ছবি: তানভীর আহাম্মেদ
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
আমনে পাস হয়নি, বোরোতেও কি ফেল হবে
ভরা মৌসুমে চালের বাজারে আগুন নিয়ে গবেষণার শেষ নেই। বইয়ে পড়া নানা তত্ত্ব আর তথ্যের গুরুগম্ভীর আলোচনা যখন জমে উঠেছে, তখন পাশ থেকে আলী বাকের বললেন, ‘আসলে আমন ফেল—এটাই সত্যি, আমাগেরও কিনি খাওয়া লাগবি।’
আমরা বলছিলাম সিন্ডিকেটের কথা তো চাঁদাবাজির কথা, মজুতদার আর মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্যের কথা; আর সরকারের ব্যর্থতার কথা আছেই। সরকারের ব্যর্থতার বয়ান ছাড়া এখন কোনো আলোচনা জমে না।
মালয়েশিয়াফেরত আলী বাকের এখন মন–দিল দিয়ে চাষবাস করেন। বিদেশ যাওয়ার আগে তাঁর নাম ছিল বকর আলী। সেখান থেকে ঘোল খেয়ে ফেরত আসার পর এখন আলী বাকের। সে অন্য কাহিনি। মালয়েশিয়ার চক্করে জমিজিরাত হারিয়ে আলী বাকের এখন ‘কন্টাক্ট চাষি’।
ভাগ চাষি বা বর্গা চাষি বলে এখন আর কিছু নেই। ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল’ নীতিতে বছরের জন্য জমি ভাড়া নিয়ে ফসল ফলাতে হয়। আলী বাকের ১৫ বছর আগে যে জমি ৫ হাজার টাকায় নিতে পারতেন, এখন সে জমি রাখতে তাঁর লাগে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা।
আরও পড়ুনচাষিদের কি রাজু ভাস্কর্যে আসতে হবে০৯ জানুয়ারি ২০২৫কেউ বেশি দিলে তিনি আর পাবেন না পরের বছর। কাজেই ‘কন্টাক্ট চাষি’রা জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেন টাকা উশুল ফসল ফলানোর জন্য।
‘আপনার এলাকায় বন্যাবাদল ছিল না; তারপরও কেন ফেল মারল আমন?’—এ প্রশ্নে আলী বাকের একটু চটে যান, কিন্তু জবাব দেন মেজাজ ঠিক রেখে। কৌতুকের আশ্রয় নিয়ে বলেন, ‘তোমার কথায় উপদেষ্টা উপদেষ্টা গন্ধ পাচ্ছি গো।’
মনে পড়ল, গদিনশিন সংশ্লিষ্ট সচিব গত ডিসেম্বরে গদগদ হয়ে বলেছিলেন, ‘বন্যার প্রভাব বাদ দিয়ে বাকি এলাকায় আমাদের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ীই ফলন হয়েছে।’ আলী বাকেরের মনে আছে সে কথা।
আলী বাকের ঘূর্ণিঝড় দানোর কথা মনে করিয়ে দিলেন। সেই ঝড়ের পূর্বাভাস আর যথাযথ সতর্কীকরণের অভাবে উপকূলের চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল আমন উৎপাদনকারী মধ্য আর উত্তরাঞ্চলের এলাকাগুলোয়। আলী বাকের বললেন, ‘লাশ না ভাসলে তোমরা দুর্যোগ মাপতি পারো না। তোমাদের দুর্যোগের দাঁড়িপাল্লায় লাশ ছাড়া আর কিছু মাপা যায় না, তাই আমনের ক্ষতি দেখতি পাও না।’
দানোর সময় লালমনিরহাটে ছিলাম। চার থেকে পাঁচ দিনের টানা বৃষ্টিতে প্রায় ঘরবন্দী অবস্থার একঘেয়েমি কাটানোর জন্য বাইরে গেলে দেখা হয় চাষি শ্যামল রায়ের সঙ্গে। সদরের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের বানিয়াপাড়া গ্রামের শ্যামল জানিয়েছিলেন, আকাশ পরিষ্কার থাকায় জমিতে পাকা ধান কাটার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। হঠাৎ বৃষ্টি ও বাতাসের কারণে জমির পাকা ধানগুলো হেলে পড়েছে মাটিতে, এখন দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
আরও পড়ুনচালের দাম: গণৎকার না হয়ে হিসাবে বসুন২৭ জানুয়ারি ২০২৫আরেক চাষি বড়বাড়ি ইউনিয়নের আলী বলেছিলেন, মরা কার্তিকের এই ঝোড়ো বৃষ্টি তাঁদের জন্য যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। বৃষ্টি ও ঝোড়ো বাতাসের কারণে ইতিমধ্যে তাঁদের ধানখেতের চরম ক্ষতি হয়েছে।
প্রবীণ চাষি হাকিমুদ্দি বলেছিলেন, যেখানে প্রতি একর জমিতে ৬০ থেকে ৬৫ মণ ধান পাওয়ার কথা ছিল, সেখানে ধানের শিষগুলো মাটিতে হেলে যাওয়ার কারণে ৪০ থেকে ৪৫ মণের বেশি ধান পাওয়া যাবে না।
কয়েক মাস আগের পত্রিকা ঘাঁটলে সারা দেশে আমন–বিপর্যয়ের অনেক আলামত বা পূর্বাভাস মিলবে। এত কিছুর পরও বলা হচ্ছে, আমরা আমনে পাস করেছি। যেখানে টেনেটুনে পাস করেছে, সেখানে উৎপাদন খরচ আর আগের মতো নেই।
বরিশালসহ দেশের অনেক জায়গায় চাষিরা ধান কেনার সরকারি মূল্য বাড়ানোর জন্য সভা–সমাবেশ ও মানববন্ধন করছেন। তাঁদের দাবি, ধানের দাম মণপ্রতি দেড় হাজার টাকা নির্ধারণ করে সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান কেনা হোক।
সরকারি মহলের কথা, এবার ধানের ফলন পর্যাপ্ত হয়েছে। ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানও জোরেশোরে চলছে। তাতে কৃষকদের সাড়াও মিলছে। সে অনুযায়ী চালের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কথা নয়। তারপরও যদি হয়ে থাকে, তবে তা কৃত্রিমভাবে করা হচ্ছে। বোরোতে আরও ভালো করব। কিন্তু কীভাবে?
যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছে, তা অন্য কিছুর আভাস দিচ্ছে। গত কিছু দিনে পত্রিকার কিছু সংবাদ শিরোনাম ছিল এ রকম:
১. মৌসুমের শুরুতেই সেচসংকট: লক্ষ্মীপুরে ব্যাহত বোরো আবাদ
২. কুমিল্লায় গোমতীর চরে আবাদ হয়নি ১৫০০ হেক্টর জমি
৩. চাঁদপুরে বোরো মৌসুমের শুরুতেই মিলছে না পানি
৪. চাঁদপুরে এক দশকে আবাদি জমি কমেছে ১১ হাজার ৬৩৭ হেক্টর
৫. গভীর নলকূপে পানি নেই, বোরো নিয়ে সংকটে কৃষক
১৫ বছরের নামতা সব সময় গাইতে ভালো লাগে না, কিন্তু আগের ব্যবস্থাপনার একটা সুরাহা না করলে পদে পদে বিপদ আর তার অনিবার্য প্রভাব পড়বে আমাদের উৎপাদনব্যবস্থায়। আমরা জানি, নিশ্চিত ফসল বোরো সেচনির্ভর ফসল।
সিংহভাগ সেচব্যবস্থা চলে সমবায় উদ্যোগে নানা কিছিমের সমিতির মাধ্যমে। এগুলো সংগঠিত করতে, চালাতে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী স্থানীয় নেতৃত্বের আশীর্বাদ লাগে। অধিকাংশ আশীর্বাদদাতার হালহকিকত আগের মতো নেই। ইতিমধ্যেই ‘এবার আমরা খাব’ গোষ্ঠী বেরিয়ে পড়েছে যার যার ক্ষমতা অনুযায়ী।
বরেন্দ্র অঞ্চল
ক্ষমতার নতুন দাবিদারদের অনাচারের ক্ল্যাসিক উদাহরণ তৈরি হয় নওগাঁর মান্দা উপজেলায় গত ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়। বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকূপের ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেন চৌবাড়িয়া গ্রামের কয়েক ব্যক্তি।
গভীর নলকূপটির অপারেটর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘প্রায় ১০ বছর আগে উপজেলার দেবীপুর মৌজায় একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়। ওই সময় থেকে আমি অপারেটরের দায়িত্ব পালন করছি।’
ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের আবেদনে উপজেলা বিএমডিএর সহকারী প্রকৌশলী ‘জটিলতা নিরসন’ করে ওই নলকূপ চালু করার দাবি করলেও পরের দিন আবার নলকূপের ঘরে তালা ঝুলিয়ে দেন নব্য দাবিদারেরা।
এ রকম ঘটনা বরেন্দ্র এলাকা ছাড়াও আরও অনেক জায়গায় ঘটছে। চাঁদাবাজিও চলেছে সেচপাম্পকে ঘিরে। আগে এসব ‘ম্যানেজ’ করতেন ‘নির্বাচিত’ স্থানীয় সরকারের চেয়ারম্যান–মেম্বররা। এখন তাঁরাও ‘ভাও’ বুঝতে পারছেন না। অনেকেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কিন্তু চাষবাস সংস্কার পর্যন্ত বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। তাই ‘নতুন অভিভাবকদের’ চাপ বাড়ছে।
লক্ষ্মীপুর
জেলায় ১১টি গভীর নলকূপ, ২ হাজার ৬১৪টি অগভীর নলকূপ ও ২ হাজার ৬৩৯ ‘লো-লিট’ সেচপাম্প রয়েছে। চলতি মৌসুমে জেলায় ৩৫ হাজার ৮৬০ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড, উফশী ও স্থানীয় জাতের বোরো চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৭৪৭ টন।
আশা ছিল, বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারি ব্যবস্থাপনা ও নজরদারি একটু বাড়াবে। উপদ্রুত এলাকায় ছোটাছুটি করে কৃষিকে আবার তার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। আমারা জানি, লক্ষ্মীপুর ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ এক জেলা। সেখানে সেচসংকটে বোরো আবাদের অর্ধেকের বেশি জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে।
মোনহরপুর কৃষি সমবায় সমিতি, দত্তপাড়া কৃষি সমবায় সমিতি, চরচামিতা, উত্তর জয়পুরসহ বেশ কয়েকটি কৃষি সমবায় সমিতির এখন ‘এতিম দশা’। এসব সমিতির আওতায় গভীর নলকূপ ও খালভিত্তিক সেচ প্রকল্পগুলো এখন অকেজো। এ কারণে ব্যাহত হচ্ছে বোরো আবাদ।
লক্ষ্মীপুর সদরের চন্দ্রগঞ্জ ইউনিয়নের পূর্ব পাঁচপাড়া কৃষক সমবায় সমিতির পদ্মা, মেঘনা ও সুরমা নামে তিনটি গভীর নলকূপ অনেক দিন ধরেই অকেজো। পাম্পগুলোর গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ নাকি চুরি হয়ে গেছে। নলকূপ তিনটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ওই গ্রামের শত শত কৃষক ধান চাষের জন্য খালের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এবার সময়মতো সেচের পানি না পাওয়ায় চার শতাধিক একর জমিতে বোরো আবাদ হয়নি এখনো।
চাষিরা জানালেন, নলকূপ তিনটি পুনরায় চালু করতে বারবার কেন্দ্রীয় সমিতির কার্যালয়ে ধরনা দিয়েও কাজ হয়নি। খালগুলো দ্রুত সংস্কার ও সেচ প্রকল্পগুলো পুনরায় চালু করা গেলে বোরো আবাদসহ কৃষি উৎপাদনে এ অঞ্চল আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।
কুমিল্লা
আখতার হামিদ খানের সময় থেকেই কুমিল্লার চাষিরা অনেক সংগঠিত–সোচ্চার। কিন্তু রাজনৈতিক শূন্যতায় তাঁরাও এখন দিশাহারা। শীতের শুরুতেই কুমিল্লার ইটভাটাগুলো যেখান থেকে পেরেছে ফসলের জান হিসেবে বিবেচ্য ‘টপ সয়েল’ নিয়ে আসা শুরু করে। এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে গোমতীর চরাঞ্চলের কৃষিজমি। এ কারণে চরের প্রায় দেড় হাজার হেক্টর জমিতে ফসল আবাদ হয়নি।
নদীর মাটিও কেটে নেওয়া হচ্ছে। এতে হুমকির মুখে পড়েছে বাঁধ, সড়ক ও বেশকিছু সেতু। চাষিরা মাটি কাটা বন্ধে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে দিয়েছেন স্মারকলিপি। এরপরও বন্ধ হয়নি মাটি কাটা।
চাঁদপুর
বোরো মৌসুমে সেচসুবিধা নিশ্চিত করতে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলায় নির্মাণ করা হয় মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প। ১টি পৌরসভা ও ১৪টি ইউনিয়নের ১৩ হাজার ৬০২ হেক্টর জমি রয়েছে প্রকল্পের আওতায়। তবে বোরো মৌসুম শুরু হলেও সেচসুবিধা পাচ্ছেন না কৃষকেরা। চারার বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে। সঠিক সময়ে চারা রোপণ করতে না পারলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা দেখা দেবে।
বোরোর অশনিসংকেতের তালিকা আরও অনেক বিস্তৃত ও ব্যাপক। এলাকা থেকে এলাকায় তার ভিন্নতাও আছে। তবে দিনের শেষে ফলাফল—ফসলের ঘাটতি, চাষির সর্বনাশ।
জনপ্রতিনিধি আর নেতৃত্বের শূন্যস্থান দক্ষতার সঙ্গে পূরণ করতে হবে ‘সবেধন নীলমণি’ স্থানীয় প্রশাসনকে। তবে তাদের দরকার সুস্পষ্ট নির্দেশনা আর কেন্দ্রের নিয়মিত তদারকি। চাষির জান আর জমির ধান নিয়ে কোনো ছাড় নয়।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
[email protected]