বাড়তি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিন দফায় গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে গত আওয়ামী লীগ সরকার। তবে আমদানি হয়েছে কম, এতে বাড়তি দাম দিয়েও গ্যাস পাননি গ্রাহকেরা। এখন এক বছরে ইতিহাসের সর্বোচ্চ আমদানির কথা বলে শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাম বাড়াতেই আমদানির অবাস্তব আশ্বাস দেওয়া হয়েছে।

দেশে দুটি উৎস থেকে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। এর মধ্যে দেশি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন করে সরবরাহ করা হয় ৭৫ শতাংশ। আর ২৫ শতাংশ আসে আমদানি করা এলএনজি থেকে। দিনে সর্বোচ্চ ১১০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের অবকাঠামো আছে দেশে। যদিও কারিগরি কারণে পুরোটা ব্যবহার করা যায় না। এটি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ১০৫ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা সম্ভব।

দিনে গড়ে ৮৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করার কথা বলে ২০১৯ সালে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। এরপর ২০১৯-২০ অর্থবছরে গ্যাস সরবরাহ করা হয় দিনে ৫৬ কোটি ঘনফুট করে। ২০২২ সালে আবারও একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করে পেট্রোবাংলা। এবার আপত্তি জানায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আগে ২৯ কোটি ঘনফুট কম সরবরাহ করে আড়াই হাজার কোটি টাকা বাড়তি নেওয়া হয়েছে বলে জানায় কমিশন। তাই ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য দিনে ৬৮ কোটি ঘনফুট আমদানি ধরে দাম বাড়ায় বিইআরসি। ওই অর্থবছরে এলএনজি আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৫ কোটি ঘনফুট করে। এরপর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ শতাংশের বেশি বাড়ানো হয় সরকারের নির্বাহী আদেশে। এখন আবার একই প্রতিশ্রুতি দিয়ে দাম বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে।

দিনে সর্বোচ্চ ১১০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের অবকাঠামো আছে দেশে। যদিও কারিগরি কারণে পুরোটা ব্যবহার করা যায় না। এটি ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ১০৫ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ করা সম্ভব।

ডলার জোগানের চ্যালেঞ্জ

পেট্রোবাংলার অনুমতি নিয়ে এলএনজি আমদানি করে রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে নিয়মিত আমদানি করে তারা। এর বাইরে চাহিদা বুঝে খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে আমদানি করে। আরপিজিসিএলের তথ্য বলছে, বছরে সর্বোচ্চ এলএনজি আমদানি হয়েছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে, ৮৩টি। এর মধ্যে ৫৭টি এসেছে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থেকে, আর ২৬টি কেনা হয়েছে খোলাবাজার থেকে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪৪টি কার্গো আনা হয়েছে। পুরো অর্থবছরে ১০১টি কার্গো আনার কথা বলেছে পেট্রোবাংলা। তার মানে বাকি ছয় মাসে আনতে হবে ৫৭টি কার্গো। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থেকে আসবে ২৭টি। খোলাবাজার থেকে কিনতে হবে ৩০টি এলএনজি কার্গো।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, খোলাবাজার থেকে এখন পর্যন্ত বছরে সর্বোচ্চ এলএনজি আমদানি হয়েছে ২৬টি। তাই ছয় মাসে ৩০টি এলএনজি কেনার প্রতিশ্রুতি যৌক্তিক ও বাস্তবসম্মত নয়। ডলার–সংকটে এলএনজির বিল নিয়মিত দিতে পারছে না পেট্রোবাংলা, বকেয়া বাড়ছে। এর মধ্যে এ বছর তাদের চাহিদা ৪৫০ কোটি ডলার। তাই বাড়তি এলএনজি কিনতে ডলার জোগানোয় হিমশিম খেতে হবে তাদের। এ বছরের লক্ষ্যমাত্রা ১১৫ কার্গো থেকে কমিয়ে সম্প্রতি ৯০টি করা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।

আগেও প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলএনজি আনেনি পেট্রোবাংলা। এটা ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা। তাই মূল্যবৃদ্ধি তো করা যাবেই না; বরং মিথ্যাচারের দায়ে শাস্তি দিতে হবে। এবারও যে আমদানির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এ ছাড়া অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর ব্যবস্থা নিলে গ্যাসের দাম কমানো যাবে।ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান মো.

রেজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জ্বালানি বিভাগের সঙ্গে বৈঠক করে বিল পরিশোধের উপায় বের করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদের আর্থিক ঘাটতি হবে ১৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। আর ২০২৫ সালে তাদের ঘাটতি হবে ২২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। তাই শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে তারা। ইতিমধ্যে প্রস্তাব মূল্যায়নে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করেছে বিইআরসি। ছয়টি গ্যাস বিতরণ সংস্থার প্রস্তাব জমা পড়েছে এ সপ্তাহে। প্রস্তাব মূল্যায়নের পর প্রতিবেদন দেবে কারিগরি কমিটি। এরপর প্রস্তাবটি আমলে নেওয়া বা খারিজ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে কমিশন।

পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তাদের আর্থিক ঘাটতি হবে ১৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। আর ২০২৫ সালে তাদের ঘাটতি হবে ২২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।

‘আশ্বাস বাস্তবায়নযোগ্য নয়’

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করে জ্বালানি বিভাগ ও বিইআরসিতে চিঠি পাঠিয়েছে রপ্তানিমুখী ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বিটিটিএলএমইএ, বিজিএমইএ, বিটিএমএ, বিকেএমইএ। দাম না বাড়ানোর অনুরোধ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, গত দেড় দশকে শিল্পে গ্যাসের দাম বেড়েছে ৪১২ শতাংশ আর শিল্পে উৎপাদিত নিজস্ব বিদ্যুৎ (ক্যাপটিভ) কেন্দ্রে গ্যাসের দাম বেড়েছে ৬৫৪ শতাংশ।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আগেও প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলএনজি আনেনি পেট্রোবাংলা। এটা ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা। তাই মূল্যবৃদ্ধি তো করা যাবেই না; বরং মিথ্যাচারের দায়ে শাস্তি দিতে হবে। এবারও যে আমদানির আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এ ছাড়া অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর ব্যবস্থা নিলে গ্যাসের দাম কমানো যাবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আমদ ন র ঘনফ ট

এছাড়াও পড়ুন:

এবার রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার যে কারণে নিয়ন্ত্রণে ছিল

আমাদের দেশে অতীত অভিজ্ঞতা মিশ্র হওয়ার কারণে রমজান মাসে বাজার পরিস্থিতি নিয়ে ভোক্তারা সর্বদা উদ্বেগে থাকেন। এই মাসে কিছু ভোগ্যপণ্যের বাড়তি চাহিদার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা ধরনের শঙ্কা উঁকি দেয়। তবে এবারের রমজানে এমনটা ঘটেনি। রমজানের শেষ দিকে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত জরিপে দেখা যায়, প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ রমজানে বাজার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সন্তুষ্ট। (এবার রোজায় দ্রব্যমূল্যে সন্তুষ্ট ৯৫ শতাংশ মানুষ, কালবেলা, ২৯ মার্চ ২০২৫)

২.

রমজান মাসের স্পর্শকাতর পণ্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে খেজুর, ডাল, ছোলা, তেল, চিনি, তাজা ফল, চাল, সবজি, পেঁয়াজ, ডিম, মাছ ও মাংস। মোটাদাগে, দু–একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছাড়া রমজান মাসজুড়ে এসব পণ্যের সার্বিক সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি সাধারণ মানুষের প্রত্যাশাকে পূরণ করেছে।

এই পরিস্থিতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এই বছরের রমজানে নিত্যপণ্যের দাম পূর্ববর্তী রমজানের তুলনায় অনেক ক্ষেত্রে কমেছে। যেমন এ বছর ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কম দামে মানুষ খেজুর কিনতে পেরেছেন। ইরাক থেকে আমদানি করা সাধারণ মানের জাহিদি খেজুর (যা মোট খেজুর আমদানির প্রায় অর্ধেক) প্রতি কেজি ১৬৫ টাকার স্থলে ১১৫ টাকায় এবং কার্টনে ২৬০ টাকার স্থলে ১৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

ডিমের দাম প্রতি ডজন ১২০ টাকায় নেমেছে (প্রতি পিস ১০ টাকা), যা একসময় ১৯০ টাকায় উঠেছিল; ছোলা ও ডাল ৫ থেকে ৩৫ শতাংশ কমেছে। চিনি গত বছর বিক্রি হয়েছে ১৪৫ টাকা, যা এবার হয়েছে ১২০ টাকা; কেজিতে কমেছে প্রায় ২৫ টাকা। গত বছর আলু ও টমেটো ছিল ৩৫ ও ৬০ টাকা, যা এবার হয়েছে যথাক্রমে ২২ ও ২০ টাকা। সবজির দামও ছিল নিম্নমুখী। রমজানকেন্দ্রিক অধিকাংশ খাদ্যপণ্যের ওপর সার্বিক মূল্যস্ফীতির চাপের তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায়নি।  

৩.

রমজানে ভোজ্যতেলের বাজার প্রথম দিকে কিছুটা অস্বাভাবিক থাকলেও পরে তা ঠিক হয়ে যায়। এই ভোজ্যতেল (সয়াবিন ও পাম) প্রায় শতভাগ আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দামের উর্ধ্বমুখী প্রবণতার কারণে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার কর্তৃক শুল্কছাড় এবং স্থানীয় বাজারে মূল্য সমন্বয়ের কারণে স্থানীয় বাজার স্থিতিশীলই থাকার ছিল। তবে গত বছরের তুলনায় প্রায় ৩৫ শতাংশ আমদানি বেশি হলেও সয়াবিনের উৎস দেশ ব্রাজিল থেকে অনেকটা প্রাকৃতিক কারণে বিলম্বে জাহাজীকরণ হয়েছিল। এর ফলে তা দেশে পৌঁছাতে সময় লেগেছে।

এই বিলম্বজনিত কারণে একশ্রেণির ব্যবসায়ী অসাধুতার আশ্রয় নিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সরকারের নিবিড় তদারকিতে তা নিয়ন্ত্রণে আসে। ১০ রমজানের পর থেকে ক্রেতাদের নির্ধারিত মূল্যে তেল কিনতে আর অসুবিধা হয়নি।

আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম গত কয়েক মাসে ‘অস্বাভাববিক’ ছিল। তা সত্ত্বেও ট্যারিফ কমিশনের পর্যবেক্ষণ অনুসারে সরকার স্থানীয় বাজারে এর দাম বাড়তে দেয়নি। রয়টার্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ১ অক্টোবর ক্রুড সয়াবিনের মূল্য ছিল ৯৮০ ডলার। আর ক্রুড পাম অয়েলের মূল্য ছিল ১ হাজার ৫০ ডলার। ওই বছরের ১ ডিসেম্বরে মূল্য দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ হাজার ৭০ ডলার ও ১ হাজার ২৩০ ডলার। পরবর্তী সময়ে সয়াবিন ১ হাজার ১৪০ ও পামের দাম উঠেছিল ১ হাজার ২৫২ ডলার। ভোজ্যতেলের এই ঊর্ধ্বগতির উত্তাপ যাতে স্থানীয় বাজারে না আসে, সে জন্য সরকার তিন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

প্রথমত, আমদানিস্থলে শুল্ক–কর ১৫ শতাংশ থেকে প্রথমে ১০ শতাংশ এবং পরে তা ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৫ শতাংশ নামিয়ে আনা হয়। এরপর যথাযথ মূল্য সমন্বয়ের স্বার্থে স্থানীয় বাজারে প্রতি লিটার ১৬৭ টাকা থেকে ১৭৫ (এক কেজি বোতল) আর খোলা তেল ১৪৭ থেকে ১৫৫ টাকায় উন্নীত করার অনুমোদন দেওয়া হয়।

দ্বিতীয়ত, বাজারে ভোজ্যতেলে বৈচিত্র্য আনার জন্য ক্যানোলা ও সানফ্লাওয়ার তেল আমদানিতে উচ্চ শুল্কহার (প্রায় ৫৮ শতাংশ) কমিয়ে সয়াবিন ও পাম তেলের মতো ৫ শতাংশে আনা হয়। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঊর্ধ্বমুখী সয়াবিন ও পাম তেলের ওপর নির্ভরতা কমানো।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে, দেশে উৎপাদিত রপ্তানিনির্ভর রাইস ব্র্যান তেলকে স্থানীয় বাজারে যুক্ত করা। এত দিন অধিকাংশ ক্রুড রাইস ব্র্যান পার্শ্ববর্তী দেশে রপ্তানি হয়ে যেত। ২০১৯ সালে রাইস ব্র্যানের রপ্তানি নিরুৎসাহিত করতে শুধু রাইস ব্র্যানের ওপর ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা হয়; কিন্তু অপরোশোধিত ও পরিশোধিত তেলে কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। এই সুযোগে দেশে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও অপরিশোধিত রাইস ব্র্যান তেল পার্শ্ববর্তী দেশে চলে যেত।

ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে রাইস ব্র্যানের পাশাপাশি অরিশোধিত ও পরিশোধিত তেলের ওপর অনুরূপ ২৫ শতাংশ রপ্তানি শুল্ক আরোপ করা হয় এবং শর্তসাপেক্ষে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এতে প্রায় তিন লাখ মেট্রিক টন রাইস ব্র্যান তেল (যা অধিকতর স্বাস্থ্যসম্মত হিসেবে বিবেচিত) স্থানীয় বাজারে নতুনভাবে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি এই দেশীয় পণ্যটি সরবরাহের ফলে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার সমমূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করে সয়াবিন ও পাম তেলের বিকল্প পণ্য হিসেবে সংযোজন হয়েছে। রমজানের বাজারে এই রাইস ব্র্যান তেলের সরবরাহও বৃদ্ধি পেয়েছে।

দেশে আচমকা বন্যায় আমনের উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ায় চালের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, দেশে ১২-১৫ লাখ মেট্রিক টন চাল ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের আলোকে ঘাটতির বিপরীতে সরকার চাল আমদানি উৎসাহিত করার জন্য এর ওপর প্রযোজ্য ৬৩ শতাংশ শুল্ক–কর মাত্র ৩ শতাংশে (এআইটি) নামিয়ে আনা হয়।

এই ঘাটতি পূরণে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পর্যাপ্ত এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলা হয়। এরই মধ্যে অধিকাংশ চাল দেশে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বাড়তি হওয়ায় আমদানি করা এই চালের দাম দেশেও কিছুটা বেড়েছে। তা সত্ত্বেও সাধারণ মানের চাল (স্বর্ণা) প্রতি কেজি ৫৫-৫৬ টাকার মধ্যে পাওয়া যায়, যা রমজানের আগে আরও বেশি ছিল। উন্নত মানের চালের (বালাম, পাইজাম, নাজিরশাইল ইত্যাদি) দামও কিছুটা বাড়তি ছিল। তবে সামনে বোরো ধান আসার সঙ্গে সঙ্গে এই পরিস্থিতি দ্রুত উন্নত হবে, এমনটা আশা করা যায়।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সরকার কর্তৃক সময়োচিত উদ্যোগে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। চালের পরিপূরক হিসেবে আটা ও ময়দার দাম গত রমজানের তুলনায় কম (কেজিতে ৭ থেকে ১০ টাকা) ছিল। ফলে চালের বিকল্প হিসেবে আটা ও ময়দার দামে সাধারণ মানুষ সন্তুষ্ট থেকেছে।

ট্যারিফ কমিশন ও অন্যান্য সংস্থার পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত মাঠপর্যায়ের জরিপে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে পণ্যমূল্যের সঙ্গে বাড়তি খরচের চাপও কমেছে। বাজারসংশ্লিষ্ট সংঘবদ্ধ অপরাধ হ্রাস পাওয়ায় তা পণ্য সরবরাহের শৃঙ্খল স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে।৪.

রমজানে দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতার পেছনে কয়েকটি বিষয় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমত, এবার রমজানের প্রায় ছয় মাস আগে থেকে প্রস্তুতি চলেছে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনসহ বাণিজ্য, খাদ্য, কৃষি, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয় (এনবিআর) সমন্বিতভাবে কাজ করেছে। এ জন্য সম্ভাব্য সব নীতিগত সাহায্য ও সহযোগিতা দেওয়া হয়েছে।

ট্যারিফ কমিশন প্রতিটি পণ্য নিয়ে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তাদের পর্যবেক্ষণ তৈরি করেছে। ডিম, পেঁয়াজ, আলু, চাল, তেল, চিনি, খেজুর, তাজা ফলসহ অন্যান্য খাদ্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে জোরালো সুপারিশ করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সার্বিক ও দূরদর্শী নেতৃত্ব দিয়েছে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, এবারের ভোক্তাদের আচরণেও ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা গেছে। বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ ভোক্তা এবার ‘প্যানিক বায়িং’(প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনাকাটা) থেকে বিরত থেকেছেন; যার যতটুকু প্রয়োজন, ততটুকুই কিনেছেন। এতে সরবরাহের ওপর তেমন বাড়তি চাপ দেখা যায়নি। লেবুর কথা ধরা যাক; কোনো কোনো স্থানে লেবু প্রথম দিকে ১০০ টাকায় হালি বিক্রি হলেও সাধারণ ভোক্তারা তা কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েননি। পরে এই লেবুর দাম ৩০-৪০ টাকায় নেমে আসে।

অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রেও ভোক্তারা স্বাভাবিক আচরণ করেছেন। ভোজ্যতেলের কিছুটা সংকট থাকলেও অধিকাংশকে সংযত আচরণ করতে দেখা গেছে। বাজার তদারকির প্রতিবেদন অনুযায়ী সরকারি সংস্থাগুলোর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে আবার সেই সংকট কেটেও যায়। সরকারি এসব পদক্ষেপে জনমনে একধরনের আস্থাও দেখা গেছে।

আরও পড়ুনইন্টেরিমের রোজা-ঈদ এবং ‘মধু মধু মধু...’৩১ মার্চ ২০২৫

তৃতীয়ত, এবারের রমজানকেন্দ্রিক পণ্য সরবরাহে নতুন নতুন ব্যবসায়ীরা যুক্ত হয়েছেন। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, আগের রমজানে নিত্যপণ্য আমদানিকারকের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৬৫; এবার তা বেড়ে হয়েছে ৪৯৯। ফলে পণ্য আমদানির ওজনে বেড়েছে ৩৪ শতাংশ, যার পরিমাণ ৩৫ লাখ ৫৪ হাজার টন; মূল্যের হিসাবে ৫১ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ১৯৬ কোটি ডলার।

নতুনদের সংযুক্ত হওয়া ও বিপুল আমদানির নেপথ্যের অন্যতম কারণ ছিল, সরকারের পূর্বপ্রস্তুতি এবং এর অংশ হিসেবে অনেকগুলো নিত্যপণ্যের শুল্ক–কর ও শুল্কায়ন মূল্য যৌক্তিকীকরণ করা। রমজান শুরুর অনেক আগে এ কাজ করায় এসব ব্যবসায়ী উৎসাহী হন। এতে চাহিদার তুলনায় পণ্যের সরবরাহে পর্যাপ্ততা দেখা যায়।

চতুর্থত, বাজারে সিন্ডিকেট বা চাঁদাবাজির দীর্ঘদিনের যে অভিযোগ ছিল, তা এবারে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণে ছিল। বলা যায়, সাম্প্রতিক পটপরিবর্তনের আগে এসবের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল, তারা অনেকটা আড়ালে ছিল। এর সঙ্গে অবৈধ মজুতদারি, ঘুষ ও দুর্নীতির মাত্রাও কমেছে।

ট্যারিফ কমিশন ও অন্যান্য সংস্থার পণ্য সরবরাহ সংক্রান্ত মাঠপর্যায়ের জরিপে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে পণ্যমূল্যের সঙ্গে বাড়তি খরচের চাপও কমেছে। বাজারসংশ্লিষ্ট সংঘবদ্ধ অপরাধ হ্রাস পাওয়ায় তা পণ্য সরবরাহের শৃঙ্খল স্বাভাবিক রাখতে সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। সার্বিকভাবে, এ কাজে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশন, প্রতিযোগিতা কমিশন, টিসিবি, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসন নিবিড় তদারকি করেছে।

অন্যদিকে অনেক ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনও এবারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। ব্যবসার মূল চালিকাশক্তি মুনাফা হওয়ায় যেকোনো পরিস্থিতি বা সংকটকে কাজে লাগিয়ে কেউ কেউ অস্বাভাবিক মুনাফার পথ খোঁজেন। তবে এ বিষয়ে সরকারের দায়িত্ব হলো, প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা, যাতে ভোক্তাসাধারণ ন্যায্যমূল্যে পছন্দের পণ্যটি ক্রয় করতে পারেন। সরকারি সংস্থাগুলো এবারে এ কাজটি অনেকাংশে করতে পেরেছে। ট্যারিফ কমিশনসহ অন্য সংস্থাগুলো ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক করে তাদের প্রকৃত সমস্যা চিহ্নিত করে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে।

৫.

রমজানে জনমনের এই স্বস্তি পরবর্তী সময়ে ধরে রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সব সংস্থার যে রকম সুষ্ঠু সমন্বয় ছিল, তেমনটা অব্যাহত রাখা দরকার; কোথাও ছন্দপতন ঘটলে সময়মতো ত্বরিত ব্যবস্থা নিতে হবে। নিত্যপণ্যের বাজারে কোনটির মৌসুমি প্রভাব রয়েছে। এর জন্য পর্যাপ্ত মজুতখানাসহ নানা ধরনের অবকাঠামো তৈরি ও উদ্যোগ নেওয়া এবং তা বাস্তবায়নে নীতিসহায়তা ও সমর্থন দিতে হবে।

বন্দরে পণ্য খালাসে বিলম্ব রোধ, শুল্কায়ন প্রক্রিয়ায় মিথ্যা ঘোষণা ও চোরাচালান প্রতিরোধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নেওয়া, সময়ে সময়ে ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশ আমলে নিয়ে শুল্ক–কর ও শুল্কায়ন মূল্য যৌক্তিকীকরণ করা, প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করতে ট্যারিফ পলিসি ২০২৩ সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা এবং নিবিড়ভাবে বাজার মনিটরিং করাসহ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। এবার রমজানের অভিজ্ঞতায় জনমনে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে। প্রত্যাশা পূরণ করা এখন সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও সংগঠনগুলোর দায়িত্ব।

ড. মইনুল খান চেয়ারম্যান (সচিব), বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এবার রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার যে কারণে নিয়ন্ত্রণে ছিল
  • চলতি বছরে মূল‍্যস্ফীতি বেড়ে ১০.২ শতাংশে পৌঁছাবে, কমবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি 
  • মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবসা বাড়াচ্ছে শপআপ, বড় বিনিয়োগ
  • যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক সাড়া আশা করছে সরকার
  • ৫০ হাজার টন চাল আমদানিতে ব্যয় হবে ২৫৪ কোটি টাকা
  • ১ কোটি ২০ লাখ লিটার সয়াবিন তেল ও ১০ হাজার টন মসুর ডাল কিনবে সরকার
  • ১২০১ কোটি টাকা ব্যয়ে কেনা হবে ২ কার্গো এলএনজি
  • স্পট মার্কেট থেকে দুই কার্গো এলএনজি আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন
  • যুক্তরাষ্ট্র থেকে বড় আকারে আমদানি বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি
  • ২৫৪ কোটি টাকার সেদ্ধ চাল কিনবে সরকার