নির্বাচনী প্রচারণায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ‍যুদ্ধ করতে যাচ্ছেন না, যুদ্ধ বন্ধ করতে যাচ্ছেন। তাঁকে ভোট দিয়েছিলেন মুসলিমসহ আরব মার্কিনিরা। শপথের আগেই দূতিয়ালি করে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকরে সফল হন। কিন্তু এবার তিনি যা বললেন, তা ছিল নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘাঁ’র মতো। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ওয়াশিংটনে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প জানান, তিনি গাজা দখল করতে চান এবং সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক সরিয়ে দেবেন। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাম্পের আগে আর কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন ইস্যুতে এভাবে একপক্ষীয় অবস্থান নেননি। তীব্র সমালোচনা করে অনেকে এটাকে ট্রাম্পের আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন ও ‘আকাশকুসুম কল্পনা’ বলেও বর্ণনা করছেন। ট্রাম্প যখন নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠক করছিলেন, তখন হোয়াইট হাউসের বাইরে অবস্থান নিয়ে শত শত বিক্ষোভকারী স্লোগান তোলেন, ‘ফিলিস্তিন বিক্রির জন্য নয়’। তারা ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের দাবি জানান ও ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।

বিক্ষোভকারীদের একজন মাইকেল সার্জার বলেন, মার্কিনিরা চান না তাদের করের টাকায় ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হোক। আলজাজিরাকে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনের মানুষ কোথাও যাচ্ছে না। তারা ওই ভূখণ্ডের আদিবাসী। লোকজনকে জোর করে সরিয়ে দেওয়াটা দখলদারি মানসিকতা। বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন ইরানি বংশদ্ভূত মার্কিনি সোফিয়া আহমেদও। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে দিতে ট্রাম্পের পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনা করেন তিনি। সোফিয়া বলেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) একজন ফ্যাসিস্ট, সাইকোপ্যাথ ও তীব্র আত্মপ্রেমী।’ এ সময় তিনি নেতানিয়াহুকে ‘গণহত্যার মূল স্থপতি’ বলে বর্ণনা করেন। 

কয়েকদিন ধরে গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছেন ট্রাম্প। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় হোয়াইট হাউসে নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে ট্রাম্প আরও একধাপ এগিয়ে বলেন, তিনি গাজা দখল করবেন। সেখানে থাকা ফিলিস্তিনিদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে চলে যেতে বলেন তিনি। ট্রাম্প বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র গাজা উপত্যকার দখল নেবে; আমরা এটিকে নিয়ে কাজও করব। আমরা এটির মালিক হব এবং সেখান থেকে সব বিপজ্জনক অবিস্ফোরিত বোমা ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করার দায়দায়িত্ব নেব।’

ট্রাম্প বলেন, ‘যদি প্রয়োজন হয়, আমরা এটা করব। আমরা ভূখণ্ডটির দখল নিতে যাচ্ছি। আমরা এটির উন্নয়ন করতে চলেছি। এখানে হাজার হাজার কাজের সুযোগ তৈরি হবে। এটা এমন কিছু হবে, যার জন্য পুরো মধ্যপ্রাচ্য অনেক গর্বিত হবে।’ এ সময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, তাহলে সেখানে থাকবে কে? তখন ট্রাম্প বলেন, জায়গাটিকে উন্নত করা হবে এবং বিশ্ববাসী সেখানে থাকবেন।

ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছেন গাজার বাসিন্দারা। গাজা সিটির বাসিন্দা ৬৫ বছরের উম তামের রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা আমাদের মাটি ছাড়ব না; আমরা দ্বিতীয় নাকবা চাই না।’ তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প একটা উন্মাদ। কোনো বোমা বা অনাহারের কারণে আমরা গাজা ছাড়ব না।’ আরেক বাসিন্দা সামির আবু বাসেল বলেন, ‘নিজের পরিকল্পনা, অর্থ আর বিশ্বাস নিয়ে ট্রাম্প জাহান্নামে যেতে পারেন, আমরা কোথাও যাচ্ছি না।’ এক ফিলিস্তিনি নারী বিবিসিকে বলেন, ‘গাজা আমাদের মাতৃভূমি; আমরা এখানে বাঁচব ও মরব। আমরা প্রায় দেড় বছর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ মোকাবিলা করেছি; বলতে গেলে এখনও করছি। কিন্তু কখন এমনটা ভাবিনি।’ 

একটি জনগোষ্ঠীকে তার নিজ ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত করে অন্যায়ভাবে তা দখলের এ পরিকল্পনায় নিন্দার ঝড় উঠেছে বিশ্বব্যাপী। এরই মধ্যে ফিলিস্তিন, মিসর, সৌদি আরব ও অন্যান্য দেশ এর নিন্দা জানিয়েছে। বুধবার কায়রোতে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মোহামেদ মুস্তফার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মিসরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদেল আতি। এ সময় তারা ট্রাম্পের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেন। দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসও। আর হামাস বলেছে, এটা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শত্রুভাবাপন্ন বক্তব্য, যা আগুনে তেল ঢালার মতো কাজ করবে। এমন বক্তব্য এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনবে না। হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা সামি আবু জহরি বলেন, গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরানোর আহ্বান হলো জাতিগত নিধন চালানোর শামিল। ট্রাম্পের পরিকল্পনা অবাস্তব ও হাস্যকর। ইরান বলেছে, তারা এ পরিকল্পনা সমর্থন করেন না। 

ট্রাম্পের পরিকল্পনার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া বলেছে, পশ্চিম তীর দখল ও গাজার মানুষকে সরিয়ে দেওয়া ইসরায়েলের পরিকল্পনা। সংঘবদ্ধ শাস্তি দেওয়ার পদ্ধতিকে রাশিয়া সমর্থন করে না। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গাজা থেকে জোরপূর্বক বাসিন্দাদের সরানোর পরিকল্পনার বিরোধিতার কথা জানিয়ে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের কথা বলেছে। তুরস্ক এটাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলে বর্ণনা করেছে। জার্মানি বলেছে, গাজা ফিলিস্তিনের মানুষের। তাদের সরানো হবে অগ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক আইনবিরোধী। এ ছাড়া ফ্রান্স, স্পেন, আয়ারল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া ট্রাম্পের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছে।

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার আবারও দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের বিষয়ে বলেছেন এবং ট্রাম্পের সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে জানিয়েছেন। ট্রাম্পের বক্তব্যে যুদ্ধবিরতি ব্যাহত হতে পারে বলে যে শঙ্কা করা হচ্ছে, সেটাও তিনি উড়িয়ে দিয়েছেন। ফিলিস্তিনের জাতিসংঘের বিশেষ ‌র‍্যাপোর্টার ফ্রান্সিসেসকা আলবানিজ বলেছেন, ট্রাম্পের পরিকল্পনা ‘বেআইনি, অনৈতিক ও একেবারেই দায়িত্বজ্ঞানহীন।’ ট্রাম্প ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ’ করার পরামর্শ দিচ্ছেন। 

ইসরায়েলের অনেক বাসিন্দা ট্রাম্পের পরিকল্পনার সমর্থন করছেন না। নেটিভ হাসারার বাসিন্দা হিলা ফ্যানলন বলেন, এটা কোনো সমাধান নয়। নিজ দল রিপাবলিকান পার্টির ভেতরেও এ নিয়ে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া রয়েছে। সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম বলেন, গাজার সম্ভাব্য দখল হবে বিপজ্জনক। যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই এ বিষয়ে তার আরব মিত্রদের বক্তব্য শুনতে হবে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল র দখল

এছাড়াও পড়ুন:

আকুর ১৭৫ কোটি ডলার পরিশোধ, কমল রিজার্ভ

এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) জানুয়া‌রি ও ফেব্রুয়ারি মাসের আমদানি বিল বাবদ ১৭৫ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে এসেছে।  

রবিবার (৯ মার্চ) বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

বাংলা‌দেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আকুর বিল পরিশোধের পর দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ২৫ বিলিয়ন ডলার নেমে এসেছে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিপিএম-৬ গণনার মান অনুযায়ী রিজার্ভ এখন ১৯ দশ‌মিক ৭০ বিলিয়ন ডলার।

এর আগে ৬ মার্চ বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ২৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। আর বিপিএম-৬ ছিল ২১ দশ‌মিক ৪০ বিলিয়ন ডলার।
 
আকু কী?

আকু হলো একটি আন্তঃদেশীয় লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার লেনদেনের দায় পরিশোধ করা হয়। ইরানের রাজধানী তেহরানে আকুর সদর দপ্তর। এ ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি দুই মাস অন্তর আমদানির অর্থ পরিশোধ করে। তবে এখন আকুর সদস্য পদ নেই শ্রীলঙ্কার। অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আমদানি ব্যয় পরিশোধের বিভিন্ন শর্ত পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় দেশটির আকু সদস্যপদ সাময়িক স্থগিত করা হয়েছে।

জাতিসংঘের এশিয়া অঞ্চলের অর্থনীতি ও সামাজিক কমিশনের (এসক্যাপ) ভৌগোলিক সীমারেখায় অবস্থিত সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর জন্য আকুর সদস্য পদ উন্মুক্ত।

ঢাকা/এনএফ/এনএইচ

সম্পর্কিত নিবন্ধ