অন্তর্বর্তী সরকারের রাষ্ট্র সংস্কারের অনেকগুলো উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম আলোচিত ও প্রতীক্ষিত ছিল দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার প্রতিবেদন। বিগত সময়ে দুর্নীতির ব্যাপকতা এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুর্নীতি দমনে চরম ব্যর্থতার জন্য এটি একটি অবশ্যপ্রয়োজনীয় বিষয় ছিল। ক্ষেত্রবিশেষে সরকার স্বপ্রণোদিতভাবে দুর্নীতিবাজদের রক্ষা করেছে বলেও অভিযোগ পাওয়া যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ড.

ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি সংস্কার কমিশন গঠিত হয় এবং কমিশন দুর্নীতি প্রতিরোধে ৪৭টির মতো সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছে।

কিছু সংস্কার প্রস্তাবে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য জোর দেওয়া হয়েছে। আবার কিছু প্রস্তাবে দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য জোর দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের জন্য স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলা হয়েছে। এই সংস্কার প্রতিবেদনে যেমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাব এসেছে, ঠিক তেমনি কিছু প্রস্তাব বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য, সেটা নিয়ে দেখা দিয়েছে নানা প্রশ্ন!

যে বিষয়গুলো প্রশংসার যোগ্য

এই সংস্কার প্রতিবেদনে সবার আগে যে বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, তা হলো প্রাতিষ্ঠানিক স্বাধীনতাকে শক্তিশালীকরণ। যেমন প্রস্তাবিত সংস্কারের পরিকল্পনাগুলো দুদককে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাবমুক্ত করার জন্য উল্লেখযোগ্য প্রস্তাব দিয়েছে। দুদক যেন স্বাধীনভাবে তদন্ত ও বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে, সে জন্য উপযুক্ত নীতি তৈরি ও তার বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে।

আদালত ও দার্শনিক সংস্থার মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে শক্তিশালী বিধি প্রণয়নের পরিকল্পনা করেছে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণে উন্মুক্তভাবে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ ও সরকারের কার্যক্রমে নাগরিকদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্বচ্ছতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছে।

এ ছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অন্যান্য সংস্থার সমন্বয় বৃদ্ধির জন্য তথ্য শেয়ারের সুপারিশ করেছে। সমন্বয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতিবেদনে জেলা পর্যায়ে অফিস স্থাপন, টাস্কফোর্স গঠন ও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তদন্তকারী দল গঠনের প্রস্তাব সত্যিই প্রশংসনীয়।

তা ছাড়া দক্ষ জনবল নিয়োগের মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। কর্মীদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ একাডেমি তৈরির সুপারিশ আসলেই সময়োপযোগী একটি উদ্যোগ হবে বলে মনে করি। তদন্ত–মামলা পরিচালনা করতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে এসব সংস্কার প্রস্তাব জাতিসংঘের দুর্নীতি দমন কনভেনশনের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ, যা ভবিষ্যতে ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপের বা ওজিপি (দুর্নীতি প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশের সরকার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বহুপক্ষীয় সংস্থা) অংশীদারত্ব বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশকে সহায়তা করবে।

বাংলাদেশ যদি ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপে স্বাক্ষর করতে পারে, তাহলে দুর্নীতি দমনে বাংলাদেশের জন্য এটি হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ওপেন গভর্নমেন্ট পার্টনারশিপে স্বাক্ষর করলে স্বাক্ষরিত দেশগুলোকে তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপে পুরোপুরি স্বচ্ছতা আনতে হয়, তা নিশ্চিত করতে হয় এবং এর মাধ্যমে মূলত প্রতিষ্ঠানগুলোয় কাঠামোগত অনেক পরিবর্তন হয়, যা দুর্নীতি প্রতিরোধে সহায়ক ভূমিকা হিসেবে পালন করে। আমি মনে করি, কমিশনের সুপারিশে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি যে পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে পারলে বাংলাদেশের দুর্নীতি দমনের নতুন এক অধ্যায় সূচনা হবে।

প্রতিবেদনে দুর্বলতা ও বাস্তবায়নে জটিলতা

জটিলতা হিসেবে প্রথমেই উপস্থিত হতে পারে আইনি পরিবর্তনের বিষয়গুলো। অনেকগুলো সংস্কার করার জন্য আইনের বড় ধরনের পরিবর্তনের প্রয়োজন হবে। যেমন সংবিধানের ৩২(ক) ধারার মতো আইন সংশোধন করতে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পর্যায়ে বাধার মুখোমুখি হতে হবে। এ ছাড়া নতুন আদালত গঠন, ‘প্লি বার্গেইনিং’ (এমন একটি আইনি প্রক্রিয়া, যেখানে বিচার এড়াতে অভিযুক্ত ব্যক্তি লঘু অপরাধে দোষ স্বীকার করেন)–এর মতো আইন তৈরি হতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে, যা হয়তোবা পাঁচ বছর মেয়াদে তৈরি ও বাস্তবায়ন করা সম্ভব না–ও হতে পারে।

প্লি বার্গেইনিং ও বিশেষ আদালত গঠন করার নতুন ধারাগুলো বিচার বিভাগের কাছ থেকে বাধার সম্মুখীন হতে পারে। অনেক রিটের মাধ্যমে মামলায় জট ও বিচারপ্রক্রিয়াকে ধীরগতির করে সংস্কারকে দীর্ঘায়িত করতে পারে। দ্বিতীয় সমস্যাটি হচ্ছে আর্থিক জোগান। জেলা পর্যায়ে অফিস স্থাপন, যোগাযোগ তৈরি ও নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য যোগ্য বাজেটের প্রয়োজন।

এ ছাড়া কর্মীদের জন্য পারফরম্যান্স বোনাসসহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধার যে অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হবে, সরকারের বা দুদকের পক্ষে জোগান দেওয়া অনেকটা দুষ্কর হতে পারে। এনবিআর বা সিআইডির সঙ্গে সমন্বয় করতে গেলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোরও ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। কেননা, ক্ষেত্রবিশেষে দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগ, তখন তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার একটি জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে। অতীতেও দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠান একে অপরকে তথ্য প্রদান করতে অনীহা করেছে।

দুদকের ক্ষেত্রে আরেকটি বড় ভাবনার বিষয় ছিল বা আছে, তা হচ্ছে দুদকের অভ্যন্তরে থাকা দুর্নীতির ঝুঁকি ও অদক্ষতা সংস্কার কার্যক্রমকে সব সময় বাধাগ্রস্ত করবে। এ ক্ষেত্রে যারা পুরোনো ব্যবস্থার সুবিধাভোগী, তারা নতুন পরিবর্তনের বিরোধিতা করতে পারে। তাই দুদকের কর্মীদের মধ্যেও সংস্কারবিরোধী মনোভাব দেখা দিতে পারে। একই সঙ্গে আমলাতন্ত্র ও রাজনৈতিক মহল সংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

কেননা, বাংলাদেশের অধিকাংশ বড় বড় দুর্নীতির ক্ষেত্রে আমলা, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদেরা একই সঙ্গে ত্রিভুজ জোটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করেছে। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের পাশ কাটিয়ে এ ধরনের আমূল পরিবর্তন কতটা সম্ভব হবে, তা–ও ভাবার বিষয়!

তাহলে উপায় কী

বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে একটি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ প্রয়োজন, যেমনটি ‘জাকার্তা ডিক্লারেশন’ বা ‘জাকার্তা প্ল্যান অব অ্যাকশন’, যা ১৯৯৮ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেট ব্যাংকের দুর্নীতি প্রতিরোধ ফোরামে ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় গৃহীত হয়েছিল। এ ঘোষণা ১৬টি বিস্তৃত পদক্ষেপের মাধ্যমে দুর্নীতি দমনের জন্য একটি পথনির্দেশনা প্রদান করেছিল, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি বিষয় সংস্কার কমিটি দ্বারা উল্লেখিত হয়েছে। তবে এসব পদক্ষেপের মধ্যে ধারাবাহিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তাহলে বাংলাদেশে দুদকসহ অন্য সব ধরনের দুর্নীতি প্রতিরোধমূলক সংস্কারের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য অত্যন্ত জরুরি। কারণ, রাজনৈতিক ইচ্ছা যদি না থাকে, তবে কোনো প্রস্তাবই বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রথমেই যে কাজ করা উচিত, তা হলো সর্বজনসমর্থিত ও যোগ্য ব্যক্তিদের সুপারিশের মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান করা এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করা। এর মাধ্যমে দুদক জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরে পেতে পারে। কারণ, বর্তমানে দুদকের প্রতি জনগণের আস্থা অনেক কমে গেছে, প্রায় শূন্যের কোঠায়।

এ ছাড়া দরকার স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়া ও কিছু চৌকস কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি করা। যখনই দুদক কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেবে, তখন জনগণের মধ্যে একটি সামাজিক চাপ তৈরি হবে, যা ওই পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়নকে ত্বরান্বিত করবে। ফলস্বরূপ প্রতিবেদনে উল্লেখিত বিষয়গুলো একে একে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। এভাবে রাজনৈতিক সহমত ও কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে দুর্নীতি দমন ও শাসনব্যবস্থার সংস্কার সম্ভব।

নুরুল হুদা সাকিব অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র র জন য র জন ত ক ধ র জন য পদক ষ প পর য য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

রাজশাহীতে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ারের বাড়িতে আগুন

রাজশাহীর বাঘায় সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের গ্রামের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে উপজেলার আড়ানী পৌর এলাকার চকসিংগা মহল্লায় অবস্থিত বাড়িতে আগুন লাগানো হয়। এ ছাড়া উপজেলার মণিগ্রাম ইউনিয়নের সাফারি গ্রামে শাহরিয়ার আলমের ট্রেনিং সেন্টারে অগ্নিসংযোগ করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ৫০ থেকে ৬০টি মোটরসাইকেলে প্রায় দেড় শ লোক এসে বাড়িতে হামলা চালায়। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক জসিম উদ্দিন এ সময় পালিয়ে যান। স্থানীয় লোকজন এসে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাঁরা হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আপনারা চলে যান, তা ছাড়া আপনাদের অসুবিধা হবে।’ এরপর তারা বাড়িতে হামলা চালিয়ে দরজা-জানলা ভাঙচুর করে কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। তারপর পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়ে চলে যায় তারা।

এই বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে বাঘা ফায়ার সার্ভিস স্টেশন হলেও তারা প্রথমে আগুন নেভাতে আসতে পারেনি। স্থানীয় লোকজন বলেন, ফায়ার সার্ভিসের লোকজন আগুন নেভানোর জন্য আসার প্রস্তুতি নিলে হামলাকারীরা তাঁদের বাধা দেয়। এ জন্য তাঁরা সময়মতো আগুন নেভাতে আসতে পারেননি। ততক্ষণে আগুন চারতলা বাড়ির তিন তালায় উঠে যায়।

আগুন লাগানোর প্রায় আধা ঘণ্টা পর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা গিয়ে আগুন নেভাতে শুরু করেন। প্রায় একই সময়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে চলে আসে। তখন দেখা যায়, বাড়ির চারটি এসি পুড়ে গেছে। বাড়ির ২২টি ফ্যান আগুনে পুড়ে বাঁকা হয়ে গেছে। একটি ফ্যান খুলে নিচে পড়ে গেছে। দুটি জেনারেটরসহ বাড়ির আসবাবপত্র আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের বাঘা স্টেশন অফিসার মিজানুর রহমান বলেন, বেলা একটার মধ্যে তারা আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এনেছেন।

বাঘা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এফ এম আছাদুজ্জামান বলেন, সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের বাসার আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এবং পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ