দেশে রড উৎপাদন সক্ষমতায় শীর্ষে একেএস
Published: 6th, February 2025 GMT
বিশেষায়িত চুল্লিতে ১ হাজার ৬০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ১০০ টন স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরা গলানো হচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর আলোর ঝলকানি। বিভিন্ন রাসায়নিকের পাশাপাশি অক্সিজেন ও কার্বন দিয়ে এই পরিশোধনপ্রক্রিয়া চলছে। চুল্লির ওপরে অপদ্রব্য জমা হচ্ছে। সেগুলো আবার চুল্লি থেকে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে মাত্র ৪৮ মিনিটে বিশুদ্ধ তরল লোহা উৎপাদিত হচ্ছে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শীতলপুরে আবুল খায়ের স্টিল মেল্টিং লিমিটেডের (একেএসএমএল) কারখানার গত ২৭ জানুয়ারি বিকেলে এই চুল্লির কয়েক ফুট দূরের নিরাপদ পথ দিয়ে যাওয়ার সময় প্রচণ্ড তাপের হল্কা এসে লাগল। এত বড় কর্মযজ্ঞ, অথচ কর্মী খুবই কম। মেল্টিং সেকশনের নিয়ন্ত্রণকক্ষে মাত্র কয়েকজন প্রকৌশলী স্বয়ংক্রিয়ভাবে উৎপাদন প্রক্রিয়া পরিচালনা করছেন।
একেএসের কারখানায় স্ক্র্যাপ থেকে বিশুদ্ধ লোহা উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেস (ইএএফ) নামের বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তির। বাংলাদেশে ২০১৫ সালে প্রথম এই প্রযুক্তি নিয়ে আসে একেএস। বর্তমানে তাদের দুটি ইএএফ রয়েছে। সম্প্রতি আধুনিক একটি রি-রোলিংয়ের ইউনিট চালু করেছে তারা। শিগগিরই এটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাবে। এতে কারখানাটিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৭ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
শীতলপুরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে আধা কিলোমিটার ভেতরে ৭৫০ একর জমিতে আবুল খায়ের স্টিল মিল গড়ে উঠেছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ এই কারখানায় পরিবেশবান্ধব পদ্ধতিতে রড উৎপাদন হয়। রড উৎপাদনে প্রচুর পানি লাগে, যদিও ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে না তারা। বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও কারখানা–সংলগ্ন পাহাড়ে গড়ে তোলা ড্যামের পানি ব্যবহার করা হয়। তা ছাড়া বায়ুদূষণ রোধে ফিউম ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট রয়েছে। বর্তমানে কারখানার বিশাল ছাদে ১২ মেগাওয়াটের সৌরবিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপন করছে একেএস।
একেএসের কারখানায় রড উৎপাদন শুরু হয় ২০০৯ সালে। কিছুদিন আগেও বার্ষিক উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ১২ লাখ টন। তবে নতুন রি-রোলিং ইউনিটের একক সক্ষমতা হতে যাচ্ছে ১৮ লাখ টন। এতে করে তাদের বার্ষিক রড উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়াবে ৩০ লাখ টনে, যা দেশের অন্য যেকোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি—এমনটাই জানালেন একেএসের কর্মকর্তারা। তাঁদের দাবি, রড উৎপাদনে এটি দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ প্ল্যান্ট।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসএমএ) হিসাবে, দেশে ইস্পাত খাতে স্বয়ংক্রিয় কারখানা প্রায় ৪০টি। তার মধ্যে বড় প্রতিষ্ঠান ৪-৫টি। প্রতিষ্ঠানগুলোতে বছরে এক কোটি টনের বেশি রড উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। দেশে রডের বার্ষিক ব্যবহার ৬৫-৭৫ লাখ টন। ফলে কারখানাগুলোর সক্ষমতার একটা অংশই এখনো অব্যবহৃত।
ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ১৯৪৬ সালে নোয়াখালী থেকে প্রায় শূন্য হাতে চট্টগ্রামে এসেছিলেন যুবক আবুল খায়ের। তাঁরই হাত ধরে ১৯৫৩ সালে বিড়ির কারখানা স্থাপনের মধ্য দিয়ে আবুল খায়ের গ্রুপের গোড়াপত্তন। বর্তমানে ইস্পাত ছাড়াও সিমেন্ট, শিপিং, সিরামিকসহ বিভিন্ন খাতে ৪০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান রয়েছে গ্রুপটির। এসব কারখানায় ৫৫ হাজার কর্মী কাজ করেন। গত অর্থবছরে তাদের লেনদেন ছিল প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
পরিবেশবান্ধব রড উৎপাদন
ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে বিশুদ্ধ তরল লোহা উৎপাদনের প্রাথমিক ধাপের কথা শুরুতে বলা হয়েছে। এরপর সেই তরল বিশাল পাত্রে করে ল্যাডেল রিফাইনিং ফার্নেসে (এলআরএফ) আবারও পরিশোধনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট গ্রেডের রড উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান যুক্ত করা হয়।
পরিশোধনের পর তরল লোহা কন্টিনিয়াস কাস্টিংয়ে প্রবেশ করানো হয়। সেখানে নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে বিলেটের আকার দেওয়া হয়। সেই বিলেটকে ওয়াটার কুলিংয়ের মাধ্যমে ১২ মিটার লম্বা করে কাটা হয়। সেই বিলেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় রোলিং সেকশনে। তার আগে বিলেট উত্তপ্ত করে ধাপে ধাপে রড তৈরি করা হয়। তারপর ঠান্ডা করে বিশাল চুম্বকযুক্ত ক্রেনের সাহায্যে রড সংরক্ষণ বা পরিবহন করা হয়।
আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারে রড উৎপাদনের এই প্রক্রিয়া দেখার আগে কারখানার পেছনে গিয়ে দেখা যায় পাহাড়ের খাঁজে গড়ে তোলা হয়েছে ড্যাম বা পানির আঁধার। সেখান থেকে বড় পাইপের মাধ্যমে পানি কারখানায় নেওয়া হচ্ছে। এই পানি স্থানীয় লোকজনও ব্যবহার করেন।
একেএসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান মোমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইলেকট্রিক আর্ক ফার্নেসে স্ক্র্যাপ পরিশোধনের মাধ্যমে প্রায় শতভাগ বিশুদ্ধ বিলেট উৎপাদন করা যায়। সে জন্য ভূমিকম্প সহনশীল রড সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে। এই প্রযুক্তি বিদ্যুৎ–সাশ্রয়ী। পাশাপাশি পুরো উৎপাদনপ্রক্রিয়া পরিবেশবান্ধব করতে পানির আঁধার গড়ে তোলার পাশাপাশি বায়ু পরিশোধনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এখন সৌরবিদ্যুতে বিনিয়োগ করছি আমরা।’
ঢেউটিনে বিনিয়োগের পরিকল্পনা
সীতাকুণ্ডের মাদামবিবিরহাট এলাকায় আবুল খায়ের স্টিল প্রোডাক্টস নামের কারখানায় ঢেউটিন উৎপাদন হয়। ১৯৯৩ সালে ৩০০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত আবুল খায়েরের এই কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা ৬ লাখ ৪০ হাজার মেট্রিক টন। তাদের উৎপাদিত গরু মার্কা ঢেউটিন ২০ বছরের বেশি সময় ধরে বাজারের শীর্ষস্থান দখল করে আছে।
আবুল খায়ের স্টিল প্রোডাক্টসের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) এজাজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে চাহিদা কম থাকায় অর্ধেক সক্ষমতায় এই কারখানা চালানো হচ্ছে। তবে শিগগিরই বাজার ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা করে জানালেন, ‘বাসাবাড়ি ও শিল্পকারখানায় রঙিন টিনের ব্যবহার বাড়ছে। সে জন্য আমরা উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে নতুন বিনিয়োগের পরিকল্পনা করছি।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
‘কৃষির উন্নয়নে জাপানের অংশীদারিত্ব আরও বৃদ্ধি করা হবে’
স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) বলেছেন, “জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নে অন্যতম প্রধান অংশীদার ও পরীক্ষিত বন্ধু। জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)-এর মাধ্যমে দেশটি বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে ব্যাপকভাবে সহায়তা করে আসছে। আগামী দিনে বাংলাদেশের কৃষি খাতের উন্নয়নে জাপানের অংশীদারিত্ব আরও বৃদ্ধি করা হবে।”
বুধবার (৩০ এপ্রিল) সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাঁর অফিসকক্ষে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত Saida Shinichi-এর সাক্ষাৎকালে তিনি এসব কথা বলেন।
বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে কৃষি খাতে সহযোগিতা বিশেষ করে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ, ফসলের পোস্ট হার্ভেস্ট ম্যানেজমেন্ট ও সংরক্ষণ, জলবায়ু ও স্মার্ট কৃষি, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা, ২০২৭ সালে জাপানের ইয়োকোহামাতে অনুষ্ঠিতব্য আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার এক্সপো’তে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, কৃষি বিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পুলিশ সংস্কার, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় সহযোগিতা, জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যু সহ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকের শুরুতে রাষ্ট্রদূতকে স্বাগত জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, “জাপান বাংলাদেশের অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আগামী দিনগুলোতে এ সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।”
উপদেষ্টাকে ধন্যবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, “২০২৭ সালে জাপানের ইয়োকোহামা'তে ‘আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার এক্সপো’ অনুষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক এ এক্সপো'তে বাংলাদেশকে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ।”
উপদেষ্টা বলেন, “বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। আর জাপান কৃষি খাতে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারী দেশ। তাই জাপান বাংলাদেশের কৃষি খাতে বিশেষ করে কৃষি পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণ, ফসলের পোস্ট হার্ভেস্ট ম্যানেজমেন্ট ও সংরক্ষণ, জলবায়ু ও স্মার্ট কৃষি, সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি খাতে সহযোগিতা করতে পারে।”
তিনি বলেন, “জাপান বাংলাদেশের কৃষি পণ্য সংরক্ষণে আধুনিক হিমাগার স্থাপন ও কুলিং ভ্যান সরবরাহ করে সহযোগিতা করতে পারে। তাছাড়া জাপান আমাদেরকে আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি দিয়ে সহায়তা করতে পারে।”
তিনি এসময় রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশে আধুনিক কৃষি সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি তৈরির জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে সহযোগিতার আহ্বান জানান।
রাষ্ট্রদূত বলেন, “কৃষি বিষয়ক দু'দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সর্বশেষ সভা ২০২৪ সালের মে মাসে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্রুত এ সংক্রান্ত পরবর্তী সভা আয়োজন করা দরকার।”
উপদেষ্টা জানান, জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের পরবর্তী সভা এ বছরের অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ সভা আয়োজনের বিষয়ে বাংলাদেশ সব ধরনের সহযোগিতা করবে।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে রাষ্ট্রদূতের প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, “বর্তমানে ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ক্রমশ উন্নতি হচ্ছে। তবে এটির আরও উন্নতির সুযোগ রয়েছে এবং আমরা এ ব্যাপারে চেষ্টা করে যাচ্ছি।”
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কেমন হবে জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, “তখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির কোনো সুযোগ নেই, বরং দিন দিন এটির উন্নতি ঘটবে বলে আমি আশা করছি।”
পুলিশের সামর্থ্য ও গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, “৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতির তুলনায় বর্তমানে পুলিশের সামর্থ্য, মনোবল ও বিশ্বাসযোগ্যতা অনেক বেশি বেড়েছে।”
তিনি এসময় আধুনিক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় জাপানের সহায়তা কামনা করেন। তাছাড়া তিনি নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডকে পেট্রোল ভেসেল ও আধুনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে সহযোগিতা এবং অধিক সংখ্যক পুলিশ সদস্যকে জাপানে উন্নত প্রশিক্ষণে প্রেরণের জন্য রাষ্ট্রদূতকে অনুরোধ করেন।
রাষ্ট্রদূত জানান, আগামী ইন্টারপোল নির্বাচনে নির্বাহী কমিটির সদস্য পদে জাপানের পক্ষ থেকে মনোনয়ন প্রদান করা হবে। উপদেষ্টা এ পদে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জাপানকে পূর্ণ সমর্থনের আশ্বাস প্রদান করেন।
বৈঠকে কৃষি মন্ত্রণালয় ও জাপান দূতাবাসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।
ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এস