শ্রমিক আন্দোলন এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। মালিকের ভোজসভায়, বনভোজন কিংবা এনজিও সেমিনারকক্ষে, সিডনি, ফ্রাঙ্কফুর্ট, ব্রাসেলস, স্টকহোম কিংবা নিউইয়র্কের বিশাল সম্মেলনে জন্ম হয় এখন তারকা শ্রমিকনেতাদের। আইপ্যাড কিংবা আইফোনের ব্যবহার, বাহারি রংবেরঙের ভিজিটিং কার্ড, সচিবালয়ের বারান্দায় আনাগোনা নির্ধারণ করে কে কত বড় শ্রমিকনেতা!

কিন্তু সহিদুল্লাহ চৌধুরী নেতা হয়ে উঠেছিলেন লড়াইয়ের ময়দানে। কারখানার শ্রমিক ছিলেন, কিংবদন্তি নেতা হয়েছেন, কিন্তু আজীবন শ্রমিক পরিচয়কে আঁকড়ে থেকেছেন। দীর্ঘ জীবনে শ্রমিক আন্দোলন, জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম, দুর্যোগ-দুর্বিপাক—সবখানেই শ্রমিকের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে অবিচল সংগ্রাম করেছেন।

জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ট্রেড কেন্দ্রের নেতৃত্ব দিয়েছেন, ৮০ বছর বয়সেও খুলনা থেকে চট্টগ্রাম চষে বেড়িয়েছেন পাটকল-চিনিকল রক্ষার সংগ্রামে। শ্রমিকশ্রেণির এই মহান শিক্ষক আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন ৩ জানুয়ারি। তাঁর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শ্রমিক আন্দোলনে একটি যুগের অবসান হলো বলা যায়।

১৯৫০ সালে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে সহিদুল্লাহ চৌধুরীদের সংসারে নেমে আসে অর্থনৈতিক সংকট। পিতা জমিদারের নায়েব ছিলেন, জমিজমাও দান করে দিয়েছিলেন। চরম আর্থিক সংকটে ১৬ বছর বয়সেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মনিকারা গ্রাম থেকে পাড়ি জমালেন রাজধানী ঢাকায়। তাঁর এক চাচাতো ভাইয়ের সূত্রে লতিফ বাওয়ানি জুট মিলে গেলেন কাজের সন্ধানে। বয়স কম, শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেয় না কারখানা। হতাশ হয়ে শুরু করলেন জর্দার ব্যবসা, ভবঘুরে কিশোর ব্যবসায় ব্যর্থ হলেন। শুরু করলেন মাটিকাটা দিনমজুরের কাজ।

মাটি কাটা রেখে একসময় বদলি শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করেন লতিফ বাওয়ানি জুট মিলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে পারেননি। কিন্তু গরিব শ্রমিকের বঞ্চনা ও নিদারুণ শোষণ গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন জুট মিলে। এই মিল তাঁর কাছে শুধু জীবিকা নির্বাহের উপায় নয়; ছিল শ্রমিকের বঞ্চনা পাঠের বিশ্ববিদ্যালয়।

এই মিলেই প্রত্যক্ষ করেছেন কীভাবে অবাঙালি বিহারি কিংবা পাঞ্জাবি লোকেরা পঞ্চম শ্রেণি পাস করেও জুট বিভাগের প্রধান হয়েছে। অথচ বাঙালিরা বিএ পাস করেও থেকে গেছেন সুপারভাইজার। মিলমালিক নিজেদের স্বার্থে শ্রমিকদের মধ্যে দাঙ্গা লাগিয়েছে, গর্ভবতী এক নারীকে অবাঙালি শ্রমিকেরা ছুরি মেরে হত্যা করল মিলগেটেই। তিনি দেখেছেন ৪০-৫০ বছর ধরে শ্রমিকেরা মাসিক ৫০ টাকায় জীবন যাপন করে আসছে, জীবনে কোনো উন্নতি নেই। এসব বঞ্চনার বিরুদ্ধে ১৯৬৪ সালে এক ধর্মঘট ডাকা হয়, তিনি সেই ধর্মঘটে শ্রমিকদের সংগঠিত করেন।

ধর্মঘট ভাঙার জন্য মালিকেরা সন্ত্রাসী বাহিনী ভাড়া করল। অন্যদিকে শ্রমিকদের এমনিতেই অল্প বেতন, তার ওপর দীর্ঘদিন ধর্মঘট চালানো তাঁদের জন্য খুব কঠিন। কিন্তু তিনি ছিলেন অবিচল। গড়ে তোলেন কৃষক শ্রমিক ঐক্য, কৃষক দাঁড়াল শ্রমিকের পাশে, রচনা করলেন প্রায় ৫৬ দিন স্থায়ী সফল ধর্মঘট। ফলে শ্রমিকদের মাসিক মজুরি বেড়েছিল ৬৫ থেকে ৮১ টাকা। দেশব্যাপী প্রায় দুই লাখ শ্রমিক সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন এই ধর্মঘটে। এই ঘটনার একটি বিশেষ রাজনৈতিক তাৎপর্যও ছিল বলে মনে করেন তিনি। রাজনৈতিক অঙ্গনে একদিকে আইয়ুবের স্বৈরাচারী মিলিটারি শাসন, অন্যদিকে হাজার হাজার নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন, জনমনে এক গভীর হতাশা।

এই ধর্মঘটের পথ বেয়ে এসেছিল ১৯৬৯ সালের অভ্যুত্থান। আসাদ, দরজিশ্রমিক, তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয় ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯ সালে। আসাদ শহীদ হওয়ার পর মানুষ প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠল। সহিদুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সে সময় সুতা ও পাটকল শ্রমিকদের ইউনিয়নকর্মী, শ্রমিকদের সংগঠিত করেছেন তিনি। ছাত্রদের ডাকে ২৪ জানুয়ারি দেশব্যাপী ঘেরাও কর্মসূচি পালিত হলো।

সে দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলছেন, ‘আমরা ডেমরা থেকে ২০ হাজারের মতো শ্রমিক রওনা হই, প্রত্যেকের হাতে ৫-৬ ফুট লম্বা বাঁশের লাঠি, মুখে স্লোগান “রক্তের বদলে রক্ত চাই।” ডেমরা পার হওয়ার পর সেই মিছিল এক লাখ শ্রমিকের মিছিলে পরিণত হলো। শ্রমিকের স্বতঃস্ফূর্ত জনস্রোত দেখে অভ্যুত্থানের সংগঠক ছাত্রনেতারা ভয় পেয়ে গেল। কারণ, এই বিশাল শ্রমিকের জনসমুদ্র নিয়ন্ত্রণ করবে কীভাবে? অবশেষে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল মাঠে। সবাইকে বলা হয় দোয়া-দরুদ পড়তে, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ।” শ্রমিকদের সে সময়ের ভূমিকা সম্পর্কে ছাত্রনেতা সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক বলেন, “এই শ্রমিকদের অংশগ্রহণ ছাড়া এই অভ্যুত্থান কোনোভাবেই সফল হতো না।”’

অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর পর ১৯৭০-এর নির্বাচন, এরপর মুক্তিযুদ্ধ। সেখানেও সহিদুল্লাহ চৌধুরী ট্রেড ইউনিয়ন হাতিয়ার নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি শ্রমিকদের মধ্যে রিক্রুট করেছেন মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের আগরতলা পৌঁছে দিয়েছেন প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। প্রশিক্ষণ শেষে সবাই নরসিংদীর রায়পুরা ও শ্রীপুর অঞ্চলে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। এই যুদ্ধের অংশ হিসেবে বাওয়ানি জুট মিলের কারখানাকে রূপান্তর করেছিলেন গ্রেনেড বানানোর ওয়ার্কশপে, এখানে শ্রমিকেরা গ্রেনেড বানাত যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য। এ ছাড়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), যে পার্টির সঙ্গে তিনি ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, সেই পার্টির কুরিয়ার হিসেবে কাজ করেন। ঢাকায় আটকে পড়া পার্টির বুদ্ধিজীবী যেমন শহীদুল্লা কায়সারসহ অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, খবর আদান-প্রদান করা, আটকে পড়া মানুষদের আগরতলা পৌঁছে দেওয়া ছিল তাঁর অন্যতম কাজ। এই কাজ করতে গিয়ে পাকিস্তান আর্মিদের হাতে একবার ধরাও পড়েন একসময়, কিন্তু কৌশলে প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৬৯ সালে ডেমরা বাওয়ানি জুট মিলে এক টর্নেডোয় জুট মিল এলাকার ঘরবাড়ি ভেঙে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। তিনি হতবিহ্বল হয়ে পড়েন, কী করবেন অসহায় শ্রমিকদের জন্য এই মহাবিপদে! তিনি ডেমরা থেকে পায়ে হেঁটে দৈনিক সংবাদ অফিসে আসেন, সেখানে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা সসত্যেন সেন, রণেশ মৈত্র তাঁদের পাওয়া যাবে—এই ভরসায়। তাঁদের যখন তিনি এসব বলেন, তাঁরা বিশ্বাস করেননি; একজন ফটোগ্রাফার পাঠান। ফটোগ্রাফার ডেমরায় মানুষের রক্তাক্ত ও বীভৎস চেহারা দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। ফলে আবার তাঁকে পায়ে হেঁটে ঢাকায় আসতে হয়।

এবার এলেন ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের কাছে, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক সে সময় সংগঠনের নেতা। ঘুটঘুটে অন্ধকারে রাস্তায় মানিকের সঙ্গে দেখা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের সামনে। মানিক সে দিনের ঘটনা সম্পর্কে বলছেন, ‘ তখন রাত ১০টা বাজে, সহিদুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আমরা চলে গেলাম ডেমরায়। লাইটটাইট নাই, তার মধ্যে যাতায়াত কঠিন, গিয়ে দেখলাম যে বীভৎস অবস্থা!! ওখানে পুরোদমে ত্রাণকাজ শুরু করলাম।” এই ত্রাণ চলে প্রায় দেড় মাস, এর মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে ইউনিয়নের প্রতি শ্রমিকদের গভীর আস্থা ও বিশ্বাস। এভাবেই সহিদুল্লাহ ভাই হয়ে উঠেছিলেন শ্রমিকের আপদে-বিপদে এক অকৃত্রিম বন্ধু।’

সহিদুল্লাহ চৌধুরী ৮০ বছর বয়সেও অবিচল থেকেছেন শ্রমিকের সংগ্রামে। বিগত স্বৈরাচার সরকার ২০২০ যখন একের পর এক চিনিকল ও পাটকল বন্ধ করে দিল, তিনি শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের (স্কপ) দায়িত্ব কাঁধে নিলেন। বিকল্প প্রস্তাব তৈরি করলেন, বললেন ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করলে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল আধুনিকায়ন করে ৭৫ হাজার শ্রমিকের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব। ছুটে বেড়ালেন খুলনা থেকে চট্টগ্রাম সর্বত্র, শ্রমিকদের আবার জাগিয়ে তুলতে। হয়ে উঠলেন পাটকল-চিনিকল শ্রমিকের নিজস্ব কণ্ঠস্বর। কিন্তু সরকার তাঁর কথা শোনেনি। এর পরপরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ছেড়ে গেলেন আমাদের এবং তাঁর দরদের মানুষ শ্রমিকদের।

সহিদুল্লাহ ভাই আমাদের মধ্যে বেঁচে থাকবেন অনেক দিন, অনুপ্রেরণা দেবেন। শক্তি জোগাবেন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে আজকের অন্ধকার কাটিয়ে আলোর যাত্রাপথে।

জাফর ইকবাল পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: সহ দ ল ল হ চ ধ র কর ছ ন র জন য করল ন

এছাড়াও পড়ুন:

বাংলাদেশকে দেওয়া ২ স্থলবন্দরের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল ভারতের

পেট্রাপোল ও গেদে স্থলবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রপ্তানি পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। এ সুবিধা বাতিল হলেও ভারতের ভূখণ্ড হয়ে ভুটান ও নেপালে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছে দিল্লি। তবে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করার পর গতকাল বুধবারই বেনাপোল বন্দর থেকে চারটি পণ্যবাহী ট্রাক ফেরত পাঠিয়েছে দেশটি। 

এদিকে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে যাওয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে গতকাল রাতেই জরুরি বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কার্যালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। অনলাইনে যুক্ত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা।

বৈঠক শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানির যে প্রক্রিয়া তাতে এ সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে সরকার তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ সার্বিক বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দরের নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করে এ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হবে। সেখানে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

গত মঙ্গলবার ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে এক বিজ্ঞপ্তিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশের জন্য যে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তাতে ভারতের বিমান ও সমুদ্রবন্দরে উল্লেখযোগ্য জট হতো। ফলে পণ্য নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি ও রপ্তানিকারকদের খরচ বেড়ে যেত। তবে এটিও পরিষ্কার– এ সুবিধা বাতিলে নেপাল ও ভুটানে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য ট্রানজিটে কোনো প্রভাব পড়বে না।

সিবিআইসির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০২০ সালের ২৯ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে পেট্রাপোল স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশি পণ্যকে কলকাতা স্থল ও বিমানবন্দর এবং মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে নাভা শিভাবন্দরে পরিবহনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া একই সময় রেল সুবিধা ব্যবহার করে পেট্রাপোল ও গেদে বা রানাঘাট স্থলবন্দর ব্যবহার করে নাভা শিভাবন্দরে পণ্য পরিবহনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, যা বাতিল করা হলো। তবে ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগের বিজ্ঞপ্তিটি সংশোধন করে শুধু কলকাতা বিমানবন্দরের সঙ্গে দিল্লি বিমানবন্দরের এয়ার কার্গোকেও সংযুক্ত করে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান সমকালকে বলেন, ইতোমধ্যে ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্ক ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে। একই দিন ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল, যা উদ্বেগের। এ সিদ্ধান্তের ফলে ভারতের স্থল ও বিমানবন্দরগুলো দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। বিঘ্নিত হতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি কার্যক্রম। কারণ, সুবিধাটি বাণিজ্য সহজ ও খরচ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। এখন বাংলাদেশের জন্য লজিস্টিক্যাল চাপ বাড়তে পারে, যা আঞ্চলিক বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে গত ৪ এপ্রিল বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বৈঠকের এক সপ্তাহ না পেরোতেই এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিল ভারত।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে বলেছেন, ভারত সমুদ্রবন্দরগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পর সিঙ্গাপুরের পরিবর্তে সেগুলো ব্যবহারের জন্য আমাদের একাধিকবার বলেছে। কিন্তু রুটটি পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের জন্য খুব বেশি সুবিধাজনক না হওয়ায় তেমন ব্যবহার করা হয়নি। এ বন্দরগুলো হয়ে নগণ্য পরিমাণ পণ্য যেত। ফলে সুবিধা বাতিলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে এ মুহূর্তে দুই দেশের সম্পর্কে যে শীতলতা বিরাজ করছে, সে বিবেচনায় সিদ্ধান্তটির যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) আনোয়ার হোসেন জানান, বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিজিএমইএসহ অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এর প্রভাব কী হতে পারে, তা পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরে তেমন পড়বে না বাণিজ্যিক প্রভাব

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় দু’দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সর্ম্পকে কিছুটা প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে ট্রানজিটের মাধ্যমে গত পাঁচ বছরে যে পরিমাণ পণ্য আনা- নেওয়া হয়েছে তাতে সরাসরি বাণিজ্যিক প্রভাব তেমন বেশি হবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত পাঁচ বছরে খুব অল্প পরিমাণ ট্রানজিট পণ্য আনা-নেওয়া করেছে ভারত। এসব পণ্য থেকে বাংলাদেশ খুব বেশি রাজস্বও পায়নি। ভারত হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নিলেও বাংলাদেশ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমি মনে করি না। তবে তাৎক্ষণিক এ বিষয়ে বাংলাদেশের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো ঠিক হবে না।

ভারত হয়ে নেপাল ও ভুটানে কিছু গার্মেন্ট পণ্য যায়। এটিও রপ্তানি হারের তুলনায় অনেক কম বলে মন্তব্য করেন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, আমার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত শুল্কনীতি ভারতকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছে। তারা হয়তো ভেবেছে, এই সুযোগ অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের পণ্য সেখানে নিয়ে ‘মেড ইন ভারত’ লিখে রপ্তানি করার সুযোগ নিতে পারে অসাধু ব্যবসায়ীরা। হয়তো এ কারণে সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এটিকে কূটনৈতিক চ্যানেলে মোকাবিলা করতে হবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল ম্যানেজার এনামুল করিম বলেন, ট্রানজিটের আওতায় চার-পাঁচটি চালানে পণ্য এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। মাত্র আট টন চা পাতা এই বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়ছে ভারতে। বন্দরের মোট হ্যান্ডলিংয়ের তুলনায় এটি খুবই সামান্য। 

চার মালবাহী ট্রাক ফেরত পাঠিয়েছে ভারত

বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করায় গতকাল বেনাপোল বন্দর থেকে চারটি মালবাহী ট্রাক ফেরত পাঠিয়েছে ভারত। পরে রপ্তানি পণ্যবোঝাই চারটি ট্রাক ঢাকায় ফেরত আসে।

এ বিষয়ে ভারতের পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, স্থলবন্দর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা বন্ধের জন্য ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় একটি চিঠি ইস্যু করেছে কাস্টমসে। এ চিঠির আলোকে ট্রানজিট সুবিধার পণ্য বেনাপোল থেকে পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। 

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুজিবর রহমান বলেন, ভারত সরকার ট্রানজিট সুবিধা বাতিল করায় আজ (বুধবার) বেনাপোল থেকে চারটি রপ্তানি পণ্যবোঝাই ট্রাক ফেরত গেছে। ঢাকার রপ্তানিকারক ডিএসভি এয়ার অ্যান্ড সি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠানের ছিল ট্রাকগুলো।

সম্পর্কিত নিবন্ধ