শ্রমিক আন্দোলন এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। মালিকের ভোজসভায়, বনভোজন কিংবা এনজিও সেমিনারকক্ষে, সিডনি, ফ্রাঙ্কফুর্ট, ব্রাসেলস, স্টকহোম কিংবা নিউইয়র্কের বিশাল সম্মেলনে জন্ম হয় এখন তারকা শ্রমিকনেতাদের। আইপ্যাড কিংবা আইফোনের ব্যবহার, বাহারি রংবেরঙের ভিজিটিং কার্ড, সচিবালয়ের বারান্দায় আনাগোনা নির্ধারণ করে কে কত বড় শ্রমিকনেতা!

কিন্তু সহিদুল্লাহ চৌধুরী নেতা হয়ে উঠেছিলেন লড়াইয়ের ময়দানে। কারখানার শ্রমিক ছিলেন, কিংবদন্তি নেতা হয়েছেন, কিন্তু আজীবন শ্রমিক পরিচয়কে আঁকড়ে থেকেছেন। দীর্ঘ জীবনে শ্রমিক আন্দোলন, জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম, দুর্যোগ-দুর্বিপাক—সবখানেই শ্রমিকের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে অবিচল সংগ্রাম করেছেন।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ট্রেড কেন্দ্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন, ৮০ বছর বয়সেও খুলনা থেকে চট্টগ্রাম চষে বেড়িয়েছেন পাটকল-চিনিকল রক্ষার সংগ্রামে। শ্রমিকশ্রেণির এই মহান শিক্ষক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ৩ জানুয়ারি। তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনে একটি যুগের অবসান হলো বলা যায়।

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে সহিদুল্লাহ চৌধুরীদের সংসারে নেমে আসে অর্থনৈতিক সংকট। পিতা জমিদারের নায়েব ছিলেন, জমিজমাও দান করে দিয়েছিলেন। চরম আর্থিক সংকটে ১৬ বছর বয়সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনিকারা গ্রাম থেকে পাড়ি জমালেন রাজধানী ঢাকায়। তাঁর এক চাচাতো ভাইয়ের সূত্রে লতিফ বাওয়ানি জুট মিলে গেলেন কাজের সন্ধানে। বয়স কম, শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেয় না কারখানা। হতাশ হয়ে শুরু করলেন জর্দার ব্যবসা, ভবঘুরে কিশোর ব্যবসায় ব্যর্থ হলেন। শুরু করলেন মাটিকাটা দিনমজুরের কাজ।

মাটি কাটা রেখে একসময় বদলি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন লতিফ বাওয়ানি জুট মিলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। কিন্তু গরিব শ্রমিকের বঞ্চনা ও নিদারুণ শোষণ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন জুট মিলে। এই মিল তাঁর কাছে শুধু জীবিকা নির্বাহের উপায় নয়; ছিল শ্রমিকের বঞ্চনা পাঠের বিশ্ববিদ্যালয়।

এই মিলেই প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে অবাঙালি বিহারি কিংবা পাঞ্জাবি লোকেরা পঞ্চম শ্রেণি পাস করেও জুট বিভাগের প্রধান হয়েছে। অথচ বাঙালিরা বিএ পাস করেও থেকে গেছেন সুপারভাইজার। মিলমালিক নিজেদের স্বার্থে শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা লাগিয়েছে, গর্ভবতী এক নারীকে অবাঙালি শ্রমিকেরা ছুরি মেরে হত্যা করল মিলগেটেই। তিনি দেখেছেন ৪০-৫০ বছর ধরে শ্রমিকেরা মাসিক ৫০ টাকায় জীবন যাপন করে আসছে, জীবনে কোনো উন্নতি নেই। এসব বঞ্চনার বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালে এক ধর্মঘট ডাকা হয়, তিনি সেই ধর্মঘটে শ্রমিকদের সংগঠিত করেন।

ধর্মঘট ভাঙার জন্য মালিকেরা সন্ত্রাসী বাহিনী ভাড়া করল। অন্যদিকে শ্রমিকদের এমনিতেই অল্প বেতন, তার ওপর দীর্ঘদিন ধর্মঘট চালানো তাঁদের জন্য খুব কঠিন। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল। গড়ে তোলেন কৃষক শ্রমিক ঐক্য, কৃষক দাঁড়াল শ্রমিকের পাশে, রচনা করলেন প্রায় ৫৬ দিন স্থায়ী সফল ধর্মঘট। ফলে শ্রমিকদের মাসিক মজুরি বেড়েছিল ৬৫ থেকে ৮১ টাকা। দেশব্যাপী প্রায় দুই লাখ শ্রমিক সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন এই ধর্মঘটে। এই ঘটনার একটি বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্যও ছিল বলে মনে করেন তিনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে একদিকে আইয়ুবের স্বৈরাচারী মিলিটারি শাসন, অন্যদিকে হাজার হাজার নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন, জনমনে এক গভীর হতাশা।

এই ধর্মঘটের পথ বেয়ে এসেছিল ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থান। আসাদ, দরজিশ্রমিক, তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয় ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে। আসাদ শহীদ হওয়ার পর মানুষ প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠল। সহিদুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সে সময় সুতা ও পাটকল শ্রমিকদের ইউনিয়নকর্মী, শ্রমিকদের সংগঠিত করেছেন তিনি। ছাত্রদের ডাকে ২৪ জানুয়ারি দেশব্যাপী ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হলো।

সে দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘আমরা ডেমরা থেকে ২০ হাজারের মতো শ্রমিক রওনা হই, প্রত্যেকের হাতে ৫-৬ ফুট লম্বা বাঁশের লাঠি, মুখে স্লোগান “রক্তের বদলে রক্ত চাই।” ডেমরা পার হওয়ার পর সেই মিছিল এক লাখ শ্রমিকের মিছিলে পরিণত হলো। শ্রমিকের স্বতঃস্ফূর্ত জনস্রোত দেখে অভ্যুত্থানের সংগঠক ছাত্রনেতারা ভয় পেয়ে গেল। কারণ, এই বিশাল শ্রমিকের জনসমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে? অবশেষে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল মাঠে। সবাইকে বলা হয় দোয়া-দরুদ পড়তে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শ্রমিকদের সে সময়ের ভূমিকা সম্পর্কে ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক বলেন, “এই শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছাড়া এই অভ্যুত্থান কোনোভাবেই সফল হতো না।”’

অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পর ১৯৭০-এর নির্বাচন, এরপর মুক্তিযুদ্ধ। সেখানেও সহিদুল্লাহ চৌধুরী ট্রেড ইউনিয়ন হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শ্রমিকদের মধ্যে রিক্রুট করেছেন মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের আগরতলা পৌঁছে দিয়েছেন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শেষে সবাই নরসিংদীর রায়পুরা ও শ্রীপুর অঞ্চলে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। এই যুদ্ধের অংশ হিসেবে বাওয়ানি জুট মিলের কারখানাকে রূপান্তর করেছিলেন গ্রেনেড বানানোর ওয়ার্কশপে, এখানে শ্রমিকেরা গ্রেনেড বানাত যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। এ ছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), যে পার্টির সঙ্গে তিনি ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, সেই পার্টির কুরিয়ার হিসেবে কাজ করেন। ঢাকায় আটকে পড়া পার্টির বুদ্ধিজীবী যেমন শহীদুল্লা কায়সারসহ অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, খবর আদান-প্রদান করা, আটকে পড়া মানুষদের আগরতলা পৌঁছে দেওয়া ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে পাকিস্তান আর্মিদের হাতে একবার ধরাও পড়েন একসময়, কিন্তু কৌশলে প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৬৯ সালে ডেমরা বাওয়ানি জুট মিলে এক টর্নেডোয় জুট মিল এলাকার ঘরবাড়ি ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন, কী করবেন অসহায় শ্রমিকদের জন্য এই মহাবিপদে! তিনি ডেমরা থেকে পায়ে হেঁটে দৈনিক সংবাদ অফিসে আসেন, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সসত্যেন সেন, রণেশ মৈত্র তাঁদের পাওয়া যাবে—এই ভরসায়। তাঁদের যখন তিনি এসব বলেন, তাঁরা বিশ্বাস করেননি; একজন ফটোগ্রাফার পাঠান। ফটোগ্রাফার ডেমরায় মানুষের রক্তাক্ত ও বীভৎস চেহারা দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ফলে আবার তাঁকে পায়ে হেঁটে ঢাকায় আসতে হয়।

এবার এলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের কাছে, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক সে সময় সংগঠনের নেতা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে রাস্তায় মানিকের সঙ্গে দেখা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের সামনে। মানিক সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে বলছেন, ‘ তখন রাত ১০টা বাজে, সহিদুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আমরা চলে গেলাম ডেমরায়। লাইটটাইট নাই, তার মধ্যে যাতায়াত কঠিন, গিয়ে দেখলাম যে বীভৎস অবস্থা!! ওখানে পুরোদমে ত্রাণকাজ শুরু করলাম।” এই ত্রাণ চলে প্রায় দেড় মাস, এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ইউনিয়নের প্রতি শ্রমিকদের গভীর আস্থা ও বিশ্বাস। এভাবেই সহিদুল্লাহ ভাই হয়ে উঠেছিলেন শ্রমিকের আপদে-বিপদে এক অকৃত্রিম বন্ধু।’

সহিদুল্লাহ চৌধুরী ৮০ বছর বয়সেও অবিচল থেকেছেন শ্রমিকের সংগ্রামে। বিগত স্বৈরাচার সরকার ২০২০ যখন একের পর এক চিনিকল ও পাটকল বন্ধ করে দিল, তিনি শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) দায়িত্ব কাঁধে নিলেন। বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করলেন, বললেন ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল আধুনিকায়ন করে ৭৫ হাজার শ্রমিকের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব। ছুটে বেড়ালেন খুলনা থেকে চট্টগ্রাম সর্বত্র, শ্রমিকদের আবার জাগিয়ে তুলতে। হয়ে উঠলেন পাটকল-চিনিকল শ্রমিকের নিজস্ব কণ্ঠস্বর। কিন্তু সরকার তাঁর কথা শোনেনি। এর পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ছেড়ে গেলেন আমাদের এবং তাঁর দরদের মানুষ শ্রমিকদের।

সহিদুল্লাহ ভাই আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন অনেক দিন, অনুপ্রেরণা দেবেন। শক্তি জোগাবেন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে আজকের অন্ধকার কাটিয়ে আলোর যাত্রাপথে।

জাফর ইকবাল পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সহ দ ল ল হ চ ধ র কর ছ ন র জন য করল ন

এছাড়াও পড়ুন:

সহিদুল্লাহ চৌধুরী: শ্রমিক থেকে লড়াইয়ের ময়দানের নেতা

শ্রমিক আন্দোলন এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। মালিকের ভোজসভায়, বনভোজন কিংবা এনজিও সেমিনারকক্ষে, সিডনি, ফ্রাঙ্কফুর্ট, ব্রাসেলস, স্টকহোম কিংবা নিউইয়র্কের বিশাল সম্মেলনে জন্ম হয় এখন তারকা শ্রমিকনেতাদের। আইপ্যাড কিংবা আইফোনের ব্যবহার, বাহারি রংবেরঙের ভিজিটিং কার্ড, সচিবালয়ের বারান্দায় আনাগোনা নির্ধারণ করে কে কত বড় শ্রমিকনেতা!

কিন্তু সহিদুল্লাহ চৌধুরী নেতা হয়ে উঠেছিলেন লড়াইয়ের ময়দানে। কারখানার শ্রমিক ছিলেন, কিংবদন্তি নেতা হয়েছেন, কিন্তু আজীবন শ্রমিক পরিচয়কে আঁকড়ে থেকেছেন। দীর্ঘ জীবনে শ্রমিক আন্দোলন, জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম, দুর্যোগ-দুর্বিপাক—সবখানেই শ্রমিকের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে অবিচল সংগ্রাম করেছেন।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ট্রেড কেন্দ্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন, ৮০ বছর বয়সেও খুলনা থেকে চট্টগ্রাম চষে বেড়িয়েছেন পাটকল-চিনিকল রক্ষার সংগ্রামে। শ্রমিকশ্রেণির এই মহান শিক্ষক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ৩ জানুয়ারি। তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনে একটি যুগের অবসান হলো বলা যায়।

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে সহিদুল্লাহ চৌধুরীদের সংসারে নেমে আসে অর্থনৈতিক সংকট। পিতা জমিদারের নায়েব ছিলেন, জমিজমাও দান করে দিয়েছিলেন। চরম আর্থিক সংকটে ১৬ বছর বয়সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনিকারা গ্রাম থেকে পাড়ি জমালেন রাজধানী ঢাকায়। তাঁর এক চাচাতো ভাইয়ের সূত্রে লতিফ বাওয়ানি জুট মিলে গেলেন কাজের সন্ধানে। বয়স কম, শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেয় না কারখানা। হতাশ হয়ে শুরু করলেন জর্দার ব্যবসা, ভবঘুরে কিশোর ব্যবসায় ব্যর্থ হলেন। শুরু করলেন মাটিকাটা দিনমজুরের কাজ।

মাটি কাটা রেখে একসময় বদলি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন লতিফ বাওয়ানি জুট মিলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। কিন্তু গরিব শ্রমিকের বঞ্চনা ও নিদারুণ শোষণ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন জুট মিলে। এই মিল তাঁর কাছে শুধু জীবিকা নির্বাহের উপায় নয়; ছিল শ্রমিকের বঞ্চনা পাঠের বিশ্ববিদ্যালয়।

এই মিলেই প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে অবাঙালি বিহারি কিংবা পাঞ্জাবি লোকেরা পঞ্চম শ্রেণি পাস করেও জুট বিভাগের প্রধান হয়েছে। অথচ বাঙালিরা বিএ পাস করেও থেকে গেছেন সুপারভাইজার। মিলমালিক নিজেদের স্বার্থে শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা লাগিয়েছে, গর্ভবতী এক নারীকে অবাঙালি শ্রমিকেরা ছুরি মেরে হত্যা করল মিলগেটেই। তিনি দেখেছেন ৪০-৫০ বছর ধরে শ্রমিকেরা মাসিক ৫০ টাকায় জীবন যাপন করে আসছে, জীবনে কোনো উন্নতি নেই। এসব বঞ্চনার বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালে এক ধর্মঘট ডাকা হয়, তিনি সেই ধর্মঘটে শ্রমিকদের সংগঠিত করেন।

ধর্মঘট ভাঙার জন্য মালিকেরা সন্ত্রাসী বাহিনী ভাড়া করল। অন্যদিকে শ্রমিকদের এমনিতেই অল্প বেতন, তার ওপর দীর্ঘদিন ধর্মঘট চালানো তাঁদের জন্য খুব কঠিন। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল। গড়ে তোলেন কৃষক শ্রমিক ঐক্য, কৃষক দাঁড়াল শ্রমিকের পাশে, রচনা করলেন প্রায় ৫৬ দিন স্থায়ী সফল ধর্মঘট। ফলে শ্রমিকদের মাসিক মজুরি বেড়েছিল ৬৫ থেকে ৮১ টাকা। দেশব্যাপী প্রায় দুই লাখ শ্রমিক সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন এই ধর্মঘটে। এই ঘটনার একটি বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্যও ছিল বলে মনে করেন তিনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে একদিকে আইয়ুবের স্বৈরাচারী মিলিটারি শাসন, অন্যদিকে হাজার হাজার নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন, জনমনে এক গভীর হতাশা।

এই ধর্মঘটের পথ বেয়ে এসেছিল ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থান। আসাদ, দরজিশ্রমিক, তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয় ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে। আসাদ শহীদ হওয়ার পর মানুষ প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠল। সহিদুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সে সময় সুতা ও পাটকল শ্রমিকদের ইউনিয়নকর্মী, শ্রমিকদের সংগঠিত করেছেন তিনি। ছাত্রদের ডাকে ২৪ জানুয়ারি দেশব্যাপী ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হলো।

সে দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘আমরা ডেমরা থেকে ২০ হাজারের মতো শ্রমিক রওনা হই, প্রত্যেকের হাতে ৫-৬ ফুট লম্বা বাঁশের লাঠি, মুখে স্লোগান “রক্তের বদলে রক্ত চাই।” ডেমরা পার হওয়ার পর সেই মিছিল এক লাখ শ্রমিকের মিছিলে পরিণত হলো। শ্রমিকের স্বতঃস্ফূর্ত জনস্রোত দেখে অভ্যুত্থানের সংগঠক ছাত্রনেতারা ভয় পেয়ে গেল। কারণ, এই বিশাল শ্রমিকের জনসমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে? অবশেষে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল মাঠে। সবাইকে বলা হয় দোয়া-দরুদ পড়তে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শ্রমিকদের সে সময়ের ভূমিকা সম্পর্কে ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক বলেন, “এই শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছাড়া এই অভ্যুত্থান কোনোভাবেই সফল হতো না।”’

অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পর ১৯৭০-এর নির্বাচন, এরপর মুক্তিযুদ্ধ। সেখানেও সহিদুল্লাহ চৌধুরী ট্রেড ইউনিয়ন হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শ্রমিকদের মধ্যে রিক্রুট করেছেন মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের আগরতলা পৌঁছে দিয়েছেন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শেষে সবাই নরসিংদীর রায়পুরা ও শ্রীপুর অঞ্চলে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। এই যুদ্ধের অংশ হিসেবে বাওয়ানি জুট মিলের কারখানাকে রূপান্তর করেছিলেন গ্রেনেড বানানোর ওয়ার্কশপে, এখানে শ্রমিকেরা গ্রেনেড বানাত যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। এ ছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), যে পার্টির সঙ্গে তিনি ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, সেই পার্টির কুরিয়ার হিসেবে কাজ করেন। ঢাকায় আটকে পড়া পার্টির বুদ্ধিজীবী যেমন শহীদুল্লা কায়সারসহ অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, খবর আদান-প্রদান করা, আটকে পড়া মানুষদের আগরতলা পৌঁছে দেওয়া ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে পাকিস্তান আর্মিদের হাতে একবার ধরাও পড়েন একসময়, কিন্তু কৌশলে প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৬৯ সালে ডেমরা বাওয়ানি জুট মিলে এক টর্নেডোয় জুট মিল এলাকার ঘরবাড়ি ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন, কী করবেন অসহায় শ্রমিকদের জন্য এই মহাবিপদে! তিনি ডেমরা থেকে পায়ে হেঁটে দৈনিক সংবাদ অফিসে আসেন, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সসত্যেন সেন, রণেশ মৈত্র তাঁদের পাওয়া যাবে—এই ভরসায়। তাঁদের যখন তিনি এসব বলেন, তাঁরা বিশ্বাস করেননি; একজন ফটোগ্রাফার পাঠান। ফটোগ্রাফার ডেমরায় মানুষের রক্তাক্ত ও বীভৎস চেহারা দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ফলে আবার তাঁকে পায়ে হেঁটে ঢাকায় আসতে হয়।

এবার এলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের কাছে, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক সে সময় সংগঠনের নেতা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে রাস্তায় মানিকের সঙ্গে দেখা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের সামনে। মানিক সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে বলছেন, ‘ তখন রাত ১০টা বাজে, সহিদুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আমরা চলে গেলাম ডেমরায়। লাইটটাইট নাই, তার মধ্যে যাতায়াত কঠিন, গিয়ে দেখলাম যে বীভৎস অবস্থা!! ওখানে পুরোদমে ত্রাণকাজ শুরু করলাম।” এই ত্রাণ চলে প্রায় দেড় মাস, এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ইউনিয়নের প্রতি শ্রমিকদের গভীর আস্থা ও বিশ্বাস। এভাবেই সহিদুল্লাহ ভাই হয়ে উঠেছিলেন শ্রমিকের আপদে-বিপদে এক অকৃত্রিম বন্ধু।’

সহিদুল্লাহ চৌধুরী ৮০ বছর বয়সেও অবিচল থেকেছেন শ্রমিকের সংগ্রামে। বিগত স্বৈরাচার সরকার ২০২০ যখন একের পর এক চিনিকল ও পাটকল বন্ধ করে দিল, তিনি শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) দায়িত্ব কাঁধে নিলেন। বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করলেন, বললেন ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল আধুনিকায়ন করে ৭৫ হাজার শ্রমিকের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব। ছুটে বেড়ালেন খুলনা থেকে চট্টগ্রাম সর্বত্র, শ্রমিকদের আবার জাগিয়ে তুলতে। হয়ে উঠলেন পাটকল-চিনিকল শ্রমিকের নিজস্ব কণ্ঠস্বর। কিন্তু সরকার তাঁর কথা শোনেনি। এর পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ছেড়ে গেলেন আমাদের এবং তাঁর দরদের মানুষ শ্রমিকদের।

সহিদুল্লাহ ভাই আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন অনেক দিন, অনুপ্রেরণা দেবেন। শক্তি জোগাবেন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে আজকের অন্ধকার কাটিয়ে আলোর যাত্রাপথে।

জাফর ইকবাল পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া

সম্পর্কিত নিবন্ধ