আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের ভালো লাগুক আর মন্দ লাগুক এমনটাই কিন্তু আশঙ্কা করা হয়েছিল—ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভালো দেখতে পুরো বিশ্বব্যবস্থাকেই ওলট-পালট করে দিতে পারেন। ইতিমধ্যে জলবায়ু তহবিল আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় অর্থায়ন থেকে তিনি সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

ইউএসএআইডি অর্থায়িত প্রকল্প কাটছাঁট করছেন। চীন, মেক্সিকো, কানাডার বিরুদ্ধে বিরাট শুল্ক–বাধা সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন। এমনকি ইউরোপের ২৭টি দেশের বিরুদ্ধেও একই কাজের হুমকি দিচ্ছেন। নিদেনপক্ষে সারা বিশ্ব যেন এক বাণিজ্যযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এর হোতা হচ্ছেন স্বয়ং ট্রাম্প।

এভাবে বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে শুল্ক নিয়ে লড়াইয়ে বিশ্ববাণিজ্য কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে সন্দেহ নেই। তবে এ শঙ্কা বড় ধরনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে বাংলাদেশের সামনে বলে অনেকেই বলছেন। মনে হচ্ছে, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন পণ্যের রপ্তানিতে নতুন করে বাড়তি চাহিদা তৈরি হবে। তুলনামূলক কম শুল্ক সুবিধায় চীন মেক্সিকোর পণ্যের চেয়ে বাংলাদেশের পণ্য পশ্চিমা ভোক্তাদের কাছে দামে সাশ্রয়ী হবে।

ধারণা করা হচ্ছে, কম শুল্কের সুবিধা নিতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, কানাডাসহ অনেক দেশই বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে পারে। বড় অর্থনীতির দেশগুলোর পারস্পরিক শুল্ক লড়াই যত তীব্র হবে, ততই কপাল খুলতে পারে বাংলাদেশের। এসব কথা বলেছেন ব্যবসা–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও বিশেষজ্ঞরা। তবে তাঁরা এটাও বলছেন, সঠিক কৌশল নিয়ে এগোতে না পারলে সুযোগ হাতছাড়া হবে।

আমাদের প্রতিযোগী কিছু দেশ নতুন নতুন নীতিসহায়তা নিয়ে আসছে। তাই সুযোগ আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদেরও আটঘাট বেঁধেই নামতে হবে

অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে কানাডার পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে একই হারে মার্কিন পণ্যেও শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে কানাডা সরকার। ধারণা করা হচ্ছে, কানাডার অনুসরণে মেক্সিকো ও চীন একই ধরনের পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারে। ইউরোপও এমনটা ভাবছে। বড় অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে এ শুল্ক লড়াইয়ে কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিশ্ববাণিজ্য। তবে তৈরি পোশাকের মতো মৌলিক চাহিদার পণ্য ব্যবহার ব্যাপক হারে কমানোর সুযোগও তেমন নেই।

অনেকেই মনে করেন, বড় দেশগুলোর শুল্ক লড়াই বাংলাদেশের রপ্তানি এবং এফডিআইয়ের ক্ষেত্রে বড় সুবিধা তৈরি করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে বিপদের কথা হচ্ছে, বিশ্ব অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইউরোপেও রপ্তানি কমতে পারে। তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে অভিবাসন বাধাগ্রস্ত হবে। রেমিট্যান্সপ্রবাহ কমতে পারে। এমনটাও আশঙ্কা করা হচ্ছে, চীন ও মেক্সিকো থেকে অনেকেই বিনিয়োগ স্থানান্তর করবেন।

তবে আরেকটি নির্মম সত্য হচ্ছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিধিবিধানের যে পাকাপোক্ত শিকল আছে, তা মুক্ত করতে না পারলে সুযোগ কাজে লাগানো যাবে না। পাঁচটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলকে (এসইজেড) উপযুক্ত করা এবং এক ছাদের নিচে সব সেবা নিশ্চিত করা গেলে সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর সুযোগ রয়েছে। ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভালো সম্পর্ক। এ রকম অনেক দেশই বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত।

তৈরি পোশাক বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য। মোট রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের ওপর আসে এ পণ্যটি থেকে। আবার একক রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র পোশাকের প্রধান রপ্তানি বাজার। মোট রপ্তানি আয়ের ২০ থেকে ২২ শতাংশ আসে দেশটি থেকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের প্রভাব বেশি। দেশটিতে পোশাক রপ্তানিতে চীনের হিস্যা ২১ শতাংশ।

বাংলাদেশের হিস্যা ৯ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেলের (ওটেক্সা) সর্বশেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে শীর্ষ ১০ পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। মেক্সিকোর অবস্থান ষষ্ঠ।

শুল্ক লড়াই কোথায় গিয়ে ঠেকে, তা নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে একটা অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে। এ কারণে ক্রেতারা বিকল্প দেশ হিসেবে বাংলাদেশে নজর বাড়াবে বলেই মনে হয়। কারণ, তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ভিত্তি অনেক মজবুত। এটা বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই একটা বড় সুযোগ।

এ সুযোগ কতটা কাজে লাগানো যায়, সেটাই দেখার বিষয়। কারণ, হঠাৎ আবারও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির মতো নীতি সিদ্ধান্ত উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে। ব্র্যান্ড-ক্রেতারা এখনই এ বিষয়ে কৌশল নিচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশের সুযোগ হাতছাড়াও হতে পারে। সুবিধা চলে যেতে পারে প্রতিযোগী ভিয়েতনাম ও ভারতে।

অন্যদিকে কম শুল্ক–সুবিধায় বাংলাদেশি পণ্য ওই দেশগুলোতে দামে সাশ্রয়ী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া সরাসরি রপ্তানি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানোর সুযোগ ছাড়াও প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) আসবে বাংলাদেশে।

যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে বাংলাদেশের পণ্যে গড়ে সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্কারোপ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিতে কম হারের এ শুল্কসুবিধা নিতে চীন ও মেক্সিকোর উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগ বাড়াবেন।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমাপ্ত ২০২৪ ক্যালেন্ডার বছরে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ৭২০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে, যা বছরের মোট পোশাক রপ্তানির প্রায় ১৯ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে একসময় বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত বা জিএসপি সুবিধা পাওয়া যেত। অবশ্য তৈরি পোশাক এ সুবিধার আওতায় ছিল না।

২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসের পর আন্তর্জাতিক মানের শ্রম পরিবেশ না থাকার কারণ দেখিয়ে জিএসপি স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ। পোশাকশিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করা হয় এখন। এ সুবিধায় চীনাদের জন্য বাংলাদেশে বিনিয়োগ আরও সহজ হবে বলে মনে করেন উদ্যোক্তারা।

তবে এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে গেলে আমাদের ভাবতে হবে, আমাদের পক্ষে উৎপাদন কতটা বাড়ানো সম্ভব, সে ক্ষেত্রে আবার কী কী নতুন উপকরণ বা যন্ত্রপাতি প্রয়োজন। আমাদের শ্রমিকদের দক্ষতা এখানে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না তো? বর্তমান আইনশৃঙ্খলা ও জ্বালানি পরিস্থিতি কতটুকু সহায়ক হবে? নতুন উৎপাদন বা সক্ষমতা বৃদ্ধি কার্যক্রমের অর্থায়ন আসবে কোত্থেকে? অন্যদিকে আবার আমাদের প্রতিযোগী কিছু দেশ নতুন নতুন নীতিসহায়তা নিয়ে আসছে। তাই সুযোগ আর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদেরও আটঘাট বেঁধেই নামতে হবে।

মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

দুই বছরেও শেষ হয়নি ৩৭ মিটার সেতুর কাজ

ধর্মপাশা উপজেলা সদরের মধ্যবাজারে অবস্থিত মাত্র ৩৭ মিটার দৈর্ঘ্যের শয়তানখালী সেতুর পুনর্নির্মাণ কাজ দুই বছরেরও শেষ হয়নি। নির্মাণকাজে অবহেলা ও ধীরগতির কারণে ঠিকাদারের ওপর অসন্তুষ্ট থাকলেও এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। নির্ধারিত সময়ে সেতুটি নির্মাণ না হওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে প্রায় ১৫-২০টি গ্রামের মানুষকে। 

জানা যায়, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে অর্ধশত বছরের পুরোনো শয়তানখালী সেতুটি দেবে যেতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সেতুটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে। তখন সেতুটির ওপর দিয়ে পথচারী ও যান চলাচল বন্ধ করে দেয় প্রশাসন। দেবে যাওয়া পুরোনো সেতুর পরিবর্তে নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয় এলজিইডি। ২০২৩ সালে এলজিইডির হাওর এলাকায় উড়াল সড়ক ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় শয়তানখালী সেতু নির্মাণসহ ধর্মপাশা থানার সামনে থেকে বাহুটিয়াকান্দা পর্যন্ত ১ হাজার ৪০০ মিটার সড়ক ও একটি কালভার্ট নির্মাণের জন্য ৯ কোটি ৯৭ লাখ ৮০ হাজার ৪৮০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ কাজ বাস্তবায়নে সুনামগঞ্জের মাহবুব এন্টারপ্রাইজকে ঠিকাদার নিযুক্ত করে ওই বছরের ২৬ মার্চ কার্যাদেশ দেয় এলজিইডি। একই বছরের ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সেতু ও সড়ক নির্মাণের কাজ শেষ করার সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি। এ নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। কাজে ধীরগতির অভিযোগ এনে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ধর্মপাশা বাজারের ব্যবসায়ীরা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছেন। কিন্তু এতেও কোনো হেলদোল নেই ঠিকাদারের। ঠিকাদার আগের মতোই ধীরগতিতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।  

ধর্মপাশা বাজারের ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন বলেন, শয়তানখালী সেতুটি দ্রুত নির্মাণ না হওয়ায় মধ্যবাজারের ব্যবসায়ীরা ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। ব্যবসায় মন্দা দেখা দেওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন।

আরেক ব্যবসায়ী শামীম আহমেদ বলেন, শয়তানখালী সেতুটির কারণে দীর্ঘ চার বছর ধরে ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দ্রুত কাজ শেষ করা হলে মধ্যবাজারে ব্যবসায় গতি ফিরে আসবে।  

অভিযোগ প্রসঙ্গে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহবুব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবুল মহসিন মো. মাহবুবের ব্যক্তিগত নম্বরে একাধিকবার কল দেওয়া হলেও তিনি সাড়া দেননি। প্রকল্প সাইটে ঠিকাদারের নিযুক্ত ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, এটি রাজধানীর হাতিরঝিলের সেতুর আদলে তৈরি হচ্ছে। শুরুর দিকে মিস্ত্রি পাওয়া যাচ্ছিল না এবং গত বর্ষায় কাজ করতে না পারায় কাজ পিছিয়েছে। মাস দুয়েকের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করা যাবে বলে তিনি আশাবাদী।

উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী মোহাম্মদ শাহাব উদ্দিন বলেন, অত্যন্ত ধীরগতিতে সেতুটির নির্মাণকাজ চলতে থাকায় প্রকল্প পরিচালক কার্যাদেশ বাতিল করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নতুন ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়ার কারণে কাজটি আরও পিছিয়ে যেতে পারে– এমন ভাবনা থেকে তা করা হয়নি। তাই ঠিকাদারকে সতর্ক করে দিয়ে আগামী ২৫ জুনের মধ্যে সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করতে বলা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ না হলে কার্যাদেশ বাতিলের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করা হবে। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ