন, কল্লোল বসু, রায়হানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। শিল্পী মহিতোষ তালুকদার তাপসের নেতৃত্বে টাইমস স্কয়ারে শতকণ্ঠ থেকে সহস্র কণ্ঠে হয়ে ওঠা যে কত আনন্দের ও গৌরবের, তা ভাষায় প্রকাশের নয়। নিউইয়র্কের তথা আমেরিকার সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালিরা একত্র হয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সারাবিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে। প্রত্যেক শিল্পী ও সংস্কৃতিপ্রেমী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটিকে নিজের করে নিয়েছেন। টাইমস স্কয়ারে বাংলা নববর্ষ বরণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই ছিল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। 

২০২৫ সালের বর্ষবরণ উৎসব হবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্নর কার্যালয় এপ্রিলের ৭ তারিখে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন করবে। যেহেতু ৮ তারিখে অধিবেশন শেষ, তাই আলবিনে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আইনপ্রণেতারা বাঙালির সর্বজনীন ও সবচেয়ে বড় এই উৎসব নিয়ে এক আলোচনায় অংশ নেবেন। সেখানে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূতসহ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ। আমন্ত্রণ জানানো হবে নিউইয়র্ক শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রধানদের। বিষয়টি প্রত্যেক বাঙালির গর্ব বলে আমি মনে করি। বাংলা বছরের প্রথম দিনে আনন্দ আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে শিল্পী এবং দর্শনার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, নাচ-গান ও যাত্রাপালা, সবকিছুই থাকে আয়োজনে। নিউইয়র্কের বর্ষবরণ উৎসব পহেলা বৈশাখের ভোরের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রমনার বটমূলের আদলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুপ্রেরণায় প্রাণিত।

লেখক: এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন, নিউইয়র্ক

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ভ রমণ বছর র প রথম র প রথম দ ন ন উইয়র ক র ২২ জ ন য় র ন উইয র ক নববর ষ র জন য র জ বন হয় ছ ল আম র ক গ রহণ আনন দ বরণ র

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলা বর্ষবরণ ও নিউইয়র্কে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি

জীবনে কিছু কিছু দিন আসে যখন মানুষ কেবল নিজে বেঁচে থাকতে চায় না। সে তখন সবার হতে চায়। মনে হয় তার জীবনের সব ভালো কাজ সব মানুষের হোক। মহৎ অর্জনের সুখ সবার অনুভববেদ্য হোক। আমার জীবনের এ রকম একটি দিন ২২ জানুয়ারি (২০২৫)।

সেদিন ছিল নিউইয়র্কের শীতের সকাল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ গ্রহণ করেছেন। তাঁর ঘোষিত অভিবাসী নিয়মের কঠোরতায় অনেকেরই আতঙ্কের জীবন শুরু হয়েছে। সবাই জানেন, নতুন অভিবাসীদের জীবনে থাকে সংগ্রাম ও নিরন্তর টিকে থাকার লড়াই। আবার পুরোনো হলেও পরিশ্রমের দিন কিন্তু শেষ হয় না। প্রবাস জীবনেও আসে দুঃখের পাশে ব্যক্তিগত অর্জনের নানা সুখাবেশ। তবে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় যেখানে মুখ্য, সেখানে সাংস্কৃতিক পরিসরে সম্মিলিত জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো খুবই গুরুত্ববহ। 

বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যান্য দেশ থেকে আসা বাঙালি জাতি আমেরিকায় শত ফুলের মালা গেঁথেছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সংগ্রামমুখর জীবনে। এখানে বৈচিত্র্যের মাঝে আছে ঐক্য, সংকটের মাঝে আছে সম্প্রীতি, বিভেদের মাঝে আছে সহিষ্ণুতা। এজন্য ২২ জানুয়ারি সম্মিলিত বাঙালি জীবনে আনন্দের বারতা নিয়ে এসেছে। ১৪ এপ্রিল ‘বাংলা নববর্ষ’-এর স্বীকৃতি লাভের জন্য একাধিক সিনেটরকে প্রস্তাব প্রদান এবং সিনেট সভায় উত্থাপনের নেপথ্যে কৃতিত্ব আমার হলেও অর্জনের আনন্দ সকলের। 

২. বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মেধাবী বাঙালি ও খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব অনেক আগে থেকেই আমেরিকায় পরিচিত। ১৯ শতকের শেষের দিকে বাংলাদেশি অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে আসতে শুরু করে। বিশ্বখ্যাত স্থপতি এফ আর খান, সেতার বাদক আলী আকবর খান, লেখক রুমানা আলম, কবি শহীদ কাদরী, সাহিত্যিক ঝুম্পা লাহিড়ী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা এনায়েতুর রহিম, বিজ্ঞানী দেবব্রত বসু, মূলধারার লেখক অমিতাভ ঘোষ, বিজ্ঞানী ইকবাল কাদির, ইউটিউবের কো-প্রতিষ্ঠাতা জাওয়াদ করিম, সারাবিশ্বের যুবসমাজকে বিনা ফি-তে অঙ্ক শেখানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘খান একাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সালমান খান, ইন্টেলের চেয়ারপারসন বিজ্ঞানী ওমর ইশরাকের মতো বাঙালিরা বহু জাতিগোষ্ঠীর আমেরিকায় বাংলা ও বাঙালিদের পরিচিতিকে মহিমান্বিত করেছেন। নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালিরা বিশ্বের রাজধানী খ্যাত এই সিটি তথা স্টেটে বাঙালি সংস্কৃতির ফল্গুধারা বিকাশের নিরন্তর প্রয়াস চালাচ্ছেন।  

বর্তমান বাঙালিরা বাংলা বছরের প্রথম দিন ‘পহেলা বৈশাখ’ ঘটা করে উদ্‌যাপন করছেন টাইমস স্কয়ারসহ নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নতুন বছরের প্রথম দিন তথা পহেলা বৈশাখ বরণে এখন হাজারো নারী-পুরুষের সাথে নতুন প্রজন্মের বাঙালিরাও উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠে। বাংলাদেশ, ভারত এবং আমেরিকার শতাধিক সংগঠনের শিল্পী-কলাকুশলীরা হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালি সংস্কৃতির জয়গান করেন। পাশাপাশি মেধা আর শ্রমের বিনিয়োগ ঘটিয়ে নিউইয়র্ক স্টেট তথা আমেরিকার উন্নয়নেও বাঙালিরা অবদান রেখে চলেছেন। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আরও গৌরব আর অহংকারের সাথে উদ্ভাসিত করতে নিউইয়র্ক স্টেট সিনেটর লুইস সেপুলভেদা ১৫ জানুয়ারি সিনেটে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন ‘১৪ এপ্রিলকে নিউইয়র্কে বাংলা নববর্ষ’-এর স্বীকৃতি প্রদানের জন্য।  

২৩৪ নম্বরের এই রেজল্যুশন (Memorializing Governor Kathy Hochul to proclaim April 14, 2025, as Bangla New Year Day in the State of New York) ২২ জানুয়ারি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে। অর্থাৎ আসছে ১৪ এপ্রিল ঘটা করে উদযাপিত হবে ‘বাংলা নববর্ষ’ এবং তা স্টেট, সিটি, কুইন্স, ব্রুকলিন, ব্রঙ্কস বরো-সহ সব পর্যায়ে এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণে আর কোনো বাধা থাকবে না। এ ধরনের একটি ঘোষণাপত্র শিগগিরই স্টেট গভর্নর ক্যাথি হোকুল বিতরণ করবেন। উল্লেখ্য, নিউইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও হিসেবে আমি এমন একটি রেজল্যুশনের জন্য স্টেট সিনেটর লুইস সেপুলভেদাসহ একাধিক সিনেটরের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম এবং পাস হওয়া রেজল্যুশনেও তা উল্লেখ রয়েছে।

ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সিদ্ধান্ত অনুসারে সংবাদপত্রে পরিবেশিত মূল বক্তব্য হলো এ রকম– ‘যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে ১৪ এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অঙ্গরাজ্যের রাজধানী আলবেনিতে গভর্নর অফিস বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় এই উৎসবকে উদ্‌যাপন করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নিউইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ৩২ স্টেট সিনেট লুইস সেপুলভেদার প্রস্তাবে অঙ্গরাজ্যের আইনসভার অধিবেশনে ২২ জানুয়ারি আইনপ্রণেতারা সর্বসম্মতিক্রমে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপনের এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গভর্নর ক্যাথি হোকুল ২৩৪ নম্বর প্রস্তাবের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করেন। ঘোষণাটি নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেটের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে।

ওই ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়, ১৪ এপ্রিল, অর্থাৎ বাংলা বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিন পহেলা বৈশাখকে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে বাংলা নববর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই অঙ্গরাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি হিসেবে এবং এই রাজ্যে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি দৃঢ় করার লক্ষ্যেই এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। বাংলা নববর্ষের ইতিহাস বর্ণনা করে এতে আরও বলা হয়, ভারতের মোগল সাম্রাজ্যে পহেলা বৈশাখ উদ্‌যাপনের সূচনা হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন কৃষিপ্রধান দেশে, যেমন– লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একই সময়ে নববর্ষ উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে। বাংলা ভাষায় কথা বলেন– এমন অভিবাসীর কথা উল্লেখ করে ঘোষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক অভিবাসী এ রাজ্যে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছেন। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন। এদের অর্ধেকই নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা। পহেলা বৈশাখ বাঙালির জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ঘোষণায় বলা হয়, প্রতিবছরই বিপুল সমারোহে দিনটি উদ্‌যাপিত হয়ে থাকে। ২০২২ সাল থেকে দিবসটি নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে উদ্‌যাপিত হয়ে আসছে।

৩. গত বছর (২০২৪) ১০ সহস্রাধিক মানুষের উপস্থিতিতে নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে বরণ করে নেওয়া হয়েছিল ১৪৩১ বঙ্গাব্দকে। তার আগের বছর (২০২৩) শত কণ্ঠে বর্ষবরণ উদ্‌যাপন হয়েছিল। উদ্বোধন অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও কণ্ঠে কণ্ঠে বর্ষবরণের মহোৎসব আমাদের এক মোহনায় সমবেত করেছিল। গত দু’বছরে মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে কেবল মহড়া পরিচালনার মুহূর্তগুলো সংগীত আয়োজক মহিতোষ তালুকদার তাপসের সঙ্গে শিল্পীবৃন্দসহ সাধারণ মানুষের আগ্রহ-উদ্দীপনা আর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা ছিল অভিনব, অনন্য। প্রতিদিনের মহড়ায় গানের সঙ্গে প্রাণের বন্যা যুক্তরাষ্ট্রের বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ২০২৩ সালে নিউইয়র্কের শত আলোকিত মানুষের অংশগ্রহণে বর্ষবরণের প্রথম মহড়া দেখে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি অভিভূত হয়েছিলেন। মহড়াতে অসংখ্য মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল প্রশংসনীয়। বৈশাখী আয়োজনে ছিল পাপেট শো, যাত্রাপালা, পুঁথিগান, কবির লড়াই, বায়োস্কোপসহ হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতির উপস্থাপনা।

লেখাবাহুল্য, টাইমস স্কয়ারে বাংলা নববর্ষ বরণের এই যাত্রায় এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড সেক্রেটারি তোফাজ্জল লিটন ও সহযাত্রী শিবলী সাদেক, সৌম্যব্রত দাসগুপ্ত, নূরুল বাতেন, কল্লোল বসু, রায়হানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। শিল্পী মহিতোষ তালুকদার তাপসের নেতৃত্বে টাইমস স্কয়ারে শতকণ্ঠ থেকে সহস্র কণ্ঠে হয়ে ওঠা যে কত আনন্দের ও গৌরবের, তা ভাষায় প্রকাশের নয়। নিউইয়র্কের তথা আমেরিকার সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালিরা একত্র হয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সারাবিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে। প্রত্যেক শিল্পী ও সংস্কৃতিপ্রেমী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটিকে নিজের করে নিয়েছেন। টাইমস স্কয়ারে বাংলা নববর্ষ বরণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই ছিল সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। 

২০২৫ সালের বর্ষবরণ উৎসব হবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের গভর্নর কার্যালয় এপ্রিলের ৭ তারিখে বাংলা নববর্ষ উদ্‌যাপন করবে। যেহেতু ৮ তারিখে অধিবেশন শেষ, তাই আলবিনে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আইনপ্রণেতারা বাঙালির সর্বজনীন ও সবচেয়ে বড় এই উৎসব নিয়ে এক আলোচনায় অংশ নেবেন। সেখানে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূতসহ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ। আমন্ত্রণ জানানো হবে নিউইয়র্ক শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রধানদের। বিষয়টি প্রত্যেক বাঙালির গর্ব বলে আমি মনে করি। বাংলা বছরের প্রথম দিনে আনন্দ আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে শিল্পী এবং দর্শনার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, নাচ-গান ও যাত্রাপালা, সবকিছুই থাকে আয়োজনে। নিউইয়র্কের বর্ষবরণ উৎসব পহেলা বৈশাখের ভোরের সূর্যোদয়ের সাথে সাথে রমনার বটমূলের আদলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুপ্রেরণায় প্রাণিত।

লেখক: এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন, নিউইয়র্ক

সম্পর্কিত নিবন্ধ