নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চলতি দায়িত্বপ্রাপ্ত চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (সিএনএস) ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতির মাধ্যমে বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাট, জমিসহ সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি।
গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিনের দুর্নীতি-অনিয়ম বিষয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও নৌপরিবহন অধিদপ্তর, এমনকি দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) বহু আগে তদন্ত করেছিল। কিন্তু ‘গোপালগঞ্জ পরিচয়’ এবং পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতাদের প্রভাবে বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন তিনি। জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলেনের বিরুদ্ধে বিতর্কিত ভূমিকা পালনের অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।
গিয়াসের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে লিখিত নির্দেশ দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। দুর্নীতিবাজ এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভুক্তভোগীদের আন্দোলনের বিষয় ও লিখিত অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে গত ২২ জানুয়ারি এই নির্দেশ দেওয়া হয়। এমন নির্দেশে নড়েচড়ে বসেছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও।
নিয়োগেই গলদ
গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বিদেশি জাহাজের চাকরি ছেড়ে ২০১২ সালে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার অ্যান্ড এক্সামিনার পদে নিয়োগ পান। পর্যায়ক্রমে কন্ট্রোলার অব এডুকেশন ও প্রিন্সিপাল অফিসার এবং সর্বশেষ চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ারের (চলতি) দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগের সময় প্রয়োজনীয় যোগ্যতা না থাকলেও জাল অভিজ্ঞতার সনদ জমা দেন গিয়াস। এমন অনিয়মের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০১৪ সালে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। তবে ‘গোপালগঞ্জ’ পরিচয়ের পাশাপাশি গিয়াসের টাকা ও ক্ষমতার দাপটে সেই তদন্ত রিপোর্ট আর আলোর মুখ দেখেনি।
সনদ প্রদানে দুর্নীতি
সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকদের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ধারাবাহিক অব্যাহতিপত্র (কন্টিনিউয়াস ডিসচার্জ সার্টিফিকেট-সিডিসি) প্রদান নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে গিয়াস ও তাঁর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ২০২৩ সালে অযোগ্য ও অদক্ষ নাবিকদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৮-১০ লাখ টাকা নিয়ে আরামবাগ প্রেসে ছাপানো নকল ‘পানামা সিডিসি’র অনুকূলে ১২৭টি বাংলাদেশি সিডিসি প্রদান করে এই সিন্ডিকেট। এতে ১২ কোটি ৭০ লাখ টাকা অবৈধ আয় হয় তাদের।
সরকারি-বেসরকারি মেরিটাইম প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নীতিমালা ভঙ্গ করে অধিদপ্তরের অনুমোদনবিহীন ‘প্রি-সি স্পেশাল রেটিং কোর্স’ চালু এবং ২০০ জনকে সিডিসি প্রদানের জন্য নির্বাচিত করাসহ জনপ্রতি ৫ লাখ টাকা করে ১০০ কোটি টাকা অগ্রিম গ্রহণের অভিযোগও রয়েছে গিয়াসের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে দুটি মামলা আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মেরিটাইম আইনের লঙ্ঘন ও জালিয়াতির মাধ্যমে গিয়াস অবৈধভাবে ইন্দোনেশিয়া, পানামা, ফিলিপাইন ও মালয়েশিয়ার নেভিগেশন সার্টিফিকেট দিয়েছেন। এতে এসব দেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে।
নিয়োগ পরীক্ষায় অনিয়ম
গিয়াস উদ্দিন অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ, কোস্টাল, ফিশারিজ ও বিদেশগামী জাহাজের বিভিন্ন গ্রেডের মাস্টারসহ অন্যান্য ডেকের নাবিকদের লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় অনিয়ম করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দালাল চক্রের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ প্রার্থীদের কাছে এসব পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ও তাদের পাস করিয়ে কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন তিনি।
এদিকে, দ্বিতীয় শ্রেণির মাস্টারশিপ পরীক্ষায় অবৈধ অর্থ লেনদেনের অভিযোগে গিয়াসসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে গত বছরের অক্টোবরে তদন্ত শুরু করেছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। তাদের বিরুদ্ধে গত বছরের ৬ জুন অনুষ্ঠিত ওই পরীক্ষায় সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ২২ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ আনা হয়েছে।
গিয়াসের যত সম্পদ
ঢাকা মহানগরীতে ১০টি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের মালিক গিয়াস উদ্দিন। এর মধ্যে রাজধানীর ধানমন্ডি ২৭ নম্বর (নতুন ১৬ নম্বর) রোডের ইস্টার্ন ডালিয়ার এ/৪ নম্বর ফ্ল্যাটে বসবাস করেন তিনি। ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের এই ফ্ল্যাটের বাজারমূল্য ৫ কোটি টাকা।
তাঁর মালিকানাধীন অন্য ফ্ল্যাটগুলো হচ্ছে– ধানমন্ডি ৭/এ নম্বর রোডের বিশ্বাস ক্রিডেন্সে (বাড়ি নম্বর ৬৭) ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা মূল্যের ৩ হাজার ৬০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নম্বর ডি/৪); ধানমন্ডি ৭ নম্বর রোডের রেজাস ড্রিমে (হাউস নম্বর ৩১) ৫ কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (ফ্ল্যাট নম্বর সি/৩); ধানমন্ডি ৬ নম্বর রোডের (মিরপুর রোড) মীর অনিকা ইয়াকুব কমার্শিয়াল টাওয়ার (হাউস নম্বর ১৭) দ্বিতীয় তলায় ৫ কোটি ৫০ লাখ টাকা মূল্যের ফ্ল্যাট; খিলগাঁও প্রধান সড়কসংলগ্ন র্যাংগস ভবনে ৫ কোটি টাকা মূল্যের ২ হাজার ৫০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (নম্বর এ/৮, এ/৯); উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরের ৬ নম্বর রোডে স্বপ্নধারা হাউজিংয়ে (বাসা নম্বর ৪৬/৩) ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা মূল্যের ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট; একই রোডের ইস্টার্ন হাউজিংয়ে (বাসা নম্বর এ/৭) ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মূল্যের ২ হাজার ২০০ বর্গফুট ফ্ল্যাট; উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর রোডের জিবিডিএল পার্কে (বাসা নম্বর ৪৬/৩) ২ কোটি ৮৮ লাখ টাকা মূল্যের ২ হাজার ৪০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট; উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ডোমিনো-এ (বাসা নম্বর ডি/৮) ১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা মূল্যের ১ হাজার ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট এবং মিরপুর ডিওএইচএসের ৬ নম্বর রোডে ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা মূল্যের ২ হাজার ২০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট (বাসা নম্বর এ/৩)।
এদিকে, ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ব্লক-ই-তে পাঁচ কাঠা এবং গাজীপুরের পুবাইলের পূর্বাচল মেরিন সিটিতে পাঁচ কাঠা করে দুটি প্লট রয়েছে গিয়াসের।
সমকালের অনুসন্ধানকালে ফ্ল্যাটগুলোর বেশির ভাগে গিয়ে কারও বক্তব্য নেওয়া যায়নি। নিরাপত্তারক্ষী ও ফ্ল্যাটগুলোর বাসিন্দারা মুখ খুলতে রাজি হননি।
নিজ গ্রাম গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের লোহাইড়ে বাড়িতে পৈতৃক ভবনের পাশে অত্যাধুনিক ডুপ্লেক্স বাড়ি তৈরি করেছেন গিয়াস। চাকরি শুরুর আগেও সেখানে গিয়াসের পরিবারের তিন বিঘা জমি ছিল। এখন বেড়ে সেটা কয়েক হাজার বিঘায় দাঁড়িয়েছে।
পাঁচটি আধুনিক মডেলের গাড়ি ব্যবহার করেন গিয়াস। এর মধ্যে একটি ব্ল্যাক প্রিমিও ও দুটি এক্স করোলা ব্র্যান্ডের প্রাইভেটকার এবং দুটি সর্বশেষ মডেলের নোয়া মাইক্রোবাস। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে বেসরকারি ওশান মেরিটাইম একাডেমিতে গিয়াসের স্ত্রী সাজেদা আহমেদের মালিকানা আছে। জালিয়াতির দায়ে সিআইডি পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে বন্ধ হওয়া ওজিমা নামের আরেকটি মেরিন একাডেমির কাগজপত্রে গিয়াসের ৫১ শতাংশ মালিকানা রয়েছে। গিয়াসের প্রভাব খাটিয়ে তাঁর বড় শ্যালক মোখলেছুর রহমান লিটন ঢালী বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ধানমন্ডিতে ‘ভূতের আড্ডা’ নামে রেস্তোরাঁ আছে লিটনের।
সূত্র জানায়, গিয়াস ও তাঁর স্ত্রী সাজেদার নামে ১৩টি ব্যাংক হিসাব রয়েছে। এসব হিসাবের মাধ্যমে অবৈধ লেনদেন হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। গিয়াসের নামে থাকা হিসাবগুলো ইসলামী ব্যাংক লোকাল অফিস, ঢাকা; ব্র্যাক ব্যাংক, দিলকুশা শাখা; আইএফআইসি ব্যাংক, মতিঝিল শাখা; ন্যাশনাল ব্যাংক দিলকুশা শাখা; সোনালী ব্যাংক প্রধান কার্যালয় এবং যমুনা ব্যাংক, ধানমন্ডি ও দিলকুশা শাখা এবং ওয়ান ব্যাংক, ধানমন্ডি শাখায় রয়েছে। সাজেদার নামে সোনালী ব্যাংক কাকরাইল; প্রিমিয়ার ব্যাংক ধানমন্ডি; ডাচ্-বাংলা ব্যাংক ধানমন্ডি; উত্তরা ব্যাংক, ধানমন্ডি ও আইএফআইসি ব্যাংক, ধানমন্ডি শাখায় প্রচুর অবৈধ টাকা জমা রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
কাদের সহযোগিতায় অনিয়ম-দুর্নীতি
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী খরচ বাবদ গিয়াস তাঁর এলাকার সাবেক এমপি ও সাবেক মন্ত্রী লে.
সাবেক এই দুই মন্ত্রীর প্রচ্ছন্ন আশীর্বাদ ছিল গিয়াসের প্রতি। তাঁর অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে দুর্নীতি-অনিয়মে আরও সহযোগিতা করেন সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, মাগুরার সাবেক এমপি সাইফুজ্জামান শেখর, গিয়াসের নিকটাত্মীয় ও পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত আইজি মনিরুল ইসলাম, মনিরুলের স্ত্রী ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব শায়লা ফারজানা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কেন্দ্রিক গোপালগঞ্জ গ্রুপটি। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ছত্রছায়ায় থেকে দুর্নীতি করায় গিয়াসের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে সাহস পাননি।
অভিযোগ উঠেছে, জুলাই-আগস্ট গণআন্দোলনকালে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমর্থকদের হুমকি দেন গিয়াস। আন্দোলন দমনে ৫০ লাখ টাকা প্রদানসহ গোপালগঞ্জ থেকে সন্ত্রাসী বাহিনীকে ঢাকায় এনে তাঁর ফ্ল্যাটে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেন তিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির হোয়াটসআপ গ্রুপের সদস্য হয়েও বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেন।
গত ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর এসব প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সবাই আত্মগোপনে থাকায় কারও বক্তব্য জানা যায়নি। তবে বিভিন্ন সময় গিয়াসের পক্ষে দেওয়া একাধিক সাবেক মন্ত্রী-এমপির লিখিত পত্র ও সুপারিশে তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের প্রমাণ মেলে।
দুদকের তদন্ত বাধাগ্রস্ত
২০১৮ সালের অক্টোবরে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগে গিয়াসের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছিল দুদক। সেই তদন্ত শেষ পর্যন্ত ধামাচাপা পড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করার অভিযোগ ওঠে গিয়াসের বিরুদ্ধে। সেখানেও তাঁকে ‘গোপালগঞ্জ’ পরিচয় বিশেষ সুবিধা এনে দেয়।
অভিযোগ রয়েছে, সেই সময় দুদকে জমা দেওয়া সম্পদের হিসাবে তাঁর পূর্বতন কর্মস্থল বিদেশি জাহাজ থেকে আয়ের অঙ্কের শেষে একটি অতিরিক্ত শূন্য যুক্ত করে অবৈধ পথে অর্জিত সম্পদ হালাল করার চেষ্টা করেন গিয়াস। জাহাজের তৃতীয় কর্মকর্তা হিসেবে তাঁর মাসিক বেতন ছিল ৩ হাজার ডলার। কিন্তু ৩০ হাজার ডলার ঘোষণা দিয়ে দুদকে কাগজপত্র জমা দেন, যা দুদকের অনুসন্ধানে বের হয়ে এলেও এ বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ওই সময়ের দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের সবাই অবসরে যাওয়ায় তাদের বক্তব্য জানা যায়নি।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের নির্দেশ
গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রেক্ষাপটে গিয়াসের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নামেন। বৈষম্যবিরোধী নাবিক আন্দোলনের ব্যানারে নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন এবং সংবাদ সম্মেলন করে প্রভাবশালী এই কর্মকর্তার অনিয়মের বিচার চেয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
এ ছাড়া তাঁর দুর্নীতি-অনিয়মের ফিরিস্তি তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং সংশ্লিষ্ট একাধিক উপদেষ্টাসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়কের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ইফতেখার আহমেদ নামের একজন ভুক্তভোগী। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে গত ২২ জানুয়ারি এক চিঠিতে গিয়াসের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম বলেন, ‘গিয়াস উদ্দিনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ বিষয়ে অবহিত হয়েছি। বিষয়টিতে আমাদের ডিপার্টমেন্টের সম্পৃক্ততা কতটুকু, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
যা বললেন গিয়াস উদ্দিন
নৌপরিবহন অধিদপ্তরের চিফ নটিক্যাল সার্ভেয়ার (চলতি দায়িত্ব) ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সমকালকে তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে আমার নিয়োগে অনিয়মের অভিযোগ বিষয়ে দুদক ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় থেকে তিনটি তদন্ত হয়েছে। এ বিষয়ে আমার কোনো মতামত নেই।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার যা সম্পদ আছে, তার সব হিসাবই দুদকে দেওয়া আছে। এর বাইরে কোথাও আমার এক পয়সার কোনো সম্পদ নেই।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ৫০ ল খ ট ক গ প লগঞ জ পর ক ষ য় ধ নমন ড কর ছ ন আহম দ সরক র তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
জলে-স্থলে মূর্তিমান আতঙ্ক
মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদীতে দীর্ঘদিন ধরে সংঘটিত বহু অপরাধের নেতৃত্ব দিয়েছে কানা জহির। তার বিরুদ্ধে হত্যাসহ অনেক মামলা থাকলেও তাকে গ্রেপ্তারে তৎপরতা না থাকায় নদী ও স্থল পথে জহির এখন মূর্তিমান আতঙ্ক।
বালুবাহী বাল্কহেড থেকে বিট তোলার মধ্য দিয়ে উত্থান নৌ-ডাকাত জহিরুল ইসলাম ওরফে কানা জহিরের। মূলত নৌ-ডাকাত বাবলা নিহত হওয়ার পর বেপরোয়া হয়ে ওঠে কানা জহির। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার রাতে প্রতিপক্ষের সঙ্গে গোলাগুলিতে লিপ্ত হয় জহির ও তার সহযোগীরা। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রিফাত ও রাসেল ফকির নামের দু’জন। এ ঘটনার পাঁচ দিন পর গত মঙ্গলবার কানা জহিরকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়েছে।
জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার আধারা ইউনিয়নের কালিরচর গ্রামের মাহমুদ মিয়ার ছেলে জহির ইসলাম। জন্ম থেকে তার ডান চোখ কানা হওয়ায় সবাই তাকে কানা জহির নামে চিনে। গজারিয়া, বেলতলী, চর আবদুল্লাপুর ও মোহনপুর পুলিশ ফাঁড়ির আশপাশে চলে তার সব অপকর্ম। মাদক বেচাকেনা, চাঁদাবাজি, চুরি-ডাকাতি ও মেঘনা নদীতে রাতে অবৈধভাবে বালু তোলাসহ নানান অপকর্ম চালাচ্ছে জহির।
জানা গেছে, কানা জহিরের ভয়ংকর রূপ চোখে পড়ে মূলত রাতে। জহির একা নয়, তার একটি বাহিনী রয়েছে। জহির ও তার ছোট ভাই এবং বাহিনীর অন্য সদস্যরা রাতে মেঘনায় অবৈধভাবে বালু তোলে ও নৌযানে ডাকাতি করে। এ ছাড়া বিভিন্ন চরে গরু চুরি, ডাকাতি থেকে শুরু বিভিন্ন ধরনের অপকর্ম করে তারা।
নদী তীরবর্তী গ্রামবাসী সূত্রে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জের কালিরচর থেকে শুরু করে কালিপুর-ষাটনল, নাসিরাচর হয়ে মোহনপুর পর্যন্ত ডাকাতি এবং মাদক সরবরাহ করে কানা জহিরের সিন্ডিকেট। জহিরের অন্যতম সহযোগী হিসেবে কাজ করে তার আপন ভাই আঙুল কাটা শাহিন। সশস্ত্র শাহিন ও জহির দিনের বেলা অবস্থান করে কালিরচরসহ আশপাশের কয়েকটি চরে। বকচর থেকে কালিরচর পর্যন্ত শাহিন এবং কালিরচর থেকে নাসিরাচর ও মোহনপুর পর্যন্ত জহির তাদের অবৈধ কর্মকাণ্ডের স্বর্গরাজ্য বানিয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, কানা জহির একসময় নৌ-ডাকাত বাবলা গ্রুপের হয়ে কাজ করত। কিন্তু পরে জহির ও তার ভাই শাহিন নিজেরাই তৈরি করে ডাকাত দল। চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও ডাকাতির বখরা আদায় করা তাদের মূল কাজ। জহির ও তার বাহিনীর অত্যাচারে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে দিনযাপন করছেন।
জানা গেছে, গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে কানা জহির চাঁদপুরের মেঘনা নদীর মোহনপুর এলাকায় তার দলবল দিয়ে ডাকাতের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। খবর পেয়ে চাঁদপুরের নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ড ওই এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় জহিরের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি বিনিময় হয়। একপর্যায়ে কানা জহির পুলিশের আক্রমণে টিকতে না পেরে অস্ত্র, স্পিডবোট এবং গোলা বারুদ রেখে পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পালায়। পরে পুলিশ ও কোস্টগার্ড জহিরের ব্যবহৃত স্পিডবোট, কাটা বন্দুক, দেশীয় বিভিন্ন অস্ত্র উদ্ধার করে। এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা করা হয়।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, গত শনিবার খবর পেয়ে মেঘনার নৌ-ডাকাত কানা জহির ও তার বাহিনীর সদস্যদের গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্য কালিরচর গ্রামের বাচ্চু মেম্বারের বাড়ি-সংলগ্ন মেঘনা নদীতে অভিযান চালায় পুলিশ। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে কানা জহিরসহ পাঁচ সহযোগী স্পিডবোটে করে পালাতে চেষ্টা করে। এ সময় পুলিশ তাদের পিছু নিলে পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে কানা জহির ও তার সহযোগীরা। এ সময় পাল্টা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এ ঘটনায় কানা জহির ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে মুন্সীগঞ্জ সদর থানার পৃথক দুটি মামলা করা হয়।
মুন্সীগঞ্জ সদর থানার ওসি এম সাইফুল আলম বলেন, কানা জহির একজন আন্তঃজেলা ডাকাত দলের সরদার। তার বিরুদ্ধে গজারিয়া, ষাটনল, মতলব উত্তর, চাঁদপুর ও লৌহজং থানায় হত্যা, ডাকাতিসহ ১৮টি মামলা রয়েছে। চরাঞ্চলের দুর্গম স্থানে অবস্থান করায় কানা জহিরকে গ্রেপ্তারে বিলম্ব হচ্ছে বলেও জানান তিনি।