বাবা-ছেলের আশ্চর্য বিদায়ের ঘটনা
Published: 6th, February 2025 GMT
হজরত ওমর (রা.)-এর খিলাফতকালীন একটি বছরকে বলা হতো ‘আম উর রামাদা’ বা ‘ছাইয়ের বছর’। সেটি ছিল হিজরির অষ্টাদশ বছর। অর্থাৎ মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের সাত বছর পর।
সে বছর সিরিয়া ও তার আশপাশের অঞ্চলে প্লেগের সংক্রমণ শুরু হয়। প্লেগে আক্রান্ত হয়ে অনেক খ্যাতনামা সাহাবি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন হজরত উবায়দা (রা.
মৃত্যুর সময় মুয়াজ (রা.)-এর বয়স হয়েছিল মাত্র ৩৩ বছর। জীবিত অবস্থায় তিনি ছিলেন আরবের মুফতি। তিনি ওহি লেখকের দায়িত্বও পালন করেছেন। মহানবী (সা.) নিজেই তাঁকে বলেছিলেন, ‘হে মুয়াজ, আমি তোমাকে খুবই ভালোবাসি।’
আরও পড়ুনআত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা যায় না৩০ নভেম্বর ২০২৩প্লেগ সংক্রমণের সময় মুয়াজ (রা.) ফিলিস্তিনে ছিলেন। সেখানেই তিনি আক্রান্ত হন। প্লেগে আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি বলছিলেন, ‘এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত, এটা হলো নবী (সা.)-এর দোয়ার ফসল। আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রিয় বান্দাদের এভাবেই উঠিয়ে নেন। যাঁরা প্লেগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তাঁরা শহীদ।’
মহানবী (সা.) একবার দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, আপনি মুয়াজ ও তাঁর পরিবারকে আপনার রহমতের সবচেয়ে বড় অংশটি দান করুন।’ মুয়াজ (রা.) ঠিকই বুঝেছিলেন, আল্লাহর রহমতের সবচেয়ে বড় অংশ তাঁরাই পাবেন, যাঁরা দুনিয়াতে কষ্টের ভেতর থাকেন।
কিছুদিনের মধ্যেই মুয়াজ (রা.)-এর প্রিয়তম সন্তান আবদুর রহমান অসুস্থ হয়ে পড়েন। মুয়াজ (রা.)-এর বয়স যদি ৩৩ হয়ে থাকে, তাহলে আবদুর রহমানের বয়স ছিল আরও অনেক কম। তিনি খুবই নেককার সন্তান ছিলেন।
অসুস্থ অবস্থায় মুয়াজ (রা.) আবদুর রহমানকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আমার পুত্র, তুমি এখন কেমন আছ?’
আরও পড়ুনজীবনযাপন করতে হবে যেন ভ্রমণে এসেছি২৯ নভেম্বর ২০২৩আবদুর রাহমান কোরআনের মাধ্যমে জবাব দিয়েছিলেন, আলহামদুলিল্লাহ। ‘প্রকৃত সত্য আপনার প্রতিপালকের থেকে আসে সুতরাং আপনি সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হবেন না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৪৭)
মুয়াজ (রা.) জবাব দিলেন, ‘ইনশা আল্লাহ। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন’। (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৫৩)
বোঝাই যাচ্ছে এই পিতা-পুত্রের মধ্যে কতটা মধুর সম্পর্ক ছিল। এটাই ছিল তাঁদের মধ্যে সর্বশেষ কথোপকথন। এরপর আবদুর রহমান মারা যান। পরদিন সকালে মুয়াজ (রা.) সন্তানের জানাজা সম্পন্ন করলেন।
এরপর তিনিও অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুস্থতা এবং দুঃখ একসঙ্গে যেন তাঁকে জড়িয়ে ধরল। কিছু বর্ণনা অনুযায়ী, তিনি অসুস্থ অবস্থায় লম্বা সময় পর্যন্ত অচেতন হয়ে পরে থাকতেন। যখন জ্ঞান ফিরত, তখন জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতেন।
অসুস্থ অবস্থায় তিনি একটি দোয়া করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ, যা দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন, তা দিয়েই আমাকে শেষ করে দিন। আপনি তো জানেন, আমার অন্তরে আপনার ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই নেই।’
আরও পড়ুনজান্নাতে প্রবেশ ও জাহান্নাম থেকে নাজাতের উপায়২৯ নভেম্বর ২০২৩জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ে তিনি কিছু কথা বলেছিলেন, ‘হে মৃত্যু, তোমাকে স্বাগতম। হে আমার মেহমান, তুমি ঠিক তখনই আমার কাছে এলে, যখন তোমাকে দরকার ছিল। হে আল্লাহ, আমি একসময় আপনাকে অনেক ভয় করতাম, আজ আমি আপনার কাছে আসার জন্য পাগল হয়ে আছি। হে আল্লাহ, আপনি তো জানেন দুনিয়াতে আমি কখনো রাজার হালে থাকতে আসিনি। এই পৃথিবীতে আমি সেই লম্বা রাতগুলো পছন্দ করতাম, যে রাতে আপনার ইবাদত করে কাটিয়ে দিতাম। সারা দিন ধরে রোজা রাখতাম। আর আপনার বিজ্ঞ বান্দাদের কাছ থেকে জ্ঞান লাভ করতাম। শুধু জিনিসগুলোই আমি পছন্দ করতাম। আপনি তো জানেন, আমি আপনাকে কতটা ভালোবাসি।’
এরপর মুয়াজ (রা.) চলে গেলেন। কোরআন ও আল্লাহর প্রশংসা দিয়েই পিতাপুত্রের জীবনাবসান ঘটেছিল।
অনুবাদ: সাজিদ আল মাহমুদ
আরও পড়ুনরুমির মুদিদোকানি ও তোতা পাখির গল্প২৮ নভেম্বর ২০২৩উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আবদ র রহম ন কর ছ ল ন অবস থ য় আল ল হ আপন র করত ম
এছাড়াও পড়ুন:
যে কারণে দোয়া ইউনুস পড়া হয়
হজরত ইউনুস (আ.) ছিলেন একজন নবী। সুরা ইউনুস নামে পবিত্র কোরআনে স্বতন্ত্র একটি সুরা আছে। এই সুরায় তওহিদের প্রমাণ ও অংশীবাদের প্রতিবাদ রয়েছে। সুরাটিতে অবিশ্বাসীদের সম্বোধন করে তওহিদ, ওহি, নবুয়ত ও পরকালের সত্যতা ঘোষণা করা হয়েছে।
সুরা ইউনুস ছাড়াও কোরআনে আরও ছয়টি সুরায় হজরত ইউনুস (আ.) সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দুজন নবী মায়ের নামে পরিচিত হয়েছেন। একজন হজরত ঈসা ইবনে মরিয়ম (আ.), অন্যজন হজরত ইউনুস ইবনে মাত্তা (আ.)। মাত্তা হজরত ইউনুস (আ.)-এর মায়ের নাম। মায়ের নামেই তাঁকে ইউনুস ইবনে মাত্তা বলা হয়। কোরআনে তাঁকে তিনটি নামে উল্লেখ করা হয়েছে—ইউনুস, জুননুন ও সাহিবুল হুত। জুননুন ও সাহিবুল হুতের অর্থ মাছওয়ালা। মাছ–সংশ্লিষ্ট ঘটনার দিকে ইঙ্গিত করে তাঁকে এ নামে ডাকা হয়েছে।
হজরত ইউনুস (আ.)-কে বর্তমান ইরাকের মসুল নগরীর কাছাকাছি নিনাওয়া জনপদে নবী হিসেবে পাঠানো হয়েছিল। সুরা সাফফাতের ১৪৭ আয়াতে এ নিয়ে আলোচনা আছে। তিনি মসুলবাসীকে আল্লাহর পথে ডাকলেন। আখিরাতের বিষয়ে সতর্ক করলেন। কিন্তু তাঁর সম্প্রদায়ের লোকেরা তাঁর কথা শোনেনি। নবী ইউনুস (আ.) তাদের ইমান নিয়ে হতাশ হয়ে পড়লেন।
আরও পড়ুন‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া’ কেন পড়ব২৪ মার্চ ২০২৪তিন দিনের মধ্যে আল্লাহর আজাব তাদের ওপর নিপতিত হচ্ছে ঘোষণা দিয়ে তিনি নিজ এলাকা ছেড়ে গেলেন। কিন্তু এলাকা ছাড়ার ব্যাপারে তিনি আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা করেননি। আল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষা না করে তাঁর নিজে নিজে বের হয়ে যাওয়াটা আল্লাহর পছন্দ হয়নি। এ ধরনের বিচ্যুতিতে আল্লাহ তাঁর প্রিয় বান্দাদের শিক্ষা দিয়ে থাকেন।
হজরত ইউনুস (আ.) এলাকা ছাড়ার পর লোকজন ভয় পেয়ে গেল যে এবার নিশ্চিত আল্লাহর আজাব চলে আসবে। তারা লোকালয় ছেড়ে বনবাদাড়ের দিকে চলে গেল। গবাদিপশু ও শিশুদেরও সঙ্গে নিল। সেখানে সবাই আল্লাহর কাছে আশ্রয় ও ক্ষমা প্রার্থনা করল। তাদের তওবার কারণে আল্লাহ তাদের ওপর থেকে আজাব সরিয়ে নেন।
এলাকা ছাড়ার পর হজরত ইউনুস (আ.) ভাবলেন, তার সম্প্রদায় হয়তো আল্লাহর আজাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। তিনি কল্পনাও করেননি যে তারা তওবা করে আল্লাহর প্রতি ইমান নিয়ে আসবে। তিনি যখন জানতে পারলেন, তারা সবাই ইমান নিয়ে এসেছে, একদিকে তিনি অবাক হলেন, অন্যদিকে ভীত হয়ে পড়লেন। তিনি তাদের বলেছিলেন, তিন দিনের মধ্যে আল্লাহর আজাব আসবে, কিন্তু সেই আজাব সরে গেছে। তারা তাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে হত্যা করতে পারে। সে সময়ে মিথ্যা বলার শাস্তি ছিল হত্যা। এ আশঙ্কায় তিনি দেশে না ফিরে দূর দেশে যাওয়ার জন্য মানুষবোঝাই একটি নৌকায় চড়ে বসলেন। নৌকা মাঝনদীতে পৌঁছামাত্র প্রচণ্ড ঝড় শুরু হলো। প্রবল ঢেউয়ে নৌকা ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলো। অবস্থা বেগতিক দেখে মাঝি বললেন, মালিকের অবাধ্য হয়ে এই নৌকায় কেউ উঠেছে। এমন কেউ থেকে থাকলে তাকে নদীতে ফেলে দিতে হবে। না হলে অন্য যাত্রীরা এই বিপদ থেকে রক্ষা পাবে না।
যাত্রীদের মধ্যে লটারি করা হলো। তিনবার লটারি করা হলে প্রতিবারই হজরত ইউনুস (আ.)-এর নাম এল। হজরত ইউনুস (আ.) তখন নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। একটি বিশালদেহী মাছ এসে তাঁকে গিলে ফেলল। মাছটির প্রতি আল্লাহর নির্দেশ ছিল, হজরত ইউনুস (আ.)-এর যেন কোনো ক্ষতি না হয়।
আরও পড়ুনযে কারণে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়া হয়২৫ মার্চ ২০২৪মাছের পেটে গিয়ে হজরত ইউনুস (আ.) একটি দোয়া পড়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইলেন। ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সেটিই দোয়া ইউনুস নামে পরিচিত। তিনি বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭ ) অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র মহান, আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’
এই দোয়ার ফলে মাছের পেট থেকে আল্লাহ তাঁকে মুক্তি দেন। কোরআনে আছে, ‘সে যদি আল্লাহর মহিমা আবৃত্তি না করত, তাহলে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত তাকে মাছের পেটে থাকতে হতো।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ১৪৩-১৪৪)
কিছুদিন পর মাছটি হজরত ইউনুস (আ.)-কে নদীতীরে উগড়ে ফেলে দিল। আল্লাহ সেখানে তাঁর শারীরিক প্রশান্তির জন্য একটি লতাবিশিষ্ট গাছ উদ্গত করে দেন। কোরআনে আল্লাহ বলেন, ‘তারপর ইউনুসকে আমি তৃণহীন প্রান্তরে ফেলে দিলাম, তখন সে অসুস্থ ছিল। পরে তাকে ছায়া দেওয়ার জন্য আমি একটি লাউগাছ গজালাম।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ১৪৫-১৪৬)
আরও পড়ুনপাপ থেকে প্রত্যাবর্তন করার নাম তওবা২৬ মার্চ ২০২৪‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭ )
দোয়া ইউনুসের অর্থ
অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র মহান, আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’
দোয়া ইউনুস এর ফজিলত
মাছের পেটে গিয়ে হজরত ইউনুস (আ.) একটি দোয়া পড়ে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাইলেন। ক্ষমা প্রার্থনা করলেন। সেটিই দোয়া ইউনুস নামে পরিচিত। তিনি বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন।’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত: ৮৭ ) অর্থাৎ ‘হে আল্লাহ তুমি ছাড়া কোনো উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র মহান, আমি তো সীমালঙ্ঘনকারী।’
এই দোয়ার ফলে মাছের পেট থেকে আল্লাহ তাঁকে মুক্তি দেন। কোরআনে আছে, ‘সে যদি আল্লাহর মহিমা আবৃত্তি না করত, তাহলে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত তাকে মাছের পেটে থাকতে হতো।’ (সুরা সাফফাত, আয়াত: ১৪৩-১৪৪)
যেকোনো বিপদে পড়লে আল্লাহর সাহায্য ও আশ্রয় কামনা করতে হয়।
হজরত সাদ (রা.)-এর বরাতে একটি হাদিস পাওয়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, জুননুন ইউনুস (আ.) মাছের পেটে দোয়া করেছিলেন, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন। কোনো মুসলমান যখনই এই দোয়া পড়ে, আল্লাহ অবশ্যই তার দোয়া কবুল করে থাকেন। (তিরমিজি, হাদিস: ৩৫০৫)
আরও পড়ুনহাসবুনাল্লাহু ওয়া নিমাল ওয়াকিল কখন পড়বেন২৬ মার্চ ২০২৪