প্রশাসনের সব কর্মকর্তা সচিবালয়ে আসতে পারবেন না। সচিবালয় চলবে সব সার্ভিসের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস)-এর কর্মকর্তাদের দিয়ে। এতে উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদের কর্মকর্তারা থাকবেন।
এসইএসে উপসচিব পদে প্রশাসনের জন্য ৫০ শতাংশ এবং অন্য সার্ভিসের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা থাকবে। এসব প্রস্তাব করা হয়েছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে। গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ এ প্রতিবেদন তুলে দেন কমিশনের প্রধান আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী।
প্রতিবেদনে মন্ত্রণালয় কমিয়ে ২৫ ও বিভাগ কমিয়ে ৪০টি করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ জন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে সমপ্রকৃতির পাঁচটি গুচ্ছে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলো হলো বিধিবদ্ধ প্রশাসন; অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য; ভৌত অবকাঠামো ও যোগাযোগ; কৃষি ও পরিবেশ; মানবসম্পদ ও সামাজিক উন্নয়ন। বর্তমানে মোট ৪৩টি মন্ত্রণালয় ও ৬১টি বিভাগ রয়েছে।
বিদ্যমান বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারকে ‘বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস’ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এই ক্যাডার সার্ভিসের পদগুলো মাঠ প্রশাসনেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সুপারিশ অনুযায়ী, প্রশাসনিক সার্ভিসের কর্মকর্তাদের শুরুর পদের নাম এখনকার মতো সহকারী কমিশনার। মাঠ পর্যায়ে তাদের শীর্ষ পদ হবে বিভাগীয় কমিশনার; যাদের পদমর্যাদা হবে গ্রেড-১, যা সচিবের সমান। তবে এই সার্ভিসের জন্য একটি শীর্ষ পদ থাকবে, নাম হবে ‘প্রধান কমিশনার’; যিনি বিশেষ গ্রেড পাবেন, যা মুখ্য সচিবের সমান। এর সঙ্গে মিল রেখে অন্যান্য সার্ভিসের জন্যও ভিন্ন নামে পদ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।
অন্যান্য সার্ভিসের পদগুলো হবে পর্যায়ক্রমে সহকারী পরিচালক, উপজেলাপ্রধান, অতিরিক্ত পরিচালক, পরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক ও মহাপরিচালক। এর বাইরে প্রতিটি সার্ভিসের জন্য একটি শীর্ষ পদ থাকবে। যেমন ‘চিফ অব হেলথ সার্ভিস’। প্রতিটি সার্ভিসের কর্মকর্তারা পরীক্ষার মাধ্যমে ওই সব পদে পদোন্নতি পাবেন।
সব সার্ভিসের কর্মকর্তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে নিয়োগ পাবেন। এই কর্মকর্তারা সচিবালয়ে দায়িত্ব পালন করবেন। বর্তমানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই সচিবালয় চালাচ্ছেন।
প্রশাসন সার্ভিসের যে কর্মকর্তারা এসইএসে যাওয়ার জন্য পরীক্ষা দেবেন না বা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হবেন, তারাও নিজ সার্ভিসের পদগুলো, অর্থাৎ অতিরিক্ত জেলা কমিশনার, জেলা কমিশনার, অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনার ও প্রধান কমিশনার পদে পদোন্নতির সুযোগ পাবেন। একইভাবে অন্যান্য সার্ভিসের কোনো কর্মকর্তা এসইএসে যাওয়ার সুযোগ না পেলে তারাও নিজ সার্ভিসের সহকারী পরিচালক, উপজেলাপ্রধান, অতিরিক্ত পরিচালক, পরিচালক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক, মহাপরিচালক ও সংশ্লিষ্ট সার্ভিসের চিফ পদে থাকবেন।
ডিসি-ইউএনও পদের নাম পরিবর্তন
জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদের নাম জেলা কমিশনার (ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার-ডিসি) এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নাম উপজেলা কমিশনার (সাব-ডিস্ট্রিক্ট কমিশনার-এসডিসি) করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) পদবি পরিবর্তন করে ‘অতিরিক্ত জেলা কমিশনার (ভূমি ব্যবস্থাপনা) করার প্রস্তাব করেছে কমিশন।
মামলা নিতে পারবেন ডিসিরা
জেলা কমিশনারকে মামলা গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বিষয়ে বলা হয়, জেলা কমিশনারকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সিআর (কোর্ট রেজিস্ট্রার) মামলা প্রকৃতির অভিযোগগুলো গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করা হলো। তিনি অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য উপজেলার কোনো কর্মকর্তাকে বা সমাজের স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মাধ্যমে সালিশি বা তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারবেন। প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হলে থানাকে মামলা গ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবেন। পরে মামলাটি যথাযথ প্রক্রিয়ায় আদালতে চলে যাবে। কমিশন বলেছে, এর ফলে সাধারণ নাগরিকরা সহজে মামলা করার সুযোগ পাবেন। অন্যদিকে সমাজের ছোটখাটো বিরোধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তি হয়ে গেলে আদালতের ওপর অযৌক্তিক মামলার চাপ কমবে। তবে এ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী একই বিষয়ে পুনরায় আদালতে যেতে পারবেন না। এ সুপারিশ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন
কমিশন উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুনঃস্থাপনের সুপারিশ করেছে। এ বিষয়ে কমিশন বলেছে, এটি করা হলে সাধারণ নাগরিকরা অনেক বেশি উপকৃত হবে। এ বিষয়েও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ‘উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা’ পদের সুপারিশ করেছে। কমিশন বলেছে, থানার ‘অফিসার ইনচার্জ’-এর কাজ ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার তদারকির জন্য উপজেলা পর্যায়ে একজন সহকারী পুলিশ সুপারকে ‘উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা’ হিসেবে পদায়ন করা যেতে পারে। এর ফলে থানার জবাবদিহি বাড়বে।
গাড়ির ঋণ বাতিলের প্রস্তাব
বর্তমানে উপসচিব থেকে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত গাড়ির ঋণ এবং গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। এ সুযোগ বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।
বিসিএস ক্যাডার বাদ দিয়ে আলাদা নাম
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) আওতায় বিদ্যমান একীভূত ‘ক্যাডার সার্ভিস’ বাতিল করে সার্ভিসের ধরন অনুযায়ী আলাদা নামকরণের সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান ২৬টি ক্যাডার কমিয়ে ১৩টি প্রধান সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিদ্যমান বিভিন্ন ক্যাডার কর্মকর্তাদের এসব সার্ভিসে একীভূত করার কথা বলা হয়েছে। ১৩টি সার্ভিস হলো– প্রশাসনিক সার্ভিস, বিচারিক সার্ভিস, জননিরাপত্তা সার্ভিস, পররাষ্ট্র সার্ভিস, হিসাব সার্ভিস, নিরীক্ষা সার্ভিস, রাজস্ব সার্ভিস, প্রকৌশল সার্ভিস, শিক্ষা সার্ভিস, স্বাস্থ্য সার্ভিস, কৃষি সার্ভিস, তথ্য সার্ভিস এবং তথ্যযোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিস।
এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান কিছু ক্যাডার কিছু সার্ভিসে একীভূত করার সুপারিশ করা হয়েছে। যেমন বিসিএস খাদ্য ও সমবায়কে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিসের (বর্তমানের প্রশাসন ক্যাডার) সঙ্গে একীভূত করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে এ দুটি সার্ভিসে নতুন নিয়োগ করা যাবে না।
বিসিএস (হিসাব ও নিরীক্ষা) সার্ভিসকে দুটো সার্ভিসে বিভক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। একটি হবে ‘বাংলাদেশ হিসাব সার্ভিস’, আরেকটি ‘বাংলাদেশ নিরীক্ষা সার্ভিস’। কমিশন সুপারিশ করেছে, এলজিইডি এবং জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরে কর্মরত প্রকৌশলীদের ‘প্রকৌশল সার্ভিস’ হিসেবে একীভূত করা হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যোগদানের তারিখ থেকে পারস্পরিক জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণ করা হবে।
বর্তমানে বিসিএস (সাধারণ তথ্য) ক্যাডারের অধীনে তিনটি সাব ক্যাডার আছে। যাদের মধ্যে পদোন্নতির সুযোগ-সুবিধার বৈষম্য রয়েছে। এসব বৈষম্য দূর করার জন্য তিনটি সাব ক্যাডারকে বিলুপ্ত করে সহকারী পরিচালক, তথ্য কর্মকর্তা, গবেষণা কর্মকর্তা ও সহকারী অনুষ্ঠান পরিচালক এবং সহকারী বার্তা নিয়ন্ত্রক পদগুলো নিয়ে একটি একীভূত সার্ভিস গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে। সম্মিলিত মেধাতালিকার ভিত্তিতে তাদের জ্যেষ্ঠতা, পদোন্নতি ও পদায়নের সুপারিশ করেছে কমিশন।
সরকারি দপ্তরের আইসিটি কর্মকর্তাদের ‘তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সার্ভিসে’ অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিসিএসকে (তথ্য প্রকৌশল) এই সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। বিসিএসের (বন) কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিবেশ সার্ভিসের কর্মকর্তাদের একীভূত করে বাংলাদেশ কৃষি সার্ভিসের উপ-সার্ভিস হিসেবে ‘বন ও পরিবেশ সার্ভিস’ করারও সুপারিশ করেছে কমিশন। বিসিএস (ট্রেড) ক্যাডার বিলুপ্ত করে বিসিএসের (শুল্ক ও আবগারি) সঙ্গে একীভূত করার জন্য করেছে। এভাবে আরও কিছু ক্যাডারকে বিভিন্ন ক্যাডারে একীভূত করার কথা বলেছে কমিশন।
নিয়োগ পদোন্নতির জন্য তিন পিএসসি
নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে তিনটি পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিস ছাড়া বাকি সার্ভিসের নিয়োগ ও পদোন্নতির পরীক্ষার জন্য একটি পিএসসি হবে। এর নাম হবে পিএসসি (সাধারণ)। আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সার্ভিসের নিয়োগ ও পদোন্নতির জন্য পৃথক দুটি পিএসসি করার সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমান বিসিএস ক্যাডার ও নন ক্যাডার নিয়োগে একটি পিএসসি কাজ করছে।
বর্তমানে পিএসসির অধীন তিন ধাপের নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ২৬টি ক্যাডারে নিয়োগ হয়। চাকরিপ্রার্থীদের পছন্দক্রম ও পরীক্ষায় প্রাপ্ত ফলের ভিত্তিতে ক্যাডার নির্ধারণ করা হয়। ক্যাডারগুলো হলো– প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, কর, কৃষি, আনসার, নিরীক্ষা ও হিসাব, সমবায়, শুল্ক ও আবগারি, পরিবার পরিকল্পনা, মৎস্য, খাদ্য, বন, সাধারণ শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য, পশুসম্পদ, ডাক, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, গণপূর্ত, রেলওয়ে প্রকৌশল, রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্যিক, সড়ক ও জনপথ, পরিসংখ্যান ও বাণিজ্য ক্যাডার। একেকটি চাকরির কাজের ধরন একেক রকম। পদ-পদোন্নতি ও সুযোগ-সুবিধায় ভিন্নতা আছে। এসব নিয়ে ক্যাডারগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বও আছে।
বিসিএস পরীক্ষা এক বছরে শেষ করতে হবে
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিসিএস পরীক্ষার দীর্ঘ প্রক্রিয়া সহজতর করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি অনুসরণ করা প্রয়োজন। এর মাধ্যমে সরকারি পরীক্ষায় নিয়োগ প্রক্রিয়াটি আরও দ্রুত এবং কার্যকর হবে। সরকারি নিয়োগ প্রক্রিয়া দ্রুত ও কার্যকর করতে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) পরীক্ষা এক বছরের মধ্যে শেষ করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। কমিশন বলছে, বর্তমান নিয়োগ প্রক্রিয়া অত্যধিক দীর্ঘ হওয়ায় নিয়োগ থেকে যোগদান পর্যন্ত সময় অনেক বেশি লাগে, যা কমিয়ে আনা প্রয়োজন।
প্রস্তাবিত নতুন সময়সীমা অনুযায়ী, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) পরীক্ষার বার্ষিক ক্যালেন্ডার নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। এতে জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ, এপ্রিল মাসে প্রিলিমিনারি পরীক্ষা, জুনে মূল লিখিত পরীক্ষা, ডিসেম্বরে ফল প্রকাশ, এবং জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যে মৌখিক পরীক্ষা সম্পন্ন করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে চূড়ান্ত ফল ঘোষণা, মে মাসে স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে গেজেট প্রকাশ করা হবে। গেজেট প্রকাশের পর জুলাই মাসের প্রথম দিন থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাজে যোগদানের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এরপর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে পিএটিসির ফাউন্ডেশন ট্রেনিংয়ে যোগদান।
পদোন্নতির কোটা ৫০: ৫০
সব সার্ভিস থেকে মেধাবী ও দক্ষ কর্মকর্তা নিয়ে সচিবালয়ের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদগুলো নিয়ে একটি ‘সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস’ (এসইএস) গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, মেধার ভিত্তিতে (মেরিটোক্রেসি) উচ্চতর পদগুলোতে আরোহণের সুযোগ প্রদান করাই যুক্তিসংগত। বিশ্বের বহু দেশেই এ নীতি অনুসরণ করা হয়। এ অবস্থায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদগুলো নিয়ে এসইএস গঠিত হতে পারে। সব সার্ভিস থেকে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার ভিত্তিতে এসইএসে নিয়োগ করা হলে মধ্যমেয়াদি একদিকে মেধার প্রাধান্য নিশ্চিত হবে, অন্যদিকে আন্তঃসার্ভিস অসমতা দূর হবে। প্রশাসন ক্যাডারের জন্য বর্তমানে উপসচিব পদের ৭৫ শতাংশ সংরক্ষিত আছে। কমিশন প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ কোটা হ্রাস করে ৫০ শতাংশ করার বিষয়টি অধিকতর যৌক্তিক মনে করছে। অবশিষ্ট ৫০ শতাংশ পদ অন্যান্য সার্ভিসের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
সচিব পদোন্নতিতে মন্ত্রিসভা কমিটি
একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা কমিটি অতিরিক্ত সচিবদের মধ্য থেকে বাছাই করে সচিব ও সচিবদের মধ্য থেকে মুখ্য সচিব পদে পদোন্নতির প্রস্তাব সরকারপ্রধানের কাছে পেশ করবে। বর্তমান সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড বাতিল করা যেতে পারে। অতিরিক্ত সচিবদের মধ্য থেকে সচিব নিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনাময় অফিসারদের জন্য উচ্চতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো তারা যোগ্য হতে পারে।
বিলুপ্ত হচ্ছে ‘সিনিয়র সচিব’
মন্ত্রণালয়গুলোকে পুনর্বিন্যস্ত করা হলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যে একাধিক বিভাগ সৃষ্টি হবে, তাদের মধ্যে সমন্বয়ের জন্য সেসব মন্ত্রণালয়ে কর্মরত একজন সচিবকে মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমান সিনিয়র সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে এ পদে পদায়ন করা যেতে পারে। বর্তমান ‘সিনিয়র সচিব’ নামকরণ বাদ দেওয়ার সুপারিশ করেছে কমিশন।
শূন্য পদ ছাড়া পদোন্নতি নয়
বর্তমান প্রশাসনে শূন্য পদের চেয়ে অধিক সংখ্যক পদে পদোন্নতি দিয়ে জটিলতার সৃষ্টি করা হয়। এ জন্য শূন্য পদের বিপরীতে সমসংখ্যক পদে পদোন্নতি দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
পদোন্নতির ক্ষেত্রে গোয়েন্দা প্রতিবেদন বাতিল
পদোন্নতির ক্ষেত্রে পুলিশ বা কোনো গোয়েন্দা বিভাগের কাছে রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাওয়ার প্রথা বাতিল করার জন্য সুপারিশ করেছে কমিশন। একই সঙ্গে কোনো সরকারি কর্মকর্তা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে আয়োজিত কোনো কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না বলে নির্দেশনা জারি করতে বলেছে।
মন্ত্রীদের পিএস হতে পারবেন রাজনৈতিক ব্যক্তি
মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর একান্ত সচিব (পিএস) ও সহকারী একান্ত সচিব মন্ত্রীদের অভিপ্রায় অনুসারে সিভিল সার্ভিসের বাইরে থেকে নিয়োগ করা যাবে। কারণ, সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তারা পিএস হলে পরবর্তী সরকারের আমলে তাদের হয়রানির শিকার, পদোন্নতিবঞ্চিত ও ওএসডি করা হয়।
এ ছাড়া বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে একটি করে প্রধান কলেজ নির্বাচন, ন্যায়পাল দপ্তর, প্রশাসনিক ন্যায়পাল নিয়োগ ও তার সচিবালয় এবং স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠনের কথা বলা হয়েছে। ১৫ বছর চাকরি পূর্তিতে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করা যাবে। দক্ষতা উন্নয়নের কাঠামো এবং প্রশিক্ষণ ও পেশাগত উন্নয়ন সম্পর্কে বেশ কিছু সুপারিশ পেশ করা হয়েছে। দক্ষতা ও কার্যকরিতা অর্জনের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোও রয়েছে প্রতিবেদনে। দুর্নীতি দমন ও তথ্য কমিশনকে শক্তিশালী করার কথাও বলা হয়েছে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ত কর র স প র শ কর র স প র শ কর ছ স র ভ স র জন য র জন য একট উপসচ ব থ ক সব স র ভ স পর ক ষ র এক ভ ত ক র র জন য র পদগ ল মন ত র পর য য় ব স এস কর র ক তদন ত প এসস উপজ ল গ রহণ সরক র সহক র
এছাড়াও পড়ুন:
গাড়িবিলাস
সোমবার প্রকাশিত সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনমতে, এ পর্যন্ত সরকারিভাবে সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা নিয়ে গাড়ি কিনেছেন ৪ হাজার ২০০ আমলা। এ সত্ত্বেও বেশির ভাগ কর্মকর্তা অবৈধভাবে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এতে প্রতি মাসে চালক, রক্ষণাবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক খরচ হচ্ছে ২১ কোটি টাকা। সে হিসাবে বার্ষিক খরচ দাঁড়ায় ২৫২ কোটি টাকা।
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সচিবদের জন্য গাড়ি ক্রয়ে সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা চালু করে। মূলত আমলাদের বাগে আনতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের জন্য নানা সুবিধার বন্দোবস্ত করেছিলেন। এটি ছিল তারই ধারাবাহিকতা। প্রতিবেদনে সাবেক এক সচিব এ নীতিকে ঘুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যখন গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ওঠে, তখন তা অত্যন্ত বেদনা ও হতাশার।
প্রতিবেদনমতে, উপদেষ্টাদের কারও কারও বিরুদ্ধে তিন-চারটি গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। তাঁর জন্য চালক বরাদ্দ রয়েছে ৩ জন। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ একাই ব্যবহার করছেন তিনটি গাড়ি। এভাবে অনেকেই একাধিক গাড়ি ব্যবহার করছেন, যা আইন ও নৈতিকতার পরিপন্থি।
অর্থ সচিব, খাদ্য সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব এবং তাদের পিএস বেআইনিভাবে আলাদা গাড়ি ব্যবহার করছেন। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবদের বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া পরিবারের জন্য রেখেছেন আলাদা যানবাহন।
একটি মিথ্যা হাজার মিথ্যার জন্ম দেয়। তেমনিভাবে একটি অসৎ পন্থা আরও বহু অসততার দিকে ঠেলে দেয়। এ কারণে পরিবহন পুল থেকে সচিবদের জন্য গাড়ি সরবরাহ নীতি বন্ধ হওয়ার পরও বিভিন্ন অজুহাতে মন্ত্রণালয়গুলো গাড়ি কেনা বাড়িয়েছে। সুতরাং, প্রত্যাশিতভাবে আওয়ামী সরকার গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে সুদমুক্ত যে ঋণ সুবিধা চালু করেছিল, তা রাষ্ট্রীয় তহবিল তছরুপের পথ প্রশস্ত করেছে। অর্থাৎ সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতা না থাকায় একটি দুর্নীতি অন্যান্য দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত করেছে। এই তো, ২০১৭ সাল থেকে উপসচিবদেরও একই ঋণ সুবিধা দেওয়া শুরু হয়। প্রতিবেদনমতে, শুরুতে গাড়ি কিনতে ২০ লাখ এবং চালক, তেল বাবদ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে গাড়ি বাবদ ৩০ লাখ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা বাড়ানো হয়।
গবেষক ও সাবেক আমলা আকবর আলি খান ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ গ্রন্থে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতিকে ‘সামগ্রিক কাঠামোগত’ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, এ ধরনের দুর্নীতি নিরন্তর প্রতিক্রিয়া বা চেইন রিঅ্যাকশন সৃষ্টি করে। ‘এক ধরনের দুর্নীতি অন্য ধরনের দুর্নীতির জন্ম দেয়, এক খাত হতে দুর্নীতি অন্য খাতে সংক্রমিত হয়।’ সচিবদের পর উপসচিবদের ঋণ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর এ মন্তব্য প্রযোজ্য।
বাংলাদেশ এখন পাঁচ দশকের রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও দু্র্নীতির কবলে নিমজ্জিত। কাঠামোগত দুর্নীতির কারণে পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে আমাদের দরকার নতুন রাজনৈতিক কাঠামো, যা ‘শুয়রের বাচ্চাদের’ অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেই এসব জঞ্জাল মুক্ত করা সম্ভব। তবে সেই আশা এখনও বহুদূর।
আমলা ও উপদেষ্টাদের গাড়িবিলাস নিয়ে যে প্রতিবেদন দেখা যাচ্ছে, তা স্পষ্টত গণভ্যুত্থানের ‘স্পিরিট’-এর পরিপন্থি। ইতোমধ্যে কয়েকটি বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা উঠলে সরকার তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেছে। আশা করি, গাড়ি বরাদ্দে যেসব অব্যবস্থাপনা রয়ে গেছে, সেগুলোর শিগগিরই নিরসন হবে।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
Iftekarulbd@gmail.com