চুয়াডাঙ্গার জীবননগরের বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জৈব সার চুরির অভিযোগ উঠেছে দুই বিএনপি নেতার বিরুদ্ধে। উপজেলা পরিষদের বার্ষিক উন্নয়ন তহবিল ও এডিপি থেকে বরাদ্দ পাওয়া সারের মধ্যে ১২২ বস্তা পাচারের সময় আটক করেন স্থানীয় জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপি নেতাকর্মী। তাদের ভাষ্য, একই ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার ও সহসভাপতি খাদেমুল ইসলাম খোকন এই সার পাচারে জড়িত।

মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদ গুদাম থেকে পাচার হওয়া সার জীবননগর বাসস্ট্যান্ডে আটক করা হয়। পরে জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির নেতাকর্মী সারভর্তি পাওয়ার টিলার চালককে আটক করে ইউনিয়ন পরিষদ ঘেরাও করেন। তাদের সঙ্গে স্থানীয় জনতাও যোগ দেয়। পরে উত্তেজিত জনতা বিএনপির দুই নেতার বাড়িতে হামলা চালায়। 

পাওয়ারটিলারের চালক মুন্নার ভাষ্য, উথলী ইউনিয়নের আনারুল বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সার আনার জন্য তাঁর সঙ্গে ভাড়ার চুক্তি করেন। বাঁকা ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার ও সহসভাপতি খোকনের নির্দেশে তিনি গুদাম থেকে সার পাওয়ারটিলারে তোলেন। সার নিয়ে উথলী যাওয়ার পথে জামায়াতের লোকজন গাড়ি আটক করেন। জামায়াতের কর্মীরা আবার গাড়িটি ইউনিয়ন পরিষদে নিয়ে আসেন। এর বেশি কিছু জানেন না তিনি।

জানা গেছে, বাঁকা ইউনিয়ন পরিষদে বার্ষিক উন্নয়ন তহবিল ও এডিপির আওতায় বরাদ্দ দেয় উপজেলা প্রশাসন। ইউপি চেয়ারম্যানরা ওই টাকা থেকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে সার, সেলাই মেশিন ও কীটনাশক স্প্রে মেশিন বিতরণ করেন। ওই ইউনিয়নের সাধারণ কৃষকদের মধ্যে বিতরণের জন্য বরাদ্দ হয় ৬২২ বস্তা সার। সেখান থেকে ১২২ বস্তা জৈব সার মঙ্গলবার বিএনপির দুই নেতার নির্দেশে পাওয়ারটিলারে তোলা হয়। 

ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর আমির মফিজুর রহমান বলেন, সাধারণ কৃষকদের মধ্যে বিতরণের জন্য ৬২২ বস্তা জৈব সার পরিষদে আনা হয়। সন্ধ্যায় জানতে পারেন, পরিষদের গুদাম থেকে সার পাওয়ারটিলারে করে পাচার করা হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দলের কর্মীরা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল খালেককে নিয়ে জীবননগর বাসস্ট্যান্ড থেকে সারভর্তি পাওয়ার টিলার আটক করে। পরে পাওয়ারটিলারটি পরিষদে নেওয়া হয়। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এলাকাবাসী বলেন, ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার ও সহসভাপতি খোকন দীর্ঘদিন ধরে নানা অপকর্ম চালিয়ে আসছেন। দলীয় প্রভাব দেখিয়ে চাঁদা আদায়সহ জোর করে অনেকে জমি দখলেও তারা জড়িত। এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আবুল বাশার বলেন, আগের ইউপি চেয়ারম্যানের সময় এই সার কেনা হয়। এখন প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ায় নতুন কমিটি হয়েছে। তারাই এডিপির টাকায় কাজ করবেন। এ কারণে এই সার দোকান মালিকের কাছে ফেরত পাঠানো হচ্ছিল। দলীয় কোন্দলের জেরে ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল খালেক ও যুবদল নেতা রাজা তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করছেন দাবি করে বাশার বলেন, ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি নিজেই এই ঘটনায় জড়িত। 

অপর বিএনপি নেতা খাদেমুল ইসলাম খোকন সার চুরি করে বিক্রির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন। তাঁর ভাষ্য, ‘আমি প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হয়েছি। তারা আমার বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়েছে। বাড়িতে থাকা মা ও স্ত্রীকে মারধর করেছে।’

ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল খালেক বলেন, পরিষদের গুদাম থেকে চুরি করে পাচারের সময় সার আটক করেছেন। এর পেছনে ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবুল বাশার ও সহসভাপতি খোকনের নাম উঠে আসে। তাঁর দলে কখনও চোরের স্থান দেওয়া হবে না। যিনিই অন্যায় করবেন, তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। 

ইউনিয়ন পরিষদের সচিব মো.

আসাদুর রহমানের ভাষ্য, বিএনপি নেতা আবুল বাশার জোর করে ওই সার পরিষদের গুদামে নিয়ে আসেন। এর বেশি জানেন না। ইউপি প্রশাসকের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ জুয়েল শেখ জানান, আগের কমিটি ইতোমধ্যে বিলুপ্ত করা হয়েছে। সারের বিষয়টি পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত হলেও আনঅফিসিয়াল। অতীতে কেউ অপকর্ম করলে বর্তমান পরিষদ দায় নেবে না। মঙ্গলবারের ঘটনাটি তদন্ত করা হচ্ছে।

ওই সার ইউপির মাধ্যমেই কৃষকদের মধ্যে বিতরণের কথা জানিয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন জানান, এখানে উপজেলা কৃষি বিভাগের সম্পৃক্ততা নেই। বিষয়টি নজরে এসেছে উপজেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্বে থাকা ইউএনও মো. আল আমিনের। তিনি বলেন, ইউপি প্রশাসককে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন। 

চাল চুরিতে কৃষক লীগ নেতা

মঙ্গলবার রাতে পটুয়াখালীর দুমকীতে ওএমএসের  চাল পাচারের সময় অটোরিকশা থেকে ১১ বস্তা (৫৫০ কেজি) চাল আটক করেছে স্থানীয় লোকজন। এই চাল উপজেলার লেবুখালী ইউনিয়নের হতদরিদ্রদের মাঝে বিক্রির জন্য বরাদ্দ হয়েছিল। মঙ্গলবার রাতে লেবুখালীর পাগলার মোড় ইউনিভার্সিটি স্কয়ার থেকে চাল জব্দ করেন ইউএনও মো. শাহীন মাহমুদ। পরে রাতেই তিনি ডিলারের গুদাম সিলগালা করেন। 

ইউনিয়নের ডিলার খলিল শিকদারের ভাগনে উপজেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক জহির হাওলাদার এ ঘটনায় জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি বেশি দামে বিক্রির জন্য খলিলের গুদাম থেকে চাল স্থানীয় মালেক শিকদারের দোকানে পাঠাচ্ছিলেন বলে জানা গেছে। 

এ বিষয়ে জহির হাওলাদারের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর মামা ডিলার খলিল শিকদারের দাবি, তিনি এ ঘটনায় জড়িত নন। চালও তাঁর নয়। জহির খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ডিলার ছিলেন। তাঁর ডিলারশিপের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। তাই তাঁর (খলিল) গুদামে চাল রেখে ব্যবসা করেন। জহিরের কাছ থেকে তিনি গুদামের অর্ধেক ভাড়া নিয়ে ওএমএসের চাল রাখেন। তাঁর এক টন চাল এখনও গুদামে আছে। জহির নিজের চালই বিক্রি করেছেন।

ইউএনও শাহীন মাহমুদ বলেন, সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে ১১ বস্তা চাল জব্দ করেন। পরে ডিলারের গুদাম সিলগালা করেছেন। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ র জন য র সময় উপজ ল ব তরণ ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

২০০৭ ও ২০২৪ : সেনাবাহিনীর শান্তি রক্ষা কার্যক্রমই তুরুপের তাস

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক এখন টক অব দ্য টাউন। কারণ, তিনি একটি অনুষ্ঠানে তথ্যবোমা ফাটিয়েছেন। সম্প্রতি বিবিসির ‘হার্ডটক’ অনুষ্ঠানে সঞ্চালক স্টিফেন স্যাকার গাজা, সুদান, ইউক্রেনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি তুলে ধরে ফলকার টুর্কের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, আন্তর্জাতিক আইন ও মূল্যবোধ মেনে এসব পরিস্থিতি সমাধানে জাতিসংঘকে ক্ষমতাহীন মনে হচ্ছে। এর জবাবে বাংলাদেশের প্রসঙ্গ তুলে ফলকার টুর্ক বলেন, ‘আমি গত বছরের বাংলাদেশের উদাহরণ দিচ্ছি।

আপনি জানেন, জুলাই-আগস্টে সেখানে ছাত্রদের ব্যাপক বিক্ষোভ হয়।’ ‘বাংলাদেশে তখন শেখ হাসিনার সরকার ছাত্রদের আন্দোলন দমনে ব্যাপক নিপীড়ন চালিয়েছিল’—এ কথা উল্লেখ করে ফলকার টুর্ক বলেন, ‘আমরা কী বলি, আমরা কী করতে পারি এবং আমরা ওই পরিস্থিতি কীভাবে দেখি, সেটি নিয়ে তাদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। আমরা প্রকৃতপক্ষে সেনাবাহিনীকে সতর্ক করি—যদি তারা এতে জড়িত হয়, তার অর্থ হবে, তারা হয়তো আর শান্তিরক্ষী পাঠানোর দেশ থাকতে পারবে না। ফলে আমরা পরিবর্তন দেখলাম।’

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিক্ষোভের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনেও বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রতি সতর্কবার্তার ইঙ্গিত আছে। প্রতিবেদনটিতে নিয়মবহির্ভূত বলপ্রয়োগে সেনাবাহিনীর সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে ১৩৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের কারণে জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হতে পারে—এমন আশঙ্কা, যা বিক্ষোভ চলাকালে জাতিসংঘ বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিল। সেটি বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে সেনা কর্মকর্তাদের অনাগ্রহী করে তোলে।’ জাতিসংঘের নীতি অনুযায়ী, যাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনে যুক্ত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রয়েছে, সেসব প্রার্থীকে শান্তি রক্ষা বা জাতিসংঘের অন্য কোনো কার্যক্রমে রাখা হয় না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে অনুচ্ছেদটিতে। (সূত্র: ‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে সতর্ক করেছিল জাতিসংঘ, কতটা চাপ তৈরি করেছিল’, তোয়াহা ফারুক, বিবিসি নিউজ বাংলা, ৭ মার্চ ২০২৫) 

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে একটা বড় ধরনের ওলট-পালট ঘটে যায়। শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। হাসিনা গোপনে দেশ ছাড়েন। ওই সময় আসলে কী ঘটেছিল? 

ডেটলাইন ৫ আগস্ট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা ‘মার্চ ফর ঢাকা’ কর্মসূচি ২৪ ঘণ্টা এগিয়ে আনেন। চারদিক থেকে জনস্রোত ঢাকায় আসতে থাকে। তাদের লক্ষ্য ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো। ঠিক এ অবস্থায় দুপুরে টেলিভিশনের স্ক্রলে একটি খবর ভেসে ওঠে, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বেলা দুইটায় ভাষণ দেবেন। দেশে একটি ‘শক্তিশালী রাজনৈতিক সরকার’ থাকা অবস্থায় সেনাপ্রধান টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন, এটা ছিল অবাক করার মতো খবর। দেশে কি আরেকটি সামরিক অভ্যুত্থান হলো? ঘণ্টা দুয়েক পর তিনি টিভির পর্দায় এলেন। বললেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। সামরিক বাহিনী জনগণের জানমালের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে। যেহেতু সরকার বদলের প্রচলিত সাংবিধানিক ধারার ব্যতিক্রম ঘটিয়ে এটি ঘটল, জনমনে এ ধারণা হওয়া স্বাভাবিক যে আরেকটি ‘সামরিক অভ্যুত্থান’ হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থান হলে তো আন্দোলনের নেতারাই রেডিও-টিভির নিয়ন্ত্রণ নিতেন, তাঁরাই সেখানে ঘোষণা দিতেন, যেভাবে মেজররা ঘোষণা দিয়েছিলেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। 

সাধারণ মানুষ স্বস্তি পেয়েছিল। সেনাবাহিনীকে তারা সাধুবাদ জানিয়েছিল। সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার তখন রীতিমতো হিরো। কিন্তু ফলকার টুর্কের ফাঁস করা উক্তি শুনে মনে হতে পারে, সেনাপ্রধান স্বপ্রণোদিত হয়ে নয়, বরং চাপে পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। 

এটা ঠিক যে পালাবদলের একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। ১৬ বছরের দুঃশাসন, তিন-তিনটি তামাশার নির্বাচন, বছরের পর বছর ভিন্নমতাবলম্বীদের গ্রেপ্তার-গুম-হত্যা-নির্যাতন, পারিবারিক ফ্যাসিবাদ, লুটপাট করে দেশকে দেউলিয়া করা এবং শেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমন করতে সব ধরনের নৃশংসতা চালানো—এসবই ছিল পরিবর্তনের শর্ত, যা হাসিনা নিজেই তৈরি করেছিলেন। 

এ সময় সেনাবাহিনীর, বিশেষ করে জুনিয়র কর্মকর্তা এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদেরও মুখর হতে দেখা যায়। এটাকে সেনানেতৃত্বের উপেক্ষা করার উপায় ছিল না, যদিও এই নেতৃত্ব হাসিনারই তৈরি করা। হাসিনা ১৬ বছর শত অপকর্ম করেও টিকে ছিলেন আমলা, পুলিশ, র‍্যাব, ডিজিএফআইকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে। তাদের সঙ্গে জুটেছিল তাঁর আত্মীয়স্বজন, একপাল স্তাবক সাংবাদিক, শিল্পী, লেখক ও বুদ্ধিজীবী। নির্বাচনের মাধ্যমে এই সরকার পরিবর্তনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। ফলে অভ্যুত্থান ছাড়া বিকল্প ছিল না। 

৫ থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সরকার বলতে ছিল সামরিক বাহিনী আর রাজপথ ছিল ছাত্রদের দখলে। ওই সময় যা যা ঘটেছে, তার দায়দায়িত্ব সবই বর্তায় সেনাবাহিনীর ওপর। এটাই সত্য যে শেখ হাসিনা শত অপরাধ সত্ত্বেও সেফ এক্সিট পেয়েছিলেন। তাঁর কুখ্যাত সহযোগীদের অল্প কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও অন্যরা থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। অনেকেই পালিয়ে বিদেশে চলে যান। এ নিয়ে জনমনে ক্ষোভ রয়েছে। অভিযোগ আছে বড় অঙ্কের অর্থের লেনদেনের। 

যখন পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি ও গোয়েন্দা দিয়ে আন্দোলন দমানো যাচ্ছিল না, যখন দেখা গেল—‘গুলি করি, মরে একটা, আহত হয় একটা। একটাই যায় স্যার, বাকিডি যায় না ’—এ পর্যায়ে সেনাবাহিনী শেখ হাসিনার নির্দেশ না মেনে ‘জনগণের পাশে’ থাকার কথা বলে। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে জাতিসংঘের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশে শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের বাহিনীগুলোর অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি হওয়ার পর থেকে লাভবান হয়েছে মিশনে অংশগ্রহণকারী বাহিনীগুলো ও তাদের সদস্যদের পরিবারগুলো। তাঁরা পালাক্রমে মিশনে যান। এক বছরে যে আয় করেন, তা তাঁরা ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করেন, জমি-বাড়ি-গাড়ি কেনেন। তাঁদের সংখ্যা কম নয়।

সেনানেতৃত্বের কোনো ভূমিকা বা সিদ্ধান্তের কারণে এ সুযোগ নষ্ট হয়ে গেলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাধারণ সৈনিকদের খেপে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এ দেশে সিপাহি বিদ্রোহের ইতিহাস আছে। সব ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্র নয়, বঞ্চনা আর ক্ষোভ থেকেও বিদ্রোহের সূত্রপাত হয়। এ পরিস্থিতিতে সেনানেতৃত্বের হাসিনার নির্দেশের বাইরে পা ফেলা ছাড়া বিকল্প ছিল না। হাসিনা একটা ভালো নির্বাচন দিয়ে গণরায় মেনে নিলে এ অবস্থার সৃষ্টি হতো না। তাঁর মধ্যে একটা গোঁয়ার্তুমি ছিল—আমার বাবা স্বাধীনতা দিয়েছে; এখন আমরা বংশপরম্পরায় এ দেশটা শাসন করব, লুটেপুটে খাব।

পরিবর্তনের শর্ত অভ্যন্তরীণভাবে তৈরি হয়েছিল। তার ওপর কাজ করেছে জাতিসংঘের সতর্কবার্তা। এটাকে হাসিনার সমর্থকেরা বলেন ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’। 

এমনটি আগেও ঘটেছিল একবার। এক-এগারোতে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নিয়েছিল। সেবারও জাতিসংঘের চিঠি ধন্বন্তরির কাজ করেছিল। প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘ গায়ে পড়ে খামাখা চিঠি দেবে কেন? ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ম্যানিপুলেট করে বিএনপি যেভাবে ছক কষেছিল, তার ফলে পূর্বঘোষিত ২২ জানুয়ারির (২০০৭) নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হতো। আওয়ামী লীগ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিল।

নিউইয়র্কের সদর দপ্তর থেকে ২০০৭ সালের ১০ জানুয়ারি পাঠানো জাতিসংঘের চিঠিতে বলা হয়েছিল: 

‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট তার নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বৈধতাকে ভীষণ রকম ঝুঁকিতে ফেলেছে।...দেশটির পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় জাতিসংঘ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং সংঘাত থেকে বিরত থাকার জন্য সব দলের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে। আমরা আশা করছি, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা অন্যরা সংযত আচরণ করবে এবং মানবাধিকারের প্রতি সম্মান দেখাবে। একটি সমসুযোগের পরিবেশ তৈরির জন্য জাতিসংঘ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে, যাতে দলগুলো নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় আস্থাশীল হওয়ার সুযোগ পায়। বর্তমান সংকট অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অর্জন ও আন্তর্জাতিক অবস্থানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে জাতিসংঘ উদ্বেগ জানাচ্ছে। একটা সমঝোতায় পৌঁছাতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।’ (সূত্র: মহিউদ্দিন আহমদ, এক-এগারো: বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮, প্রথমা প্রকাশন)

এক-এগারোর অভ্যুত্থানের কারণে বিএনপি খুব ক্ষুব্ধ এবং আওয়ামী লীগ ছিল খুবই খুশি। ২০২৪ সালের আগস্ট অভ্যুত্থানের কারণে আওয়ামী লীগ খুবই ক্ষুব্ধ এবং বিএনপি মহাখুশি। ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ বলেছিল, এক-এগারো হচ্ছে তাদের আন্দোলনের ফসল। ২০২৪ সালে এসে বিএনপি বলছে, আগস্ট অভ্যুত্থানে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। 

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়। তবে কখন হবে, বলা মুশকিল।

মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক

সম্পর্কিত নিবন্ধ