তিন জোটের রূপরেখা: ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা
Published: 5th, February 2025 GMT
জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জারি করেন সামরিক শাসন। আশির দশকজুড়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন হয়। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও বামপন্থী দলগুলোর নেতৃত্বাধীন ‘তিন জোটের রূপরেখা’ ঘোষণা করে ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামো হাজির করে।
ওই রূপরেখায় নির্বাচনে ভোট ডাকাতি, মিডিয়া ক্যু এবং ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করা হয়। ভবিষ্যতে কেউ যেন এ ধরনের কর্মকাণ্ড করতে না পারে, সে লক্ষ্যে ব্যক্ত করা হয় দৃঢ় সংকল্প।
কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নব্বই–পরবর্তী নির্বাচনী অভিযাত্রার প্রথম ধাপে তৎকালীন বিএনপি সরকার নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীনে নির্বাচনের অঙ্গীকার থেকে সরে আসে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দলীয় সরকারের অধীন একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি আবারও ক্ষমতায় আসে। কিন্তু আন্দোলনের চাপে দেড় মাসের কম সময়ের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রবর্তনে বাধ্য হয় তারা। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনে জেতে আওয়ামী লীগ।
এখানে দুটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে, দলীয় সরকারের অধীন কখনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনে ওই দলকে কখনো হারানো যায়নি। আবার নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনে আগের সরকার কখনো ক্ষমতায় আসেনি। দ্বিতীয়ত, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে বিএনপি মাত্র দুই মাস ক্ষমতায় টিকতে পেরেছিল। ওই একই কাজ করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় টিকে থেকেছে দীর্ঘ এক যুগ।
তিন জোটের রূপরেখা বাস্তবায়িত না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করা হয়। এ কথা আংশিক সত্য। তবে সেই সঙ্গে রূপরেখা বাস্তবায়নের পদ্ধতিগত ত্রুটির বিষয়টিও এড়ানো যায় না। তিন জোটের রূপরেখায় দেশে ‘স্থায়ী গণতান্ত্রিক ধারা’ এবং ‘প্রকৃত জনপ্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার’ অঙ্গীকার করা হয়েছিল। কোনো দল বা গোষ্ঠী কর্তৃক অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা দখলের অবসান ঘটিয়ে সাংবিধানিক পন্থায় অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হাতবদল ও হস্তান্তর নিশ্চিত করাও আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল। অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সার্বভৌম সংসদ প্রতিষ্ঠা করাকে তিন জোটের রূপরেখা আন্দোলনের ‘কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু’ হিসেবে নির্ধারণ করেছিল।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর কোনো নির্বাচিত গণপরিষদের অধীনে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উপযোগী সংবিধান গ্রহণ করা হয়নি। পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের আরোপিত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) অধীন যাঁরা নির্বাচিত হয়েছিলেন, ম্যান্ডেট না থাকা সত্ত্বেও তাঁরাই স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছিলেন। রচিত হয়েছিল একব্যক্তিকেন্দ্রিক ও একদলীয় একটি সংবিধান।
দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আশির দশকের সামরিক স্বৈরাচারবিরোধী তিনটি রাজনৈতিক জোট রাষ্ট্র গঠনের এই আদি পাপকে শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিল। সংসদকে ‘সার্বভৌম’ ধরে ব্যবস্থা পরিবর্তনের ইশতেহার হাজির না করে স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানানোকেই ‘গণতন্ত্র’ ধরে নেওয়া হয়েছিল। ফলে স্বৈরাচারের পতন ঘটলেও স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল তবিয়তে থেকে গেছে।
আরও পড়ুনসংস্কার, ম্যান্ডেট ও নির্বাচন নিয়ে একের ভেতর দুই ফর্মূলা০৭ জানুয়ারি ২০২৫এই ঐতিহাসিক গলদের খেসারত আজতক বাংলাদেশকে দিতে হচ্ছে। নব্বইয়ের নাগরিক অভ্যুত্থানের পর একটি গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজন করে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা হলে হয়তো আওয়ামী ফ্যাসিবাদের কবলে জাতিকে পড়তে হতো না। তিন জোটের রূপরেখায় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন আয়োজনের কথা বলা হয়েছিল। পূর্ণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকারও ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক না হলে স্রেফ সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যে ‘পূর্ণ গণতন্ত্র’ নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না, রাজনৈতিক দলগুলো এই সরল সত্য উপলব্ধি করতে পারেনি।
তিন জোটের রূপরেখায় আরও কিছু তাৎপর্যপূর্ণ দফা ছিল। যেমন ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে এবং অসাংবিধানিক যেকোনো পন্থায় ক্ষমতা দখলের প্রতিরোধ করা হবে।’ সেগুলোর কোনোটাই বাস্তবায়িত হয়নি।
একদিকে বলা হয়েছে, এরশাদবিরোধী ওই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ‘সার্বভৌম সংসদ’ প্রতিষ্ঠা করা। আবার অন্যদিকে ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি’র কথা বলা হয়েছে। এ দুই ধারণা পরস্পরবিরোধী। আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংসদ নয়, কেবল ও কেবলমাত্র জনগণ সার্বভৌম হতে পারে। সংসদ, সরকার, এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত সার্বভৌম জনগণের অধীন। সংবিধানের আমূল পরিবর্তন বা বড় সংশোধনীর জন্য গণপরিষদ গঠন করা একটা রেওয়াজ। অথচ বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদকে সংবিধান পরিবর্তনের এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায়ের দলিল জনগণের প্রতিনিধিরা পরিবর্তন করতে পারেন কি না, এমন প্রশ্ন এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।
গণ-অভিপ্রায়ই সংবিধান এবং সংবিধানই প্রজাতন্ত্রের ‘সর্বোচ্চ আইন’। তার মানে, সংবিধানের যা কিছু গণ-অভিপ্রায়ের বিপরীতে অবস্থান নেয়, তা-ই অসাংবিধানিক, তথা বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণে আমরা বলেছি, ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানই সাংবিধানিক, বিদ্যমান সংবিধান অসাংবিধানিক।রূপরেখায় একটা গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রনৈতিক বিষয় হলো, ‘জনগণের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতির ভিত্তিতে দেশে সাংবিধানিক শাসনের ধারা নিরঙ্কুশ ও অব্যাহত রাখা হবে।’ অর্থাৎ গণসার্বভৌমত্বই সাংবিধানিক শাসনের ভিত্তি। কোনো সরকার ও রাষ্ট্র যদি নিজেকে সার্বভৌম দাবি করে গণ-অভিপ্রায়ের বিপরীতে দাঁড়ায় এবং যদি সংবিধান তাদের দোহাই হয়, তাহলে খোদ ওই সংবিধানই অসাংবিধানিকতায় রূপ নেয়। তখন একে বাতিল করাই সাংবিধানিক বিষয়ে পরিণত হয়। এই বিবেচনায় চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সাংবিধানিক, বিদ্যমান বাহাত্তরের সংবিধান অসাংবিধানিক।
রূপরেখার আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। এক.
গণ-অভ্যুত্থানকে বলা হয় পুরোনো স্বৈরাচারী এবং নতুন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যবর্তী ক্রান্তিকাল। গণ-অভ্যুত্থানের পর সংবিধান সভার (গণপরিষদ) নির্বাচন আয়োজন করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উপযোগী গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নই রেওয়াজ। অর্থাৎ বাহাত্তর সালে প্রণীত বিতর্কিত স্বৈরতান্ত্রিক সংবিধান বাতিল করে নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা উচিত ছিল। এর জন্য প্রয়োজন ছিল গণপরিষদ নির্বাচন। তা না করে রাজনৈতিক দলগুলো গণ-অভ্যুত্থানকে স্রেফ একটি সরকার পরিবর্তন, তথা সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়ে সংকুচিত করেছিল। এর মাশুল এখনো বাংলাদেশ দিয়ে যাচ্ছে।
গণ-অভিপ্রায়ই সংবিধান এবং সংবিধানই প্রজাতন্ত্রের ‘সর্বোচ্চ আইন’। তার মানে, সংবিধানের যা কিছু গণ-অভিপ্রায়ের বিপরীতে অবস্থান নেয়, তা-ই অসাংবিধানিক, তথা বাতিল হিসেবে গণ্য হবে। এ কারণে আমরা বলেছি, ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থানই সাংবিধানিক, বিদ্যমান সংবিধান অসাংবিধানিক।
নব্বইয়ের পর দীর্ঘ প্রায় তিন যুগ পর আরও একটি গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। এ অভ্যুত্থানকে পুরোনো ভুলের হাত থেকে রক্ষা করা দরকার। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা স্বৈরতান্ত্রিক। বাহাত্তরের সংবিধান এ স্বৈরতান্ত্রিকতার মূল জ্বালানি সরবরাহ করে। কাজেই স্বৈরতন্ত্রের উৎস এ সংবিধানকে বাতিল করে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করাই হবে গণ-অভ্যুত্থান–পরবর্তী রোডম্যাপ। এ জন্য বিদ্যমান সংবিধানের অধীন সংসদ নির্বাচন নয়; প্রয়োজন নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে গণপরিষদ নির্বাচন আয়োজন করা। সংবিধান প্রণয়ন শেষে ওই গণপরিষদই আইনসভায় রূপ নেবে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান স্রেফ সরকার পরিবর্তন নয়। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার দোহাই দিয়ে নব্বইয়ের পুনরাবৃত্তি করার চেষ্টা হবে গণ-অভ্যুত্থানকে বেহাত করার শামিল। ফ্যাসিবাদীব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গোড়াপত্তন করার ঐতিহাসিক মওকা আমাদের সামনে হাজির। এ সুযোগ হেলায় হারানো যাবে না।
● সারোয়ার তুষার লেখক ও চিন্তক; যুগ্ম আহ্বায়ক, জাতীয় নাগরিক কমিটি
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ন জ ট র র পর খ ন ত র ক ব যবস থ ব যবস থ র র জন ত ক ব ত ল কর র পর খ য় ক ষমত য় জনগণ র হয় ছ ল দলগ ল ব এনপ আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
সিকদার গ্রুপের ৪২টি বিও হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ
শিল্পগোষ্ঠী সিকদার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রন হক সিকদার, তাঁর মা মনোয়ারা সিকদারসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ৪২টি বিও হিসাব (বেনিফিশিয়ারি ওনার্স অ্যাকাউন্ট) অবরুদ্ধ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ মো. জাকির হোসেন আজ রোববার এ আদেশ দেন।
দুদকের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়েছে, ন্যাশনাল ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদে সিকদার পরিবারের সদস্যরা ব্যাংকে জনগণের আমানত হাজার হাজার কোটি টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ দিয়ে তা মানি লন্ডারিং করেছেন।
দুদকের পক্ষ থেকে আদালতকে আরও জানানো হয়, সিকদার পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। তাঁরা বিদেশে থেকে বিও হিসাবগুলো হস্তান্তরের চেষ্টা চলছে।
শুনানি নিয়ে আদালত সিকদার গ্রুপের রন হক সিকদার, তাঁর মা মনোয়ারা সিকদারসহ তাঁদের পরিবারের সদস্যদের ৪২টি বিও হিসাব অবরুদ্ধ করার আদেশ দেন।
এর আগে গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর সিকদার গ্রুপের রন হক, তাঁর মাসহ তাঁদের পরিবারের কয়েকজন সদস্যের স্থাবর সম্পদ জব্দের আদেশ দেন আদালত। মোট ১৫টি ভবন ও ফ্লোর জব্দের আদেশ দেওয়া হয়।
ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সাবেক চেয়ারম্যান মনোয়ারা সিকদার। ব্যাংকটির সাবেক পরিচালক রন হক সিকদার ও তাঁর ভাই রিক হক সিকদার। তাঁরা প্রভাব খাটিয়ে ব্যাংকটির বিপুল অর্থ লুট ও বিদেশে পাচার করেছেন বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
দুদকের পক্ষ থেকে আদালতে বলা হয়, জনগণের আমানতের অর্থ আত্মসাৎ করে তাঁরা নিজেদের, পরিবারের সদস্যদের ও নিকট আত্মীয়দের নামে-বেনামে প্রচুর সম্পদ গড়েছেন।