বাড়তি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিন দফায় গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার। তবে আমদানি হয়েছে কম, এতে বাড়তি দাম দিয়েও গ্যাস পাননি গ্রাহকেরা। এখন এক বছরে ইতিহাসের সর্বোচ্চ আমদানির কথা বলে শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম বাড়াতেই আমদানির অবাস্তব আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

দেশে দুটি উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন করে সরবরাহ করা হয় ৭৫ শতাংশ। আর ২৫ শতাংশ আসে আমদানি করা এলএনজি থেকে। দিনে সর্বোচ্চ ১১০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের অবকাঠামো আছে দেশে। যদিও কারিগরি কারণে পুরোটা ব্যবহার করা যায় না। এটি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ১০৫ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা সম্ভব।

দিনে গড়ে ৮৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করার কথা বলে ২০১৯ সালে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছরে গ্যাস সরবরাহ করা হয় দিনে ৫৬ কোটি ঘনফুট করে। ২০২২ সালে আবারও একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করে পেট্রোবাংলা। এবার আপত্তি জানায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আগে ২৯ কোটি ঘনফুট কম সরবরাহ করে আড়াই হাজার কোটি টাকা বাড়তি নেওয়া হয়েছে বলে জানায় কমিশন। তাই ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য দিনে ৬৮ কোটি ঘনফুট আমদানি ধরে দাম বাড়ায় বিইআরসি। ওই অর্থবছরে এলএনজি আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৫ কোটি ঘনফুট করে। এরপর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয় সরকারের নির্বাহী আদেশে। এখন আবার একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে দাম বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে।

দিনে সর্বোচ্চ ১১০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের অবকাঠামো আছে দেশে। যদিও কারিগরি কারণে পুরোটা ব্যবহার করা যায় না। এটি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ১০৫ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা সম্ভব।

ডলার জোগানের চ্যালেঞ্জ

পেট্রোবাংলার অনুমতি নিয়ে এলএনজি আমদানি করে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে নিয়মিত আমদানি করে তারা। এর বাইরে চাহিদা বুঝে খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে আমদানি করে। আরপিজিসিএলের তথ্য বলছে, বছরে সর্বোচ্চ এলএনজি আমদানি হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, ৮৩টি। এর মধ্যে ৫৭টি এসেছে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থেকে, আর ২৬টি কেনা হয়েছে খোলাবাজার থেকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪৪টি কার্গো আনা হয়েছে। পুরো অর্থবছরে ১০১টি কার্গো আনার কথা বলেছে পেট্রোবাংলা। তার মানে বাকি ছয় মাসে আনতে হবে ৫৭টি কার্গো। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থেকে আসবে ২৭টি। খোলাবাজার থেকে কিনতে হবে ৩০টি এলএনজি কার্গো।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খোলাবাজার থেকে এখন পর্যন্ত বছরে সর্বোচ্চ এলএনজি আমদানি হয়েছে ২৬টি। তাই ছয় মাসে ৩০টি এলএনজি কেনার প্রতিশ্রুতি যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত নয়। ডলার–সংকটে এলএনজির বিল নিয়মিত দিতে পারছে না পেট্রোবাংলা, বকেয়া বাড়ছে। এর মধ্যে এ বছর তাদের চাহিদা ৪৫০ কোটি ডলার। তাই বাড়তি এলএনজি কিনতে ডলার জোগানোয় হিমশিম খেতে হবে তাদের। এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা ১১৫ কার্গো থেকে কমিয়ে সম্প্রতি ৯০টি করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

আগেও প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলএনজি আনেনি পেট্রোবাংলা। এটা ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা। তাই মূল্যবৃদ্ধি তো করা যাবেই না; বরং মিথ্যাচারের দায়ে শাস্তি দিতে হবে। এবারও যে আমদানির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এ ছাড়া অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর ব্যবস্থা নিলে গ্যাসের দাম কমানো যাবে।ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো.

রেজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে বিল পরিশোধের উপায় বের করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদের আর্থিক ঘাটতি হবে ১৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। আর ২০২৫ সালে তাদের ঘাটতি হবে ২২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। তাই শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তারা। ইতিমধ্যে প্রস্তাব মূল্যায়নে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে বিইআরসি। ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থার প্রস্তাব জমা পড়েছে এ সপ্তাহে। প্রস্তাব মূল্যায়নের পর প্রতিবেদন দেবে কারিগরি কমিটি। এরপর প্রস্তাবটি আমলে নেওয়া বা খারিজ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে কমিশন।

পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদের আর্থিক ঘাটতি হবে ১৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। আর ২০২৫ সালে তাদের ঘাটতি হবে ২২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।

‘আশ্বাস বাস্তবায়নযোগ্য নয়’

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করে জ্বালানি বিভাগ ও বিইআরসিতে চিঠি পাঠিয়েছে রপ্তানিমুখী ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিটিটিএলএমইএ, বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বিকেএমইএ। দাম না বাড়ানোর অনুরোধ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, গত দেড় দশকে শিল্পে গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪১২ শতাংশ আর শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ) কেন্দ্রে গ্যাসের দাম বেড়েছে ৬৫৪ শতাংশ।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আগেও প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলএনজি আনেনি পেট্রোবাংলা। এটা ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা। তাই মূল্যবৃদ্ধি তো করা যাবেই না; বরং মিথ্যাচারের দায়ে শাস্তি দিতে হবে। এবারও যে আমদানির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এ ছাড়া অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর ব্যবস্থা নিলে গ্যাসের দাম কমানো যাবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আমদ ন র ঘনফ ট

এছাড়াও পড়ুন:

ত্রাণের পর এবার গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করছে ইসরায়েল

গাজায় বন্দী বাকি ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি দিতে হামাসকে বাধ্য করতে এবার সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল। কাতারের রাজধানী দোহায় যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরুর আগে এই নির্দেশ দিল ইসরায়েল সরকার।

গতকাল রোববার ইসরায়েলের জ্বালানিমন্ত্রী এলি কোহেন এ ঘোষণা দেন। এক সপ্তাহ আগে ইসরায়েল গাজায় সব ধরনের ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। গাজায় ২০ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করেন।

গতকাল এক ভিডিও বার্তায় কোহেন বলেন, ‘জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে এবং যুদ্ধ শেষে গাজায় আর এক দিনও যেন হামাসের অস্তিত্ব না থাকে, তা নিশ্চিত করতে আমাদের হাতে যা কিছু আছে, তার সবই আমরা ব্যবহার করব।’

বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হলে শুরুতেই গাজায় পানি বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থায় প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গাজার বাসিন্দাদের বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ইসরায়েল সরকার বলেছে, তারা গাজায় পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার বিষয়টিও উড়িয়ে দিচ্ছে না।

বিবৃতিতে কোহেন আরও বলেন, ‘আমি এইমাত্র গাজা উপত্যকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশে সই করেছি।’

যুদ্ধের শুরুতে ইসরায়েল গাজায় প্রধান প্রধান বিদ্যুৎ সরবরাহব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।

আজ সোমবার কাতারে গাজা যুদ্ধবিরতি নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। গাজায় ভঙ্গুর এক যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ ১ মার্চ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের বিষয়ে কোনো আলোচনা এখনো হয়নি।

ইসরায়েল চাইছে, হামাস তাদের যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের সময় বাড়ানোর প্রস্তাবে রাজি হোক। তবে হামাস যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরু করতে চাইছে।

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে এই যুদ্ধবিরতি চুক্তির দ্বিতীয় ধাপে বাকি জিম্মিদের মুক্তি, গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাদের প্রত্যাহার করে নেওয়া এবং স্থায়ীভাবে যুদ্ধ অবসানের কথা বলা আছে।

ধারণা করা হচ্ছে যে হামাসের হাতে এখনো ২৪ জন জীবিত জিম্মি এবং ৩৫ জিম্মির মরদেহ আছে।

ইসরায়েল গাজায় ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার পর হামাস বলেছিল, এর প্রভাব গাজায় থাকা জিম্মিদের ওপরও পড়বে।

আরও পড়ুনগাজায় যুদ্ধবিরতি শুরু হচ্ছে, সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান১৮ জানুয়ারি ২০২৫

গতকাল বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণার পর গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা নিজেদের অবস্থানে কোনো ধরনের পরিবর্তন না করেই মিসরের মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে সর্বশেষ যুদ্ধবিরতি আলোচনা শেষ করেছে। তারা যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা দ্রুত শুরু করতেও বলেছে।

যুদ্ধে গাজার বেশির ভাগ অঞ্চল বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। সেখানে জেনারেটর ও সৌর প্যানেলের মাধ্যমে অল্প পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা আছে।

গাজায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে ইসরায়েল।

আরও পড়ুনগাজায় দ্বিতীয় ধাপের যুদ্ধবিরতি আলোচনা ঘিরে অনিশ্চয়তা০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • চুপ করুন, ছোট মানুষ: পোল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ইলন মাস্ক
  • ত্রাণের পর এবার গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করছে ইসরায়েল
  • প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ২৪ টাকা ৩৯ পয়সা দিতে চান ব্যবসায়ীরা
  • তিন পার্বত্য জেলায় ২ হাজার কোটি টাকার ফলের ব্যবসা
  • চট্টগ্রামে আহতের তালিকা নিয়ে বৈষম্যের অভিযোগ
  • গ্যাসে দুই দফা ভ্যাট, পেট্রোবাংলার বকেয়া ১৮ হাজার কোটি টাকা
  • দক্ষিণ এশীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বকেয়া পরিশোধের সিদ্ধান্ত
  • বেড়েছে ব্যাংক-বহির্ভূত ঋণ, ৬ মাসে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার
  • ছয় মাসে ব্যাংক থেকে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে সরকার
  • সাতক্ষীরায় অপরিকল্পিতভাবে মরিচ্চাপ নদ খনন: