টেকসই উন্নয়নে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কেন জরুরি?
Published: 7th, February 2025 GMT
একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তন এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনে সৃষ্ট বৈশ্বিক উষ্ণায়ন। ২০১৫ সালে ১৯৬টি দেশ প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং বিশ্ব উষ্ণায়নের খারাপ প্রভাব রোধ করতে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। প্যারিস চুক্তি, গ্লাসগো অ্যাকর্ড এবং অন্যান্য পরিবেশ রক্ষায় গৃহীত চুক্তি, প্রটোকল, কনভেনশনের কার্যকারিতা-সংশ্লিষ্ট দেশের প্রাতিষ্ঠানিক মানের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বহু ক্ষেত্রে এসব চুক্তিতে স্বাক্ষর করেও অনেক রাষ্ট্র চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে। রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানগুলো কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন হ্রাসের জন্য কাজ করার ম্যান্ডেটধারী এবং সে জন্য পরিবেশগত আইনের বিকাশ ও প্রয়োগের জন্য তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থাকতে পারে সরকার, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানগুলো নানা কর্মকাণ্ড দ্বারা প্রভাবিত হয়।
আমরা প্রায়ই দেখি, যাদের কাজ পরিবেশ রক্ষা করা তারাই পরিবেশের বেশি ক্ষতি করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও রয়েছে। বাংলাদেশে ‘ফ্লাড অ্যাকশন প্ল্যান’ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি কিংবা চকরিয়া সুন্দরবন ধ্বংসে আন্তর্জাতিক সংস্থার বিনিয়োগ ছিল। আর সেখানে রাষ্ট্র পরিচালনায় নিয়োজিত সরকার ও নীতিনির্ধারকদের ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিফলন ছিল।
টেকসই বাস্তুসংস্থানের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা নিরূপণ করতে গিয়ে গবেষকরা আইনের শাসন ও দুর্নীতিকে পরিমাপের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহার করেন। পরিবেশ রক্ষায় গৃহীত নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে দরকার নিরপেক্ষ প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, যেগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা যুক্ত।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বলতে সরকারের ক্ষমতায় থাকাকালীন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের ক্ষমতা বোঝায়। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা একটি জাতির কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের মাত্রার ওপর বিভিন্ন প্রভাব ফেলে। একটি স্থিতিশীল, যোগ্য সরকারই কেবল কোনো স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে পরিবেশবান্ধব নীতি প্রণয়ন ও তা আরোপ করার ক্ষমতা রাখে এবং সেখান থেকে ভালো ফল আসে।
ব্রাজিলে পরিচালিত এক গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে সেখানে নির্গমনের মাত্রা কমে গেছে। ১৯৯৬ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত পরিচালিত সৌদি আরবের অন্য গবেষণার তথ্য-উপাত্তমতে, সেখানে রাজনীতি স্থিতিশীলতার সঙ্গে কার্বন নির্গমন হ্রাসের একটি সম্পর্ক রয়েছে বলে উঠে এসেছে। রাজনীতিক, নীতিনির্ধারকের প্রশাসনিক স্বচ্ছতা না থাকলে সেখানে দুর্নীতি বাসা বাঁধে এবং এ ক্ষেত্রে ভঙ্গুর প্রশাসন প্ররোচক লবিস্ট দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ঘুষের মাধ্যমে পরিবেশ-সংশ্লিষ্ট অপরাধকে জায়েজ করে দিতে পারে। এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা পরিবেশদূষণ কমিয়ে আনার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, অস্থিতিশীল শাসন ব্যবস্থা দেশি-বিদেশি প্রভাবে এবং পরিবেশ রক্ষায় শক্তিশালী আইন প্রণয়ন, দূষণ বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ কিংবা পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি গ্রহণে বাধাগ্রস্ত হয়।
রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল রাষ্ট্রগুলোতে বিনিয়োগে আগ্রহ যেমন কম থাকে, তেমনি আন্তর্জাতিক সহযোগিতাও কম। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আন্তর্জাতিক করপোরেশনগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করে। এ কারণে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবে, জলবায়ু বিপর্যয়কে আরও জরুরিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারকে চাপ দেবে। এভাবে সুশাসন দ্বারা পরিচালিত ও রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল রাষ্ট্রে পরিবেশ রক্ষার কর্মকাণ্ড বেগবান হয়।
আমরা অনেক আলোচনায় পরিবেশ রক্ষায় কিংবা দূষক নির্গমন প্রশমনে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পন্থাকে উত্তম বলে উল্লেখ করেছি। কিন্তু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে সেখানে পুরো ব্যবস্থাই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট রাষ্ট্রে এই স্থিতিশীলতা যেমন প্রয়োজন, তেমনি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোয় কী ধরনের রাজনৈতিক চর্চা বিদ্যমান, সেটারও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিপক্ষ মার্কিন ক্যাপিটল বিল্ডিং আক্রমণ করে এবং ভাঙচুর চালায়, যেটি দেশটির ইতিহাসে বিরল। গণতান্ত্রিক দেশ আমেরিকায় এমন রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশ্বে টেকসই উন্নয়নের পথে বিরাট বাধা বলে মনে করা হয়। কারণ দেশটির রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক অনেক নীতিনির্ধারণের সম্পর্ক রয়েছে।
গণতন্ত্র আইন ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত এবং জনগণের সম্মতির ওপর নির্মিত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সর্বোচ্চ সম্ভাবনা প্রদান করে। এখানে স্বৈরাচারীর ‘পেশিশক্তি’ নয়, জনগণের সম্মতিই প্রকৃত রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার উৎস। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং পৃথিবীকে ধ্বংস না করে অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত যেমন প্রয়োজন এবং তেমনি তার মোকাবিলায় দরকার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কেবল কিছু আইন দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং সেই আইনের প্রয়োগ এবং এর পবিত্রতা রক্ষার মাত্রার ওপর নির্ভর করে। এটিকে অনেকটা সামাজিক গঠন কিংবা বন্ধন হিসেবেও অভিহিত করা যায়।
ট্রাম্প নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতা গ্রহণের অব্যবহিত পরে আমেরিকা কর্তৃক আন্তর্জাতিক সহযোগিতা স্থগিতকরণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে নিজ দেশকে গুটিয়ে নেওয়া টেকসই উন্নয়নের পথে বাধা এবং বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্য রক্ষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এর বাইরে রাশিয়া, চীনসহ অন্যান্য রাষ্ট্রের রাজনীতি ও টেকসই উন্নয়নের পথে প্রভাব বিস্তার করে আসছে। আঞ্চলিক পরিসরে চিন্তা করলেও দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক টানাপোড়েনে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যেমন দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি দিন দিন সংঘাতের আশঙ্কা স্পষ্ট হচ্ছে। মিয়ানমারে চলমান দীর্ঘ সংঘাতে ইতোমধ্যে সেখানকার পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপন্ন এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বন্ধ থাকায় বিপর্যয়ের মুখে দেশটি।
বিশ্বব্যাপী মানবিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন, স্থিতিশীল রাজনীতি এবং বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমেই কেবল বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা বিশ্বকে টেকসই পথে পরিচালিত করা যায়।
ড.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র র জন ত ক পর চ ল ত পর ব শ র ন র গমন ব যবস থ ক র বন র ওপর সরক র গ রহণ ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতের মাতাল বিমানযাত্রী সহযাত্রীর সঙ্গে যে আচরণ করলেন
এয়ার ইন্ডিয়ার এক যাত্রীর বিরুদ্ধে আরেক সহযাত্রীর গায়ে প্রস্রাব করে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। গতকাল বুধবার দিল্লি থেকে ব্যাংককে যাওয়ার পথে এ ঘটনা ঘটে। এর আগেও ভারতের যাত্রীদের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা এটিই প্রথম নয়। তাঁরা একাধিকবার এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছেন। গতকালের ঘটনায় এয়ার ইন্ডিয়া ও ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো অভিযোগের ঘটনা খতিয়ে দেখবে বলে ঘোষণা দিয়েছে।
এয়ার ইন্ডিয়ার যে ফ্লাইটে সহযাত্রীর গায়ে প্রস্রাব করার ঘটনা ঘটেছে, সেটার নম্বর এআই২৩৩৬। ভুক্তভোগী যাত্রীর অভিযোগের পর উড়োজাহাজের ক্রুরা ওই ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেন।
এক বিবৃতিতে এয়ার ইন্ডিয়া ওই ঘটনাকে ‘উচ্ছৃঙ্খল আচরণ’ বলে মন্তব্য করেছে। এ ঘটনার কথা বেসামরিক বিমান চলাচল অধিদপ্তরকে (ডিজিসিএ) জানিয়েছে তারা এবং অভিযোগ খতিয়ে দেখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
এয়ার ইন্ডিয়া আরও জানিয়েছে, তাদের ক্রুরা যাত্রীদের কাছে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ নিয়ে সতর্কবার্তা জারি করছেন। পাশাপাশি ভুক্তভোগী যাত্রীকে ব্যাংককে নামার পর স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ জানাতে অনুরোধ করেছেন। তবে ভুক্তভোগী যাত্রী প্রাথমিকভাবে ব্যাংককে অভিযোগ করবেন না বলে জানিয়েছেন।
ভারতের বেসামরিক বিমান পরিবহনমন্ত্রী কে রামমোহন নাইডু বলেছেন, ‘যদি কোনো অন্যায় করা হয়ে থাকে, আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’ তাঁর মন্ত্রণালয় বিষয়টি তদন্ত করবে এবং ফ্লাইট পরিচালনা কর্তৃপক্ষগুলোর সঙ্গে কথা বলবে।
ঘটনা খতিয়ে দেখতে এয়ার ইন্ডিয়া একটি স্বাধীন কমিটি গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। কমিটি ঘটনা যাচাই করে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাবে।
এর আগে ২০২৩ সালের মার্চ মাসে আর্য ভোহরা নামের এক ভারতীয় শিক্ষার্থী একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে সহযাত্রীর গায়ে প্রস্রাব করেছিলেন। এই ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারলাইনস তাঁকে নিষিদ্ধ করে। আর্য ভোহরা যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন।
ওই ঘটনার কয়েক মাস পর ২০২৪ সালের নভেম্বরে একই ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল। তখন শংকর মিশ্র নামের এয়ার ইন্ডিয়ার এক যাত্রী মাতাল অবস্থায় এক বয়স্ক নারী সহযাত্রীর গায়ে প্রস্রাব করে দিয়েছিলেন। এই ঘটনায় বেশ সমালোচনা হয়েছিল।