মিয়ানমারের সাবেক গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির ইনিয়া লেকের পাশে অবস্থিত বাড়িটি নিলামে বিক্রির চেষ্টা করে আবারও ব্যর্থ হয়েছে সামরিক জান্তা। আজ বুধবার এই নিলাম হয়। বাড়িটি কেনার জন্য কেউই দাম হাঁকায়নি। এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো বাড়িটি বিক্রির চেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়েছে।

ইয়াঙ্গুনে অবস্থিত দুই তলাবিশিষ্ট বাড়িটি দশমিক ৮ হেক্টর বা ১ দশমিক ৯ একর জমির ওপর অবস্থিত। ন্যূনতম দাম ১৪ কোটি ডলার ধরে বাড়িটি বিক্রির জন্য নিলাম শুরু করা হয়। কয়েক দশক এই বাড়ি নিয়ে সু চির সঙ্গে তাঁর ভাইয়ের বিরোধ ছিল।

সাবেক জান্তা সরকারের অধীন গৃহবন্দী অবস্থায় ওই বাড়িতে অনেক বছর কাটিয়েছেন অং সান সু চি। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারের ক্ষমতা পুনর্দখলের পর সামরিক বাহিনী সু চিকে গ্রেপ্তার করেছিল।

মিয়ানমারের মার্কিন দূতাবাসের কাছেই লিফি ইউনিভার্সিটি অ্যাভিনিউয়ে ঔপনিবেশিক আমলের বাড়িটির বাইরে সাদা পোশাকের নিরাপত্তাকর্মীদের তত্ত্বাবধানে নিলামের আয়োজন করা হয়। এতে প্রায় এক ডজন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত এএফপির সাংবাদিকেরা জানান, নিলামে সু চির বাড়িটির দাম হাঁকা হয় ২৯ হাজার ৭০০ কোটি কিয়েটে, যা দেশটির সরকারি বিনিময় হার অনুযায়ী ১৪ কোটি ডলারের সমান। কিন্তু নিলামে কোনো সাড়া না পেয়ে নিলামকারী বিক্রয় বাতিল করে দেন।

নিলামকারী বলেন, ‘তিনবার দরপত্র আহ্বান করার পরও আমি ঘোষণা করছি, নিলাম সফল হয়নি।’

গত বছরের মার্চ ও আগস্ট মাসেও নিলামে সু চির বাড়িটি বিক্রির চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।

সামরিক অভ্যুত্থানে সৃষ্ট গৃহযুদ্ধের ফলে মিয়ানমারের অর্থনীতি ভেঙে পড়ার পর ক্রমেই জীর্ণ হয়ে পড়া বাড়িটির জন্য কেউ ১৪ কোটি ডলার ব্যয় করতে পারবেন কি না, তা স্পষ্ট নয়।

রিয়েল এস্টেট এজেন্টরা বলছেন, অভিজাত ইয়াঙ্গুন অঞ্চলে একই আকারের সম্পত্তির দাম ১০ থেকে ২০ লাখ ডলার হতে পারে।

মিয়ানমারের ইতিহাসে বাড়িটি একটি বিশেষ জায়গা দখল করে আছে। ১৯৮৮ সালে তৎকালীন জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভের সময় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন অং সান সু চি। এরপর তাঁকে বাড়িটির জীর্ণ চার দেয়ালের মধ্যে টানা ১৫ বছর গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল।

সে সময় সু চির স্বামী ও সন্তানেরা ইংল্যান্ডে ছিলেন। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন সু চি বন্দিদশায় পিয়ানো বাজিয়ে, গোয়েন্দা উপন্যাস পড়ে ও ধ্যান করে সময় কাটাতেন।

গণতন্ত্র ও অহিংসার মাধ্যমে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বিষয়ে অং সান সু চির বক্তব্য শুনতে শত শত মানুষ নিয়মিত বাড়িটির বাইরের ফুটপাতে জড়ো হতেন।

২০১০ সালে মুক্তি পাওয়ার পর সু চি ওই বাড়িতেই থাকতেন। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাংবাদিক, কূটনীতিকসহ বিভিন্ন বিদেশি নেতার সঙ্গে সেখানেই তিনি সাক্ষাৎ করেছেন।

বর্তমানে রাষ্ট্রদ্রোহ, ঘুষ কেলেঙ্কারি, আইন লঙ্ঘনসহ বিভিন্ন অভিযোগে ২৭ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন সু চি। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো বলছে, সু চিকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

‘জুলাই ঘোষণা’ ও ফিরে দেখা রাজনীতি

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির খসড়া ঘোষণাপত্র ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত। গত ১৬ জানুয়ারি ‘জুলাই ঘোষণা’ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বানে সর্বদলীয় এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের আগে একটি খসড়া জুলাই ঘোষণা দলগুলোকে পাঠানো হয়। এ দুটি ঘোষণাপত্রের প্রধান কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রসঙ্গে
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর কাঁচামাল এবং পুঁজি সংগ্রহের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এই শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। যার প্রথম প্রকাশ ঘটে বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারের রক্তস্নাত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় হয়। এর পর বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন এবং ১১ দফার ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় পায়। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল এসব গণআন্দোলনের স্বাভাবিক পরিণতি। এই মুক্তিযুদ্ধে জাতির একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ রাজাকার, আলবদর বাহিনী যেমন ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছে, তেমন লাখো-কোটি জনগণ অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করেছে। কিন্তু এই গৌরব আওয়ামী লীগ একা আত্মসাৎ করতে গিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। 

মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গঠিত হলো, তা প্রথম দিন থেকেই শোষণ, জুলুম, অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতার দিকে পা বাড়াল। সর্বশেষ ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানকে কবরস্থ করে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়। 
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত একের পর এক ক্যু, পাল্টা ক্যু চলতে থাকে এবং সর্বশেষ নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হন। এরপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত এ দুটি সরকারই দেশকে কোনো স্থায়িত্ব দিতে পারেনি। উপরন্তু সংবিধানে একের পর এক সংশোধনী এনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব এবং একের পর এক জনবিরোধী নীতি কার্যকর করেছে। সর্বশেষ ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ এই শোষণ-জুলুম-অত্যাচার-বাকস্বাধীনতা হরণকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে। ২০১৪, ’১৮ ও ’২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে। জুলাই ঘোষণার মধ্যে ইতিহাসের বর্ণনায় এই উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো বাদ পড়েছে। 

বাহাত্তরের সংবিধান প্রসঙ্গে 
জুলাই ঘোষণাপত্রে তারা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকেই বাংলাদেশের সংবিধানের যথার্থ ভিত্তি হিসেবে ধরছেন। অথচ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিবকে সব রকম প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁর হাতে বিপুল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক সাম্য, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও সুবিচার– এই শব্দগুলোতে লাখো কোটি জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায় আওয়ামী লীগ সেগুলোকে বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। এই সংবিধান প্রণয়নের আগে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে মুজিববাদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটাকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্ন এখন এসেছে যে, এই সংবিধানের ভাবাদর্শগত ভিত্তি হলো মুজিববাদ। তবে জেনে রাখা উচিত, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়ারা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারী স্বাধীনতা, এক মানুষ-এক ভোট– এসব প্রগতিশীল ধারণা নিয়ে এসেছিল। এর পর থেকে সব বুর্জোয়া রাষ্ট্রই তাদের সংবিধানকে এই ধারণাগুলোর ওপর দাঁড় করায়। ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল সন্তোষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটি সভায় এক প্রস্তাব গৃহীত হয়– ‘...সংবিধান হবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক।’ ফলে আওয়ামী লীগ মুজিববাদ বলে যা দাবি করেছে, তা অন্তঃসারশূন্য।    
বাহাত্তরের সংবিধানের প্রগতিশীল ইতিবাচক দিকগুলোকে অক্ষত রেখে মূলত কাঠামোগত দিকটি সংস্কার করা উচিত। একই সঙ্গে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজ– এই ছয়টি মৌলিক অধিকারকে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে সংযুক্ত করা উচিত এবং মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে রচিত অধিকারগুলোকে আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য করা উচিত। 

ঘোষণাপত্র দুটির মধ্যে পার্থক্য
সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহণে সরকার গঠন, ‘ডিকলোনাইজড ট্রুথ অ্যান্ড হিলিং কমিশন’-এর প্রস্তাবনা, সেনাশাসন-রাষ্ট্রীয় পুঁজি-বৃহৎ ব্যবসায়ী-আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রস্তাবনা– এসব ছাত্রদের দেওয়া ঘোষণায় থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সরকারের দেওয়া খসড়া ঘোষণায় নেই। 

গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে
আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব জাগরণ এই গণঅভ্যুত্থান। দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছেন এই আন্দোলনে। আহত হয়েছেন ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। এই গণঅভ্যুত্থান থেকে ফ্যাসিবাদ ধ্বংসের স্লোগান উঠেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতন মানেই ফ্যাসিবাদের পতন নয়। ফ্যাসিবাদ কোনো দল আনে না। ফ্যাসিবাদ আনে একটি ব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে উন্নত কিংবা অনুন্নত সব দেশেই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দেখা যায়। ফলে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিলোপ ঘটেনি; ফ্যাসিবাদ পিছু হটেছে মাত্র। 
১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, এর পর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে আবার ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনা। তাই সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠন, সর্বোপরি নাগরিক সমাজের সুচিন্তিত মতামত নিয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমেই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা উচিত।

মাসুদ রানা: সমন্বয়ক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরাম, বাসদ (মার্ক্সবাদী)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের মানবাধিকারবিষয়ক রাষ্ট্রদূতের সাক্ষাৎ
  • ঢাবিতে মানবাধিকার বিষয়ক সেমিনার অনুষ্ঠিত 
  • ‘জুলাই ঘোষণা’ ও ফিরে দেখা রাজনীতি
  • জার্মানিতে ডানপন্থি উত্থানের আশঙ্কা
  •  শেখ হাসিনা এদেশে গণতন্ত্রকে আবারও হত্যা করতে চায় : টিপু