নিকারাগুয়ার কবি রুবেন দারিও (১৮ জানুয়ারি ১৮৬৭ - ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬)। একাধারে তিনি সাংবাদিক, কূটনীতিক, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক ও গল্পকার। দারিওকে বলা হয় ‘স্প্যানিশ আধুনিকতার জনক’, বলা হয় ‘দ্য ডিভাইন পোয়েট’। দারিও একসময় বুয়েনস আইরেসে কলম্বিয়ান কনসাল হিসেবে কাজ করেছেন, কাজ করেছেন আর্জেন্টিনার সংবাদপত্র ‘লা নাসিওন’-এর সংবাদদাতা হিসেবেও। ভ্রমণ করেছেন বহু দেশ।
দারিওর চেহারা যদি কেউ চেনে তাহলে তাকে দেখতে পাবে নিকারাগুয়ার সর্বত্র– মুদ্রা, ডাকটিকিট, চুরুট, প্রেসিডেন্ট ভবন, মানাগুয়ার বিমানবন্দর, চিনানদেগার কফিশপ, জাদুঘর, পাঠাগার, পার্ক, হোটেলের প্রবেশপথ, জাতীয় থিয়েটার, এমনকি মানাগুয়ায় একটি সাঁজোয়া ট্রাকেও তার প্রতিকৃতি, ম্যুরাল বা ভাস্কর্য দেখা যেতে পারে। তার প্রতিকৃতি ঝোলানো অবস্থায় দেখা যায় গ্রানাদার অনেক রেস্তোরাঁয়ও।
রুবেন দারিওর পুরো নাম ফেলিক্স রুবেন গার্সিয়া সারমিয়েন্তো। জন্ম নিকারাগুয়ার মেটাপায়। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি কবিতা লেখা শুরু করেন, পরিচিত হয়ে ওঠেন ‘বালক কবি’ হিসেবে। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো– ‘আজুল’, ‘পোয়েটিক অ্যান্থলজি’, ‘সংস অব লাইফ অ্যান্ড হোপ’, ‘মার্গারিটা’ ইত্যাদি। ভাষা রক্ষায় নিকারাগুয়ার সরকার তাঁকে ‘জাতীয় বীর’-এর মর্যাদা দিয়েছে। হিস্পানিক ‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার নায়ক’ হিসেবে পরিচিত এ কবির জন্মদিন প্রতিবছর রাষ্ট্রীয়ভাবে উদযাপন করে দেশটি।
‘আজুল’ (নীল) দারিওর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রচনা। গল্প ও কবিতার এই সংকলনটি প্রকাশিত হয় ১৮৮৮ সালের ৩০ জুলাই, চিলিতে। এর একটি গল্প ‘ইল পাখারো আজুল’ (নীল পাখি)। মূল স্প্যানিশ থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন হোসে হিডালগো, সেখানে থেকে এটি বাংলায় ভাষান্তরের চেষ্টা করা হলো।
*
প্যারিস এমন এক শহর, যেখানে হাস্যরস ও বিষণ্নতা অদ্ভুতভাবে মিশে থাকে। এ শহরেরই একটি আড্ডার জায়গা ছিল ‘প্লম্বিয়ে ক্যাফে’। আড্ডার নিয়মিত সদস্যরা ছিল তরুণ ও সাহসী। সবাই নিজেদের শিল্পকর্ম নিয়ে প্রাণপণ সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে কে নেই! আছে চিত্রশিল্পী, ভাস্কর ও লেখক। কবি! হ্যাঁ, তা তো আছেই।
তবে সবার প্রিয় ছিল গারসিন। সে একটু বিষণ্ন প্রকৃতির, অ্যাবসিন্থের মতো তেতো মদের বোতল সব সময় তার সঙ্গী। কিন্তু গারসিন কখনও মাতাল হতো না, শুধুই স্বপ্নে মগ্ন এক নায়ক ছিল সে। নিখুঁত বোহেমিয়ান এবং অসম্ভব সৃজনশীল। ছিল অসাধারণ এক তাৎক্ষণিক কবিতা রচয়িতা।
প্লম্বিয়ে ক্যাফের সেই ভাঙাচোরা ঘরটিতে আমাদের উচ্ছল আড্ডা হতো নিয়মিত। অগোছালো ছোট্ট সে ঘরের দেয়ালের প্লাস্টার ধুলোয় ভরে থাকত। সে দেয়ালে ছিল ভবিষ্যতের ধ্রুপদি শিল্পকর্মের আঁচড়, নানা অঙ্গভঙ্গির স্কেচ, পরিকল্পনার খসড়া, হিজিবিজি রেখা আর একের পর এক কবিতার ছত্র– সবই ছিল আমাদের প্রিয় গারসিনের বাঁকা হাতে লেখা।
আসলে গারসিনই ছিল আমাদের নীল পাখি। তোমরা কি জানো না, কেন তাকে এই নামে ডাকা হতো? আমরা সবাই মিলে তাকে এই নাম দিয়েছিলাম। শুধু খামখেয়ালি করে দেওয়া নাম নয়, উপযুক্ত কারণও ছিল।
গারসিন ছিল অন্তর্মুখী, গভীর চিন্তা ও বিষণ্নতায় নিমগ্ন এক কবি। যখন আমরা সবাই হাস্যরসে মেতে উঠতাম, তাকে জিজ্ঞেস করতাম, কেন সে দুঃখী? তখন সে ভ্রুকুটি করত। মাথা তুলে ছাদের দিকে তাকিয়ে কষ্টসাধ্য এক হাসি দিয়ে বলত, “বন্ধুরা, তোমরা জানো কি? আমার মস্তিষ্কে একটি নীল পাখি বন্দি, তাই।”
বসন্ত এলেই গারসিন প্যারিসের নতুন নতুন গ্রামের দিকে ঘুরতে যেতে ভালোবাসত। তার মতে, উদ্যানের পরিবেশ শরীরের জন্য ভালো। বনভূমির বাতাস তার ফুসফুসে স্বস্তি দিত, কবি এসে আমাদের তা বলত।
ভ্রমণে গেলে সে বেগুনি ফুল ও কবিতার নোটবুক নিয়ে ফিরত। এগুলো ছিল পাতার মৃদু ঝরে পড়ার আওয়াজে লেখা, আকাশে মেঘহীন বিস্তৃতির মতো। বেগুনি ফুলগুলো ছিল তার প্রতিবেশী নিনির জন্য– সে এক গোলাপি গালওয়ালা সুন্দরী, যার চোখ ছিল গভীর নীল।
আর কবিতাগুলো ছিল আমাদের জন্য। আমরা সেগুলো পড়ে তার প্রশংসা করতাম। গারসিন ছিল প্রকৃত প্রতিভাবান। আমরা বিশ্বাস করতাম, একদিন তার সময় আসবে। গারসিন তার নতুন কবিতা আওড়ে যেত, “ওহ, নীল পাখি উড়ে যাবে অনেক উঁচুতে!” আমরা বলতাম, “বাহ! অসাধারণ! ছেলেটি আসলেই এক বিস্ময়!” সবাই তাকে ভালোবাসত, সবাই প্রশংসা করত।
গারসিনের বিশ্বাস ছিল:
ফুলের মধ্যে সেরা যার রং সুন্দর নীল।
রত্নের মধ্যে সেরা নীলপাথর।
বিশ্বের মধ্যে সেরা আকাশ ও ভালোবাসা– এটা ছিল নিনির চোখের মণি। যেমন সে বলত, “মূর্খতার চেয়ে স্নায়ুজনিত ব্যাধি অনেক ভালো।”
তবে মাঝে মাঝে গারসিন আরও বিষণ্ন হয়ে পড়ত। শহরের মোড়ে মোড়ে ঘুরে বেড়াত, কিন্তু কোনো বিলাসবহুল গাড়ি বা সুন্দরী নারীর দিকে তার দৃষ্টি থাকত না। গাড়িগুলো উদাসীনভাবে চলে যেত, অভিজাত ব্যক্তিরা হেঁটে যেত, অপরূপা নারীরা তার দিকে চেয়ে ঠোঁট চেপে হাসত।
কখনও সে কোনো গহনার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হাসত। কিন্তু যখন কোনো বইয়ের দোকানের কাছ দিয়ে যেত, তখন থেমে থাকত। কাচের জানালায় তাকিয়ে বইয়ের ঝলমলে মলাট দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলত। হতাশায় সে আকাশের দিকে মুখ তুলত, ছুটে আসত আমাদের কাছে ক্যাফেতে। উত্তেজিত ও প্রায় অশ্রুসজল হয়ে বলত, “হ্যাঁ, আমার মস্তিষ্কে একটি নীল পাখি বন্দি, এবং সেই পাখিটি মুক্তি চায়।’
এমন সময় একদিন শহরের কিছু মানুষ ভাবতে শুরু করল যে, গারসিনের মানসিক অবস্থা ভালো নয়। একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞকে ঘটনাটি জানানো হলো, তিনিও বিষয়টিকে মানসিক অসংগতি বলে চিহ্নিত করলেন। তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ নিয়ে সন্দেহ করার মতো প্যারিসে কেউ ছিল না। স্নায়ুবিজ্ঞানের সব পরীক্ষার পর, সবাই মেনে নিতে বাধ্য হলো যে গারসিন সত্যিই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। অবশেষে, হতভাগা গারসিনকে ‘পাগল’ বলে ঘোষণা করা হলো।
গারসিনের বাবা ছিলেন নরম্যান্ডির এক বৃদ্ধ কাপড় ব্যবসায়ী। একদিন তিনি তাকে একটি চিঠি পাঠালেন:
“আমি তোমার প্যারিসের পাগলামির কথা সব শুনেছি। যতদিন তুমি এই অবস্থায় থাকবে, আমি তোমাকে এক পয়সাও পাঠাব না। এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। এসো, আমার দোকানের হিসাবপত্র দেখো, আর তোমার সেই নির্বুদ্ধিতার পাণ্ডুলিপিগুলো পুড়িয়ে ফেলো। তবেই আমি তোমাকে টাকা দেব।”
সেদিন আমরা প্লম্বিয়ে ক্যাফেতে বসে ছিলাম। চিঠিটি সবার সামনে দাঁড়িয়ে শোনানো হলো। কেউ কেউ হাতে নিয়েও দেখতে চাইল, আবার পড়া হলো:
“তুমি কি যাবে?”
“তুমি কি নেবে না?”
“তুমি কি রাজি?”
“তুমি কি নাকচ করবে?”
আমাদের সবার চোখের সামনে গারসিন চিঠিটি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলল। শাবাশ গারসিন! চিঠিটি ছিঁড়ে ফেলে কল্পনাকে মুক্তি দিয়ে সে উৎসাহের সঙ্গে কবিতা রচনা করল। কবিতায় শেষ অংশটি ছিল এমন কিছু:
“হ্যাঁ, আমি চিরকাল অলস থাকব,
আর এটাই আমি উদযাপন করি,
যতদিন না মস্তিষ্কে বন্দি থাকা নীল পাখি
মুক্তি পায়!”
তারপর থেকে গারসিন বদলে গেল। তার চরিত্রে আমূল পরিবর্তন এলো। সে কথা বলত বেশি, সব সময় উল্লাসে থাকত, নতুন পোশাক কিনল আর ‘নীল পাখি’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা লেখা শুরু করল।
প্লম্বিয়ে ক্যাফেতে আমাদের প্রতিরাতের আড্ডায় গারসিন সেই কবিতা পড়ে শোনাত। ওই কবিতায় ছিল এক সুন্দর আকাশ, এক সতেজ গ্রাম এবং ফুলের মধ্যে উঁকি মারা শিশুদের মুখ। আর ছিলেন ঈশ্বর, যিনি সেইসবের ওপর এক নীল পাখি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সেই পাখিটি কবির মস্তিষ্কে আশ্রয় নেয় এবং বন্দি হয়ে পড়ে।
এই ছিল সেই কবিতা: “যখন পাখিটি গান গায়, তখন আনন্দের কবিতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু যখন পাখিটি উড়তে চায় এবং তার ডানা ছড়িয়ে দেয়, তখন মস্তিষ্কের দেয়ালে আঘাত করে।”
কবিতা পড়া শেষে কবি তার কপাল কুঁচকায় এবং এক গ্লাস কড়া অ্যাবসিন্থ পান করে।
একদিন গারসিন এসে বলল, “নতুন খবর! নিনি মারা গেছে। বসন্ত আসে, নিনি চলে যায়।” সেই রাতে গারসিন খুব হাসছিল, অথচ সে ছিল বিষণ্ন। গারসিন বলল, “এখনও কবিতার শেষ অংশ লেখা বাকি। নাম হবে: কীভাবে নীল পাখি উড়ে যায় নীল আকাশে।”
পরদিন সকালে গারসিনকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কোথাও না। আমরা সবাই ক্যাফেতে তাকে খুঁজছিলাম। তারপর আমরা তার ঘরে গিয়ে দেখি– সে বিছানায় শুয়ে আছে, মাথার খুলিটি গুলিতে উড়ে গেছে, রক্তে লাল হয়ে আছে বিছানার চাদর। বালিশের পাশে তার বিখ্যাত কবিতার পাণ্ডুলিপি পড়ে ছিল।
তার শেষ পৃষ্ঠায় লেখা:
“আজ, বসন্তের ফুল ফোটার দিনে, আমি খাঁচার দরজা খুলে দিচ্ছি, হতভাগা নীল পাখিটিকে মুক্ত করে দিচ্ছি।”
ওহ গারসিন! কতজনের মস্তিষ্কেই না বন্দি রয়েছে তোমার মতোই নীল পাখি!
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর ছ ন আম দ র একদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
নারী নির্যাতন, বিচারহীনতা ও সরকারের অস্পষ্ট অবস্থান
মাগুরায় আট বছরের শিশু ধর্ষণের বীভৎস ঘটনা যে কোনো বিবেকবান মানুষকে হতবুদ্ধি করে দেয়। বিকৃতির কোন পর্যায়ে আপন ঘরেই শিশু পাশবিক নির্যাতনের শিকার হতে পারে! দেশে ধর্ষণের ঘটনা নতুন নয়, সারাদেশ তোলপাড় করা বেশ ক’টি ধর্ষণের ঘটনার কথা এক নিঃশ্বাসে আমরা বলতে পারি। পূর্ণিমা, তনু, মুনিয়া... বিভিন্ন সময়ে আলোড়ন-জাগানিয়া এসব ধর্ষণকাণ্ডের একটিরও যথার্থ বিচার হয়নি। ধর্ষণের শিকার অগণিত নারী-শিশুর খবর পত্রিকার পাতা পর্যন্ত আসেও না।
অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্রমাবনতির সমান্তরালে বেড়েছে নারী নির্যাতন। নারী ও শিশু ধর্ষণ, নির্যাতন, দলবদ্ধভাবে হেনস্তা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, বিদ্যালয় ও সড়ক-মহাসড়কে সজোর প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। রোববার মধ্যরাতে রোকেয়া হলের ছাত্রীরা রাজপথে বেরিয়ে এসে প্রতিবাদের ঝড় তোলে, গড়ে ওঠে ‘ধর্ষণবিরোধী প্রতিবাদ মঞ্চ’; দাবিদাওয়ার মুখে সরকারের উপদেষ্টাদের আপাত সরব দেখা যায়।
সোমবারের (১০ মার্চ, ২৫) সমকাল ও প্রথম আলোর কয়েকটি শিরোনাম: দিনের পর দিন ধর্ষণ, মুক্তি মেলেনি মায়ের মৃত্যুতেও; কেরানীগঞ্জে অন্তঃসত্ত্বাকে দলবদ্ধ ধর্ষণ; শেরপুর ও কুমিল্লায় ধর্ষণের শিকার শিশু, দুই বৃদ্ধ গ্রেপ্তার; সেই শিশুর বুকে বসানো হলো টিউব, জ্ঞান ফেরেনি চার দিনেও; ধর্ষণ থামছে না, ফেব্রুয়ারিতে দিনে গড়ে ১২টি মামলা; শিশুটি কান্নাকাটি করে বোনের বাসা থেকে চলে আসতে চেয়েছিল; ৩ শিশু ধর্ষণের শিকার, অন্তঃসত্ত্বা নারীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ। দেশের প্রধান দুটি দৈনিকের প্রথম পাতায় এক দিনের শিরোনাম দেখে মনে হয়, এই দেশে অন্ধকার যুগ চলছে। ধর্ষণের বিরুদ্ধে যখন নারীরা রাস্তায় প্রতিবাদমুখর; তখন আনাচে-কানাচে নারী নিপীড়নের মাত্রা পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
২.
সাম্প্রতিক দুটি নারী নির্যাতনের ঘটনা মনে করা যাক। লালমাটিয়ায় চায়ের দোকানে দুই নারীকে সিগারেট খাওয়ার ‘অপরাধে’ মারধর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ওড়না না পরার কারণে কর্মচারীর ‘সবক’। দুই ক্ষেত্রেই ‘তৌহিদি জনতা’ দৃশ্যপটে হাজির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে ‘সবকদাতা’ কর্মচারীর মুক্তির দাবিতে ‘তৌহিদি জনতা’ শাহবাগ থানাও ঘেরাও করে। পরদিন জামিনপ্রাপ্ত নারী উত্ত্যক্তকারীকে ফুলের মালা ও পাগড়ি পরানো হয়।
নারীর পোশাক নিয়ে সমালোচনার অন্ত নেই। এমনকি নারী টিপ দিল কেন, ঘোমটা নেই কেন– এসব নিয়েও সমালোচনামুখর অনেকে। এসব আচরণ আমাদের সমাজে নারী নির্যাতনের অন্তর্ভুক্ত নয়। অথচ পোশাক বা সাজসজ্জার জন্য প্রতিবন্ধকতায় পড়াই তো বড় নারী নির্যাতন! এই নির্যাতন লাগাতার চলেছে; ওয়াজ মাহফিলে, সামাজিক মাধ্যমে, উগ্রবাদী দলের সভায় নারীর চলন-পোশাক ‘ঠিক’, ‘বেঠিক’ রায় দেওয়া হচ্ছে। এমন ভাষা ও ভঙ্গিমায় বর্ণনা করা হচ্ছে, যেন নারী পণ্যমাত্র, তাঁকে ‘সঠিকভাবে পরিবেশন’ করতে হবে! এই দৃষ্টিভঙ্গি ও পরিবেশনা নারীর স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায় কেবল নয়, নারীর প্রতি সহিংস সমাজ ও প্রতিবেশ গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখছে।
৩.
৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে দুঃশাসক আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিষ্ঠার পর সমাজ ও সংস্কৃতির প্রতি সংবেদনশীল আচরণ ন্যূনতম প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা দেখি মাজার ভাঙা, মুক্তিযুদ্ধের স্থাপনা ভাঙা, ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর চূর্ণ-বিচূর্ণ করা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য ভাঙা– সবকিছুতেই নির্বিকার ও নির্লিপ্ত সরকার। তারপর নারীর প্রতি একের পর এক রুচিহীন আক্রমণ। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর হোসেন লালমাটিয়ায় দুই নারীকে প্রহারের পর বলেন, ‘উন্মুক্ত স্থানে নারী বা পুরুষ যে কারও জন্য সিগারেট খাওয়া অপরাধ।’ হা হতোস্মি! যে দেশে উন্মুক্ত স্থানে প্রকাশ্যে যত্রতত্র পুরুষ মূত্রত্যাগ করে, সে দেশে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন এই কথা? পুরুষ তো পারলে অন্যের ঘাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খায় এ দেশে। কী বলছেন তিনি? বুঝে বলছেন!
রাজধানীর গুলশানে বা যে কোনো শহরের অলিগলিতে কয়েকজন মিলে স্লোগান দিতে শুরু করে– ‘স্বৈরাচারের দোসরেরা/ হুঁশিয়ার সাবধান।’ তারপর ঢুকে যায় কারও তালাবদ্ধ বাড়িতে। তছনছ, ভাঙচুর, লুটপাট করে। তখন প্রশ্ন জাগে, দেশে সরকার বলতে কিছু আছে কিনা?
মব সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে অবস্থান স্পষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে সরকার। মব সন্ত্রাসীরা নিতান্ত ছোট গোষ্ঠী, তারা এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাঙ্ক্ষা ও সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে না। সরকারের কি ধারণা, মবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তাদের বৈধতা কমে আসবে? আশ্চর্যের বিষয়, সরকার তার শক্তি সম্পর্কেই জ্ঞাত নয়!
সরকারপ্রধান বারবার বলেন, পতিত আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা কালো টাকা ব্যবহার করে সরকারের বিরুদ্ধে অস্থিরতায় ইন্ধন জোগাচ্ছে। না, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর সুযোগ নেই। ক্ষমতাচ্যুতরা সরকারের চেয়েও শক্তিশালী– একথা আপনি বললেও আমরা মানতে পারি না। দেশের ছাত্র-জনতার সমর্থনে আপনি দায়িত্ব নিয়ে কেন পতিত গোষ্ঠীকে এত সমীহ করবেন? ধর্মীয়, লিঙ্গীয় বা রাজনৈতিক পরিচয়ে এ দেশে মানুষে মানুষে নানা পার্থক্য থাকতে পারে। কেউ কারও সঙ্গে একমত না হতেই পারেন, কিন্তু কারও ওপর কেউ আক্রমণ করতে পারবে না। এই ন্যূনতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অবস্থান স্পষ্ট করতে পারেনি। তাদের দু-একজন উপদেষ্টা বরং দেশের ইতিহাস, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে আপন আপন মতামত দিতে শুরু করেছেন। দেশের মুক্তিযুদ্ধকে কোথাও কোথাও তাতে খর্ব করার উৎসাহও আমাদের চোখে পড়ে। এসবই উগ্র ডানপন্থিদের সবল করার কসরত বলে মনে হয়।
রোববার রাতে প্রেস ব্রিফিংয়ে আইন উপদেষ্টা সাম্প্রতিক নানা ঘটনা প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চেয়ে বলেছেন, এখন থেকে তারা আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় জোর দেবেন। সাত মাস পর এ ধরনের মিনতি শঙ্কাজাগানিয়া। এতদিন তারা আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কেন আরও উদ্যোগী হলেন না? আইন উপদেষ্টা ধর্ষণ মামলায় জামিন পাওয়ার অধিকার রাখবেন না জানিয়ে বলেছেন, এ মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে বিচার হবে। তবে জামিন অযোগ্য মামলা হওয়ায় অপ্রয়োজনীয় মামলা বাড়বে কিনা, এদিকে জোর যেমন দেওয়া উচিত; তেমনি আইনি কাঠামো আরও সম্প্রসারণ ও জোরদার করবার প্রসঙ্গটিকেও তিনি গুরুত্ব দেবেন বলে প্রত্যাশা। তথ্য উপদেষ্টা একই ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘জনগণকে জানাতে চাই, যেখানেই মব জাস্টিস পরিস্থিতি হবে, সে যে-ই হোক না কেন, যে ধর্মের, লিঙ্গের, বর্ণের, জাতের হোন না কেন, আমরা এখন থেকে কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবো।’
তথ্য উপদেষ্টার কথাতেই পরিষ্কার, মব সন্ত্রাস নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের এতদিনকার অবস্থান স্পষ্ট ও দৃঢ় ছিল না। সরকারের অবস্থান সুস্পষ্ট থাকলে নারীর প্রতি সহিংসতাও বাড়ত না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে হবে সরকারকে। যেহেতু নির্বাচনে দাঁড়ানোর প্রশ্ন নেই; তাই কারও মন জয় করবার বাড়তি তাগিদও থাকা উচিত নয় সরকারের। সে কারণে তার স্বজনপ্রীতিও থাকবার কথা নয়। আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কঠোর হাতে সরকারের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল ও সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com