মানুষ সংগ্রাম চালিয়ে যায়। স্থান-অঞ্চল ছাপিয়ে তা কদাচিৎ সব মানুষের গণ–অভ্যুত্থান হয়ে ওঠে। তখন মানুষ নিজের জীবন পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখে। আশায় বুক বাঁধে। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থান আশাবাদের ঢেউ জাতির মধ্যে জাগিয়ে দিয়েছে। কৃষকেরাও সেই আশায় বুক বেঁধেছেন। কিন্তু তাঁদের কথা বলবে কে? প্রান্ত থেকে তাঁদের দুর্দশার কথা কীভাবে পৌঁছাবে কেন্দ্রে? এই কথাগুলো দাবি করে তোলার জন্য গত ২৬ জানুয়ারি চিলমারীতে ছিল কৃষক মহাসমাবেশ। সেখানে অনেক কথা বলার ছিল সর্বার্থে প্রান্তে বাস করা এই মানুষগুলোর। সেসবের কিছু অগ্রগণ্য চাওয়া তুলে ধরা যাক।

হাট ও ঘাট থেকে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ

গত বছরের ঘটনা। ফিরছিলাম গরুর হাট হয়ে। সেখানে কয়েকজন গরু ক্রেতার কাছ থেকে খাজনার রসিদের ফটো ও ক্রেতার ভিডিও রেকর্ড নিই। দেখে ফেলেন ইজারাদারের লোক। জোর করে ভিডিও ও ফটো মুঠোফোন থেকে মুছে দেন। সেখান থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে ফিরতি একটি গরুবাহী ভটভটির লোকদের সঙ্গে কথা বলি। গরুর পাইকার উলিপুর ধামশ্রেণির ব্যাপারী আবুল কাশেম (৬৫) ও উলিপুর সদরের আমিনুল(৫০)। তাঁরা খাজনার রসিদ দেখান। রসিদে গরুর মূল্য লেখা ৫০ হাজার, কিন্তু খাজনার ঘর ফাঁকা। তাঁরা জানান, বিক্রেতার কাছ থেকে খাজনা নিয়েছেন ৩০০ টাকা এবং তাঁদের কাছ থেকে ৪০০ টাকা।

পরে রসিদের ছবি ফেসবুকে দিলে পোস্টে কড়াই বরিশাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক সাদাকাত হোসেন (৪৫) জানান, ‘উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর হাট জোড়গাছের এখন সুনামের পরিবর্তে দুর্নামে ভরপুর।’ হাসান আল নাহিদ লিখেছেন, ‘এরা সংখ্যায় বেশি, যা জুলুম করে তা-ই মানতে বাধ্য হয়।’

চিলমারী বন্দর থেকে রৌমারী। একটি ৪০ হাত নৌকা। একবারে যাত্রী পারাপার সম্ভব ১৫০ জনের। সোয়া ঘণ্টার পথ। একই শক্তির শ্যালো ইঞ্জিন একটি ভটভটি একই সময়ে চিলমারী বন্দর থেকে কুড়িগ্রাম শহরে যায় ১০ জন যাত্রী নিয়ে। ভাড়া জনপ্রতি ৫০ টাকা। তাহলে ১০ গুণ যাত্রী নিয়ে নৌকা চললে ভাড়া হওয়ার কথা ৫ টাকা। সেখানে ১০০ টাকা ভাড়া কেন? বাড়তি ৯৫ টাকা নৌযাত্রীরা কেন দেবেন?

পাকিস্তান আন্দোলনের ভিত্তি ছিল জমিদারি উচ্ছেদ। কৃষকেরা যে হাটে কৃষিপণ্য কেনাবেচা করেন, সেটা নিয়েও ব্যাপক আন্দোলন ছিল। জমিদারের হাটের খাজনার অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকেরা নিজেরা হাট বসিয়েছেন। নৌপথে খাজনার অত্যাচারে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলার ঘটনা আছে। হাট ও ঘাট থেকে ইজারার নামে জমিদারি প্রথাটি রয়ে গেছে। ফলে সড়কপথের চেয়ে নৌপথে তেল-মবিল খরচ কম লাগলেও সড়কপথের চেয়ে নৌপথে ভাড়া দু–তিন গুণ গুনতে হয়।

কৃষকের সঙ্গে আলোচনা করে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ

ব্রহ্মপুত্রের শাখাহাতী চরের মিলন মিয়া (৪০) তিনি নিয়ে এসেছেন ১০ মণ কাঁচা বাদাম। প্রতি মণ তিন হাজার টাকা দরে বিক্রির আশা থাকলেও তা দুই হাজারের ওপরে দাম বলছেন না ব্যবসায়ীরা। হতাশা নিয়ে তিনি বলেন, আবাদে যা খরচ হয়েছে, তা–ই উঠবে না। লাভ তো দূরের কথা। বাড়ির সবাই মাঠে খেটে ছয় বিঘা জমিতে বাদাম চাষে এবার খরচ হয়েছে ৮০ হাজার টাকার মতো। বাদাম হয়েছে ৩০ মণ। প্রতি মণ গড়ে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করলে আবাদের খরচই ওঠে না। মাঝখানে বন্যায় কিছু খেয়ে গেছে। কামলা খরচ বাদ দিয়ে হিসাব করলেও লস। সব জায়গাতেই কৃষকদের বিপদ।

বাজারে নতুন আলু এখন ১৫ টাকা। অথচ বীজ আলু কৃষকেরা কিনেছেন ২ হাজার টাকা মণ। অর্থাৎ ৫০ টাকা কেজি। সঙ্গে বিষ, বীজ, কামলা খরচ তো আছেই। কৃষকের ঘরে আলু। কোল্ডস্টোরগুলো যেখানে ৫০ কেজির প্রতি বস্তা গত বছর ভাড়া নিয়েছে ৩০০ টাকা। এ বছর ৪০০ টাকা নিচ্ছে। কৃষকের লাভ কে খায়?

শিল্পপণ্যের দাম নির্ধারণ করেন শিল্পপতিরা। এটা সারা দুনিয়াতেই হয়। সেই শিল্পোন্নত দেশগুলোতে কৃষিপণ্যের দামটি নির্ধারণ করেন সেখানকার কৃষকেরা। কিন্তু বাংলাদেশের কৃষকেরা তা পারেন না। কৃষক যে ট্রাক্টর, বীজ কেনেন, তা কোম্পানির নির্ধারিত মূল্যে। আর কৃষক নিজের উৎপাদিত পাট, তুলা, বাদাম, ধানের দামটা নির্ধারণ করতে পারেন না। চাষিদের মতামতের ভিত্তিতে সরকারিভাবে কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করার দাবি কি খুব অপ্রাসঙ্গিক?

রেশম ও এন্ডি পোকার লার্ভা খোলাবাজারে বিক্রির ব্যবস্থা

রেশম উৎপাদনব্যবস্থা একাধারে কৃষি ও কুটির শিল্প—দুটোই। আগে কৃষকেরা অন্যান্য আবাদের সঙ্গে তুঁতগাছের চাষ করতেন। পাতা খাইয়ে রেশম পোকা পালন করতেন নিজের ঘরে। এই পোকা পালনই হলো কুটির শিল্প।

কিন্তু এখন চাইলেই যে কেউ রেশম চাষ করতে পারবে না। যখন রেশম বোর্ড প্রকল্পের নামে বাজেট পাবে, তখন তারা নিবন্ধিত কৃষকদের চারা, লার্ভা ও উৎপাদনের পুরো খরচ দেবে। চারা লাগানোর জন্য দুবারে মোট ২৫ হাজার ও ঘর তোলার জন্য ১ লাখ টাকা দেবে। একজন নিবন্ধিত কৃষকও চাইলে এক বিঘার বেশি আবাদ করতে পারবেন না। একজন কৃষককে মাত্র ১ বিঘা জমির জন্য যতটুকু রেশম পোকার লার্ভা লাগবে, ততটুকুই দেওয়া হবে।

লার্ভা কেন খোলাবাজারে সবার জন্য বিক্রি হয় না। কর্তারা জানিয়েছেন, লার্ভাগুলো ফ্রিজে বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা হয়। আগে যখন ফ্রিজ ছিল না, তখন আমাদের কৃষকেরা রেশম উৎপাদন কেমন করে করতেন? অর্থাৎ সরকারগুলো নিজেই রেশম উৎপাদনকে মুক্ত করে না দিয়ে আটকে রেখেছে।

শুধু ইলিশ নয়, সব মাছের ডিম ছাড়ার মৌসুমে মাছ ধরা

চিলমারীর জেলে আবু বক্কর সিদ্দিক (৫৫) বলেন, ‘ইলিশের ডিম ছাড়ার মৌসুম, মাছ ধরা বন্ধ। লাভ কার? যারা ইলিশ সারা বছর ধরে তাদের। কিন্তু হামরা রুই-কাতলা, বাগাড়.

..হ যে মাছগুলো মারি, সেগুলা তো ডিম পাড়ে ফাল্গুন-চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ মাসে। সেগুলা আবার ডিম ফোটায় নদীর তলার কোলায় গিয়ে। এই মাছগুলা রক্ষার কথা তো আপনারা কন না।’

মানে ফাল্গুন-চৈত্রে নদ-নদী শুকাতে থাকে। তখন চরের মাঝখানে নিচু জলাভূমি তৈরি হয়। এর তিন দিকে চর, আরেক দিক নদীর স্রোতের সঙ্গে যুক্ত। একে বলে কোলা। একেকটা কোলা একেকটা হালদা নদীর মতো মিঠাপানির মাছের আধার। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে যখন নদীর পানি কমতে শুরু করে, তখন পৈরালী (বৈরালী), কালবাউশসহ কয়েক জাতের মাছ কোলাগুলোতে ঢুকে ডিম পাড়ে। একেকটি কোলায় প্রায় ১০০ প্রজাতির মাছ থাকে। এক একর আয়তনের পুকুরে এক বা দুই প্রজাতির মাছ থাকে। একপর্যায়ে প্রভাবশালীরা কোলার ইজারা নিয়ে মুখ বন্ধ করেন। তারপর কেউ বিষ দিয়ে মাছ মারেন। কেউ কাঁথা জাল দিয়ে কোলা সেচে ফেলেন। এতে মাছ ও সব কীটপতঙ্গ ঝাড়ে-বংশে নিপাত হয়।

মাছের এই একক চাষ প্রকৃতিতে ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে। জেলেরা এটা জানেন। তাঁদের জীবনদর্শনও এই যে তাঁরা প্রকৃতিকে খণ্ড খণ্ড করে দেখেন না। তাঁরা জানেন, মাছ যখন আহরণ থেকে চাষে পরিণত হয়, তখন জীবনও বদলে যায়।

চরের ভাঙন রোধে বিন্নার বেষ্টনী

চরগুলোতে কোটি টাকা খরচ করে ভবন নির্মাণ করা হয়। এনজিওরা বাড়ি–ভিটা উঁচু করে। চরের এজমালি জমি দখল করেন চেয়ারম্যানের লোকেরা। কিন্তু চরগুলোকে ভাঙনের হাত থেকে রক্ষার কথা কেউ বলে না।

বাংলাদেশে সচরাচর যেসব বিন্না ঘাস চোখে পড়ে, সেগুলোর শিকড় ছড়িয়ে যায়, সোজা গভীরে যায় না। ফলে এগুলো নদীভাঙন ঠেকাতে অক্ষম। অথচ শিলিগুড়িতে তিস্তার ভাঙন ও পাহাড়ধস ঠেকিয়ে রাখে। কারণ, শিলিগুড়ির বিন্না ঘাস সোজা ২০ ফুট পর্যন্ত গভীরে চলে যায়। ইরি ধান লাগানোর মতো করে চারা রোপণ করা গেলে এক বছরেই ঘন বেষ্টনী তৈরি হয়। পাহাড়ের পার্শ্বঢাল রক্ষায় এই বিন্না ঘাসের জুড়ি নেই। গবেষকেরা জানিয়েছেন, বিন্নার তিনটা শিকড় ১ সুতি লোহার সমান শক্ত। লোহা ক্ষয় হয়, এটা দিনকে দিন মজবুত হয়।

নগরীর টাইগারপাস ও লালখান বাজারের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত বাটালি হিলের মিঠাপাহাড়ের পাদদেশে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে এই ঘাস লাগানোও সফল বলে প্রমাণিত হয়।

এই পাহাড়ি বিন্না ঘাস পাহাড়ের ধস ঠেকাতে পারলে নদীভাঙন তো সহজ। এর বিস্তার করতে পারলে গরু-মহিষের এজমালি গোচারণভূমির কাজও হবে। এতে ভূমিহীনেরা গরু-মহিষ পালন করতে পারবেন। চরাঞ্চলের চতুর্দিকে ৪০–৫০ হাত প্রশস্ত বেষ্টনী প্রাকৃতিক বনের অভাবও পূরণ করবে। চরের নারীদের কুটির শিল্পের মাধ্যমে বাড়তি আয়ের রাস্তা তৈরি হবে। নদ–নদীর বাস্তুসংস্থানও ঠিক থাকবে। পাখপাখালির ঠাঁই হবে। বাহাত্তরের সংবিধান ৩ ধরনের মালিকানার স্বীকৃতি দিয়েছে। রাষ্ট্রীয়, সমবায় ও ব্যক্তি মালিকানা। কিন্তু এগুলোর বাইরে সামাজিক মালিকানা বলে একধরনের মালিকানা আছে। অবাঙালি জাতিগুলোতে এটা চালু আছে। তাদের এই সামাজিক মালিকানার সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকা উচিত।

আরও রয়ে গেল

এ তো গেল কিছু বড় ব্যাপার। এ ছাড়া গরিব মানুষের প্রতিদিনের জীবনযুদ্ধের দিকে কে তাকাবে? চরাঞ্চলে ভুয়া ভূমিহীনদের হাত থেকে খাসজমি দখলমুক্ত করে প্রকৃত ভূমিহীনদের মধ্যে তা বিতরণ; আন্তনগর ট্রেনে কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য তিনটি সুলভ বগি সংযুক্ত করা দরকার। পচনশীল কৃষিপণ্য বহনকারী যানবাহনকে রাস্তায় ও ফেরীতে আগে যেতে দেওয়া; আখ ও বিট চিনির আবাদ বাড়িয়ে সব চিনিকল সংস্কার করে চালু করা চাই। কৃষকের গুড় উৎপাদনের স্বাধীনতাদানে ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের আখমাড়াই আইন এখনো রয়ে গেছে। মহাজনি প্রথা থেকে লবণচাষিদের রক্ষা করতে মিলমালিকদের পক্ষে সরাসরি ক্রয়কেন্দ্র খোলা তো আশু করণীয়।

আইন-আদালত তো এই গরিবদের পক্ষে না। গোবিন্দগঞ্জে দেখেছি, পুলিশ সাঁওতাল কৃষকদের কুঁড়েঘরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। সেই মামলায় উল্টো কৃষকেরা কোর্টের বারান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়িরও একই ঘটনা। গত বছর করোনার সময় চিলমারীর একজন কৃষককে ১০ হাজার টাকা ঋণের কারণে ২৫ বছর পর মধুপুর এলাকা থেকে পুলিশ ধরে এনে জেলে ঢুকিয়েছে। হাজার হাজার কৃষক অনাদায়ি কৃষিঋণের দায়ে এলাকাছাড়া। সেই ঋণ আদায়ে মামলা ও গ্রেপ্তারের আইন বাতিল করে সব ধরনের ক্ষুদ্র কৃষিঋণ মওকুফ করা উচিত।

সহস্র জনতার প্রাণের বিনিময়ে সংগঠিত গণ–অভ্যুত্থানের পর এই দাবিগুলো কি খুব বেশি চাওয়া?

নাহিদ হাসান আহ্বায়ক, কৃষক মহাসমাবেশ বাস্তবায়ন গণকমিটি

[email protected]

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: খ জন র র জন য উৎপ দ ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

ইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে

ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও সিভিল ডিফেন্সের ১৫ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা যোদ্ধা ছিলেন না। সন্ত্রাসীও ছিলেন না। তাঁদের কাছে কোনো রকেট বা অস্ত্র ছিল না। তাঁরা ছিলেন ত্রাণকর্মী, মানবতার সেবক। যখন যেখানে বোমা ফেলা হচ্ছিল, সেখানেই তাঁরা আহতদের সাহায্য করতে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।

এর আগে গত ২৩ মার্চ গাজার দক্ষিণে রাফা এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনী একটি অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবার গাড়ির বহরকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এতে আটজন রেড ক্রিসেন্টের কর্মী, ছয়জন ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের কর্মী এবং একজন জাতিসংঘের কর্মী নিহত হন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছিল, এই গাড়িগুলো ছিল অপরিচিত। সন্দেহ করা হয়েছিল, গাড়ির মধ্যে যোদ্ধারা ছিলেন, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল।

রিফাত রাদওয়ান নামে নিহত চিকিৎসাকর্মীদের একজনের মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া ফুটেজে দেখা যায়, গাড়িগুলোতে স্পষ্টভাবে লালবাতি জ্বলছিল; সেগুলো চিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্স ছিল এবং কোথাও কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি। তারপর শুরু হয় ইসরায়েলি বাহিনীর প্রচণ্ড গুলি।

পরে রিফাতের মরদেহ আরও ১৩ জনের সঙ্গে একটি গণকবরে পাওয়া যায়। তাঁদের কয়েকজনের দেহে সরাসরি হত্যার চিহ্ন ছিল—মাথা বা বুকে গুলি লেগেছিল। কারও কারও হাত বাঁধা অবস্থায় ছিলেন।

মৃত্যুর পরও তাঁদের প্রমাণ দিতে হলো যে তাঁরা ত্রাণকর্মী ছিলেন।

তারপরও পশ্চিমা গণমাধ্যমের বড় অংশ প্রথমেই ইসরায়েলের কথাই প্রচার করল, ‘ইসরায়েল বলছে…’, ‘আইডিএফ দাবি করছে…’, ‘একজন সামরিক সূত্র জানিয়েছে…।’ এসব কৌশলে সাজানো বাক্য যেন রেড ক্রিসেন্টের রক্তমাখা ইউনিফর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। যেন তারা সত্যের চেয়ে বেশি ‘সত্য’।

এটা নতুন কিছু নয়। এটা একবারের ভুলও নয়।
এটাই একটা সিস্টেম।

এখানে ফিলিস্তিনিদের শুধু বেঁচে থাকাই অপরাধের মতো মনে করা হয়। আমাদের অস্তিত্বকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়—প্রথমে সবাইকে বোঝাতে হয় যে আমরা কোনো হুমকি নই, আমাদের জীবনও মূল্যবান, তারপর হয়তো কেউ আমাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। এটাই হচ্ছে মানবতা হারানোর আসল রূপ।

আমি গাজায় জন্মেছি, সেখানেই বড় হয়েছি। আমি জানি, রেড ক্রিসেন্টের ইউনিফর্মের অর্থ কী। এর মানে হলো, সব শেষ হয়ে গেলেও আশার একটা আলো আছে। এর মানে হলো, কেউ আসছে সাহায্য করতে—লড়াই করতে বা হত্যা করতে নয়, জীবন বাঁচাতে। এর মানে হলো, ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও কারও কাছে জীবন এখনো মূল্যবান।

বিশ্বকে এখনই ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে যে তাঁরা মানুষ। আমরা মিথ্যা বলি আর আমাদের হত্যাকারীরা সত্য বলে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেরেশতা, শুধু তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করা যাবে, এই ভাষ্যকে আর প্রচার করতে দেওয়া যাবে না।

আমি এটাও জানি, সেই আশাকে হারালে কেমন লাগে। সেখানে চিকিৎসাকর্মীদের প্রথমে হত্যা করা হয়, তারপর তাঁদের সম্মান নষ্ট করা হয়। তাঁদের সততা নিয়ে বিতর্ক তোলা হয় আর তাঁদের সহকর্মীরা গণকবর খুঁড়ে মরদেহ উদ্ধার করেন। তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তারপর ভুলে যাওয়া হয়।

মানবতা হারানো শুধু কথার কথা নয়, এটা শুধু গণমাধ্যমের কাঠামো বা রাজনৈতিক ভাষার সমস্যা নয়। এটা হত্যা করে। মুছে ফেলে। এটা পুরো জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরও বিশ্বকে চোখ ফিরিয়ে নিতে বলে। এটা আমাদের বলে দেয়: তোমার জীবন ততটা মূল্যবান নয়; তোমার শোক সত্যি কি না, তা আমরা যাচাই না করা পর্যন্ত শোক বলে বিবেচিত হতে পারে না; তোমার মৃত্যু দুঃখজনক কি না, তা আমাদের ছাড়পত্রের ওপর নির্ভরশীল।

এ কারণেই এই ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকর্মীর মৃত্যু এত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের গল্প নয়। এটি সেই অবিশ্বাসের প্রক্রিয়ার গল্প, যা প্রতিবার ফিলিস্তিনিরা নিহত হলে উঠে আসে। এটি সেই বাস্তবতা, যেখানে আমাদের নিজেদেরই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হতে হয়, নিজেদের আইনি লড়াই চালাতে হয়, নিজেদের প্রচারের কাজ করতে হয় এবং সবকিছুর সঙ্গে মরদেহের জন্য শোকও করতে হয়।

এই বোঝা আর কাউকে বইতে হয় না। যখন কোনো পশ্চিমা সাংবাদিক নিহত হন, তাঁদের সম্মান জানানো হয়। যখন কোনো ইসরায়েলি নাগরিক মারা যান, তখন তাঁদের নাম আর ছবি বিশ্বজুড়ে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। কিন্তু যখন কোনো ফিলিস্তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবারের প্রথম কাজ হয় প্রমাণ করা, যে তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন না।
আমাদের সব সময় দোষী ধরে নেওয়া হয়, যতক্ষণ না নির্দোষ প্রমাণিত হই। অনেক সময় সেটা প্রমাণ করাও সম্ভব হয় না।

অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইসরায়েলের কথা বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কথা গুরুত্ব দেওয়া হয় কম। ইসরায়েল যদি কোনো দাবি করে, তা যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করা হয়; কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কিছু বললে তা সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তাঁদের দুঃখ-কষ্ট, কান্না বা শোক তাঁদের কথাকে অবিশ্বাস্য বা অতিরঞ্জিত করে তোলে; অর্থাৎ ফিলিস্তিনিরা যা বলছেন, তা সত্য হলেও তাঁদের যন্ত্রণা দেখিয়ে তাঁরা বেশি বলছেন বা বাড়িয়ে বলছেন—এমন ধারণা তৈরি করা হয়।

এই গণমাধ্যমের ধারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকেও প্রভাবিত করে—অস্ত্র বিক্রি থেকে শুরু করে কূটনৈতিক দায়মুক্তি, আন্তর্জাতিক মঞ্চে নীরবতা থেকে জাতিসংঘে ভেটো দেওয়া পর্যন্ত। সবকিছু একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি মানুষ বলে যেহেতু গণ্য করা হয় না, সেহেতু তাদের হত্যাকারীদেরও পুরোপুরি দায়ী করা হয় না।

এর মানসিক চাপও ভয়াবহ। আমরা শুধু শোক করি না; আমাদের শোকের স্বীকৃতির জন্যও লড়তে হয়। আমরা শুধু আমাদের মৃত ব্যক্তিদের দাফন করি না; তাঁদের মৃত্যু স্বীকার করানোর জন্যও সংগ্রাম করি। আমরা এমন এক মানসিক চাপে বাস করি, যা কোনো সম্প্রদায়ের সহ্য করা উচিত নয়। আমাদের প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হয় যে আমরা তা নই, যা বিশ্ব আমাদের ভেবে নিয়েছে।

এই ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকর্মী ছিলেন সত্যিকারের নায়ক। তাঁরা বিপদের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের জনগণের সেবা করেছিলেন। তাঁরা জীবনের পবিত্রতায় বিশ্বাস করতেন। তাঁদের স্মৃতি সম্মানের যোগ্য। অথচ তাঁদের গল্পও একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্বকে এখনই ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে যে তাঁরা মানুষ। আমরা মিথ্যা বলি আর আমাদের হত্যাকারীরা সত্য বলে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেরেশতা, শুধু তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করা যাবে, এই ভাষ্যকে আর প্রচার করতে দেওয়া যাবে না।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আহমেদ নাজার একজন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাট্যকার।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • নড়াইলে হত্যা মামলায় একজনের যাবজ্জীবন
  • রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ইয়াংওয়ানের চেয়ারম্যান কিহাক সাংকে
  • দিনাজপুরের বনতাড়া গ্রামে ৭ দিন আতঙ্কের পর এল সম্প্রীতির বার্তা
  • নেত্রকোনায় কৃষক আনোয়ারুল হত্যা মামলায় একজনের মৃত্যুদণ্ড
  • ‘ও খোদা, এই ট্রাক দি আঁই কিরমু’
  • চলন্ত ট্রাকের চাকা বিস্ফোরণের পর রিংয়ের আঘাতে বিচ্ছিন্ন হলো পথচারীর পা
  • মধ্যপ্রাচ্যে নিষিদ্ধ ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’, মুখ খুললেন জন আব্রাহাম
  • ‘গায়ে আগুন লাগার পর তা নেভাতে আমি পশুর মতো এদিক-ওদিক ছুটছিলাম’
  • ‘মাইগ্রেন’ কি ভয়াবহ কোনো রোগ?
  • ইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে