দেশের বর্তমান পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বিএনপি। দলটি বলেছে কঠোরভাবে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকা দৃশ্যমান করা এখন সময়ের দাবি।

বৃহস্পতিবার রাতে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই দাবি জানায় বিএনপি। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর সই করা বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত পতিত পরাজিত পলাতক স্বৈরাচার এবং তার দোসরদের উসকানিমূলক আচরণ, জুলাই–আগস্টের রক্তক্ষয়ী ছাত্র গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে অশালীন এবং আপত্তিকর বক্তব্য মন্তব্য দেশের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ এবং ক্রোধের জন্ম দিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে গতকাল বুধবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পতিত স্বৈরাচারের স্মৃতি, মূর্তি, স্থাপনা ও নামফলকসমূহ ভেঙ্গে ফেলার মতো জনস্পৃহা দৃশ্যমান হয়েছে।’

অন্তর্বর্তী সরকারের পদক্ষেপের সমালোচনা করে বিএনপির বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গত ৬ মাসেও পলাতক স্বৈরাচার এবং তাদের দোসরদের আইনের আওতায় আনতে যথেষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ জনসম্মুখে দৃশ্যমান করতে সফল হয়নি বলে জনমনে প্রতিভাত হয়েছে, ফলে জনগণ আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার মতো বেআইনি কর্মকান্ডে উৎসাহিত হচ্ছে। একটি সরকার বহাল থাকা অবস্থায় জনগণ এভাবে নিজের হাতে আইন তুলে নিলে দেশে বিদেশে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে পারে। অথচ জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের আকাঙ্খা অনুযায়ী জনগণের প্রত্যাশা ছিল দেশে আইনের শাসন পুনপ্রতিষ্ঠিত হবে, যা বর্তমান সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল। বর্তমানে দেশে বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ নানান ধরণের দাবিদাওয়া নিয়ে যখন তখন সড়কে ‘‘মব কালচারের’’ মাধ্যমে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি করছে যা সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে মুন্সিয়ানা দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে।’

বিএনপির বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘জুলাই আগস্টের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবারদের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা এবং আহতদের যথাযথ চিকিৎসা ও পুনর্বাসন, নিন্দিত ঘৃণিত পলাতক স্বৈরাচার এবং তার দোসরদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা, পরাজিত ফ্যাসিস্টদের উসকানিমূলক তৎপরতা রোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অতি জরুরি অগ্রাধিকার, অথচ এসব বিষয়ে দৃশ্যমান এবং উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।’

পুলিশ প্রশাসনসহ বিভিন্ন দায়িত্বে গণঅভ্যুত্থানবিরোধী সক্রিয় সদস্যরা এখনও কর্মরত উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘এখনও প্রশাসনকে পতিত ফ্যাসিস্ট শাসকের দোসরমুক্ত করা হয়নি, বিচার বিভাগে কর্মরত ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনও বিদ্যমান, পুলিশ প্রশাসনে গণঅভ্যুত্থানবিরোধী সক্রিয় সদস্যরা এখনও কর্মরত। এমতাবস্থায় সরকার জনআকাঙ্খা পূরণে সফলতা অর্জন করতে পারবে কিনা তা যথেষ্ট সন্দেহের উদ্রেক করে।’

বিএনপির বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘বাজার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের নিত্যদিনের দু:খ দুর্দশা লাঘব করা জরুরি, দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণী পেশার মানুষের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মিথ্যা গায়েবি মামলার কোনো সুরাহা এখনও হয়নি। গণতন্ত্রকামী জনগণ ফ্যাসিবাদী আমলের দায়ের করা মিথ্যা মামলায় এখনও হয়রানির শিকার হচ্ছে, অথচ এ বিষয়ে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখেনি।’

অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘জুলাই ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্খাকে ধারণ করে মানুষের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকারসহ ভোটাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথাশীঘ্র সম্ভব একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা করাই এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। নির্বাচনমুখী জরুরী সংস্কার সাধন করে দ্রুত নির্বাচনের আয়োজন করাই বর্তমান সরকারের প্রধানতম ম্যান্ডেট। অথচ জনআকাঙ্খা উপেক্ষা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিজেরাই এই অগ্রাধিকারকে প্রাধান্য না দিয়ে অন্যান্য বিষয়ে অধিক মনোযোগী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।’

বিএনপি মনে করে, ‘পতিত ফ্যাসিস্ট এবং স্বৈরাচারের স্মৃতিচিহ্ন নিশ্চিহ্ন কিংবা নির্মূলের মধ্যেই ফ্যাসিবাদের মূলোৎপাটন নিহিত নয় বরং ফ্যাসিবাদবিরোধী আদর্শিক চিন্তা, শক্তি ও প্রভাবের আদর্শিক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা এবং ফ্যাসিবাদবিরোধী গণঐক্যকে দৃঢ় ভিত্তি দেয়া এবং জাতীয় ঐক্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চাই উত্তম পন্থা। জনগণের মধ্যে এই ধরণের বার্তা ছড়িয়ে দিতে আমাদের সকলেরই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।’

বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বিএনপির উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, সরকার উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা প্রকাশ করতে না পারলে রাষ্ট্র ও সরকারের স্থিতিশীলতা হুমকির মুখে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে উগ্র নৈরাজ্যবাদী গণতন্ত্রবিরোধী দেশী–বিদেশী অপশক্তির পাশাপাশি পরাজিত ফ্যাসিস্টদের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে, যার উপসর্গ ইতিমধ্যেই দৃশ্যমান।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন পর স থ ত সরক র র ব এনপ র পদক ষ প জনগণ র

এছাড়াও পড়ুন:

বন্দির স্মৃতিতে বাংলাদেশের গোপন কারাগার

তড়িঘড়ি করে তৈরি করা দেয়ালটি তদন্তকারীরা ভেঙে ফেলার পরই বেরিয়ে আসে গোপন বন্দিশালার কয়েকটি কক্ষ। পেছনের লুকিয়ে রাখা অংশটি আড়াল করতেই ইট দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছিল এই প্রবেশপথ। ভেতরের সরু করিডোরের দুই পাশে ছিল ছোট ছোট ঘর। একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার।

ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে অল্প দূরেই এই গোপন কারাগার। মীর আহমদ বিন কাসেমসহ কয়েকজনের স্মৃতি ছাড়া তদন্তকারী দল হয়তো কখনোই এটা খুঁজে পেত না। বাংলাদেশের ক্ষমতাচ্যুত নেতার সমালোচক কাসেম সেখানে আট বছর বন্দি ছিলেন।

কারাগারে থাকাকালীন বেশিরভাগ সময়ই তার চোখ বাঁধা থাকতো। তাই স্মৃতিতে থাকা শব্দের ওপরই তাকে নির্ভর করতে হয়েছে। সেখানে বিমান অবতরণের শব্দ তিনি স্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন।

আর এটাই তদন্তকারীদের বিমানবন্দরের কাছাকাছি অবস্থিত সামরিক ঘাঁটিতে থাকা একটি গোপন বন্দিশালা খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। ঘাঁটির মূল ভবনের পেছনে কড়া পাহারায় থাকা জানালাবিহীন ইট ও কংক্রিটের তৈরি ছোট একটি ভবন তারা খুঁজে পায়, যেখানে বন্দিদের রাখা হতো।

সবার চোখের সামনে থাকলেও এটি মূলত দৃষ্টির আড়ালে ছিল।

গত আগস্টে ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর গোপন কারাগারে থাকা বন্দিদের ছেড়ে দেয়া হলে মীর আহমদ বিন কাসেমের মতো শত শত ভুক্তভোগীর সঙ্গে তদন্তকারীরা কথা বলেন। এছাড়াও আরও অনেককে অবৈধভাবে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে।

তদন্তকারীরা বলছেন, ঢাকার বিমানবন্দর সড়কের ওপারে থাকা বন্দিশালাসহ এসব গোপন কারাগার চালাতো সন্ত্রাসবিরোধী এলিট বাহিনী – র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব), যারা সরাসরি শেখ হাসিনার নির্দেশে কাজ করত।

‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে গুমের সব ঘটনার অনুমোদন, অনুমতি বা নির্দেশ দিয়েছে,’ বিবিসিকে বলেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম।

শেখ হাসিনার দলের দাবি, তাদের অজ্ঞাতসারে সংঘটিত হওয়ায় এসব ঘটনায় তাদের কোনো দায় নেই, সামরিক বাহিনী এককভাবে এসব করেছে – যদিও সেনাবাহিনী এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

তবে কাসেমসহ অন্যদের বন্দি রাখা ব্যক্তিরা নিরাপত্তা বাহিনীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে এখনও মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফলে মুক্তির সাত মাস পরও তারা আতঙ্কিত।

কাসেম জানান, তিনি কখনোই টুপি ও মাস্ক ছাড়া বাড়ি থেকে বের হন না।

‘বাইরে বের হলে আমাকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়’।

তাকে কোথায় রাখা হয়েছিল তা বিবিসিকে দেখাতে মীর আহমদ বিন কাসেম ধীরে ধীরে কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠেন। একটি ভারী ধাতব দরজা ঠেলে মাথা নিচু করে আরেকটি সরু দরজার ভেতর দিয়ে তিনি "তার" ঘরে ঢুকলেন।

এখানে তাকে আট বছর বন্দি করে রাখা হয়।

"মনে হতো বাইরের জগত থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে," বিবিসিকে বলেন তিনি। ঘরটিতে প্রাকৃতিক আলো ঢোকার কোনো উপায় ছিল না। ভেতরে থাকার সময় তিনি দিন আর রাতের পার্থক্য করতে পারতেন না।

চল্লিশের কোঠায় থাকা আইনজীবী কাসেম এর আগেও কিছু সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তবে এবারই প্রথম তিনি কোনো গণমাধ্যমকে নিয়ে তাকে এত বছর ধরে আটকে রাখা সেই ক্ষুদ্র সেলের ভেতরে গেলেন।

টর্চের আলোয় দেখা যায় ঘরটি এতটাই ছোট যে একজন গড় উচ্চতার মানুষও সেখানে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারবে না। ভেতরটায় একটা স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। কয়েকটা দেয়াল ভাঙা আর মেঝেতে ছড়িয়ে আছে ইট ও কংক্রিটের টুকরো – মনে হয় যেন অভিযুক্তরা তাদের অপরাধের প্রমাণ ধ্বংসের শেষ চেষ্টা করেছে।

‘এটা তো মাত্র একটা ডিটেনশন সেন্টার। সারা দেশে আমরা এমন ৫০০, ৬০০, এমনকি ৭০০-এর বেশি সেল খুঁজে পেয়েছি। এ থেকেই বোঝা যায় যে এটা কতটা ব্যাপক এবং সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা ছিল,’ বলেন প্রসিকিউটর ইসলাম। বিবিসির সঙ্গে তিনিও কারাগার পরিদর্শনে গিয়েছিলেন।

কাসেম তার সেলের হালকা নীল টাইলস স্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন, যা এখন ভেঙে মেঝেতে পড়ে আছে। এগুলোই তদন্তকারীদের এই ঘরটি পর্যন্ত নিয়ে আসে।

নিচতলার সেলগুলোর তুলনায় এটি তুলনামূলক বড় – প্রায় ১০ বাই ১৪ ফুট (৩ মিটার বাই ৪.৩ মিটার)। পাশে একটি নিচু টয়লেটও রয়েছে।

ঘরটির ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে বন্দিজীবনে কাসেম কীভাবে সময় কাটিয়েছেন তার দুঃসহ বর্ণনা দেন।

গ্রীষ্মকালে ঘরটা অসহনীয়ভাবে গরম হয়ে থাকতো। কুঁজো হয়ে মেঝেতে বসে দরজার নিচের ফাঁকের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কিছুটা বাতাস পাওয়ার চেষ্টা করতেন তিনি।

"এটা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল," বলেন তিনি।

এই দুঃসহ জায়গায় ফিরে আসা তার কাছে যেন আবারও সেই শাস্তি অনুভব করা। তবু সেখানে কী ঘটেছিল তা বিশ্বকে দেখানো জরুরি বলেই মনে করেন কাসেম।

‘উচ্চপদস্থ যেসব কর্মকর্তা এই ফ্যাসিবাদী শাসনকে সাহায্য করেছে, উসকেছে, সুবিধা করে দিয়েছে – তারা এখনও ক্ষমতায় আসীন,’ বলেন তিনি।

‘আমাদের গল্প বিশ্বকে জানাতে হবে। যারা আর ফিরে আসেনি, তাদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে, আর যারা বেঁচে আছে তাদের পুনর্বাসনের জন্য আমাদের যা সম্ভব করতে হবে।"

এর আগের বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, তাকে ঢাকার গোয়েন্দা সদরদপ্তরের ভেতরে কুখ্যাত "আয়নাঘরে" আটকে রাখা হয়েছিল। তবে তদন্তকারীরা এখন মনে করেন এমন একাধিক কেন্দ্র ছিল।

বিবিসিকে কাসেম বলেন, প্রথম ১৬ দিন ছাড়া তিনি বন্দিজীবনের পুরোটা সময় র‍্যাবের ঘাঁটিতেই ছিলেন। তদন্তকারীদের ধারণা, প্রথমে তাকে ঢাকার গোয়েন্দা পুলিশের কোনো কার্যালয়ে নেয়া হয়েছিল।

কাসেম বিশ্বাস করেন, তার পরিবারের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণেই তাকে গুম করা হয়।

২০১৬ সালে তিনি তার বাবার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে লড়েছিলেন। তার বাবা ছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় ইসলামপন্থী দল জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতা মীর কাসেম আলী। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সেসময় তার বিচার চলছিল এবং পরে তাকে ফাঁসি দেওয়া হয়।

'ভেবেছিলাম কখনও বের হতে পারব না'
বিবিসির সঙ্গে কথা বলা আরও পাঁচজন একই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন– কীভাবে তাদের চোখ বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং কংক্রিটের অন্ধকার সেলে আটকে রাখা হয়েছিল যেখানে বাইরের জগতের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ ছিল না। অনেকেই বলেছেন, তাদের নির্যাতন ও মারধর করা হতো।

বিবিসি স্বাধীনভাবে তাদের বক্তব্য যাচাই করতে না পারলেও প্রায় সবাই বলেছেন, তারা কোনো দিন রাস্তায় বা বাসে হঠাৎ তাদের নির্যাতকের মুখোমুখি হওয়ার আতঙ্কে ভোগেন।

"এখনও যখন গাড়িতে উঠি বা একা বাড়িতে থাকি, কোথায় ছিলাম তা ভেবেই ভয় লাগে", বলেন ৩৫ বছর বয়সী আতিকুর রহমান রাসেল।

"আমি ভাবি, কীভাবে বেঁচে গেলাম, আদৌ কি আমার বেঁচে থাকার কথা ছিল?"

তিনি বলেন, তার নাক ভেঙে গেছে আর হাতে এখনও ব্যথা। "তারা আমাকে হাতকড়া পরিয়ে প্রচুর মারধর করেছিল।"

রাসেল জানান, গত জুলাইয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলার সময় পুরান ঢাকার একটি মসজিদের বাইরে কিছু লোক তার কাছে আসে। তারা নিজেদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য বলে পরিচয় দিয়ে তাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলে।

পর মুহূর্তেই তাকে ধূসররঙা একটি গাড়িতে তুলে হাতকড়া পরিয়ে মাথা কাপড় দিয়ে ঢেকে চোখ বেঁধে ফেলা হয়। ৪০ মিনিট পর তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে কোনো ভবনের একটি ঘরে রাখা হয়।

"প্রায় আধা ঘণ্টার পরে লোকজন একে একে ঘরে ঢুকতে শুরু করে আর প্রশ্ন করতে থাকে – তুমি কে? কী করো?" এরপরই মারধর শুরু হয়, বলেন তিনি।

"ওই জায়গার ভেতরে থাকা ছিল ভয়াবহ। মনে হচ্ছিল, আমি আর কোনোদিন বের হতে পারব না।"

রাসেল এখন থাকেন তার বোন ও ভগ্নিপতির সঙ্গে। ঢাকার একটি ফ্ল্যাটের ডাইনিং টেবিলে বসে তিনি তার বন্দি অবস্থায় কাটানো কয়েক সপ্তাহের বিশদ বর্ণনা দেন। তবে তার কণ্ঠে তেমন কোনো আবেগ ছিল না, যেন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে তিনি আলাদা করে ফেলেছেন।

তিনিও মনে করেন, তার গ্রেফতার ছিল রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত– কারণ তিনি ছিলেন বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী পার্টি (বিএনপি)-র একজন ছাত্রনেতা, আর তার বাবা ছিলেন দলটির একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য। বিদেশে থাকা তার ভাই নিয়মিত সামাজিক মাধ্যমে শেখ হাসিনার সমালোচনা করতেন।

রাসেল বলেন, তাকে কোথায় রাখা হয়েছিল তা জানার কোনো উপায় ছিল না। তবে চলতি বছরের শুরুর দিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে তিনটি আটক কেন্দ্র পরিদর্শন করতে দেখার পর তার ধারণা, তাকে ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় রাখা হয়েছিল।

তবে আসলেই কতজন নিখোঁজ হয়েছেন সেই সংখ্যা হয়তো কখনও জানা যাবে না।

২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশে গুমের ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে আসা একটি এনজিও অন্তত ৭০৯ জন গুম হওয়া ব্যক্তির তথ্য নথিভুক্ত করেছে। এদের মধ্যে ১৫৫ জন এখনও নিখোঁজ।

গত সেপ্টেম্বর থেকে গঠিত গুম সংক্রান্ত তদন্ত কমিশন ইতিমধ্যে এক হাজার ৬৭৬টির বেশি অভিযোগ পেয়েছে –এছাড়া প্রতিনিয়তই নতুন ভুক্তভোগীরা আসছে।

তবে এটি মোট সংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে না, যা বাস্তবে আরও অনেক বেশি বলে মনে করা হয়।

মীর আহমদ বিন কাসেমের মতো আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম শেখ হাসিনাসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পেরেছেন।

বন্দিদের বিভিন্ন জায়গায় রাখা হলেও তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা আশ্চর্যজনকভাবে একই রকম।

শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মোহাম্মদ আলী আরাফাত এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, কেউ যদি গুম হয়েও থাকে তবে সেটা বর্তমানে ভারতে নির্বাসিত হাসিনা কিংবা তার মন্ত্রিসভার কারও নির্দেশে ঘটেনি।

"এ ধরনের কোনো আটকের ঘটনা যদি ঘটে থাকে, তা সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরীণ জটিলতার কারণে হতে পারে", বলেন আরাফাত।

"তাদের গোপনে বন্দি রেখে আওয়ামী লীগ বা সরকারের কোনো রাজনৈতিক লাভ আমি দেখি না।"

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান মুখপাত্র বলেছেন, "সেনাবাহিনীর এ ধরনের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই।"

"সেনাবাহিনী কোনো ধরনের গোপন আটক কেন্দ্র পরিচালনা করে – এমন অভিযোগ আমরা সরাসরি অস্বীকার করছি", বিবিসিকে বলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুল্লাহ ইবনে জায়েদ।

তাজুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, এসব কারাগারে আটক ব্যক্তিরাই আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততার প্রমাণ।

"যাদের আটক করা হয়েছিল, তারা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ ছিলেন আর তারা কেবল তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল –সেই কারণেই তাদের এখানে নিয়ে আসা হয়।"

এখন পর্যন্ত ১২২টি গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে, কিন্তু কোনো অভিযুক্তকেই এখনও বিচারের মুখোমুখি আনা সম্ভব হয়নি।

এ কারণেই ৭১ বছর বয়সী ইকবাল চৌধুরীর মতো ভুক্তভোগীরা মনে করেন, তারা এখনও নিরাপদ নন। চৌধুরী বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়ার পর কয়েক বছর পর্যন্ত তিনি বাড়ি থেকে বের হননি, এমনকি বাজারেও যাননি। বন্দিদশা নিয়ে মুখ না খুলতে তাকে কঠোরভাবে হুঁশিয়ার করা হয়েছিল।

"যদি তুমি কখনও বলো যে কোথায় ছিলে বা তোমার সঙ্গে কী হয়েছিল আর যদি আবার ধরা পড়ো – তাহলে কেউ তোমাকে আর কোনোদিন খুঁজে পাবে না কিংবা দেখতে পাবে না। তুমি এই পৃথিবী থেকেই মুছে যাবে", এমনটাই তাকে বলা হয়েছিল বলে জানান তিনি।

ভারত ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর অভিযোগের কারণেই তাকে নির্যাতন করা হয় বলে জানান চৌধুরী।

"আমাকে পেটানোর পাশাপাশি ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছে। ইলেকট্রিক শক দেয়ার কারণে আমার একটি আঙুল মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পায়ে আর আগের মতো জোর পাই না – পুরো শরীরেরই শক্তি হারিয়ে ফেলেছি।"

শারীরিক নির্যাতনের কারণে পূর্ণবয়স্ক পুরুষ বন্দিদের চিৎকার, কান্না ও আর্তনাদের আওয়াজ তিনি এখনো স্পষ্টভাবে মনে করতে পারেন।

"আমি এখনও ভয়ে আছি," বলেন চৌধুরী। 

'মৃত্যু পর্যন্ত এই ভয় থাকবে'

২৩ বছর বয়সী রাহমতুল্লাহ এখনও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। "তারা আমার জীবনের দেড় বছর কেড়ে নিয়েছে। সেই সময় কখনই ফিরে আসবে না," বলেন তিনি।

"তারা আমাকে এমন জায়গায় ঘুমাতে বাধ্য করেছিল যেখানে কোনো মানুষের থাকার কথা না।"

২০২৩ সালের ২৯শে আগস্ট মধ্যরাতে র‍্যাব সদস্যরা তাকে তার বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তাদের কেউ ছিল ইউনিফর্মে আর কেউ সাদা পোশাকে। সেসময় তিনি ইলেকট্রিশিয়ানের প্রশিক্ষণ নেবার পাশাপাশি পাশের শহরে রান্নার কাজ করতেন।

একাধিক জিজ্ঞাসাবাদের পর রাহমতুল্লাহ বুঝতে পারেন সামাজিক মাধ্যমে ভারতবিরোধী এবং ইসলামপন্থি কিছু পোস্ট দেয়ার কারণে তাকে আটকে রাখা হয়েছে।

কাগজ-কলম ব্যবহার করে তিনি তার সেলের নকশা এঁকে দেখান। এতে একটি খোলা নর্দমাও ছিল, যেখানে তাকে তার প্রাকৃতিক কাজ সারতে হতো।

"ঢাকার ওই জায়গার কথা ভাবলেও আমার গা শিউরে ওঠে। শোয়ার মতোও জায়গা ছিল না, আমাকে গুটিশুটি হয়ে ঘুমাতে হতো। পা সোজা করে শোয়ার উপায় ছিল না।"

বিবিসি আরও দুজন সাবেক বন্দি মাইকেল চাকমা ও মসরুর আনোয়ার-এর সঙ্গে কথা বলেছে। গোপন বন্দিশালা এবং সেসব জায়গায় কী হতো এ ব্যাপারে তারাও তাদের একই রকম অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন।

কিছু ভুক্তভোগী আজও শারীরিক ক্ষতের সঙ্গে বেঁচে আছেন। কিন্তু সবার কথায় সবচেয়ে বেশি উঠে এসেছে মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতনের ছায়া – যা কখনোই তাদের পিছু ছাড়ে না।

বছরের পর বছর ধরে চলা স্বৈরাচারী শাসনের পর দেশ বিনির্মাণের চেষ্টায় ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। দেশটির গণতান্ত্রিক অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হবে এসব অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সঠিক বিচার পরিচালনা।

তাজুল ইসলাম বিশ্বাস করেন, এটি হতে পারে এবং অবশ্যই ঘটতে হবে।

"আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি থামাতে হবে এবং ভুক্তভোগীদের প্রতি আমাদের ন্যায়বিচার করতে হবে। তারা অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।"

নিজের কংক্রিটের সেলের অবশিষ্টাংশে দাঁড়িয়ে কাসেম বলেন, যত দ্রুত সম্ভব বিচার হওয়া উচিত যাতে দেশ এই অধ্যায়টি শেষ করতে পারে।

তবে রাহমতুল্লাহর জন্য এটি এত সহজ নয়।

"ভয় চলে যায়নি। যতদিন আমি বেঁচে থাকবো, ভয় থাকবে।"

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দুধপত্রীর নারী উদ্যোক্তারা ও ক্ষীণাঙ্গী শালিগঙ্গা
  • বন্দির স্মৃতিতে বাংলাদেশের গোপন কারাগার
  • শেখ হাসিনার মতো এখনও নির্বাচন নিয়ে তালবাহানা শুরু হয়েছে: আব্দুস সালাম
  • নির্বাচনী সংস্কারের পর ইসিকে দল নিবন্ধনের দাবি জানাল এনসিপি
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের প্রশিক্ষণ-কর্মসংস্থান কার্যক্রম শুরু
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ২১জন শহীদ পরিবারকে আর্থিক অনুদান প্রদান
  • অধিকার আদায়ে সড়ক অবরোধের সংস্কৃতি
  • নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অস্পষ্টতা কতটা কাটল
  • বেরোবির জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের মাঝে চেক হস্তান্তর
  • গণঅভ্যুত্থানে হত্যা: ফেনী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর গ্রেপ্তার