পুরোনো চার বিভাগের সীমানাকে চারটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। ক্ষমতার প্রত্যর্পণ বিবেচনায় দেশে বিশাল জনসংখ্যার পরিষেবা ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করার লক্ষ্যে এ প্রস্তাব করেছে তারা। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরের জনসংখ্যা ও পরিষেবার ব্যাপ্তির কথা বিবেচনায় নিয়ে নয়াদিল্লির মতো ফেডারেল সরকার নিয়ন্ত্রিত ‘ক্যাপিটাল সিটি গভর্নমেন্ট’ অর্থাৎ ‘রাজধানী মহানগর সরকার’ গঠনের সুপারিশও করেছে কমিশন।
গতকাল বুধবার দুপুরে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এবং সরকারের কার্যপরিধি সুবিস্তৃত হওয়ার ফলে বর্তমান প্রশাসনিক ও স্থানীয় সরকার কাঠামো যথেষ্ট বলে প্রতীয়মান নয়। অন্যদিকে, এককেন্দ্রিক ব্যবস্থায় মন্ত্রণালয় পর্যায়ে খুঁটিনাটি বহু কাজ করা হয়। প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা গেলে এককেন্দ্রিক সরকারের পক্ষে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার সুযোগ কমবে। পাশাপাশি রাজধানী ঢাকা নগরের ওপরও কমবে চাপ।
‘রাজধানী মহানগর সরকার’ গঠনের ব্যাপারে কমিশনের সুপারিশে বলা হয়েছে, অন্যান্য প্রদেশের মতোই এখানে নির্বাচিত আইনসভা ও স্থানীয় সরকার থাকবে। কমিশন বলেছে, ঢাকা মহানগরী, টঙ্গী, কেরানীগঞ্জ, সাভার ও নারায়ণগঞ্জকে নিয়ে রাজধানী মহানগর সরকারের আয়তন নির্ধারণ করা যেতে পারে।
জেলা পরিষদ বাতিল
কমিশন প্রতিবেদনে জানিয়েছে, স্থানীয় সরকারের একটি ধাপ হিসেবে জেলা পরিষদ বহাল থাকবে কিনা সে বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা রয়েছে। জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কখনই নাগরিকের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হননি। কিছু জেলা পরিষদ বাদে অধিকাংশেরই নিজস্ব রাজস্বের শক্তিশালী উৎস নেই। ফলে অধিকাংশ জেলা পরিষদ আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, তাই জেলা পরিষদ বাতিল করা যেতে পারে। জেলা পরিষদের সহায়-সম্পদ প্রস্তাবিত সংশ্লিষ্ট প্রাদেশিক সরকারের কাছে হস্তান্তর করা যেতে পারে।
পৌরসভা শক্তিশালীকরণ
পৌরসভার গুরুত্ব বিবেচনায় স্থানীয় সরকার হিসেবে একে অধিকতর শক্তিশালী করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাদের মতে, পৌরসভা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন ওয়ার্ড মেম্বারের ভোটে। কারণ, চেয়ারম্যান একবার নির্বাচিত হলে মেম্বারদের আর গুরুত্ব দেন না।
উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করা
স্থানীয় সরকার হিসেবে উপজেলা পরিষদকে আরও শক্তিশালী করার সুপারিশ করা হয়েছে। তবে উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান পদটি বাতিল করা যেতে পারে। উপজেলা পরিষদকে আরও জনপ্রতিনিধিত্বশীল করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে সদস্যদের এক-তৃতীয়াংশকে আবর্তন পদ্ধতিতে পরিষদের সদস্য হওয়ার বিধান করার কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে উপজেলা পরিষদের অধীনে ন্যস্ত না রেখে তাঁকে শুধু সংরক্ষিত ও বিধিবদ্ধ বিষয়– যেমন আইনশৃঙ্খলা, ভূমি ব্যবস্থাপনা, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা ইত্যাদি দেখাশোনার ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য তাঁকে রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে রাখা। একজন জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাকে উপজেলা পরিষদের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে বলে প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন।
ইউনিয়ন পরিষদ
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন মেম্বারের ভোটে। এ ছাড়া প্রতি ওয়ার্ডে একজন করে নারী মেম্বার করার ব্যাপারেও সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউনিয়ন পরিষদের ওয়ার্ড সংখ্যা জনসংখ্যা অনুপাতে ৯ থেকে ১১ করা যেতে পারে। প্রতিটি ওয়ার্ডে দু’জন সদস্য নির্বাচিত হবেন, যাদের মধ্যে একজন অবশ্যই নারী হতে হবে বলে বিধান করার সুপারিশ করা হয়। ফলে একদিকে নারীদের ৫০ শতাংশ প্রতিনিধিত্ব এবং তাদের কর্ম এলাকা সুনিশ্চিত হবে।
ইউনিয়ন পরিষদকে অধিকতর দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে বলা হয়, উপানুষ্ঠানিক ও মসজিদভিত্তিক উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্ব ইউনিয়ন পরিষদকে দেওয়া যেতে পারে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউপি চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে কৃষি ও পানিবিষয়ক কমিটি গঠন করা যেতে পারে। একইভাবে পরিষেবা-সংক্রান্ত স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য কমিটি গঠন করা যেতে পারে। ইউনিয়ন পরিষদে বর্তমানে যে গ্রাম আদালত বা সালিশি ব্যবস্থা রয়েছে তা আরও শক্তিশালী ও কার্যকর করা হলে গ্রাম পর্যায়ে মামলা-বিরোধ ইত্যাদি কমে আসবে।
কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগ গঠনের প্রস্তাব
কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। ‘জনমুখী প্রশাসনের লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত পুনর্গঠন’ শিরোনামে এই নতুন দুটি বিভাগ গঠনের সুপারিশ করা হয়। কমিশন তাদের প্রস্তাবে বলেছে, বর্তমানে দেশে ৮টি প্রশাসনিক বিভাগ রয়েছে। ভৌগোলিক ও যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনায় কুমিল্লা ও ফরিদপুর বিভাগ গঠনের দাবি অনেক দিনের। এ ছাড়া জনসংখ্যা ও যোগাযোগ বিবেচনায় ১০টি বিভাগকে পুনর্বিন্যাস করার প্রস্তাবের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছে কমিশন।
ডিগ্রি কলেজ এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তি
ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজকে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তির সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে ২২০০টির বেশি কলেজে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান চালু আছে। ঢাকা শহরের সাতটি কলেজই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। বাকি কলেজের শিক্ষা প্রশাসন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করে। এ বিশ্ববিদ্যালয় কার্যত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের মতো স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষা বোর্ডের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ফলে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত্ব হারিয়ে ফেলেছে।
বিপুলসংখ্যক প্রতিষ্ঠানের ১১টি অনুষদের আওতায় ৪৫টি বিভাগে অধ্যয়নরত প্রায় ৩৪ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে দুরূহ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বিভাগ ও জেলায় অনেক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে, ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার ডিগ্রি পর্যায়ের কলেজকে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্তির সুপারিশ করছে কমিশন।
নাগরিক সেবায় পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল চায় কমিশন
সরকারি চাকরি ছাড়াও পাসপোর্ট, দ্বৈত নাগরিকত্ব, সমাজসেবা সংস্থা বা এনজিওর বোর্ড গঠনের মতো নাগরিক সেবার ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিল করার জন্যও সুপারিশ করেছে কমিশন। এসব বিষয়ে বলা হয়, একজন নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র থাকলে তার বিষয় নিষ্পত্তি করা যেতে পারে।
পুলিশের বদলে ইমিগ্রেশন অফিসার নিয়োগ
বর্তমানে বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনে পুলিশ কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করছেন। বিশ্বের বহু দেশে পুলিশের বদলে আলাদা ইমিগ্রেশন অফিসার নিয়োগ করা হয়। বাংলাদেশেও যোগ্যতার ভিত্তিতে আলাদা ইমিগ্রেশন অফিসার নিয়োগ করার সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, পুলিশ থেকে ২০ শতাংশ ডেপুটেশনে রাখা যেতে পারে। ইমিগ্রেশন অফিসারদের দেশ-বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা যেতে পারে।
সাব-রেজিস্ট্রি অফিসকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া
প্রতিবেদনে বলা হয়, ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিস বর্তমানে আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করছে। অন্যদিকে ভূমি ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত বিভিন্ন অফিস ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে। ভূমি ব্যবস্থাপনা ও হস্তান্তর-সংক্রান্ত দুটি আলাদা অফিস থাকায় জনদুর্ভোগ ও জটিলতা বাড়ে। এমন দ্বৈত ব্যবস্থাপনা বাতিল করে ভূমি রেজিস্ট্রেশন অফিসকে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।
ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যকর করতে উপজেলা পর্যায়ে দ্বিতীয় শ্রেণির একজন ভূমি ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার পদ সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কর্মরত কানুনগোদের পিএসসির পদোন্নতি পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অধীনে পদোন্নতি ও পদায়নের ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়েছে।
উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট স্থাপন
দেশের উপজেলা পর্যায়ে দেওয়ানি ও ফৌজদারি ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট পুনঃস্থাপনের সুপারিশ করেছে কমিশন। এ বিষয়ে কমিশন বলেছে, এটি করা হলে সাধারণ নাগরিকরা অনেক বেশি উপকৃত হবে। এ বিষয়েও সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নেওয়ার কথা বলেছে তারা।
কমিশন ‘উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা’ পদের সুপারিশ করেছে। কমিশন বলেছে, থানার ‘অফিসার ইনচার্জ’ এর কাজ ও সার্বিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষার তদারকির জন্য উপজেলা পর্যায়ে একজন সহকারী পুলিশ সুপারকে ‘উপজেলা জননিরাপত্তা কর্মকর্তা’ হিসেবে পদায়ন করা যেতে পারে।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের দেওয়া সুপারিশের বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার কথা আমরা বরাবরই বলে আসছি। এই কমিশনের সুপারিশে এমন বেশ কিছু বিষয় উঠে এসেছে। আর শুধু স্থানীয় ডিগ্রি কলেজ নয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনার দায়িত্বও স্থানীয় সরকারকে দেওয়া উচিত। কমিশনের সুপারিশগুলো নিয়ে নিশ্চয়ই সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতগুলো সরকার নেবে বলে মনে করি।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র স প র শ কর ছ স থ ন য় সরক র ব ভ গ গঠন র ব ত ল কর ক সরক র সরক র র জনস খ য পর য য় র জন য উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েল হত্যা করে, মিথ্যা বলে, আর পশ্চিমা মিডিয়া তা বিশ্বাস করে
ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি ও সিভিল ডিফেন্সের ১৫ জন সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে। তাঁরা যোদ্ধা ছিলেন না। সন্ত্রাসীও ছিলেন না। তাঁদের কাছে কোনো রকেট বা অস্ত্র ছিল না। তাঁরা ছিলেন ত্রাণকর্মী, মানবতার সেবক। যখন যেখানে বোমা ফেলা হচ্ছিল, সেখানেই তাঁরা আহতদের সাহায্য করতে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা নিজের জীবন বাজি রেখে অন্যদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।
এর আগে গত ২৩ মার্চ গাজার দক্ষিণে রাফা এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনী একটি অ্যাম্বুলেন্স ও জরুরি সেবার গাড়ির বহরকে লক্ষ্য করে হামলা চালায়। এতে আটজন রেড ক্রিসেন্টের কর্মী, ছয়জন ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্সের কর্মী এবং একজন জাতিসংঘের কর্মী নিহত হন। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছিল, এই গাড়িগুলো ছিল অপরিচিত। সন্দেহ করা হয়েছিল, গাড়ির মধ্যে যোদ্ধারা ছিলেন, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ মিথ্যা ছিল।
রিফাত রাদওয়ান নামে নিহত চিকিৎসাকর্মীদের একজনের মোবাইল ফোন থেকে পাওয়া ফুটেজে দেখা যায়, গাড়িগুলোতে স্পষ্টভাবে লালবাতি জ্বলছিল; সেগুলো চিহ্নিত অ্যাম্বুলেন্স ছিল এবং কোথাও কোনো অস্ত্র দেখা যায়নি। তারপর শুরু হয় ইসরায়েলি বাহিনীর প্রচণ্ড গুলি।
পরে রিফাতের মরদেহ আরও ১৩ জনের সঙ্গে একটি গণকবরে পাওয়া যায়। তাঁদের কয়েকজনের দেহে সরাসরি হত্যার চিহ্ন ছিল—মাথা বা বুকে গুলি লেগেছিল। কারও কারও হাত বাঁধা অবস্থায় ছিলেন।
মৃত্যুর পরও তাঁদের প্রমাণ দিতে হলো যে তাঁরা ত্রাণকর্মী ছিলেন।
তারপরও পশ্চিমা গণমাধ্যমের বড় অংশ প্রথমেই ইসরায়েলের কথাই প্রচার করল, ‘ইসরায়েল বলছে…’, ‘আইডিএফ দাবি করছে…’, ‘একজন সামরিক সূত্র জানিয়েছে…।’ এসব কৌশলে সাজানো বাক্য যেন রেড ক্রিসেন্টের রক্তমাখা ইউনিফর্মের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। যেন তারা সত্যের চেয়ে বেশি ‘সত্য’।
এটা নতুন কিছু নয়। এটা একবারের ভুলও নয়।
এটাই একটা সিস্টেম।
এখানে ফিলিস্তিনিদের শুধু বেঁচে থাকাই অপরাধের মতো মনে করা হয়। আমাদের অস্তিত্বকেও সন্দেহের চোখে দেখা হয়—প্রথমে সবাইকে বোঝাতে হয় যে আমরা কোনো হুমকি নই, আমাদের জীবনও মূল্যবান, তারপর হয়তো কেউ আমাদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করবে। এটাই হচ্ছে মানবতা হারানোর আসল রূপ।
আমি গাজায় জন্মেছি, সেখানেই বড় হয়েছি। আমি জানি, রেড ক্রিসেন্টের ইউনিফর্মের অর্থ কী। এর মানে হলো, সব শেষ হয়ে গেলেও আশার একটা আলো আছে। এর মানে হলো, কেউ আসছে সাহায্য করতে—লড়াই করতে বা হত্যা করতে নয়, জীবন বাঁচাতে। এর মানে হলো, ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও কারও কাছে জীবন এখনো মূল্যবান।
বিশ্বকে এখনই ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে যে তাঁরা মানুষ। আমরা মিথ্যা বলি আর আমাদের হত্যাকারীরা সত্য বলে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেরেশতা, শুধু তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করা যাবে, এই ভাষ্যকে আর প্রচার করতে দেওয়া যাবে না।আমি এটাও জানি, সেই আশাকে হারালে কেমন লাগে। সেখানে চিকিৎসাকর্মীদের প্রথমে হত্যা করা হয়, তারপর তাঁদের সম্মান নষ্ট করা হয়। তাঁদের সততা নিয়ে বিতর্ক তোলা হয় আর তাঁদের সহকর্মীরা গণকবর খুঁড়ে মরদেহ উদ্ধার করেন। তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখা হয়, তারপর ভুলে যাওয়া হয়।
মানবতা হারানো শুধু কথার কথা নয়, এটা শুধু গণমাধ্যমের কাঠামো বা রাজনৈতিক ভাষার সমস্যা নয়। এটা হত্যা করে। মুছে ফেলে। এটা পুরো জাতিগোষ্ঠী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পরও বিশ্বকে চোখ ফিরিয়ে নিতে বলে। এটা আমাদের বলে দেয়: তোমার জীবন ততটা মূল্যবান নয়; তোমার শোক সত্যি কি না, তা আমরা যাচাই না করা পর্যন্ত শোক বলে বিবেচিত হতে পারে না; তোমার মৃত্যু দুঃখজনক কি না, তা আমাদের ছাড়পত্রের ওপর নির্ভরশীল।
এ কারণেই এই ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকর্মীর মৃত্যু এত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের গল্প নয়। এটি সেই অবিশ্বাসের প্রক্রিয়ার গল্প, যা প্রতিবার ফিলিস্তিনিরা নিহত হলে উঠে আসে। এটি সেই বাস্তবতা, যেখানে আমাদের নিজেদেরই ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ হতে হয়, নিজেদের আইনি লড়াই চালাতে হয়, নিজেদের প্রচারের কাজ করতে হয় এবং সবকিছুর সঙ্গে মরদেহের জন্য শোকও করতে হয়।
এই বোঝা আর কাউকে বইতে হয় না। যখন কোনো পশ্চিমা সাংবাদিক নিহত হন, তাঁদের সম্মান জানানো হয়। যখন কোনো ইসরায়েলি নাগরিক মারা যান, তখন তাঁদের নাম আর ছবি বিশ্বজুড়ে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে। কিন্তু যখন কোনো ফিলিস্তিনি মারা যান, তখন তাঁর পরিবারের প্রথম কাজ হয় প্রমাণ করা, যে তিনি সন্ত্রাসী ছিলেন না।
আমাদের সব সময় দোষী ধরে নেওয়া হয়, যতক্ষণ না নির্দোষ প্রমাণিত হই। অনেক সময় সেটা প্রমাণ করাও সম্ভব হয় না।
অনেক গবেষণায় দেখা গেছে, পশ্চিমা গণমাধ্যমে ইসরায়েলের কথা বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কথা গুরুত্ব দেওয়া হয় কম। ইসরায়েল যদি কোনো দাবি করে, তা যাচাই-বাছাই ছাড়াই বিশ্বাস করা হয়; কিন্তু ফিলিস্তিনিরা কিছু বললে তা সন্দেহের চোখে দেখা হয়। এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যেন তাঁদের দুঃখ-কষ্ট, কান্না বা শোক তাঁদের কথাকে অবিশ্বাস্য বা অতিরঞ্জিত করে তোলে; অর্থাৎ ফিলিস্তিনিরা যা বলছেন, তা সত্য হলেও তাঁদের যন্ত্রণা দেখিয়ে তাঁরা বেশি বলছেন বা বাড়িয়ে বলছেন—এমন ধারণা তৈরি করা হয়।
এই গণমাধ্যমের ধারা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোকেও প্রভাবিত করে—অস্ত্র বিক্রি থেকে শুরু করে কূটনৈতিক দায়মুক্তি, আন্তর্জাতিক মঞ্চে নীরবতা থেকে জাতিসংঘে ভেটো দেওয়া পর্যন্ত। সবকিছু একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। ফিলিস্তিনিদের পুরোপুরি মানুষ বলে যেহেতু গণ্য করা হয় না, সেহেতু তাদের হত্যাকারীদেরও পুরোপুরি দায়ী করা হয় না।
এর মানসিক চাপও ভয়াবহ। আমরা শুধু শোক করি না; আমাদের শোকের স্বীকৃতির জন্যও লড়তে হয়। আমরা শুধু আমাদের মৃত ব্যক্তিদের দাফন করি না; তাঁদের মৃত্যু স্বীকার করানোর জন্যও সংগ্রাম করি। আমরা এমন এক মানসিক চাপে বাস করি, যা কোনো সম্প্রদায়ের সহ্য করা উচিত নয়। আমাদের প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হয় যে আমরা তা নই, যা বিশ্ব আমাদের ভেবে নিয়েছে।
এই ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী ও উদ্ধারকর্মী ছিলেন সত্যিকারের নায়ক। তাঁরা বিপদের দিকে ছুটে গিয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের জনগণের সেবা করেছিলেন। তাঁরা জীবনের পবিত্রতায় বিশ্বাস করতেন। তাঁদের স্মৃতি সম্মানের যোগ্য। অথচ তাঁদের গল্পও একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বকে এখনই ফিলিস্তিনিদের প্রমাণ করতে বাধ্য করা বন্ধ করতে হবে যে তাঁরা মানুষ। আমরা মিথ্যা বলি আর আমাদের হত্যাকারীরা সত্য বলে—এই ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মধ্যে যাঁরা শুধু ফেরেশতা, শুধু তাঁদের জন্য শোক প্রকাশ করা যাবে, এই ভাষ্যকে আর প্রচার করতে দেওয়া যাবে না।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আহমেদ নাজার একজন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নাট্যকার।