রাজনৈতিক ঐকমত্যের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকার যে সংলাপের আয়োজন করতে যাচ্ছে, তাতে দেশবাসীর মনে নতুন করে আশাবাদ জেগেছে বলা যায়। রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে গত বছর সরকার যে ১১টি কমিশন গঠন করেছিল, সেগুলোর বেশির ভাগই ইতিমধ্যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর মধ্যে আছে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিচারবিষয়ক সংস্কার কমিশন।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসন কমিশনের প্রতিবেদন গ্রহণকালে একে জাতীয় ও বিশ্বের সম্পদ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি সংস্কার কমিশনগুলোর এই সুপারিশ ইতিহাসে স্থান করে নেবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
এর আগে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল জানিয়েছিলেন, ৮ ফেব্রুয়ারি ছয়টি সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে এবং কমিশনপ্রধানেরা মিলিত হয়ে আশুকরণীয়, মধ্যকরণীয় ও নির্বাচনের পরে করণীয় বিষয়ে সুপারিশমালা পেশ করবেন। আর ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সব রাজনৈতিক দল ও আন্দোলনের পক্ষের শক্তি, সংস্কার কমিশনের প্রধানদের নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
আমরা মনে করি, বিভিন্ন কমিশন যেখানে কাজ শেষ করেছে, সেখান থেকেই অন্তর্বর্তী সরকার ও অংশীজনদের কাজ শুরু হবে। এই অংশীজনদের মধ্যে আছে অন্তর্বর্তী সরকার, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজন। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অভিযোগ এসেছে, এর আগে যেসব সংলাপ হয়েছে, তাতে তারা যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে মতামত প্রকাশের সুযোগ পায়নি। এবার সংলাপটা এমনভাবে করতে হবে, যাতে সব পক্ষ খোলামেলাভাবে ও যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়ে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারে।
নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে—রাজনৈতিক মহলে যে বিতর্ক আছে, সেটা অপ্রয়োজনীয় বলে মনে করি। আশা করা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য অংশীজনের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা হলে এর অবসান হবে।
আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিশেষ রাজনৈতিক পটভূমিতে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। রাজনৈতিক দলসহ অন্যান্য অংশীজনের সমর্থন ও সহায়তা না পেলে তারা কোনো কাজে সফল হবে না। আবার অন্তর্বর্তী সরকারও অংশীজনদের বাদ দিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিলে তা-ও সফল হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এখানে দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতা ও বোঝাপড়া থাকতে হবে।
আমরা যতটা জানি, কোনো দলই সংস্কারের বিষয়ে আপত্তি করেনি। তবে সংস্কারের মাত্রা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়েও মতভেদ থাকতে পারে। কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে এটা অস্বাভাবিক নয়। কথা হলো এই ভিন্নমতকে আমরা কীভাবে মোকাবিলা করব? আলোচনা ও যুক্তিতর্কই এ ক্ষেত্রেই একমাত্র পথ।
জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর জনমনে যে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে, সেটা পূরণ করার দায়িত্ব যেমন অন্তর্বর্তী সরকারের, তেমনি আন্দোলনের অংশীজনদেরও। তাঁরা স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটাতে যে দৃঢ় ঐক্যের পরিচয় দিয়েছেন, নির্বাচন ও সংস্কারের বিষয়েও তাঁরা ঐকমত্যে পৌঁছাবেন বলে আশা করা যায়। সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে, তাঁরা যে সংগঠন বা দলের হয়ে কথা বলছেন, তাঁরা কেবল তাদেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন না। প্রতিনিধিত্ব করছেন ১৭ কোটি মানুষকে। জনমানুষের প্রত্যাশাকে সবাইকে অবশ্যই গুরুত্ব দিতে হবে।
বিগত তিনটি নির্বাচনে মানুষ ভোট দিতে পারেননি। অতএব অন্তর্বর্তী সরকারকে এমন একটি নির্বাচন করতে হবে, সেখানে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ নির্ভয়ে ও নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবেন, সব প্রতিযোগী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ পাবেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে যাতে স্বৈরতন্ত্র ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য সংস্কারের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যাবে না। নির্বাচনের দিন-তারিখ কিংবা সংস্কারের মাত্রা কী হবে—এগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠারও কোনো বিকল্প নেই।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অ শ জনদ র ঐকমত য অ শ জন সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কার নিয়ে মতামত দিল আরও দুই দল
সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে লিখিত মতামত জমা দিয়েছে গণ অধিকার পরিষদ ও বিকল্প ধারা বাংলাদেশ (একাংশ)। আজ বুধবার দুপুরে দল দুটি আলাদাভাবে জাতীয় সংসদ ভবনে কমিশনের কার্যালয়ে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের কাছে মতামত জমা দেয়।
মতামত জমা দেওয়ার পর গণ অধিকার পরিষদ জানিয়েছে, তারা পাঁচটি সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোর ৮৫ শতাংশের সঙ্গে একমত। বাকি ১৫ শতাংশের ক্ষেত্রে তারা আংশিক একমত বা একমত হতে পারেনি। তারা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতীয় সরকারে রূপ দিয়ে অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কার করে তার অধীনে নির্বাচন নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছে।
গণ অধিকার পরিষদের উচ্চতর পরিষদের সদস্য আবু হানিফ, শাকিল উজ্জামান, হাবিবুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিলু খান, প্রচার সম্পাদক শহিদুল ইসলাম প্রমুখ মতামত জমা দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন।
এর আগে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাছে সংস্কার প্রস্তাব সম্পর্কে মতামত জমা দেয় নুরুল আমিন ব্যাপারীর নেতৃত্বাধীন বিকল্পধারা বাংলাদেশ।
সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর মধ্যে সংবিধান, জনপ্রশাসন, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চায় ঐকমত্য কমিশন। সুপারিশগুলোর স্প্রেডশিট আকারে ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়। ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলোকে মতামত দিতে বলা হয়েছিল। এখন পর্যন্ত ৩১টি দলের কাছ থেকে মতামত পেয়েছে কমিশন। মতামতের ভিত্তিতে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা শুরু করেছে ঐকমত্য কমিশন।