‘আগে গুলি চালাও, তারপর প্রশ্ন করো—শুল্ক বিষয়ে আমাদের এটাই কৌশল।’ গত বছরের শেষ দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের একজন গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারক আমাকে এ কথাটি বলেছিলেন।

এ ধরনের গর্বভরা কথাবার্তা তো এখন ওয়াশিংটনে হালফ্যাশন হয়ে উঠেছে; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের চিন্তাভাবনার তোয়াক্কা না করে খুব চাঁছাছোলা কথাবার্তা বলার কৌশলটা অত্যন্ত বিপজ্জনক—আমেরিকার জন্য তো বটেই, এমনকি যেসব দেশকে তিনি বাড়তি শুল্ক আরোপের জন্য বেছে নিয়েছেন, তাদের জন্যও।

এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে বিশাল দুই বিপদ আসতে পারে। এগুলো হলো উচ্চহারে মূল্যস্ফীতি ও শিল্প খাতে বিপর্যয়। আর এ দুই বিপদের কথা সবারই জানা।

এটা ঠিক যে উচ্চহারে শুল্ক আরোপের জন্য তেমন কোনো পরিণতি আমেরিকাকে তাৎক্ষণিকভাবে বহন করতে হবে না। তবে এর কৌশলগত পরিণতি একাধারে গুরুতর ও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। ট্রাম্পের শুল্ক পশ্চিমা দুনিয়ার একতার মৈত্রী ধ্বংস হওয়ার হুমকিতে ফেলেছে। বিভিন্ন দেশ আমেরিকার কাছ থেকে নতুনভাবে হুমকি অনুভব করায় একটি বিকল্প জোট গঠন করতে পারে আর ট্রাম্প সেটিরই বীজ বুনতে শুরু করেছেন।

পশ্চিমা দুনিয়ার একতা ধসে গেলে তা হবে চীন ও রাশিয়ার একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন। ট্রাম্প হয়তো ব্যক্তিগতভাবে এর তোয়াক্কা করেন না। তিনি প্রায়ই ভ্লাদিমির পুতিন ও সি চিনপিংয়ের প্রতি তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করে থাকেন। কিন্তু যে দুজনকে তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিয়োগ করেছেন, সেই মারকো রুবিও এবং মাইক ওয়ালৎজ এটা বিশ্বাস করেন যে চীনের শক্তিমত্তাকে প্রশমিত করারই হলো যুক্তরাষ্ট্রের মূল কৌশলগত চ্যালেঞ্জ।

আর তাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে চীন, কানাডা ও মেক্সিকোর ওপর বাড়তি শুল্ক করা হবে ট্রাম্পের জন্য পুরোপুরি এক বোকামি। কারণ, এর মধ্য দিয়ে তিনি এই তিন দেশের স্বার্থের মধ্যে একটি অভিন্নতা আনয়নের ঝুঁকি তৈরি করেছেন। এদের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নও (ইইউ) আছে, যারা ট্রাম্পের শুল্ক আক্রমণের পরবর্তী লক্ষ্য।

আরও পড়ুনলাখো মানুষের আমেরিকান হওয়ার স্বপ্ন আটকে গেছে যে সীমান্তে০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

২০২১ সালে বাইডেন প্রশাসন যখন দায়িত্বভার গ্রহণ করে, তখন ইইউ চীনের সঙ্গে নতুন একটি বাণিজ্য চুক্তিতে উপনীত হওয়ার পথে ছিল; কিন্তু ওয়াশিংটনের চাপ ও বেইজিংয়ের মারাত্মক কিছু ভুলের ফলে ব্রাসেলসকে সরে আসতে হয়; তবে বাইডেন প্রশাসনের মেয়াদের শেষভাগে এসে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় কমিশন একযোগে কাজ করছিল চীনের সঙ্গে বাণিজ্যকে ‘ঝুঁকিমুক্ত’ এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি রপ্তানি আটকে দেওয়ার জন্য।

বাইডেন প্রশাসনের যুক্তি ছিল, যদি যুক্তরাষ্ট্র চীনের সঙ্গে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়, তাহলে সে তখনই টিকে যাবে যখন অন্যান্য অগ্রসর গণতান্ত্রিক দেশগুলোকে তার পাশে নিয়ে কাজ করতে পারে। এর বিপরীতে ট্রাম্প আমেরিকার প্রতিপক্ষদের তুলনায় মিত্রদের ওপর অধিক মাত্রায় চড়াও হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এর সম্ভাব্য পরিণতি হতে পারে যে তিনি মিত্রদের চীনের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

ইউরোপীয় নীতিনির্ধারকেরা এটা বেশ ভালোভাবেই জানেন, পরিবেশবান্ধব হিসেবে চারপাশকে গড়ে তোলার যে উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য তাঁরা নিয়েছেন, চীনের বৈদ্যুতিক যানবাহন, ব্যাটারি ও সৌর প্যানেল ছাড়া তার বাস্তবায়ন অসম্ভব। আর আমেরিকার বাজার হাতছাড়া হওয়ার হুমকি চীনের বাজারকে আরও বেশি প্রয়োজনীয় করে তুলবে। আমি যখন একজন ঊর্ধ্বতন ইউরোপীয় নীতিনির্ধারককে গত সপ্তাহে এই বলে পরামর্শ দিয়েছিলাম যে ইইউ এখন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার কথা ভাবতে পারে, তখন তাঁর উত্তর ছিল, ‘বিশ্বাস করুন বা না–ই করুন, এই আলাপ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে।’

কানাডা ও মেক্সিকো যন্ত্রণাবিদ্ধভাবেই এটা ওয়াকিফহাল যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে বাজির দান তাদের প্রতিকূলে। কিন্তু তাদের পাল্টা আঘাত করতেই হবে। আমেরিকার বলপ্রয়োগের মুখে কোনো জাতীয় নেতাই নিজেকে দুর্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মতো কাজ করতে পারেন না; এবং ট্রাম্পকে পাল্টা আঘাত করাই সম্ভবত সঠিক কৌশল। সম্প্রতি একজন ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, ‘ট্রাম্প আপনার মুখে ঘুষি মারলে আপনি যদি পাল্টা না মারেন, তাহলে তিনি আবারও আপনাকে আঘাত করবেন।’

এমনকি কয়েকজন প্রভাবশালী ইউরোপিয়ান এই প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন যে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে কে সরাসরি বেশি হুমকি। দুই মাস আগে এ রকম প্রশ্ন অবান্তর ছিল; কিন্তু সি নয়; বরং ট্রাম্পই কানাডার স্বাধীনতার সমাপ্তি ঘটানোর কথা বলছেন। অথচ দেশটি ন্যাটোর অন্যতম সদস্য। আবার চীন সরকার নয়; বরং ট্রাম্প প্রশাসন ও ইলন মাস্ক ইউরোপে উগ্র দক্ষিণপন্থীদের মদদ জোগাচ্ছেন।

চীনের বেনিয়াবাদ এবং ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রুশ যুদ্ধকে বেইজিংয়ের সমর্থন এখনো ব্রাসেলস ও চীনের মধ্যে যেকোনো সুসম্পর্ক স্থাপনের পথে প্রধান বাধা হয়ে আছে; কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসন যদি ইউক্রেনকে পরিত্যাগ করে আর বেইজিং যদি রাশিয়ার প্রতি কঠোর হয়, তাহলে ইউরোপীয়রা চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার পথে হাঁটবে।

লাতিন আমেরিকাতেও চীন নতুন সুযোগ খুঁজতে যাবে; কারণ পানামা ও মেক্সিকোর প্রতি আমেরিকার হুমকি। ট্রাম্প যেহেতু পানামা খালের ওপর পুনর্নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে এবং মেক্সিকোর মাদক চক্রকে দেখে নিতে চান, সেহেতু এ দুই দেশের বিরুদ্ধে সামরিক শক্তি প্রয়োগসহ যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী পদক্ষেপ আসন্ন।

কিন্তু মেক্সিকোর বিরুদ্ধে ট্রাম্পের আগ্রাসন হিতে বিপরীত হতে পারে। উচ্চহারে আরোপিত শুল্কের কারণে দেশটিতে যদি মন্দা দেখা দেয়, তাহলে সেখান থেকে আমেরিকা যাওয়ার জন্য মরিয়া মানুষের সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না। একই সঙ্গে বাড়বে মাদকচক্রের দৌরাত্ম্য; যাদের রপ্তানি শুল্কের হিসাবের বাইরে, মানে চোরাই পথে।

কানাডা ও মেক্সিকো যন্ত্রণাবিদ্ধভাবেই এটা ওয়াকিফহাল যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে বাজির দান তাদের প্রতিকূলে। কিন্তু তাদের পাল্টা আঘাত করতেই হবে। আমেরিকার বলপ্রয়োগের মুখে কোনো জাতীয় নেতাই নিজেকে দুর্বল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার মতো কাজ করতে পারেন না; এবং ট্রাম্পকে পাল্টা আঘাত করাই সম্ভবত সঠিক কৌশল। সম্প্রতি একজন ইউরোপীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে বলেছিলেন, ‘ট্রাম্প আপনার মুখে ঘুষি মারলে আপনি যদি পাল্টা না মারেন, তাহলে তিনি আবারও আপনাকে আঘাত করবেন।’

এখন পর্যন্ত ব্রিটেন ও জাপান ট্রাম্পের শুল্ক আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়নি। এটা তাদের জন্য সাময়িক স্বস্তি বটে। কিন্তু তারা যদি ভেবে থাকে যে চুপচাপ থাকলে বেঁচে যাবে, তাহলে তা হবে নিজেদের ছেলে ভোলানো বুঝ দেওয়া। ট্রাম্প যদি এটা সিদ্ধান্ত নেন যে প্রথম দফার শুল্কযুদ্ধ কাজে দিয়েছে, তাহলে নিঃসন্দেহে তিনি আরও নতুন লক্ষ্যবস্তু খুঁজে বের করবেন আক্রমণ চালানোর জন্য।

করপোরেট আমেরিকারও এখন সজাগ হওয়া উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ‘অ্যানিমেল স্পিরিটস’ ফিরে আসার জল্পনায় পিঠ চাপড়ানো বন্ধ করা উচিত। ট্রাম্প আসলে আমেরিকাকে যা দিতে চাইছেন, তা হলো কথিত অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা এবং পশ্চিমা মিত্রতার ধ্বংস। আর তা আমেরিকার ব্যবসায়ীদের জন্য এক অর্থনৈতিক ও কৌশলগত বিপর্যয় ডেকে আনবে, যেখানে গোটা আমেরিকাও নিমজ্জিত হবে।

গিডিয়ন রাখম্যান ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস–এর (এফটি) পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান কলামিস্ট। এফটি থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে রূপান্তর তানিম আসজাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম র ক র ব ইউর প য় কর ছ ন র জন য হওয় র ন ইউর

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে

ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও সিভিল ডিফেন্সের ১৫ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা যোদ্ধা ছিলেন না। সন্ত্রাসীও ছিলেন না। তাঁদের কাছে কোনো রকেট বা অস্ত্র ছিল না। তাঁরা ছিলেন ত্রাণকর্মী, মানবতার সেবক। যখন যেখানে বোমা ফেলা হচ্ছিল, সেখানেই তাঁরা আহতদের সাহায্য করতে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।

এর আগে গত ২৩ মার্চ গাজার দক্ষিণে রাফা এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনী একটি অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবার গাড়ির বহরকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এতে আটজন রেড ক্রিসেন্টের কর্মী, ছয়জন ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের কর্মী এবং একজন জাতিসংঘের কর্মী নিহত হন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছিল, এই গাড়িগুলো ছিল অপরিচিত। সন্দেহ করা হয়েছিল, গাড়ির মধ্যে যোদ্ধারা ছিলেন, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল।

রিফাত রাদওয়ান নামে নিহত চিকিৎসাকর্মীদের একজনের মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া ফুটেজে দেখা যায়, গাড়িগুলোতে স্পষ্টভাবে লালবাতি জ্বলছিল; সেগুলো চিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্স ছিল এবং কোথাও কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি। তারপর শুরু হয় ইসরায়েলি বাহিনীর প্রচণ্ড গুলি।

পরে রিফাতের মরদেহ আরও ১৩ জনের সঙ্গে একটি গণকবরে পাওয়া যায়। তাঁদের কয়েকজনের দেহে সরাসরি হত্যার চিহ্ন ছিল—মাথা বা বুকে গুলি লেগেছিল। কারও কারও হাত বাঁধা অবস্থায় ছিলেন।

মৃত্যুর পরও তাঁদের প্রমাণ দিতে হলো যে তাঁরা ত্রাণকর্মী ছিলেন।

তারপরও পশ্চিমা গণমাধ্যমের বড় অংশ প্রথমেই ইসরায়েলের কথাই প্রচার করল, ‘ইসরায়েল বলছে…’, ‘আইডিএফ দাবি করছে…’, ‘একজন সামরিক সূত্র জানিয়েছে…।’ এসব কৌশলে সাজানো বাক্য যেন রেড ক্রিসেন্টের রক্তমাখা ইউনিফর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। যেন তারা সত্যের চেয়ে বেশি ‘সত্য’।

এটা নতুন কিছু নয়। এটা একবারের ভুলও নয়।
এটাই একটা সিস্টেম।

এখানে ফিলিস্তিনিদের শুধু বেঁচে থাকাই অপরাধের মতো মনে করা হয়। আমাদের অস্তিত্বকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়—প্রথমে সবাইকে বোঝাতে হয় যে আমরা কোনো হুমকি নই, আমাদের জীবনও মূল্যবান, তারপর হয়তো কেউ আমাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। এটাই হচ্ছে মানবতা হারানোর আসল রূপ।

আমি গাজায় জন্মেছি, সেখানেই বড় হয়েছি। আমি জানি, রেড ক্রিসেন্টের ইউনিফর্মের অর্থ কী। এর মানে হলো, সব শেষ হয়ে গেলেও আশার একটা আলো আছে। এর মানে হলো, কেউ আসছে সাহায্য করতে—লড়াই করতে বা হত্যা করতে নয়, জীবন বাঁচাতে। এর মানে হলো, ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও কারও কাছে জীবন এখনো মূল্যবান।

বিশ্বকে এখনই ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে যে তাঁরা মানুষ। আমরা মিথ্যা বলি আর আমাদের হত্যাকারীরা সত্য বলে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেরেশতা, শুধু তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করা যাবে, এই ভাষ্যকে আর প্রচার করতে দেওয়া যাবে না।

আমি এটাও জানি, সেই আশাকে হারালে কেমন লাগে। সেখানে চিকিৎসাকর্মীদের প্রথমে হত্যা করা হয়, তারপর তাঁদের সম্মান নষ্ট করা হয়। তাঁদের সততা নিয়ে বিতর্ক তোলা হয় আর তাঁদের সহকর্মীরা গণকবর খুঁড়ে মরদেহ উদ্ধার করেন। তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তারপর ভুলে যাওয়া হয়।

মানবতা হারানো শুধু কথার কথা নয়, এটা শুধু গণমাধ্যমের কাঠামো বা রাজনৈতিক ভাষার সমস্যা নয়। এটা হত্যা করে। মুছে ফেলে। এটা পুরো জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরও বিশ্বকে চোখ ফিরিয়ে নিতে বলে। এটা আমাদের বলে দেয়: তোমার জীবন ততটা মূল্যবান নয়; তোমার শোক সত্যি কি না, তা আমরা যাচাই না করা পর্যন্ত শোক বলে বিবেচিত হতে পারে না; তোমার মৃত্যু দুঃখজনক কি না, তা আমাদের ছাড়পত্রের ওপর নির্ভরশীল।

এ কারণেই এই ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকর্মীর মৃত্যু এত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের গল্প নয়। এটি সেই অবিশ্বাসের প্রক্রিয়ার গল্প, যা প্রতিবার ফিলিস্তিনিরা নিহত হলে উঠে আসে। এটি সেই বাস্তবতা, যেখানে আমাদের নিজেদেরই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হতে হয়, নিজেদের আইনি লড়াই চালাতে হয়, নিজেদের প্রচারের কাজ করতে হয় এবং সবকিছুর সঙ্গে মরদেহের জন্য শোকও করতে হয়।

এই বোঝা আর কাউকে বইতে হয় না। যখন কোনো পশ্চিমা সাংবাদিক নিহত হন, তাঁদের সম্মান জানানো হয়। যখন কোনো ইসরায়েলি নাগরিক মারা যান, তখন তাঁদের নাম আর ছবি বিশ্বজুড়ে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। কিন্তু যখন কোনো ফিলিস্তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবারের প্রথম কাজ হয় প্রমাণ করা, যে তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন না।
আমাদের সব সময় দোষী ধরে নেওয়া হয়, যতক্ষণ না নির্দোষ প্রমাণিত হই। অনেক সময় সেটা প্রমাণ করাও সম্ভব হয় না।

অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইসরায়েলের কথা বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কথা গুরুত্ব দেওয়া হয় কম। ইসরায়েল যদি কোনো দাবি করে, তা যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করা হয়; কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কিছু বললে তা সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তাঁদের দুঃখ-কষ্ট, কান্না বা শোক তাঁদের কথাকে অবিশ্বাস্য বা অতিরঞ্জিত করে তোলে; অর্থাৎ ফিলিস্তিনিরা যা বলছেন, তা সত্য হলেও তাঁদের যন্ত্রণা দেখিয়ে তাঁরা বেশি বলছেন বা বাড়িয়ে বলছেন—এমন ধারণা তৈরি করা হয়।

এই গণমাধ্যমের ধারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকেও প্রভাবিত করে—অস্ত্র বিক্রি থেকে শুরু করে কূটনৈতিক দায়মুক্তি, আন্তর্জাতিক মঞ্চে নীরবতা থেকে জাতিসংঘে ভেটো দেওয়া পর্যন্ত। সবকিছু একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি মানুষ বলে যেহেতু গণ্য করা হয় না, সেহেতু তাদের হত্যাকারীদেরও পুরোপুরি দায়ী করা হয় না।

এর মানসিক চাপও ভয়াবহ। আমরা শুধু শোক করি না; আমাদের শোকের স্বীকৃতির জন্যও লড়তে হয়। আমরা শুধু আমাদের মৃত ব্যক্তিদের দাফন করি না; তাঁদের মৃত্যু স্বীকার করানোর জন্যও সংগ্রাম করি। আমরা এমন এক মানসিক চাপে বাস করি, যা কোনো সম্প্রদায়ের সহ্য করা উচিত নয়। আমাদের প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হয় যে আমরা তা নই, যা বিশ্ব আমাদের ভেবে নিয়েছে।

এই ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকর্মী ছিলেন সত্যিকারের নায়ক। তাঁরা বিপদের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের জনগণের সেবা করেছিলেন। তাঁরা জীবনের পবিত্রতায় বিশ্বাস করতেন। তাঁদের স্মৃতি সম্মানের যোগ্য। অথচ তাঁদের গল্পও একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বকে এখনই ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে যে তাঁরা মানুষ। আমরা মিথ্যা বলি আর আমাদের হত্যাকারীরা সত্য বলে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেরেশতা, শুধু তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করা যাবে, এই ভাষ্যকে আর প্রচার করতে দেওয়া যাবে না।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আহমেদ নাজার একজন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাট্যকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নড়াইলে হত্যা মামলায় একজনের যাবজ্জীবন
  • রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ইয়াংওয়ানের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে
  • দিনাজপুরের বনতাড়া গ্রামে ৭ দিন আতঙ্কের পর এল সম্প্রীতির বার্তা
  • নেত্রকোনায় কৃষক আনোয়ারুল হত্যা মামলায় একজনের মৃত্যুদণ্ড
  • ‘ও খোদা, এই ট্রাক দি আঁই কিরমু’
  • চলন্ত ট্রাকের চাকা বিস্ফোরণের পর রিংয়ের আঘাতে বিচ্ছিন্ন হলো পথচারীর পা
  • মধ্যপ্রাচ্যে নিষিদ্ধ ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’, মুখ খুললেন জন আব্রাহাম
  • ‘গায়ে আগুন লাগার পর তা নেভাতে আমি পশুর মতো এদিক-ওদিক ছুটছিলাম’
  • ‘মাইগ্রেন’ কি ভয়াবহ কোনো রোগ?
  • ইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে