গরমে দেড় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে: জ্বালানি উপদেষ্টা
Published: 5th, February 2025 GMT
আসছে গরমে দেড় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। তিনি বলেন, গরমে (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর) বিদ্যুতের চাহিদা হতে পারে ১৮ হাজার মেগাওয়াট। এ সময় দেড় হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। তবে রমজান মাসে চাহিদা থাকবে সাড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। রমজান মাস লোডশেডিং মুক্ত থাকবে।
আজ বুধবার রাজধানীর বিদ্যুৎ ভবনে ‘রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি’ নিয়ে এক বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
বিস্তারিত আসছে.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব দ য ৎ সরবর হ রমজ ন উপদ ষ ট
এছাড়াও পড়ুন:
ট্যাগিং রাজনীতি যে সর্বনাশ ডেকে আনবে
বর্তমান রাজনীতিতে ‘ট্যাগিং’ একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হিসেবে হাজির হয়েছে। তা শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পুরো সমাজে ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক গোষ্ঠী, এমনকি ব্যক্তিরাও এখন একে অপরকে ভুল তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে বদনাম করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ‘ট্যাগিং রাজনীতি’ বলতে মূলত বোঝায়, কোনো ব্যক্তি বা দলকে মিথ্যা লেবেল দিয়ে তাদের গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া ও সমাজে হেয় প্রতিপন্ন করা।
২০১৩ সালের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ট্যাগিং রাজনীতি শুরু হয়। তখন রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিভাজনকে কিছু সহজ পরিচয়ে সীমাবদ্ধ করা হয়। যেমন শাহবাগি বনাম ইসলামপন্থী, ভারতপন্থী বনাম পাকিস্তানপন্থী, রাজাকার বনাম ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। এই বিভাজন শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, তা সামাজিক সম্পর্কেও বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল, যা এখনো রয়ে গেছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের পর এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি চরমভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন দল নিজেদের স্বার্থে প্রতিপক্ষকে বিশেষ লেবেল দিয়ে তাদের দুর্বল করার কৌশল নিচ্ছে। প্রায় সব দলই এই খেলায় লিপ্ত। কিছু রাজনৈতিক নেতা, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ইউটিউবার, এমনকি কিছু ভুঁইফোড় (চালায় দেন) সোর্স এই কাজে সিদ্ধহস্ত।
গঠনমূলক আলোচনা বা দেশ পরিচালনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা না বলে, কিছু দল ও গোষ্ঠী ভুল তথ্য, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও আবেগপ্রবণ প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের মত পরিবর্তনের চেষ্টা করছে। এই কৌশল স্বল্পমেয়াদে কারও জন্য লাভজনক হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি গণতন্ত্র ও সামাজিক ঐক্যের জন্য বিপজ্জনক।
১৯৭৫-৭৭ সালে ভারতের জরুরি অবস্থার সময় ইন্দিরা গান্ধীর সরকার বিরোধীদের ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। এটি সাময়িকভাবে তাঁকে ক্ষমতা ধরে রাখতে সাহায্য করলেও, পরে জনগণের ক্ষোভ বেড়ে যায়। ১৯৭৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস পার্টি বড় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। একইভাবে, এরদোয়ানের সরকার তুরস্কে প্রায়ই বিরোধী নেতাদের বিদেশি শক্তির সহযোগী বলে অভিযুক্ত করে।
প্রশ্ন হলো, এই অভিযোগ ও ট্যাগিং কৌশল সত্যিই কাজে দেয় কি না। শুরুতে এটি কিছু দলকে দুর্বল করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সবাই সবার প্রতি সন্দেহ ঢুকে যায়। যদি সব দলকে বারবার মিথ্যা তথ্য দিয়ে দুর্নাম করা হয়, তাহলে জনগণ আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাস রাখবে না।
এই সমস্যা শুধু রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, সমাজ ও সংস্কৃতিতেও ছড়িয়ে পড়েছে। ট্যাগিং রাজনীতি মানুষের দৈনন্দিন সম্পর্ক, কর্মস্থল, এমনকি ধর্ম ও লিঙ্গভিত্তিক আলোচনাতেও প্রভাব ফেলছে। মানুষ ভিন্নমত পোষণ করলেই তাকে একটি নির্দিষ্ট পরিচয়ে বাঁধা হচ্ছে, যা সমাজকে বিভক্ত করছে এবং স্বাভাবিক আলোচনা কঠিন করে তুলছে।
যদি এই বিভ্রান্তির রাজনীতি চলতে থাকে, তাহলে তা একসময় শুধু কোনো নির্দিষ্ট দলকে নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবে। সময় থাকতেই এই ভুল না শোধরানো দরকার। তা না হলে মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বিশ্বাস হারাবে এবং নিজেদের প্রয়োজনে ভিন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তখন তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।বিশ্ববিদ্যালয় ও অফিসে মতাদর্শ নিয়ে বিতর্ক আগের চেয়ে অনেক কঠিন হয়ে উঠেছে। কেউ ভিন্ন মত দিলেই তাকে শুধু বিরোধী নয়, বরং বিশ্বাসঘাতক, উগ্রবাদী বা বিদেশি এজেন্ট বলা হচ্ছে। নারী অধিকারকর্মী, সাংবাদিক বা বুদ্ধিজীবীদের কাজের স্বীকৃতি না দিয়ে তাদের গোপন রাজনৈতিক স্বার্থের অংশ হিসেবে দেখা হয়। ধর্মীয় আলোচনায়ও ভিন্ন ব্যাখ্যা দিলেই তাকে হয় চরমপন্থী, নয়তো অতিরিক্ত উদারপন্থী বলে ট্যাগিং দেওয়া হয়।
ফরাসি সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বুর্দিয়ু বলেছেন, ক্ষমতার লড়াই শুধু রাজনীতিতে নয়, সংস্কৃতিতেও চলে। আর ট্যাগিং বা লেবেলিং হলো একধরনের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, যা স্বাধীন চিন্তাকে দমন করে এবং মানুষকে নির্দিষ্ট ছকে ফেলে দেয়। এর ফলে সমাজে বিশ্বাস ও আলোচনার পরিবেশ নষ্ট হয়, আর সন্দেহ ও বিভাজন বেড়ে যায়।
আজ মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া ট্যাগিং ও ভুল তথ্য ছড়ানোর বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছে। ইউটিউব, ফেসবুক ও টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে ভিত্তিহীন অভিযোগ খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সমস্যা হলো, অনেক মানুষ মূলত সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই খবর পান, তাই তাঁরা সহজেই বিভ্রান্ত হন। ভুল তথ্যের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়। যদি কাউকে মিথ্যা দোষারোপ করা হয়, সত্য প্রকাশ পেলেও সাধারণ মানুষ তাঁর সম্পর্কে খারাপ ধারণা নিয়েই থাকেন।
বাংলাদেশেও ভুল তথ্য রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি শুধু একটি দলের জন্য সমস্যা নয়, বরং পুরো গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক। যদি সত্যের চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ বড় হয়ে যায়, তাহলে ধীরে ধীরে রাজনীতিতে সত্যের কোনো মূল্যই থাকবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনে সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে এক্স (সাবেক টুইটার) ভুল তথ্য ছড়ানোর বড় মাধ্যম হয়ে উঠেছিল। রাশিয়ার ইন্টারনেট রিসার্চ এজেন্সি ভুয়া অ্যাকাউন্ট ও পোস্ট ব্যবহার করে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে দেয়। ২০২০ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভোট জালিয়াতির অভিযোগ দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। এই গুজব থেকে ‘স্টপ দ্য স্টিল’ আন্দোলন গড়ে ওঠে, যা ২০২১ সালের ক্যাপিটল দাঙ্গার কারণ হয়। ভুল তথ্যের কারণে অনেক ভোটার এখন আর নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গণতন্ত্রের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না।
রাজনীতিতে প্রতিপক্ষকে ‘দেশদ্রোহী’ বা ‘বিদেশি এজেন্ট’ বলে ট্যাগিং দেওয়া এখন সাধারণ ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্রে, চরম রাজনৈতিক বিভাজন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে মিথ্যা অভিযোগ ও ষড়যন্ত্র তত্ত্ব জনগণের আলোচনাকে নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতি নির্বাচনের সময় নতুন নতুন ভুল তথ্য ছড়ানো হয়, যা ভোটারদের বিভ্রান্ত করে।
বাংলাদেশের রাজনীতিও এখন এক সংকটময় মোড়ে। বাংলাদেশেও ট্যাগিং প্রবণতা সাময়িকভাবে কাউকে সুবিধা দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এটি বিপজ্জনক। রাজনৈতিক দল, কর্মী ও মিডিয়ার বোঝা উচিত যে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক। কিন্তু মিথ্যা তথ্য ও বিভ্রান্তি শেষ পর্যন্ত সবাইকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। রাজনীতিবিদদের উচিত বিভক্তি বাড়ানোর বদলে বাস্তব সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দিয়ে শাসন, অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা। জনগণ চায় এমন একটি রাজনৈতিক পরিবেশ, যেখানে জনমতকে ভুল তথ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণ না করে ভালো কাজের ভিত্তিতে নির্বাচন হয়।
যদি এই বিভ্রান্তির রাজনীতি চলতে থাকে, তাহলে তা একসময় শুধু কোনো নির্দিষ্ট দলকে নয়, বরং পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করবে। সময় থাকতেই এই ভুল না শোধরানো দরকার। তা না হলে মানুষ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বিশ্বাস হারাবে এবং নিজেদের প্রয়োজনে ভিন্নভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। তখন তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার, শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়