ছোটবেলায় মা-বাবার মৃত্যুর পর চাচা জয়নাল শেখের কাছে বড় হন রফিকুল ইসলাম শেখ (২৫)। চাচার সংসারে অভাব থাকায় তিনি পড়াশোনায় বেশি দূর এগোতে পারেননি। এক সময় সিদ্ধান্ত নেন ইতালি যাওয়ার। ভাতিজা রফিকুলের জন্য ভিটেবাড়ি, সহায়-সম্বল বিক্রি করে দালালের হাতে ২০ লাখ টাকা তুলে দেন জয়নাল শেখ। ভূমধ্যসাগরে থেমে গেছে তাঁর স্বপ্নযাত্রা। 

রফিকুলের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলায়। তিনি রাঘদী ইউনিয়নের মোল্লাদী গ্রামের প্রয়াত আব্দুল মজিদ শেখের ছেলে। সম্প্রতি অবৈধভাবে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে রফিকুলের সঙ্গে এ উপজেলার আরও দুই যুবক প্রাণ হারিয়েছেন। তারা হলেন– চরপ্রসন্নদী গ্রামের ওহাব খন্দকারের ছেলে সাত্তার খন্দকার (৪০) ও মেহেদী শেখের ছেলে আরাফসান ইসলাম আশিক (১৮)। তাদের মৃত্যুতে তিন পরিবারে মাতম চলছে।

সম্প্রতি ভূমধ্যসাগরের লিবিয়া উপকূল থেকে ২০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়। তাদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশি বলে ধারণা স্থানীয় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির। গত শনিবার লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের বরাতে এই আশঙ্কার কথা জানায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের বার্তায় বলা হয়, নিহত ২০ জনেরই দাফন হয়েছে। লাশগুলো পচে যাওয়ার অবস্থায় ছিল। কেউই তাদের পরিচয় কিংবা জাতীয়তা নিশ্চিত করতে পারেনি। স্থানীয় উদ্ধারকারী কর্তৃপক্ষের মতে, অভিবাসনপ্রত্যাশীদের একটি নৌকা ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়ার পর এসব লাশ ব্রেগা তীরে ভেসে আসে।

এর মধ্যে খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, ওই ২০ জনের মধ্যে রয়েছেন সাত্তার খন্দকার, রফিকুল ইসলাম ও আরাফসান ইসলাম আশিক। তাদের লাশ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা।

রফিকুলের চাচা জয়নাল শেখ বলেন, ভাতিজাকে ইতালি পাঠাতে নিজের ভিটেবাড়ি ও সহায়-সম্বল বিক্রি করেছি। কিন্তু ভূমধ্যসাগর তাকে কেড়ে নিয়েছে। দ্রুত লাশ দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাই।

আশিকের বাবা মেহেদী শেখ বলেন, ছেলেকে ইতালি পাঠানোর জন্য ঋণ ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে ১৭ লাখ টাকা জোগাড় করি। পরে পাশের শ্রীজিতপুর গ্রামের রকমান হাওলাদারের ছেলে বাবু হাওলাদারের হাতে সেই টাকা তুলে দিই। লিবিয়া পৌঁছানোর পর ছেলের সঙ্গে তিন থেকে চারবার কথা হয়েছে। পরে জানতে পারি, ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে আমার ছেলে মারা গেছে। দালাল চক্রের কারণে আমি সন্তানহারা হলাম।

সাত্তার খন্দকারের স্ত্রী লাবনী খন্দকার বলেন, লিবিয়া পৌঁছানোর পর আমার কাছ থেকে তিন দফা টাকা নিয়েছে দালাল চক্র। ইতালি পৌঁছে দিতে ২৪ লাখ টাকা দেওয়ার মৌখিক চুক্তি হয়েছিল। কিন্তু তারা আমার কাছ থেকে ২৬ লাখ টাকা নিয়েছে। আমি দ্রুত আমার স্বামীর লাশ দেশে ফেরত আনার দাবি জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে দালালদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছি।

জনশক্তি ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক ষষ্ঠীপদ রায় বলেন, গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর ও মাদারীপুরে দালাল চক্রের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। এ চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাহী বিভাগের কাছে সুপারিশ করে প্রতিবেদন পাঠিয়েছি। কিন্তু চক্রের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দালালদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হলে তারা এ কাজ থেকে বিরত হবে।

মুকসুদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসনীন আক্তার বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে অভিযোগ দিলে তদন্ত করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গ প লগঞ জ গ প লগঞ জ ব যবস থ ইসল ম

এছাড়াও পড়ুন:

‘হামরা গরিব মাইনসের শখ আল্লাদও কাড়ি নেয় ওমরা’

‘মাছ-গোশত কিনবার তো বুদ্দি নাই। পয়লা বৈশাকে হামার সজনা (শজিনা), করলা আর পাটশাকই ভরসা। কিন্তুক বৈশাকের আগোতে শাকসবজির দাম বাড়াইচে ব্যবসায়ীরা। হামরা গরিব মাইনসের শখ-আল্লাদও কাড়ি নেয় ওমরা।’ রংপুর সিটি বাজারে গতকাল শুক্রবার বাজার করতে এসেছিলেন নিউ জুম্মাপাড়া এলাকার রিকশাচালক সাইদুল ইসলাম। এ সময় নিত্যপণ্য ও সবজির চড়া দাম দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে কথাগুলো বলেন তিনি।
রংপুর অঞ্চলের মানুষ পুরোনো দিনের রীতি অনুসরণ করে চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষ বরণ করেন। তারা খাবারের তালিকায় তিতা জাতীয় সবজি করলা, পাট শাক কিংবা শজিনা রাখেন। 
কিন্তু পহেলা বৈশাখ ঘিরে বাজারে এসব শাকসবজির দাম বেড়ে গেছে। দু’দিন আগে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও শুক্রবার করলার দাম ওঠে ৬০ টাকা। ৮০ টাকার শজিনা বিক্রি হয়েছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। ১০ টাকার প্রতি আঁটি পাট শাক নেওয়া হচ্ছে ২০ টাকা।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামে রমজান মাসে কিছুটা স্বস্তি মিললেও পহেলা বৈশাখ সামনে রেখে বাজারে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। প্রতিটি সবজির দাম কেজিতে বেড়েছে ২০ টাকা কিংবা 
তারও বেশি। বাজারে ৬০ টাকার নিচে তেমন কোনো সবজি মিলছে না। এতে ক্ষুব্ধ অনেকে বিক্রেতাদের সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়াচ্ছেন। হঠাৎ শাকসবজির দাম বাড়াতে নিম্ন আয়ের মানুষ বিপদে পড়েছেন। তাদের বাংলা নববর্ষ উদযাপনের আনন্দে ভাটা পড়েছে।
সিও বাজারে ব্যাগ হাতে ঘুরছিলেন উত্তম এলাকার আলী হোসেন নামে এক ক্রেতা। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দু’দিনের ব্যবধানে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে সবজির দাম। মৌসুমের শুরুতে চার সদস্যের পরিবারের জন্য ২০ টাকায় কেনা যেত দুই আঁটি পাট শাক। পহেলা বৈশাখ ঘিরে এখন তার দাম ৪০ টাকা। রমজানে বাজার তদারকির কারণে ন্যায্য দামে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন বিক্রেতা। এখন সবকিছুই ফের লাগামহীন হয়ে গেছে।
সিটি, সিও, কামাল কাছনাসহ নগরীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। কয়েকদিনের ব্যবধানে ৬০ টাকার পটোল ৮০, ৬০ টাকার কাঁকরোল ৭০-৮০, ৬০ টাকার ঝিঙে ৮০, ৫০ টাকার চিচিঙ্গা ৬০-৭০ টাকা, ৫০ টাকার কচুর লতি ৭০, ৪০ টাকার বরবটি ৬০ ও ৪০ টাকার বেগুন ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দু’দিন আগে রসুন ৮০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও এখন ১০০ থেকে ১২০ এবং ১২০ টাকার আদা বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। ৪০ টাকার কাঁচামরিচ ৬০, ৩০ টাকার পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৫০ এবং ৪০ টাকার পেঁপে ও গাজর বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি।
সিটি বাজারে জলকর থেকে আসা স্নিগ্ধা নামে এক গৃহবধূ বলছিলেন, ‘একেক সময় একেক অজুহাতে নিত্যপণ্য ও সবজির দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বিক্রেতা। এতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু। রমজানে কিছুটা স্বস্তি মিললেও ফের আগের নিয়মে ফিরছে সবজির বাজার।’
বাজারে সবজি কিনতে এসেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী আবুল কালাম। তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখ ঘিরে সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। বাজারে ৬০ টাকার নিচে ভালো কোনো সবজি না মেলায় নিম্ন আয়ের মানুষের বাংলা নববর্ষ উৎসবের আয়োজনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
দু’দিন ধরে পহেলা বৈশাখের প্রভাব পড়েছে বলে দাবি করেন সিটি বাজারের সবজি বিক্রেতা লোকমান গণি। তিনি বলেন, চাহিদা বাড়লেও সরবরাহ কম। যে কারণে দাম বেশি। শুক্রবার ছুটির দিনে পাইকাররা বাড়তি দাম রাখেন। আরেক বিক্রেতা আব্দুল হাকিমের ভাষ্য, রংপুর অঞ্চলে দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় মৌসুমি শাকসবজির ফলন কমেছে। এতে গ্রীষ্মকালীন শাকসবজির সরবরাহ কম। সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রংপুরের সহকারী পরিচালক বোরহান উদ্দিন বলেন, সরবরাহ থাকলেও দু’দিনের ব্যবধানে সবজির দাম বেড়েছে। নববর্ষের অজুহাতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়েছেন। এ ব্যাপারে মাঠ পর্যায়ে তদারক করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ