চল্লিশে পা দিলেন ফুটবলের উপেক্ষিত প্রতিনায়ক
Published: 5th, February 2025 GMT
বয়স, সে তো একটা সংখ্যা কেবল! এই বাণীটা অন্তত ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর ক্ষেত্রে সত্য। আজ (৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫) জীবনের ৪০তম বসন্তে পা রাখলেন তিনি। অথচ এই বয়সে কজনই বা পেশাদার ফুটবলটা চালিয়ে যাওয়ার ধৃষ্টতা দেখায়? তবে পর্তুগিজ মহাতারকা কি না এই বয়সে করে বসলেন গোলের হাফসেঞ্চুরি! না, আপনি ভুল পড়ছেন না, গত বছরের (২০২৪) জন্মদিনের পর পৃথিবী তার কক্ষপথে আরও একবার ঘুরে আসার আগে রোনালদো তার ক্যারিয়ারে যোগ করেছেন আরও ৫০টি গোল। তাকে বিশেষিত করতে গেলে বিশেষণ যে ফুরায় ভান্ডার। তবে জীবনান্দের মতো বলা যায়- এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর।
কোথা থেকে শুরু যে তার আর কোথায় হবে শেষ/রোনালদোতে মজে গেলে রাতও হবে শেষ। এই মহাতারকার জীবন যুদ্ধের গল্পের শুরুটা যে, মায়ের গর্ভ থেকেই। ভাস্কো দা গামা, ইউসোবিও আর লুই ফিগোদের দেশে ১৯৮৫ সালে জন্ম নেন রোনালদো। পর্তুগালের অখ্যাত মাদেইরাতে তিনি যখন মায়ের গর্ভে তখনই, ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেলেন গর্ভপাত করতে। তা না হলে নাকি জন্ম নেওয়া শিশুটি দূরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগবেন। তবে রোনালদোর মা মারিয়া ডোলোরেস দস সান্তোস বাঁধ সেধে বললেন- তিনি এই সন্তানকে রক্ষা করবেন যে কোন মূল্য।
অন্যদিকে সারাটা জীবন চ্যালেঞ্জ জয় করা সিআর৭ও বুড়ো আঙুল দেখালেন চিতিৎসকের ভবিষ্যত বাণীকে। তবে যে বয়সে ছোট্ট ছেলেরা লেখাপড়ায় ব্যস্ত থাকে, মা-বাবার কাছে করে খেলনার আবদার। সেই বয়স থেকেই রোনালদোর একটাই ধ্যান জ্ঞাণ, ফুটবলই যে সব তার। দারিদ্যের সঙ্গে লড়াই করা বাবা জোসে দিনিস আভেইরো ছেলের এই স্বপ্নের পথে কাঁটা হতে চাইলেন না, আর মা তো প্রতিদিন নিয়ে যেতেন অনুশীলনে।
আরো পড়ুন:
ফাইনাল পর্বে ১০ জন নিয়ে জয় ব্রাজিলের, জিতল আর্জেন্টিনাও
নারী ফুটবলার সুমাইয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার হুমকি
এরপরের গল্পটাতো সবার জানা। স্পোর্টিং সিপিতে থাকাকালীন চোখে পড়লেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা কোচ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের। ইউনাইটেডের ঘরের ছেলে ডেভিড ব্যাকহামের ৭ নম্বর জার্সিটা রোনালদোকেই দিলেন কোচ। তাতেই ইংলিশ মিডিয়াতে গেল-গেল রব পড়ে যায়। তবে জুহুরি চোখের স্যার ফার্গি কি আর হীরা চিনতে ভুল করেন? ইউনাইটেডকে ইউরোপের সেরা বানিয়ে অর্জন করলেন ক্যারিয়ারের প্রথম ব্যালন ডি-অর। প্রথম ধাপে ৬ বছর রেড ডেভিলদের হয়ে খেলেই নিজেকে নিয়ে গেলেন স্যার রবার্ট চার্লটন এবং জর্জ বেস্টদের কাতারে।
এরপর নতুন চ্যালেঞ্জের সন্ধানে যোগ দিলেন পৃথীবির সেরা ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। এই পর্তুগিজের জাদুতেই লস ব্ল্যাঙ্কসদের লা-দেসিমার (১০ নম্বর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ শিরোপা) সুদীর্ঘ ১৩ বছরের অপেক্ষার শেষ হয়। এরপর রোনালদো আরও ৩ বার তাদেরকে বানালেন ইউরোপের সেরা। রিয়ালের হয়ে ১.
তারপর তুরিন ঘুরে আবারও স্বপ্নের গালিচা ওল্ড ট্রাফোর্ডে ফিরেন। তবে দ্বিতীয় ধাপে ম্যানেজম্যান্টের সঙ্গে বনিবনা না হওয়াই চোখের জলে ছাড়তে হয় পছন্দের লাল জার্সি।
অশ্রুতেই শুরু হয়েছিল রোনালদোর জাতীয় দলের হয়ে প্রথম বড় আসর, ইউরো ২০০৪। ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত হওয়া এই আসর শুরু হওয়ার মাত্র ১০ মাস আগে পর্তুগালের মেরুন-সবুজ জার্সি গায়ে উঠেছিল তার। অথচ প্রথম আসরেই জাদু দেখিয়ে অর্জন করলেন সেরা উদীয়মানের তকমা। পর্তুগাল যদি ফাইনালে গ্রীসের বিপক্ষে অপ্রত্যাশিতভাবে না হারত, তাহলে হয়ে যেতেন আসরের সেরা খেলোয়াড়। সেই ম্যাচের পর অঝোরে কেঁদেছিলেন রোনালদো।
ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপের মঞ্চে আরও একবার চোখের জলে ভাসালেন নিজে, ভাসালেন ফুটবল বিশ্বকে। স্তাদ দে ফ্রান্সে ২০১৬ সালে স্বাগতিক ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনালে। দিমিত্রি পায়েটের এক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ট্যাকেলের কারণে চোটে পড়ে খেলার ২৫ মিনিটেই মাঠ ছাড়তে হয় তাকে। সেই সময়ে তার শিশুর মত কান্না ছুঁয়ে গেল প্রতিপক্ষ শিবিরের সমর্থকদেরও। প্রকৃতিও মনে হয় তখন কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার পণ করেছিল রোনালদোকে। এদেরের অতিরিক্ত সময়ের গোলে পর্তুগাল প্রথমবারের মত হয় ইউরোপের সেরা। ইউসোবিও, ফিগোরা সোনালী প্রজন্ম নিয়ে যা করতে পারেননি, ভাঙাচোরা একদল নিয়ে সেটা করে দেখিয়ে দিলেন রোনালদো।
সেই সময় রোনালদোর ইউরো বিজয়ী দলের সতীর্থ আন্দ্রে গোমেজ দিলেন এক বার্তা, যা আজ চিরন্তনের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, “পর্তুগাল আজ মৃত প্রায়। এখানে আজ আর কিছুই নেই। পর্তুগালে চাকরি নেই, জীবন নেই, মর্যাদা নেই। পর্তুগালের আছে শুধু একজন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।”
রোনালদোর জন্ম ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনায় নয়। তার নেই মেসি, নেইমারদের মত পূর্বনির্ধারিত ফ্যানবেজ। এমনকি নেই ইংল্যান্ড, জার্মানি, ইতালি কিংবা স্পেনের মতো বড় ফেডারেশনের ছায়া বা জার্সি পাওয়ার।
বৈশ্বিক ‘ফুটবল রাজনীতির’ মারপ্যাচে রোনালদোর অবস্থা কেমন তা বোঝাতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গেরে সাংবাদিক অরিঞ্জয় বোস লিখেছিলেন, “রোনালদো মূলত ট্রেনের দ্বিতীয় শ্রেনীর প্রতিনিধিত্ব করা মানুষের দেবতা। তিনি ফুটবল কাব্যের উপেক্ষিত প্রতিনায়ক। অথচ এই রক্ত-মাংসের কায়াকে অস্বীকার করতেই কি না প্রতিদ্বন্দ্বী শিবিরকে ঐশ্বরিক ছায়ায় আশ্রয় নিতে হয়। তুলনায় টেনে আনতে হয় বিশ্বকাপ!”
ক্যারিয়ারের ৫টি ব্যালন ডি-অর, দেশের হয়ে ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপ, ৫টি চ্যাম্পিয়নস লীগ শিরোপা কিন্তু রোনালদোর শ্রেষ্ঠ অর্জন নয়। তার অমূল্য সম্পদ হচ্ছে ২৬ বছরের ফুটবল যাত্রার বিভিন্ন সময়ে পাওয়া ভক্তরা। মাঠের লৌহদৃঢ চরিত্রের রোনালদোর হৃদয়টা এই ভক্তদের জন্য দারুণ কোমল।
তবে শুধু ভক্ত না, যখন যেখানে মানবিকতার ডাক এসেছে হাজির হয়েছেন পর্তুগিজ মহাতারকা। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় গড়ে দিয়েছেন স্কুল। এক সময়ের সতীর্থ কার্লোস মার্টিন্সের ছেলেকে ‘বোন ম্যারো’ দান করতেও দ্বিধা করেননি রোনালদো।
ডেভিড পলাসকি নামের এক কিশোর ২০১৩ সালে দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়ে কোমায় চলে যান। তিন মাস থাকেন কোমায়। অন্যদিকে একই বছরের পর্তুগালের হয়ে নভেম্বরের ১৩ তারিখে সুইডেনের বিপক্ষে অনবদ্য এক হ্যাটট্রিক করেন রোনালদো। প্লে-অফের সেই ম্যাচ জিতেই ব্রাজিল বিশ্বকাপে জায়গা পায় পর্তুগাল। সেই মহারণের ধারাভাষ্য ব্যবহার করে ডেভিডের চেতনা ফিরিয়ে আনেন চিকিৎসকরা। নশ্বর রোনালদোর আর কী বা পাওয়ার আছে এই ধরণীর বুকে?
তবুও ভক্তরা চায় তার কাছে। তারা চায় আরও ৭৭ গোল করে প্রথম ফুটবলার হিসেবে পেশাদার ক্যারিয়ারে ‘১০০০’ গোল স্পর্ষ করুক রোনালদো। ভক্তরা প্রিয় তারকার হাতে অধরা বিশ্বকাপের সোনালী শিরোপাটা চায়। ২০২৬ বিশ্বকাপে সেই সুযোগটা কী আরেকবার পাবেন রোনালদো?
তখন যে এই পর্তুগিজের বয়স হবে ৪১! রোনালদো ২০০৬ সালে জার্মানিতে প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে নেমেছিলেন। ঠিক ২০ বছর পরে যুক্তরাষ্ট্রে ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ বিশ্বকাপ কী আসলেই খেলতে পারবেন তিনি? বয়স বা ফর্ম কী সেটা হতে দিবে? যদি পেয়েও যান, তাহলে কী পারফর্ম করতে পারবেন? অন্তর্যামী হয়ে সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার উপায় নেই।
তবে প্রথম বিশ্বকাপ খেলার ‘কুড়ি বছর পরে’ রোনালদো আবারও বৈশ্বিক এই আসরে খেলার সুযোগ পেলে নিশ্চয়ই ভাববেন- জীবন গিয়েছে চ’লে আমাদের কুড়ি-কুড়ি বছরের পার/তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!
ঢাকা/নাভিদ
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ফ টবল পর ত গ ল র পর ত গ জ ফ টবল র প রথম ব বছর র
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশকে দেওয়া ২ স্থলবন্দরের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল ভারতের
পেট্রাপোল ও গেদে স্থলবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে রপ্তানি পণ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ভারত। এ সুবিধা বাতিল হলেও ভারতের ভূখণ্ড হয়ে ভুটান ও নেপালে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছে দিল্লি। তবে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করার পর গতকাল বুধবারই বেনাপোল বন্দর থেকে চারটি পণ্যবাহী ট্রাক ফেরত পাঠিয়েছে দেশটি।
এদিকে ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে যাওয়ার ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে গতকাল রাতেই জরুরি বৈঠক করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। রাজধানীর কারওয়ান বাজারের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) কার্যালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সভাপতিত্বে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাসহ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন। অনলাইনে যুক্ত ছিলেন ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা।
বৈঠক শেষে বাণিজ্য উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেন, নেপাল ও ভুটানে রপ্তানির যে প্রক্রিয়া তাতে এ সিদ্ধান্তে কোনো প্রভাব পড়বে না। তবে সরকার তৈরি পোশাক রপ্তানিসহ সার্বিক বাণিজ্য স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। ঢাকা ও সিলেট বিমানবন্দরের নিজস্ব সক্ষমতা ব্যবহার করে এ প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা হবে। অন্যান্য ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হবে। সেখানে অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
গত মঙ্গলবার ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডাইরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। পরে এক বিজ্ঞপ্তিতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, বাংলাদেশের জন্য যে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, তাতে ভারতের বিমান ও সমুদ্রবন্দরে উল্লেখযোগ্য জট হতো। ফলে পণ্য নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে দেরি ও রপ্তানিকারকদের খরচ বেড়ে যেত। তবে এটিও পরিষ্কার– এ সুবিধা বাতিলে নেপাল ও ভুটানে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য ট্রানজিটে কোনো প্রভাব পড়বে না।
সিবিআইসির প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০২০ সালের ২৯ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে পেট্রাপোল স্থলবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশি পণ্যকে কলকাতা স্থল ও বিমানবন্দর এবং মহারাষ্ট্রের মুম্বাইয়ে নাভা শিভাবন্দরে পরিবহনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া একই সময় রেল সুবিধা ব্যবহার করে পেট্রাপোল ও গেদে বা রানাঘাট স্থলবন্দর ব্যবহার করে নাভা শিভাবন্দরে পণ্য পরিবহনের সুবিধা দেওয়া হয়েছিল, যা বাতিল করা হলো। তবে ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আগের বিজ্ঞপ্তিটি সংশোধন করে শুধু কলকাতা বিমানবন্দরের সঙ্গে দিল্লি বিমানবন্দরের এয়ার কার্গোকেও সংযুক্ত করে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান সমকালকে বলেন, ইতোমধ্যে ট্রাম্পের পারস্পরিক শুল্ক ব্যবস্থা কার্যকর হয়েছে। একই দিন ভারত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করল, যা উদ্বেগের। এ সিদ্ধান্তের ফলে ভারতের স্থল ও বিমানবন্দরগুলো দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে। বিঘ্নিত হতে পারে বাংলাদেশের রপ্তানি কার্যক্রম। কারণ, সুবিধাটি বাণিজ্য সহজ ও খরচ কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছিল। এখন বাংলাদেশের জন্য লজিস্টিক্যাল চাপ বাড়তে পারে, যা আঞ্চলিক বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে গত ৪ এপ্রিল বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই বৈঠকের এক সপ্তাহ না পেরোতেই এমন কঠোর সিদ্ধান্ত নিল ভারত।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে বলেছেন, ভারত সমুদ্রবন্দরগুলো বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়ার পর সিঙ্গাপুরের পরিবর্তে সেগুলো ব্যবহারের জন্য আমাদের একাধিকবার বলেছে। কিন্তু রুটটি পশ্চিমা বিশ্বে বাংলাদেশি পণ্য পরিবহনের জন্য খুব বেশি সুবিধাজনক না হওয়ায় তেমন ব্যবহার করা হয়নি। এ বন্দরগুলো হয়ে নগণ্য পরিমাণ পণ্য যেত। ফলে সুবিধা বাতিলে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে এ মুহূর্তে দুই দেশের সম্পর্কে যে শীতলতা বিরাজ করছে, সে বিবেচনায় সিদ্ধান্তটির যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে ইপিবির ভাইস চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) আনোয়ার হোসেন জানান, বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। বিজিএমইএসহ অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এর প্রভাব কী হতে পারে, তা পর্যালোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরে তেমন পড়বে না বাণিজ্যিক প্রভাব
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় দু’দেশের মধ্যকার বাণিজ্যিক সর্ম্পকে কিছুটা প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে ট্রানজিটের মাধ্যমে গত পাঁচ বছরে যে পরিমাণ পণ্য আনা- নেওয়া হয়েছে তাতে সরাসরি বাণিজ্যিক প্রভাব তেমন বেশি হবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে গত পাঁচ বছরে খুব অল্প পরিমাণ ট্রানজিট পণ্য আনা-নেওয়া করেছে ভারত। এসব পণ্য থেকে বাংলাদেশ খুব বেশি রাজস্বও পায়নি। ভারত হুট করে এমন সিদ্ধান্ত নিলেও বাংলাদেশ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আমি মনে করি না। তবে তাৎক্ষণিক এ বিষয়ে বাংলাদেশের পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো ঠিক হবে না।
ভারত হয়ে নেপাল ও ভুটানে কিছু গার্মেন্ট পণ্য যায়। এটিও রপ্তানি হারের তুলনায় অনেক কম বলে মন্তব্য করেন বিজিএমইএর সাবেক প্রথম সহসভাপতি নাসির উদ্দিন চৌধুরী। তিনি বলেন, আমার ধারণা, যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তিত শুল্কনীতি ভারতকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করেছে। তারা হয়তো ভেবেছে, এই সুযোগ অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের পণ্য সেখানে নিয়ে ‘মেড ইন ভারত’ লিখে রপ্তানি করার সুযোগ নিতে পারে অসাধু ব্যবসায়ীরা। হয়তো এ কারণে সুবিধা বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। এটিকে কূটনৈতিক চ্যানেলে মোকাবিলা করতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দরের টার্মিনাল ম্যানেজার এনামুল করিম বলেন, ট্রানজিটের আওতায় চার-পাঁচটি চালানে পণ্য এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। মাত্র আট টন চা পাতা এই বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়ছে ভারতে। বন্দরের মোট হ্যান্ডলিংয়ের তুলনায় এটি খুবই সামান্য।
চার মালবাহী ট্রাক ফেরত পাঠিয়েছে ভারত
বেনাপোল প্রতিনিধি জানান, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করায় গতকাল বেনাপোল বন্দর থেকে চারটি মালবাহী ট্রাক ফেরত পাঠিয়েছে ভারত। পরে রপ্তানি পণ্যবোঝাই চারটি ট্রাক ঢাকায় ফেরত আসে।
এ বিষয়ে ভারতের পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্টস স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী সমকালকে বলেন, স্থলবন্দর দিয়ে ট্রানজিট সুবিধা বন্ধের জন্য ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় একটি চিঠি ইস্যু করেছে কাস্টমসে। এ চিঠির আলোকে ট্রানজিট সুবিধার পণ্য বেনাপোল থেকে পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশ বন্ধ রয়েছে।
বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট স্টাফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মুজিবর রহমান বলেন, ভারত সরকার ট্রানজিট সুবিধা বাতিল করায় আজ (বুধবার) বেনাপোল থেকে চারটি রপ্তানি পণ্যবোঝাই ট্রাক ফেরত গেছে। ঢাকার রপ্তানিকারক ডিএসভি এয়ার অ্যান্ড সি লিমিটেডের প্রতিষ্ঠানের ছিল ট্রাকগুলো।