জার্মান রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। গত এক সপ্তাহে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো দেশটিকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এই অনিশ্চয়তা শুধু ২৩ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে নয়। মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। আর উগ্র ডানপন্থী দল ‘অল্টারনেটিভ ফর জার্মানি’(এএফডি) এই পরিস্থিতিতে উল্লসিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে জার্মান রাজনীতিতে উগ্র ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ তৈরি হয়েছিল, তা এখন গভীর সংকটে পড়েছে। ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হয়তো গণতান্ত্রিক অস্থিরতার এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আর এই পুরো পরিস্থিতির জন্য দায়ী মূলত একটি রাজনৈতিক ভুল। এই ভুল করেছেন বিরোধী মধ্য ডানপন্থী ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) দলের প্রধান নেতা এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস।

ইমিগ্রেশন বা অভিবাসন ইস্যুতে কঠোর অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মের্ৎস। ঘটনাটি শুরু হয় যখন এক আফগান আশ্রয়প্রার্থী ছুরিকাঘাতে এক শিশুসহ দুইজনকে হত্যা করেন। এ ঘটনার পর মের্ৎস জার্মানির সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে আরও কড়াকড়ি করা, ফেডারেল পুলিশের ক্ষমতা বাড়ানো এবং অবৈধ অভিবাসীদের দ্রুত বহিষ্কার করার প্রস্তাব দেন।

জরিপ বলছে, অভিবাসন নিয়ন্ত্রণের পক্ষে শুধু সিডিইউয়ের সমর্থকেরাই নন, বরং সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট (এসপিডি), গ্রিন পার্টি ও লিবারেল দলের অনেক ভোটারও রয়েছেন। ডিসেম্বরে ক্রিসমাস মার্কেটে গাড়ি চালিয়ে ছয়জনকে হত্যা এবং শত শত মানুষকে আহত করার মতো ভয়াবহ সাম্প্রতিক হামলার ঘটনা সারা দেশকে নাড়িয়ে দিয়েছে। মের্ৎস মনে করেছিলেন, এই ইস্যু তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় শক্তিশালী ভিত্তি এনে দেবে।

কিন্তু মের্ৎসের এই পদক্ষেপ প্রত্যাশার চেয়ে ভিন্ন ফল বয়ে এনেছে।

কিন্তু তারপর, হয়তো ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে, মের্ৎস সিদ্ধান্ত নিলেন বুন্ডেস্ট্যাগে (জার্মান পার্লামেন্ট) দুটি প্রস্তাব উত্থাপন করবেন। তিনি দাবি করলেন যে তিনি সরাসরি এএফডির সমর্থন চাইবেন না। তবে যদি তাদের ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাও প্রত্যাখ্যান করবেন না। একই সঙ্গে, তিনি তাঁর খসড়া প্রস্তাবগুলোয় এফডির বিরুদ্ধে তীব্র ভাষা ব্যবহার করলেন যাতে প্রস্তাবগুলো এএফডি গ্রহণ করতে না পারে। মের্ৎসের মূল লক্ষ্য ছিল, তাঁর অভিবাসনসংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো সমর্থন করতে এসপিডি ও গ্রিন পার্টির ওপর চাপ সৃষ্টি করা।

কিন্তু এই রাজনৈতিক চাল ব্যর্থ হলো।

এএফডি নেতৃত্ব খুব দ্রুত বুঝতে পারল যে মের্ৎস এমন এক সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন, যা দিয়ে তারা রাজনৈতিক কেন্দ্রকে বিভক্ত করতে পারে। তারা সিডিইউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। তাদের ভোটের সাহায্যে গত বুধবার মের্ৎসের প্রথম প্রস্তাব অল্প ভোটের ব্যবধানে বুন্ডেস্ট্যাগে পাস হয়ে গেল।

এরপরই দেশজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিল। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পর দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ব্যর্থ হয়ে গেল। সিডিইউয়ের ভেতর থেকেই একদল সংসদ সদস্য বিদ্রোহ করলেন। আর এতে হস্তক্ষেপ করলেন সাবেক চ্যান্সেলর ও সিডিইউয়ের প্রভাবশালী নেতা আঙ্গেলা ম্যার্কেল।

যদি মূলধারার দলগুলোর জোট গঠনের আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে জার্মানির সামনে আরও খারাপ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। হয়তো আসবে সংখ্যালঘু রক্ষণশীল সরকার, যাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে উগ্র ডানপন্থী এএফডির সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে।

পরিস্থিতি আরও জটিল হলো যখন এএফডির সহনেত্রী অ্যালিস ভাইডেল মের্ৎসকে প্রকাশ্যে অপমান করলেন। তিনি তাঁকে দুর্বল নেতা হিসেবে আখ্যা দিয়ে বললেন, তাঁর নিজের দলই তাঁকে একদম নিচে নামিয়ে দিয়েছে।

এই পুরো পর্ব মের্ৎসের জন্য চূড়ান্ত বিপর্যয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি এএফডিকে আরও সাহসী করে তুলেছেন। নষ্ট করেছেন নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, তিনি জার্মানির যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি বড় ‘ট্যাবু’ভেঙে ফেলেছেন। সেই ট্যাবু হলো, উগ্র ডানপন্থীদের সঙ্গে কোনো ধরনের সহযোগিতা না করা।

এখন মের্ৎস যদি বলেন যে তিনি আসলে এমন কিছু করতে চাননি, তাহলে সে হবে খোড়া অজুহাত। জার্মান গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে এএফডি চরমপন্থী সংগঠন হিসেবে সন্দেহের তালিকায় রয়েছে। অথচ তাদের ভোটের ওপর নির্ভর করে অভিবাসনসংক্রান্ত প্রস্তাব পাস করানোর চেষ্টা করে মের্ৎস তাঁর নীতিগত অবস্থান হারিয়েছেন। গত নভেম্বরেও তিনি প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে সিডিইউ কখনো এএফডির সঙ্গে যাবে না। এমনকি ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা’ পাওয়ার জন্যও নয়।

কিন্তু বাস্তবে মের্ৎস ঠিক সেটাই করলেন। আর এখন এই ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে তাঁকে।

মের্ৎসের পরিকল্পনা ছিল সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট (এসপিডি) ও গ্রিন পার্টির ওপর চাপ সৃষ্টি করা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা সম্পূর্ণ উল্টো ফল দিয়েছে। তিনি এসপিডি নেতা ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ এবং গ্রিন পার্টির নেতা রবার্ট হাবেকের হাতে এমন একটি ইস্যু তুলে দিয়েছেন যা তাঁদের দুর্বল নির্বাচনী প্রচারণাকে পুনর্জীবিত করতে পারে। এখন তাঁরা তাঁদের সমর্থকদের সামনে বলার সুযোগ পাচ্ছেন, সিডিইউ যে উগ্র ডানপন্থাকে স্বাভাবিক করছে, আর তারা এর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন।

কিন্তু এই জায়গায় জার্মানি এল কীভাবে?

ফ্রিডরিখ মের্ৎস আদতে পুরোনো ধারার ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাট। তিনি মুক্তবাজারের পক্ষে, ন্যাটোর সমর্থক এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি অনুগত। তিনি আদতে জনতুষ্টিবাদী নন। তিনি জাতীয়তাবাদী বা বর্ণবাদীও নন। তা সত্ত্বেও, কেন্দ্র-বাম প্রতিদ্বন্দ্বীদের রাজনৈতিকভাবে কোণঠাসা করার চেষ্টায় এবং এএফডিকে কৌশলে পরাস্ত করতে গিয়ে তিনি নিজের নেতৃত্বের যোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতাকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছেন।

এখানে একটা বিষয় বোঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ; সিডিইউ ও তাদের সহযোগী দল, ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন (সিএসইউ) নিছক পশ্চিমা গণতন্ত্রের সাধারণ মধ্য ডানপন্থী বা রক্ষণশীল দল নয়। জার্মানির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টি (সিডিইউ) গঠিত হয়েছিল তাদের ধারার আগের ব্যর্থ দলগুলোর ধ্বংসাবশেষ থেকে। এসব দল ছিল মূলত মধ্যবিত্ত জাতীয়তাবাদী, যারা নাৎসিদের শক্তিকে গুরুত্ব দেয়নি, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে নাৎসিদের সমর্থনও করেছিল। সিডিইউয়ের প্রথম নেতা ও ফেডারেল জার্মানির (পশ্চিম জার্মানি) প্রথম দীর্ঘমেয়াদি চ্যান্সেলর কনরাড আডেনাউয়ার ছিলেন গভীরভাবে রক্ষণশীল। কিন্তু একই সঙ্গে কট্টর নাৎসিবিরোধীও। তিনি জার্মান ডানপন্থাকে গণতন্ত্রবিরোধী প্রবণতা থেকে সরিয়ে এনেছিলেন।

আডেনাউয়ার তাঁর দলে অনেক সাবেক নাৎসিকেও জায়গা দিয়েছিলেন তাঁদের গণতন্ত্রের পথে আনা যাবে ভেবে। কিন্তু কখনোই তিনি পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে কোনো গণতন্ত্রবিরোধী দলের ওপর নির্ভর করার কথা ভাবতেন না। এ কারণে সিডিইউ জার্মান গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতার জন্য এক অবিচ্ছেদ্য স্তম্ভ।

সিডিইউ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন মতাদর্শের রক্ষণশীলদের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয় হয়ে থেকেছে। তবে একটা জায়গায় তারা সব সময় কঠোর অবস্থান নিয়েছে। যাঁরা হলোকাস্টকে অস্বীকার করেন বা তাঁর গুরুত্ব কমিয়ে দেখান, তাঁদের জায়গা দলে কখনো ছিল না।

এখন যদি সিডিইউ উগ্র ডানপন্থী শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়, অথবা এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যেখানে সিডিইউ আর জার্মান ডানপন্থীদের পুরোপুরি প্রতিনিধিত্ব করতে পারছে না, তাহলে তা হবে এক ভয়ংকর সংকেত। এটি শুধু সিডিইউয়ের জন্য নয়, বরং গোটা জার্মান গণতন্ত্রের জন্য এক অশনি সংকেত হয়ে উঠতে পারে।

প্রায় প্রতিদিনই উগ্র ডানপন্থী এএফডি জার্মানির ‘স্মরণ সংস্কৃতি’ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। এই সংস্কৃতি আসলে একধরনের জাতীয় ঐকমত্য। এতে নাৎসি অতীতের অপরাধের মুখোমুখি হওয়াকে জার্মান পরিচয়ের একটি মৌলিক অংশ হিসেবে ধরা হয়। উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো, এখন এএফডি এই প্রচেষ্টায় এক শক্তিশালী সহযোগী খুঁজে পেয়েছে।

গত ২৫ জানুয়ারি এএফডির এক নির্বাচনী প্রচার সভায় ভিডিও বার্তায় ইলন মাস্ক তাদের সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, অতীতের অপরাধবোধ নিয়ে ‘বেশি চিন্তা’ করার কোনো মানে নেই। তিনি যখন এ কথা বলছিলেন, তার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরই ছিল ঐতিহাসিক অউশভিৎস মুক্তির ৮০তম বার্ষিকী। মাস্কের এই ‘অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার’ আহ্বান এএফডির কর্মীরা উল্লাসের সঙ্গে গ্রহণ করেন।

তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মের্ৎস ও তাঁর দলের মূলধারার রাজনীতিবিদদের সঙ্গে এ ধরনের ইতিহাসবিকৃতি বা নাৎসি অপরাধকে হালকা করে দেখার কোনো সম্পর্ক নেই। শুক্রবার পার্লামেন্টের বিতর্কে এসপিডির এক নেতা তাঁকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘আপনি নরকের দরজা খুলে দিয়েছেন।’ তবে এটি স্পষ্ট যে মের্ৎসের আসল উদ্দেশ্য কখনোই উগ্র ডানপন্থীদের সরকারে নিয়ে আসা ছিল না। তিনি বরং চেয়েছিলেন, এএফডির প্রভাব কমিয়ে তাদের রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে দিতে।

তাহলে প্রশ্ন হলো, মের্ৎস কেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন যে তাঁই সেই চরমপন্থী শক্তির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যাদের তিনি দুর্বল করতে চেয়েছিলেন?

জার্মানির মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো যে একসঙ্গে কাজ করতে পারছে না,তা গত সপ্তাহে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে রস্পরিক দোষারোপের মাত্রা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে নির্বাচনের পর কোনো সমঝোতায় আসা কঠিন হয়ে পড়বে। অথচ জার্মানির সংসদীয় ব্যবস্থায় কার্যকর সরকার গঠনের জন্য বিভিন্ন দলের মধ্যে জোটবদ্ধ হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

আর যদি মূলধারার দলগুলোর মধ্যে জোট গঠনের আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে জার্মানির সামনে হয়তো আরও খারাপ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। হয়তো আসবে সংখ্যালঘু রক্ষণশীল সরকার, যাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে উগ্র ডানপন্থী এএফডির সমর্থনের ওপর নির্ভর করতে হবে।

আর যদি তা–ই হয়, তাহলে তা শুধু জার্মানির জন্য নয়, বরং পুরো ইউরোপের জন্য এক অস্থির রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করবে।

ইয়খ লাও ডেই জাইট পত্রিকার আন্তর্জাতিক প্রতিনিধি

গার্ডিয়ান-এর ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ড নপন থ দ র গণতন ত র র র র জন ত ক পর স থ ত দ র বল ন র জন এসপ ড দলগ ল সরক র করল ন

এছাড়াও পড়ুন:

‘জুলাই ঘোষণা’ ও ফিরে দেখা রাজনীতি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির খসড়া ঘোষণাপত্র ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত। গত ১৬ জানুয়ারি ‘জুলাই ঘোষণা’ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বানে সর্বদলীয় এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের আগে একটি খসড়া জুলাই ঘোষণা দলগুলোকে পাঠানো হয়। এ দুটি ঘোষণাপত্রের প্রধান কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রসঙ্গে
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর কাঁচামাল এবং পুঁজি সংগ্রহের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এই শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। যার প্রথম প্রকাশ ঘটে বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারের রক্তস্নাত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় হয়। এর পর বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন এবং ১১ দফার ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় পায়। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল এসব গণআন্দোলনের স্বাভাবিক পরিণতি। এই মুক্তিযুদ্ধে জাতির একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ রাজাকার, আলবদর বাহিনী যেমন ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছে, তেমন লাখো-কোটি জনগণ অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করেছে। কিন্তু এই গৌরব আওয়ামী লীগ একা আত্মসাৎ করতে গিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 

মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গঠিত হলো, তা প্রথম দিন থেকেই শোষণ, জুলুম, অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতার দিকে পা বাড়াল। সর্বশেষ ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানকে কবরস্থ করে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়। 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত একের পর এক ক্যু, পাল্টা ক্যু চলতে থাকে এবং সর্বশেষ নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হন। এরপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত এ দুটি সরকারই দেশকে কোনো স্থায়িত্ব দিতে পারেনি। উপরন্তু সংবিধানে একের পর এক সংশোধনী এনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব এবং একের পর এক জনবিরোধী নীতি কার্যকর করেছে। সর্বশেষ ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ এই শোষণ-জুলুম-অত্যাচার-বাকস্বাধীনতা হরণকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে। ২০১৪, ’১৮ ও ’২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে। জুলাই ঘোষণার মধ্যে ইতিহাসের বর্ণনায় এই উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো বাদ পড়েছে। 

বাহাত্তরের সংবিধান প্রসঙ্গে 
জুলাই ঘোষণাপত্রে তারা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকেই বাংলাদেশের সংবিধানের যথার্থ ভিত্তি হিসেবে ধরছেন। অথচ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিবকে সব রকম প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁর হাতে বিপুল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক সাম্য, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও সুবিচার– এই শব্দগুলোতে লাখো কোটি জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায় আওয়ামী লীগ সেগুলোকে বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। এই সংবিধান প্রণয়নের আগে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে মুজিববাদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটাকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্ন এখন এসেছে যে, এই সংবিধানের ভাবাদর্শগত ভিত্তি হলো মুজিববাদ। তবে জেনে রাখা উচিত, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়ারা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারী স্বাধীনতা, এক মানুষ-এক ভোট– এসব প্রগতিশীল ধারণা নিয়ে এসেছিল। এর পর থেকে সব বুর্জোয়া রাষ্ট্রই তাদের সংবিধানকে এই ধারণাগুলোর ওপর দাঁড় করায়। ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল সন্তোষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটি সভায় এক প্রস্তাব গৃহীত হয়– ‘...সংবিধান হবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক।’ ফলে আওয়ামী লীগ মুজিববাদ বলে যা দাবি করেছে, তা অন্তঃসারশূন্য।    
বাহাত্তরের সংবিধানের প্রগতিশীল ইতিবাচক দিকগুলোকে অক্ষত রেখে মূলত কাঠামোগত দিকটি সংস্কার করা উচিত। একই সঙ্গে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজ– এই ছয়টি মৌলিক অধিকারকে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে সংযুক্ত করা উচিত এবং মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে রচিত অধিকারগুলোকে আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য করা উচিত। 

ঘোষণাপত্র দুটির মধ্যে পার্থক্য
সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহণে সরকার গঠন, ‘ডিকলোনাইজড ট্রুথ অ্যান্ড হিলিং কমিশন’-এর প্রস্তাবনা, সেনাশাসন-রাষ্ট্রীয় পুঁজি-বৃহৎ ব্যবসায়ী-আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রস্তাবনা– এসব ছাত্রদের দেওয়া ঘোষণায় থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সরকারের দেওয়া খসড়া ঘোষণায় নেই। 

গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে
আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব জাগরণ এই গণঅভ্যুত্থান। দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছেন এই আন্দোলনে। আহত হয়েছেন ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। এই গণঅভ্যুত্থান থেকে ফ্যাসিবাদ ধ্বংসের স্লোগান উঠেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতন মানেই ফ্যাসিবাদের পতন নয়। ফ্যাসিবাদ কোনো দল আনে না। ফ্যাসিবাদ আনে একটি ব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে উন্নত কিংবা অনুন্নত সব দেশেই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দেখা যায়। ফলে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিলোপ ঘটেনি; ফ্যাসিবাদ পিছু হটেছে মাত্র। 
১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, এর পর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে আবার ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনা। তাই সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠন, সর্বোপরি নাগরিক সমাজের সুচিন্তিত মতামত নিয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমেই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা উচিত।

মাসুদ রানা: সমন্বয়ক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরাম, বাসদ (মার্ক্সবাদী)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মিয়ানমারের গণতন্ত্র রক্ষা অথবা স্বৈরাচারের কাছে আত্মসমর্পণ করুন
  • স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের মানবাধিকারবিষয়ক রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
  • সু চির বাড়ি তৃতীয় দফায় নিলামে বিক্রি করতে ব্যর্থ মিয়ানমারের জান্তা
  • ঢাবিতে মানবাধিকার বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত 
  • ‘জুলাই ঘোষণা’ ও ফিরে দেখা রাজনীতি
  • জার্মানিতে ডানপন্থি উত্থানের আশঙ্কা
  •  শেখ হাসিনা এদেশে গণতন্ত্রকে আবারও হত্যা করতে চায় : টিপু