গণঅভ্যুত্থানের ছয় মাস পূর্তি ছিল গতকাল বুধবার। নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের ঘোষণা দেওয়ার কথা ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা বুধবার রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। পরে ক্রেন, এক্সকাভেটর ও বুলডোজার দিয়ে বাড়িটি ভাঙা শুরু হয়। পরে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিচিহ্ন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ভেঙে ফেলা শুরু হয় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি। গতকাল থেকে আজ বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত সারা দেশে কী কী ঘটল, তা একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ঘটনার শুরু যেভাবে
গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে কর্মসূচি দেয় আওয়ামী লীগ। এ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নানা কর্মসূচি দেন। গতকাল বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) লিফলেট বা প্রচারপত্র বিলি করার কর্মসূচি ছিল। এদিন ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের কথা ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে ফেসবুকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর অভিমুখে ‘বুলডোজার মিছিল’ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। পাশাপাশি ঘোষণা করা হয় ‘মার্চ টু ধানমন্ডি ৩২’ কর্মসূচি।
এদিন বিকেলে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দেন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য শরিফ ওসমান হাদি। রাত ৯টায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে যাওয়ার কথা থাকলেও পরে কর্মসূচি বদলে রাত ৮টায় নিয়ে আসা হয়।
এদিকে হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘হাসিনাকে বক্তব্য প্রকাশের সুযোগ দেওয়াকে বাংলাদেশের ফ্যাসিবাদবিরোধী জনগণের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ হিসেবে দেখি।’
গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ি
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে জড়ো হন বিক্ষোভকারীরা। স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ও আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন তারা। এক পর্যায়ে গেট ভেঙে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে ঢুকে পড়েন ছাত্র-জনতা। এ সময় শাবল, হাতুড়ি ও রড দিয়ে বাড়ির দেয়ালসহ বিভিন্ন জায়গায় আঘাত করা শুরু হয়। লাঠিসোটা ও শাবল হাতে ভাঙচুরে যোগ দেন অনেকে। কেউ খুলে নিয়ে যান জানালা, কেউ আবার স্মৃতি হিসেবে খুলে নিয়ে যান ইট।
ভবনটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য রাত পৌনে ১১টার দিকে সেখানে বড় একটি ক্রেন আনা হয়। কিন্তু ক্রেন দিয়ে পিলার ভাঙা সম্ভব না হওয়ায় আনা হয় ভেকু। ক্রেন সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। পরে বুলডোজার ও ভেকু দিয়ে ভাঙতে থাকে ভবনের পিলার। রাত সাড়ে ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধু ভবনের একটি অংশ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। সারা রাত ধরে ভাঙা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িটি।
সুধা সদন ভাঙচুর ও আগুন
রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার ৫ নম্বর সড়কে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে আগুন দিয়েছেন ছাত্র-জনতা। গতকাল রাত পৌনে ১১টার দিকে বিক্ষুব্ধরা ভাঙচুর চালান। পরে আগুন লাগিয়ে দেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাকিবুল ইসলাম বলেন, সুধা সদনে ভাঙচুরের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়ার চেষ্টা করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। কিন্তু জনতার বাধার মুখে তারা ফিরে গেছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সুধা সদন পুরোপুরি খালি ছিল। ‘সুধা সদন’ বাড়িটির নাম ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রয়াত স্বামী প্রখ্যাত পরমাণু বিজ্ঞানী ড.
সারা দেশে কোথায় কী করা হলো
খুলনায় বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়েছে আলোচিত শেখবাড়ি। এ সময় বাড়িটির সামনে বিক্ষোভ করেন ছাত্র-জনতা। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা নগরীর শেরেবাংলা রোডের বাড়িটির সামনে জড়ো হন। পরে রাত সোয়া ৯টার দিকে বুলডোজার এনে বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হয়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ও আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে।
সিলেটে এবার বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ম্যুরাল। গতকাল রাতে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে স্থাপিত ম্যুরালটির অবশিষ্ট অংশ বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাতে মুসলিম জনতার ব্যানারে ম্যুরালটিতে ভাঙচুর চালানো হয়েছিল।
ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার বক্তৃতা প্রচারকে কেন্দ্র করে গতকাল রাতে চট্টগ্রামে মশাল মিছিল ও বিক্ষোভ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা। পরে তারা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে গিয়ে পুরোনো একাডেমিক ভবনের সামনে থাকা বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুর করেন। পরে সেখান থেকে তারা জামালখান মোড়ের দেয়ালে থাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর করেন। এর আগে বিক্ষুব্ধরা একটি মশাল মিছিল বের করেন।
কুষ্টিয়ায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুবউল-আলম হানিফের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছে একটি দল। গতকাল রাত ১০টার দিকে এক্সক্যাভেটর নিয়ে তারা বাড়ির সামনের কিছু অংশ ভেঙে ফেলে। প্রায় আধা ঘণ্টা পর দলটি চলে যায়। স্থানীয়রা জানান, গত ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর ওই বাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়েছিল।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ পরিবারের সদস্য ও জাতীয় চার নেতার একজনের নামে থাকা সব স্থাপনার নামফলক, গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখন মুছে দিতে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। গতকাল রাত ৯টার দিকে বিক্ষোভ শেষে মিছিল নিয়ে চারটি আবাসিক হল ও একটি স্কুলের নামফলক ভেঙে নতুন নাম দেন। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের নাম পরিবর্তন করে ‘বিজয়-২৪ হল’, নির্মাণাধীন শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হলের পরিবর্তে ‘শহীদ আলী রায়হান হল’, শেখ হাসিনা হলের পরিবর্তে ‘ফাতিমা আল-ফাহরিয়া হল’ এবং বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা হলের পরিবর্তে ‘নবাব ফয়জুন নেসা চৌধুরানী’ ও শেখ রাসেল মডেল স্কুলের নাম পরিবর্তন করে ‘রিয়া গোপ মডেল স্কুল’ নাম দিয়ে ব্যানার ঝুলিয়ে দেন।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) প্রধান ফটকে শেখ হাসিনার ঘৃণাসূচক ছবি টানিয়ে গণজুতা নিক্ষেপ কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। গতকাল রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উদ্যোগে এ কর্মসূচি পালিত হয়। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার প্রতিকৃতিতে জুতা নিক্ষেপ করে তাঁর ফেসবুক লাইভে আসার প্রতিবাদ জানান।
ফেসবুকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য দেওয়ার প্রতিবাদে কুমিল্লায় তাৎক্ষণিক মিছিল ও সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। গতকাল রাতে নগরীর কান্দিরপাড়ে মিছিল করেন ছাত্ররা। ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, খুনি হাসিনার ফাঁসি চাই’, ‘রশি লাগলে রশি নে, হাসিনারে ফাঁসি দে’, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাহিরে’, ‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’ ইত্যাদি স্লোগান দেন তারা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: শ খ ম জ ব র রহম ন র ছ ত র জনত গতক ল র ত ধ নমন ড ফ সব ক র স মন আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ইতিহাসের অনন্য ঘটনা: নাহিদ
সানবিডি২৪ এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি ফলো করুনডাক, টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা। গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর বাংলা একাডেমি ভবনে কবি শামসুর রাহমান সেমিনারকক্ষে প্রকাশনা সংস্থা ‘আদর্শ’-এর আয়োজনে আহম্মদ ফয়েজের লেখা ‘সংবাদপত্রে জুলাই অভ্যুত্থান’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন উপদেষ্টা।
নাহিদ বলেন, ‘সংবাদপত্রে জুলাই অভ্যুত্থান’ গ্রন্থটি ২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানের একটি প্রামাণ্য দলিল। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সংবাদপত্রের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে কোনো কোনো পত্রিকা অভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে, যা দুঃখজনক।
উপদেষ্টা প্রকাশক ও প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, বইটিতে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে গণমাধ্যমের ভূমিকা মূল্যায়ন করা হয়েছে।
এসময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানকে কেউ তুলে ধরেছেন ছবির মাধ্যমে, আবার কেউ তুলে ধরেছেন গ্রাফিতি ও ভিডিওর মাধ্যমে। জাতীয় দৈনিকগুলোও ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানকে তুলে ধরেছেন স্বমহিমায়। ২৫টি জাতীয় দৈনিক থেকে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান নিয়ে সংকলিত ‘সংবাদপত্রে জুলাই অভ্যুত্থান’ গ্রন্থের মাধ্যমে মুক্তিকামী মানুষের লড়াই সংগ্রামের অবদান অম্লান হয়ে থাকবে।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন প্রকাশনা সংস্থা ‘আদর্শ’-এর প্রকাশক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাহাবুব রাহমান, গ্রন্থের লেখক আহম্মদ ফয়েজ এবং কবি ও সাংবাদিক সালাউদ্দিন শুভ।
বিএইচ