সবাইকে সংযত থাকার আহ্বান উপদেষ্টা রিজওয়ানার
Published: 6th, February 2025 GMT
সবাইকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন পরিবেশ, বন, জলবায়ু পরিবর্তন ও পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, আগের দমনমূলক শাসনের সময় যারা নিহত, আহত বা অন্ধ হয়েছেন; তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ। ক্ষতিগুলো মানুষকে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে তোলে, যা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলতে পারে। জাতীয় ঐক্যে ধরে রাখতে হবে।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর একটি হোটেলে নর্ডিক ডে উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার তিনটি প্রধান অগ্রাধিকারকে গুরুত্ব দিচ্ছে— বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন। বিচার প্রতিষ্ঠা সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার, যাতে অতীতের অন্যায়ের জবাবদিহি নিশ্চিত করা যায়। আগের দমনমূলক শাসনের সময় যারা নিহত, আহত বা অন্ধ হয়ে গেছেন, তাদের প্রতি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকার অঙ্গীকারবদ্ধ।
সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, জনগণের মধ্যে তাড়াহুড়ো থাকলেও কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে সুসংগঠিত প্রক্রিয়ার প্রয়োজন। তিনি সতর্ক করে বলেন, প্রক্রিয়া সঠিক না হলে কাঙ্ক্ষিত ফলও ন্যায়সঙ্গত হবে না।
নির্বাচন প্রসঙ্গে উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বলেন, সরকার গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে তিনি বলেন, নির্বাচনই সব সমস্যার সমাধান নয়, কাঠামোগত সংস্কারও জরুরি। রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়া এ সংস্কার কার্যকর হবে না।
তিনি বলেন, সরকারের সংস্কার পরিকল্পনায় খাতভিত্তিক বিশেষজ্ঞদের সম্পৃক্ত করা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ চলছে, এবং তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে আলোচনার নতুন ধাপ শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, গত ৫৩ বছরে আমাদের জনগণ বারবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে। তবে এবারের পরিবর্তন ছিল ব্যতিক্রম—রাজনৈতিক প্রভাব বা বাহ্যিক চাপ ছাড়াই তরুণদের উদ্যোগে এ পরিবর্তন এসেছে।
তিনি বলেন, অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখা, জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা ও আর্থিক খাতের সংকট সামলানো চ্যালেঞ্জিং। সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে একটি দুর্বল ব্যাংকিং ব্যবস্থা পেয়েছে, কিন্তু জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য।
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সামলানো প্রসঙ্গে তিনি জানান, গত ছয় মাসে আমরা ১৮০টি আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে মোকাবিলা করেছি। প্রচলিত পুলিশি কৌশল ব্যবহার না করে ধৈর্য দেখিয়েছি, যা হয়তো একদিন স্বীকৃতি পাবে। আমাদের সামনে আরেকটি সুযোগ নেই। বাংলাদেশ বারবার গণতন্ত্রের জন্য লড়তে পারে না—এবার সঠিক পথেই হাঁটতে হবে। তিনি স্বীকার করেন, সংস্কারের চাপ যেমন আছে, তেমনি দ্রুততম সময়ে অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্বও আমাদের কাঁধে।
উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান নর্ডিক দেশগুলোর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আপনাদের সহায়তা শুধুমাত্র অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য নয়, নাগরিক সমাজের জন্যও অত্যন্ত মূল্যবান। সরকারে যোগদানের আগে যখন আমি একটি বেসরকারি সংস্থা পরিচালনা করতাম, তখনও আপনাদের সমর্থন পেয়েছি।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত কিমো লাহদেভির্তা, ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্স মোলার, নরওয়ের রাষ্ট্রদূত হোকন আরল্ড গুলব্রান্ডসেন এবং সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে কূটনীতিক, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও বিভিন্ন খাতের নীতিনির্ধারকরা উপস্থিত ছিলেন, যারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও পরিবেশ সংরক্ষণকে এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র গণতন ত র ন শ চ ত কর উপদ ষ ট প রসঙ গ র জন য র জওয সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ফিলিস্তিনের জন্য আমরা আরও যা করতে পারি
মানুষের জীবন বাঁচাতে যাওয়া মানুষদেরই হত্যা করেছে ইসরায়েল। এমন মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে খুনের কাজটি তাদের জন্য এবারই প্রথম নয়। কয়েক মাস আগেও হাসপাতালে হামলা চালিয়ে অর্ধ সহস্র মানুষ খুন করে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার মুখে পড়েছিল তারা। সর্বশেষ ১৫ জন চিকিৎসাকর্মীকে খুন করে আবারও মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রমাণ দিল নেতানিয়াহু বাহিনী। এবারও বিশ্বব্যাপী মানুষ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, যার ছোঁয়া বাংলাদেশেও পড়েছে।
বাংলাদেশ বরাবরই ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করে আসছে। সাধারণত জুমার নামাজের পর মুসল্লিদের বিক্ষোভ মিছিল এবং মসজিদে মসজিদে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে দোয়া হয়ে থাকে। সর্বশেষ নৃশংসতায় ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে শিক্ষার্থীরা সোমবার বৈশ্বিক হরতালের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেছে। মজলুম গাজাবাসীর প্রতি সহানুভূতি জানাতে বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনগুলোও মাঠে নেমেছে। এই সহানুভূতি শুধু ধর্মীয় নয়; মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতার কারণেও।
বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই ফিলিস্তিনি মজলুম জনগণের পক্ষে ভূমিকা রেখে এসেছে। ফিলিস্তিন ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ। বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতি আন্তরিক সমর্থনের কারণে আজও ইসরায়েলকে রাষ্ট্র হিসেবে সমর্থন জানায়নি বাংলাদেশ। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর করার প্রয়োজনে ঢাকায় ফিলিস্তিনি দূতাবাসও প্রতিষ্ঠা হয়েছে।
ফিলিস্তিনের শিক্ষা উন্নয়নে বাংলাদেশ শুরু থেকেই সহযোগিতা করছে। সত্তরের দশক থেকে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশের
মেডিকেল টিম সেখানকার যুদ্ধাহতদের চিকিৎসাসেবা দিয়েছে। ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে মানবিক সেবায় এখনও বাংলাদেশ সহযোগিতা করে থাকে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক গাজায় যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষের চিকিৎসাসেবায় বেসরকারি পর্যায়েও বিভিন্ন সহযোগিতার সংবাদ পাওয়া যায়। ১৯৮০-৮২ সালে লেবাননে অবস্থান নিয়ে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা যুদ্ধে শত শত বাংলাদেশি তরুণ অংশ নিয়েছিল বলেও সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়। অনেকে শহীদও হয়েছেন।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের করণীয় কী? স্বাধীনতার লড়াই কেমন– বাঙালি জানে। কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, সেই অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। একাত্তরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বাংলার নবীন-প্রবীণ সব শ্রেণি-পেশার মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। সেই যুদ্ধ ছিল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে। যে যুদ্ধে দুনিয়ার স্বাধীনতাকামী মানুষের সমর্থন ছিল। ফিলিস্তিনের প্রশ্নেও বিশ্ব জনমত গঠনে আমরা ভূমিকা রাখতে পারি।
সোমবার যে বিশ্ব হরতালের প্রতি বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ সংহতি প্রকাশ করেছে, সেটিও বিশ্ববিবেককে নাড়া দেওয়ার প্রয়াস। এই মুহূর্তে আরও অগ্রসর চিন্তা করা উচিত বলে মনে করি। আমাদের জানা আছে, ইসরায়েলের এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মুসলিমবিশ্ব ঐক্যবদ্ধ নয়। কয়েক মাস আগে ইরান যখন ইসরায়েলে ড্রোন হামলা করেছিল, তখন একটি মুসলিম দেশ সেই হামলা প্রতিহত করার কাজে ইসরায়েলের হয়ে কাজ করেছিল। মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশ ইসরায়েলের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে খ্যাত। অথচ এই মুহূর্তে মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর মধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা অপরিহার্য।
ইসরায়েল নির্দিষ্ট কোনো জাতি কিংবা দেশের শত্রু নয়, তারা মানবতার শত্রু– এই বোধটুকু মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে
প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখতে পারে। এ ক্ষেত্রে ওআইসির ভূমিকা প্রশ্নাতীত নয়। বাংলাদেশ মুসলিম দেশগুলোর পাশাপাশি ওআইসিকে কার্যকর ভূমিকা পালনে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। বাংলাদেশ দূতিয়ালির ভূমিকা অবলম্বন করে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যসূত্র প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করতে পারে। সার্ক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বাংলাদেশেরই উদ্যোগে। এই মুহূর্তে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতায় বাংলাদেশ কিছু ইতিবাচক অবদান রাখতে পারলে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে সমাদৃত হবে; বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের আত্মবল বাড়বে এবং জাতি হিসেবে আমরা আরও মর্যাদাশীল
হতে পারব।
যে ধর্মপ্রাণ মুসলমান জনগণ ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতে সোমবার রাস্তায় নেমেছিল, তাদের একাংশ বাংলাদেশের কিছু স্থাপনা ভাঙচুর করেছে। এটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ, সন্দেহ নেই। এমন পরিস্থিতিতে মানুষ আবেগের বশে অনেক কিছুই করে। ভাবতে হবে– এই ভাঙচুরে ইহুদিদের কতটা ক্ষতি হবে; ফিলিস্তিনিদের কতটা উপকার করবে, আর বাংলাদেশেরও ক্ষতি কিংবা লাভ হবে কিনা।
আবেগকে আমাদের ইতিবাচক দিকে প্রবাহিত করতে হবে। এমন উদ্যোগ নেওয়া দরকার, যা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত এবং ইসরায়েলের পরাজয় নিশ্চিত করে। প্রশ্নবিদ্ধ আবেগ নয়, বাস্তবতাকে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়াই সবার জন্য উত্তম।
মোস্তফা হোসেইন: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক
ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক