লালমাইয়ে একটি বৌদ্ধবিহারে মূর্তি চুরি
Published: 5th, February 2025 GMT
কুমিল্লার লালমাই উপজেলায় প্রাচীন একটি বৌদ্ধবিহারে চুরির ঘটনা ঘটেছে। বৌদ্ধবিহার কর্তৃপক্ষের দাবি, চোরেরা গেটের তালা ভেঙে ১০ ইঞ্চি উচ্চতার শতবর্ষী অষ্টধাতুর একটি মূর্তি, পাঁচটি তামার মূর্তি এবং আইপিএসের দুটি ব্যাটারি চুরি করে নিয়ে গেছে। অষ্টধাতুর মূর্তিটি বেশ মূল্যবান।
গত মঙ্গলবার রাত আড়াইটার দিকে উপজেলার বাকই উত্তর ইউনিয়নের আলোকদিয়া মধ্যমপাড়ার ধর্মদূত বৌদ্ধবিহারে এ ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে বুধবার বিকেলে লালমাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো.
মিন্টু সিংহ বলেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাত দুইটার পরে চোরেরা পিকআপ ভ্যানে করে এসে বিহারের গেটের তালা ভেঙে একটি শতবর্ষী অষ্টধাতু মূর্তি, পাঁচটি তামার মূর্তি ও আইপিএসের দুটি ব্যাটারি নিয়ে গেছে। অন্য আরেকটি মূর্তি বিহারের মাঠে ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেছে। হয়তো চোরেরা নিয়ে যাওয়ার সময় সেটি পড়ে ভেঙে গেছে।
চুরি যাওয়া বিহারের পাশেই অবস্থিত আলোকদিয়া শাক্যমুনি প্যাগোডার দায়িত্বরত বৌদ্ধভিক্ষু প্রজ্ঞাদীপ্তি বলেন, আলোকদিয়া মধ্যমপাড়া এলাকায় অবস্থিত ধর্মদূত বৌদ্ধবিহারটি প্রায় শতবছরের পুরোনো। তবে সেখানে রাতে কোনো ভিক্ষু অবস্থান করেন না, শুধু দিনে ধর্মীয় কার্যক্রম চলে। ধর্মীয় উপাসনালয়ে নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়াতে তিনি প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন। যেসব মূর্তি চুরি হয়েছে, সেগুলো শতবর্ষী এবং অনেক মূল্যবান। তাঁদের চাওয়া প্রশাসন চোরদের শনাক্ত করে মূর্তিগুলো দ্রুত উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেবে।
লালমাই থানার ওসি মো. শাহ আলম বলেন, বিহারের পক্ষ থেকে লিখিত অভিযোগ পেয়েই বিহারটি পরিদর্শন করেছেন। রাতে ওই বিহারে কেউ থাকেন না। এ ছাড়া সিসি ক্যামেরাও ছিল না। এই সুযোগে বিহারের গেটের তালা ভেঙে চুরি হয়েছে। চুরি হওয়া মূর্তি উদ্ধার এবং চোরদের শনাক্ত করতে আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অবস থ
এছাড়াও পড়ুন:
বৈশাখজুড়ে শতবর্ষী মেলা
বাঙালির নানা রূপের চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতির মধ্যে বৈশাখী মেলা একটি। ঐতিহাসিকভাবে মেলার জন্য বিখ্যাত চলনবিল অধ্যুষিত জনপদ তাড়াশ। তাড়াশের কলেজশিক্ষক মোছা. মাসুমা খাতুন বলেন, ‘যেহেতু এই গ্রামীণ জনপদেই জন্ম, সেহেতু চৈত্রসংক্রান্তিতে শ্মশান থেকে হাজরা ছোটা, বৈশাখী মেলায় গিয়ে নাগরদোলায় দোল খেলা, বায়োস্কোপে বিপ্লবী ক্ষুদিরাম বসুর ফাঁসির দৃশ্য দেখে কষ্ট পাওয়া, পতুল নাচ, মৃত্যুকূপে মোটরসাইকেল খেলা, জাদু খেলা দেখা বা সার্কাসের ইয়া বড় হাতি দর্শন জীবনের এক বড় অধ্যায় হয়ে রয়েছে। সেই সঙ্গে ছোট ভাইদের জন্য টিন বা কাঠের বন্দুক, বাঁশের বাঁশি, বেলুন, আম কাটার চাকু, নিজের ও বোনদের কাচের লাল চুড়ি, চুল বাঁধার ফিতা, বনানী নামের স্নো কেনাসহ উপভোগ্য বহু ঘটনা এখনও আমায় স্মৃতিকাতর করে।’
স্থানীয় একাধিক প্রবীণ ব্যক্তি জানান, আশি ও নব্বই দশকেও তাড়াশে অনুষ্ঠিত হওয়া বেশ কয়েকটি বড় মেলায় সন্ধ্যারাত থেকে কুপি বাতি, হারিকেন, হ্যাজাক জ্বালিয়ে চলত নানা অনুষ্ঠান, হরেক রকমের পণ্যের বিকিকিনি। এখন তা চলছে বিদ্যুতের বাতিতে। তাড়াশের ২৯টি বার্ষিক মেলার সবই দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় চান্দ্রক্ষণের ওপর নির্ভর করে। মূলত সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলায় চৈত্র, বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ– এ তিন মাসে ২৯টি মেলার আয়োজন হয় বিভিন্ন গ্রামে; যার অধিকাংশ মেলার স্থান শত বা অর্ধশত বছর আগে নির্ধারিত। এগুলোর মধ্যে উপজেলা প্রশাসন মেলার ব্যাপকতা, লোক সমাগম ও গুরুত্ব বিবেচনা করে শতবর্ষী বা শতবর্ষের কাছাকাছি ১৭টি মেলাকে একদিনের বিশেষ হাট হিসেবে ইজারা দিয়ে রাজস্ব আদায় বা টোল আদায় করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য– বেহুলার স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে বৈশাখী পূর্ণিমায় বিনসাড়া গ্রামে বসে তিন দিনের বেহুলা সুন্দরীর ‘চাঁদের মেলা’। চৈত্রের পূর্ণিমার রাতে তাড়াশের ‘বারুহাঁসের ভাদাই মেলা’, বৈশাখের তৃতীয় মঙ্গলবার বসা বড় ও ছোট ‘গুড়মা মেলা’ এবং কৃষ্ণা দিঘির ‘কৃষ্ণপুরের মেলা’ অন্যতম। অন্যদিকে জ্যৈষ্ঠের শুরুতে বসে ‘গোনতা মেলা’, ‘মাঝদক্ষিণা মেলা’, ‘রানীর হাট মেলা’, ‘আড়ংগাইল মেলা’, ‘দোবিলা মেলা’, ‘বস্তল মেলা’, ‘কুন্দইল মেলা’, ‘গুড়পিপুলের নিশানের মেলা’ প্রভৃতি।
এসব মেলা ঘিরে রয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিক রেওয়াজ; যা কমবেশি আজও বিদ্যমান। মেলার আগেই ঝি, জামাই, কাছের-দূরের আত্মীয়-স্বজনকে নাইওর আনার প্রচলন রয়েছে এ জনপদে। আজও ‘বারুহাঁস’, ‘গুড়মা’, ‘রানীর হাট’, ‘বেহুলার মেলা’সহ অনেক মেলা বসার আগেই স্থানীয় প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মেয়ে জামাই, আত্মীয়-স্বজনে ঠাসা থাকে। এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বৈশাখী মেলার সতেজ আমেজ। সে আমেজে রেওয়াজ মেনে শ্বশুরবাড়ির পক্ষ থেকে শাশুড়ির হাত দিয়ে নতুন-পুরোনো সব জামাইকে মেলার ‘পরবি’ (নগদ টাকা) এবং মেলা শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সময় নতুন পোশাক, বিশেষ করে দামি লুঙ্গি উপহার দেওয়া এবং মেলার ঝুরি, মুড়কি, শাঁস, শুকনা মিষ্টি, রান্না করা খাবার বেঁধে আত্মীয় বাড়িতে পাঠানোর চল এখনও রয়েছে। নাইওরে আসা জামাইদেরও এসব মেলায় বড় অঙ্কের টাকা খরচ হয়। মেলা থেকে হাঁড়িভর্তি মিষ্টি, বড় মাছ, মাংস, শাশুড়ির জন্য পান-সুপারি কিনে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যেতে হয়। সে ক্ষেত্রে অনেক জামাই শ্বশুরের নাম রাখতে প্রতিযোগিতা করে মেলার সবচেয়ে বড় মাছ কিনে থাকেন। এ ছাড়া শ্যালক-শ্যালিকা ও তাদের সন্তানসহ ছোটদের মেলার পরবি দেওয়া বা অন্য উপহারের আবদার মেটানোও জামাইদের পুরোনো রেওয়াজ। তাড়াশের বৈশাখী মেলায় চিনি দিয়ে তৈরি সুস্বাদু হাতি, ঘোড়া, হরিণ, পাখি আকৃতির ছাঁচ, খাগড়াই, বাতাসা, কদমা প্রচুর পরিমাণে বিক্রি হয়। আরও রয়েছে বাহারি মিষ্টি রসগোল্লা, চমচম, ছানার জিলাপি, রসমালাই, শাহি, ক্ষীরশা দই। এ ছাড়া মেলায় শত শত মণ ঝুরি বিক্রি হয়। বাঁশ-বেতের জিনিস, কাঠের আসবাব, মসলা, শীতলপাটি, মৃৎ পাত্র, খেলনা, কসমেটিক সামগ্রী, কৃষিজ উপকরণ– হরপাট, কারাল, ডালি, টুপরি, চালুন, কুলা এমনকি হাতপাখা, চুন, পান-সুপারি ইত্যাদি তো আছেই। সব মিলিয়ে তাড়াশের ২৯টি মেলায় দুই-আড়াই মাসের মধ্যে কয়েক কোটি টাকার পণ্য কেনাবেচা হয়। তাড়াশের নওগাঁ জিন্দানী ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের প্রভাষক সনাতন দাশ বলেন, ‘এটা শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নয়। সব বয়সী লাখো মানুষের মেলাকেন্দ্রিক বাঙালি সংস্কৃতির অদৃশ্য খোরাক পূরণ হয় এসব মেলায়। উৎসবের মূল্যের কাছে অর্থের মূল্য অতি নগণ্য।’