হলুদ জার্সি, লুঙ্গি আর জুতা পায়ে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন আবুল হোসেন। ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আবুল হোসেনের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা জানিয়েছিলেন, আবুল হোসেনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভ্যানে তোলা হয়েছে। তার পর থেকে বিভিন্ন হাসপাতালের মর্গ, কারাগার, এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে আবুল হোসেনকে খোঁজেননি তাঁর স্ত্রী লাকী আক্তার।

প্রথম আলোকে লাকী আক্তার বলেন, ‘প্রথমে ভাবছিলাম স্বামী বাঁইচ্যা আছে। তবে ঘটনার প্রায় ২৫ দিন পর আশুলিয়া থানার সামনে ভ্যানে লাশের একটা ভিডিও ভাইরাল হয়। ভ্যানে লাশের স্তূপে হলুদ জার্সি পরা একজনকে দেখি। আমি তো দেইখ্যাই চিন্না ফালাইছি। সেই দিন তো এই জার্সি গায়ে দিয়াই বাইর হইছিল।’

আবুল হোসেনের মতো কতজনের লাশ এখনো পরিবার পায়নি, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই।

এরপর খোঁজ করতে করতে জানা যায়, আশুলিয়ায় এক জায়গায় দুজনকে কবর দেওয়া হয়েছিল। লাকী আক্তার কাপড় ও স্বামীর যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার সঙ্গে একজনেরটা মিলে যায়। এর মধ্যে লাকী আক্তার থানায় স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে মামলা করেন।

অবশেষে প্রায় ছয় মাস পর ১ ফেব্রুয়ারি আশুলিয়া থানা-পুলিশ বগাবাড়ির আমবাগান এলাকার কবরস্থান থেকে দুটি লাশ তোলে। এর মধ্যে একটি মরদেহ আবুল হোসেনের (৩৩) বলে দাবি করেছেন তাঁর স্ত্রী লাকী আক্তার। লাশের পরিচয় নিশ্চিত হতে কবর থেকে তোলা দুটি লাশের ডিএনএ পরীক্ষা করা হবে।

২০১২ সালে বিয়ের পর থেকেই লাকী স্বামীর সঙ্গে আশুলিয়ায় থাকতেন। আবুল হোসেন দিনমজুর ছিলেন। ১১ বছর ও ১২ মাস বয়সী দুই সন্তান নিয়ে একবার বাবার বাড়ি, আবার শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকেন লাকী। ভিডিওতে সব স্পষ্ট থাকলেও স্বামীর লাশ পাওয়া না যাওয়ায় শহীদ হিসেবে গেজেটে নাম নেই আবুল হোসেনের। কোনো অনুদানও পাওয়া যায়নি। গত সেপ্টেম্বর মাসে মৃত্যুনিবন্ধন সনদে আবুল হোসেনের মৃত্যুর কারণের জায়গায় হত্যা কথাটি লেখা আছে।

আবুল হোসেনের মতো এমন কতজনের লাশ এখনো পরিবার পায়নি, তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। আর পরিবার মামলা না করলে বা লাশের পরিচয় শনাক্তে আবেদন না করলে আদালতের নির্দেশে লাশ তোলা বা ডিএনএ পরীক্ষা করাও সম্ভব নয়।

আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়ন করতে ‘গণ-অভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল’ গঠন করেছে সরকার। গত ১০ নভেম্বর এক গণবিজ্ঞপ্তিতে নিহত, নিখোঁজ, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে যাঁদের দাফন করা হয়েছে, তাঁদের পরিচয়–প্রমাণসহ স্বজনদের আবেদন করতে বলা হয়। এ সেলের সদস্য মোহাম্মদ আসলাম মোল্লা বলেন, পরিবারের কাছ থেকে এ ধরনের আবেদন তেমন একটা পাওয়া যায়নি।

নিখোঁজ বা বেওয়ারিশ লাশের তালিকা নেই

আবুল হোসেনের পরিবারের মতো মো.

হাসানকেও হন্যে হয়ে খুঁজছিল তাঁর পরিবার। ৫ আগস্ট মো. হাসান সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বাসা থেকে বের হন। এর পর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ ছিল না। হাসান ঢাকার কাপ্তানবাজারে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের একটি দোকানের কর্মী ছিলেন। থাকতেন যাত্রাবাড়ীর সুতি খালপাড় বালুর মাঠ এলাকায়। হাসানের বাবা ভোলায় কৃষিকাজ করেন। দুই ভাই–বোনের মধ্যে হাসান বড়।

হাসানের চাচা নূরে আলম ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে অসংখ্যবার খোঁজ নিয়েছেন। কিন্তু ভাতিজার কোনো হদিস পাননি। গত ১২ জানুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ সেলের সহায়তায় হাসানের সঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মর্গে থাকা একটি লাশের মিল পান নূরে আলম।

এর আগে ১০ জানুয়ারি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ এ সেল প্রথমে ঢাকা মেডিকেলের কলেজের মর্গে থাকা (শাহবাগ থানার অধীন) ৬ বেওয়ারিশ মরদেহের তথ্য সামনে আনে। তখনই যাত্রাবাড়ী থানার আরেকটি লাশ মর্গে আছে, এমন তথ্য পান এ সেলের সদস্যরা। আর এ লাশই হাসানের বলে ধারণা করা হচ্ছে।

নূরে আলম গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ডিএনএ টেস্টের জন্য সিআইডি ল্যাব থেকে হাসানের মা–বাবার ডিএনএ নমুনা নিয়েছে ২০ দিন আগে। এখনো ফলাফল জানা যায়নি। হাসানকে খুঁজে পেতে অনেক জায়গায় ঘুষ পর্যন্ত দিতে হয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে গঠিত জুলাই গণ-অভ্যুত্থানবিষয়ক বিশেষ সেলের সম্পাদক হাসান ইনাম প্রথম আলোকে বলেন, আন্দোলনে গিয়ে কতজন নিখোঁজ হয়েছেন বা বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে, ছয় মাসেও তার পূর্ণাঙ্গ তালিকা না থাকার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। সরকার চাইলে শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের সঙ্গে নিখোঁজের তালিকাও করতে পারত।

মোহাম্মদ হৃদয়ের (২০) লাশও এখন পর্যন্ত খুঁজে পায়নি তাঁর পরিবার। গাজীপুরের কোনাবাড়ীর শরীফ জেনারেল হাসপাতালের সামনের এক রাস্তায় হৃদয়ের কাছে এসে পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দেন এক পুলিশ সদস্য। তারপর পুলিশ হৃদয়ের দেহ একটি গলির দিকে টেনেহিঁচড়ে নিচ্ছে, এমন ভিডিও দৃশ্যও আছে। তবে এর পরের আর কোনো ফুটেজ নেই। হৃদয়ের পরিবার ৫ আগস্টের পর থেকে তাঁর লাশ খুঁজছে।

সংসারের অভাব-অনটনের জন্য টাঙ্গাইলের হেমনগর ডিগ্রি কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি কোনাবাড়ীতে অটোরিকশা চালাতেন হৃদয়। ইন্টারন্যাশনাল ট্রুথ জাস্টিস প্রজেক্ট এবং টেক গ্লোবাল ইনস্টিটিউট হৃদয়ের ভিডিও ফুটেজের ফরেনসিক বিশ্লেষণ করে প্রামাণ্যচিত্র বানিয়েছে। সেই প্রামাণ্যচিত্রে হৃদয়কে গুলি করার সেই দৃশ্যও ছিল। মূলত তার পর থেকেই হৃদয়ের ঘটনা আবার আলোচনায় আসে।

লাশ পাওয়া যায়নি বলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মারা যাওয়া অন্য শহীদদের পরিবার বিভিন্ন অনুদান পেলেও হৃদয়ের পরিবার কোনো অনুদান পায়নি। শহীদের তালিকায়ও জায়গা পাননি হৃদয়। হৃদয়ের দুলাভাই মো. ইব্রাহিম বাদী হয়ে গত ২৬ আগস্ট কোনাবাড়ী থানায় হৃদয়কে গুলি করে হত্যা ও লাশ গুমের অভিযোগে মামলা করেন।

হৃদয়ের বড় বোন মোছাম্মৎ জেসমিন টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ গুলি করে ভাইটারে মারছে, তার ভিডিও আছে। লাশ তো আর বাংলাদেশের বাইরে পাঠায় নাই। ভাইয়ের লাশ না পাইলেও শুধু ভাইয়ের হাড্ডি হইলেও ফেরত চাই।’

লাশ শনাক্তকরণের দাবি

সিটি করপোরেশন থেকে বেওয়ারিশ লাশ দাফনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম। রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ–সংলগ্ন কবরস্থানে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করছে সংস্থাটি।

এ সংস্থার হিসাব বলছে, রায়েরবাজার কবরস্থানে জুলাই মাসে ৮০ এবং আগস্ট মাসে ৩৪ জনের বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয়েছে। তবে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া কতজন আন্দোলনে গিয়ে বা গুলিতে মারা গেছেন, তা বলা সম্ভব নয়।

স্বজনেরা আঞ্জুমান মুফিদুলে বেওয়ারিশ লাশের ছবি দেখে নিশ্চিত হওয়ার পর ছুটে যান রায়েরবাজার বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ–সংলগ্ন কবরস্থানে। সেখানকার ৪ নম্বর ব্লকে একটু পরপর ছোট ছোট বাঁশ পুঁতে একজন করে ‘বেওয়ারিশ’ লাশের কবর চিহ্নিত করা আছে। এর বাইরে কোনটি কার কবর বা অন্য কোনো চিহ্ন নেই। এখানে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে দাফন করা হয়েছে, এমন পরিবারের সদস্যরা ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে লাশ শনাক্তকরণের দাবি জানিয়ে আসছেন।

নিখোঁজ ব্যক্তি ও অজ্ঞাত লাশের পরিচয় শনাক্তে সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি স্থায়ী কমিশন বা সেল গঠনের সুপারিশ করেছেন সিআইডির (পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ) ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবের প্রধান আহমাদ ফেরদৌস। তিনি বলেন, শুধু সিআইডি বা একক কোনো সংস্থার পক্ষে কাজটি করা কঠিন। প্রতিটি নিখোঁজ ব্যক্তি ও অজ্ঞাত লাশের একটি অনলাইন ডেটাবেজ থাকতে হবে।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: কবরস থ ন র পর থ ক র পর ব র য় র পর র কবর সদস য আগস ট

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্বকে বদলে দেওয়ার যাত্রায় যুক্ত হোন

বিশ্বকে বদলাতে চাইলে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যার বিশ্বকে বদলে দেওয়ার দুর্দান্ত সব আইডিয়া রয়েছে। এসব আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে। তাই আমরা আপনাদের আমন্ত্রণ জানাই, যেন আপনারা শুধু বাংলাদেশকে নয়, পুরো বিশ্বকে বদলে দেওয়ার যাত্রায় যুক্ত হোন।’

গতকাল বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫’-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনে তিনি এ কথা বলেন। গত সোমবার শুরু হওয়া চার দিনের এই শীর্ষ সম্মেলনে দেশের ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের সুযোগ এবং অর্থনৈতিক সংস্কার তুলে ধরা হয়। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।

বিদেশি বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘ব্যবসার জন্য সেরা জায়গা বাংলাদেশ। বাংলাদেশে ব্যবসা নিয়ে আসুন এবং এর মাধ্যমে বিশ্ব বদলে দিতে ভূমিকা রাখুন।’

তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যদি কোনো লক্ষ্য নিয়ে ব্যবসা করতে চান, তাহলে বাংলাদেশই আপনার সেই জায়গা। বাংলাদেশ কাজ করে দেখায়। আর একবার কেউ শুরু করলে অন্যেরা তা অনুসরণ করে।’

বাসসের খবরে বলা হয়, কীভাবে মানুষ ব্যবসার মাধ্যমে সুখী হয়, তা বর্ণনা করেছেন ড. ইউনূস। তিনি বলেন, ‘টাকা উপার্জন করে মানুষ নিঃসন্দেহে সুখ পায়। কিন্তু অন্যকে সুখী করার মধ্যে সুপার সুখ নিহিত রয়েছে।’

সামাজিক দায়বদ্ধতা কার্যক্রমে ব্যবসায়ীদের যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘যদি আপনি বাংলাদেশে ব্যবসা করেন, তাহলে আপনি সুখ এবং সুপার সুখ দুটিই পাবেন। কোনো খরচ ছাড়াই এই সুপার সুখ আপনি লাভ করতে পারেন এবং এটি করে আপনি গর্বিত হবেন।’

ইউনূস জানান, তিনি শুধু বাংলাদেশ নয়; এ অঞ্চলকে সম্ভাবনা হিসেবে দেখেন। তিনি একই সঙ্গে অর্থ উপার্জন এবং মানুষের জীবন পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য বিশ্ব বদলে দেওয়ার একটি শক্তিশালী হাতিয়ার এবং এর মাধ্যমে নতুন সভ্যতা গঠনের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন।

তিনি বলেন, ‘আপনাদের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এই সুপার সুখ উপভোগ করতে পারবে, যদি তারা তাদের প্রভাব মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারে।’

স্পেন থেকে অস্কার গার্সিয়া, যুক্তরাজ্য থেকে রোজি উইন্টারটন এবং বাংলাদেশ থেকে নাসিম মঞ্জুর অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বাংলাদেশে ব্যবসা এবং বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন।

টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পাইপলাইন তৈরির লক্ষ্যে এই শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বিনিয়োগকারী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক নির্বাহী এবং নীতিনির্ধারকরা।

সরকার নয়, ব্যবসার মাধ্যমে তিন শূন্য

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমি বলছি, আমরা তিন শূন্যর একটি পৃথিবী তৈরি করতে পারি। এটা সরকার দিয়ে নয়, ব্যবসার মাধ্যমে করা সম্ভব। কারণ এটা সরকারের কাজ নয়; মানুষ হিসেবে আমাদের কাজ।’

নতুন সভ্যতা হবে এমন– যেখানে কার্বন নির্গমন থাকবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা তা করতে পারি। এটি হওয়া উচিত ব্যবসায়িক উদ্ভাবনী কার্যক্রমের মাধ্যমে।’

কার্বন নিঃসরণকে আত্মবিধ্বংসী ব্যবস্থা আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘অর্থ উপার্জন আনন্দের হলেও সম্পদের কেন্দ্রীকরণ মানব জাতির জন্য বিপজ্জনক। এটি পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলবে।’

তিনি শূন্য বেকারত্বের ধারণার প্রতিও গুরুত্ব দেন এবং বলেন, ‘তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী চিন্তার মাধ্যমে বিশ্বকে বদলে দিতে সক্ষম।’

শূন্যক্ষুধা প্রসঙ্গে তিনি ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘ওই সময় প্রায় ১৫ লাখ মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা যায়।’

শোনালেন গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণফোন শুরুর গল্প

উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের ড. ইউনূস শোনান গ্রামীণ ব্যাংক ও গ্রামীণফোন প্রতিষ্ঠার ইতিহাস। তিনি বলেন, ‘দুর্ভিক্ষপীড়িত দেশে একটি ছোট উদ্যোগ এসেছে কিছুটা স্বস্তি নিয়ে। মানুষকে ২ বা ৩ ডলারের মতো ছোট ঋণ দেওয়া হতো, যেন তারা ছোট ব্যবসা শুরু করতে পারে, বিশেষভাবে নারীদের ওপর গুরুত্ব দিয়ে। কারণ নারীরা ছিল সবচেয়ে অসহায়। এই ধারণা মাইক্রোক্রেডিট নামে পরিচিত হয়। আমরা একটি ব্যাংক তৈরি করি, যার নাম গ্রামীণ ব্যাংক।’

তিনি বলেন, ‘কেউ জানত না– শেষ পর্যন্ত এটি কোথায় গিয়ে পৌঁছবে। কিন্তু এটা হয়ে উঠল একটি বৈশ্বিক নাম। কারণ আপনি যে দেশে থাকুন না কেন, আপনার ভেতরে একটু হলেও ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ লুকিয়ে আছে। আপনি তা হয়তো চিনতে পারেন না, কিংবা লুকিয়ে রাখেন। আপনি জনগণের টাকা তাদের (দরিদ্রদের) দিয়ে দেন। ভাবেন, এটাই সমাধান। কিন্তু গরিব মানুষকে শুধু সরকারি টাকা দেওয়াটা কোনো সমাধান নয়। আসল সমাধান হলো একটি কাঠামো তৈরি করা, এমন একটি ব্যবস্থা, যা মানুষের শক্তিকে মুক্ত করে দেয়। মাইক্রোক্রেডিট ছিল সেই উদ্যোগের একটি ক্ষুদ্র উদাহরণ।’

১৯৮৩ সালে সামরিক অধ্যাদেশের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ২৮ বছর গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন ইউনূস। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের চেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক ও মুহাম্মদ ইউনূসকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।

গ্রামীণফোনের লাইসেন্স নেওয়ার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তখন আমাদের কোনো ফোন ছিল না। শহরে হাতেগোনা কয়েকটা টেলিফোন ছিল। তার বেশির ভাগ কাজ করত না। তখন ভাবলাম, কেন আমরা একটা টেলিফোন কোম্পানির লাইসেন্সের জন্য আবেদন করি না? একেবারে পাগলাটে একটা ভাবনা ছিল। সরকার জিজ্ঞাসা করল, এই টেলিফোন লাইসেন্স দিয়ে কী করবে? আমি বললাম, এটা গরিব মহিলাদের হাতে তুলে দেব। ওরা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করল।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা শেষমেশ লাইসেন্স পেয়ে যাই। কেউ আমাদের সঙ্গে অংশীদার হতে চাইল না। কারণ আমাদের কোনো জ্ঞান ছিল না, কিছু জানতাম না। তখন সবাই বলত, বাংলাদেশ মোবাইল ফোনের জন্য উপযুক্ত জায়গা না। এখানে মোবাইল ফোনের বাজার নেই।’

শেষ পর্যন্ত নরওয়ের টেলিনর কোম্পানি অংশীদার হতে রাজি হয়। সেই কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, ‘শুরুতে তাদের বোর্ড রাজি হয়নি। পরে তারা সম্মত হয়। এর পর তো এটি দেশের সর্ববৃহৎ টেলিফোন কোম্পানিতে রূপ নেয়।’

যেভাবে পোশাকশিল্পের শুরু

দেশের পোশাকশিল্পের শুরুর দিকের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘৭০-এর দশকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা কিছু সাহসী তরুণ, যারা অন্যরকম কিছু করার সাহস দেখিয়েছিল। বিদেশের গার্মেন্ট শিল্প দেখে তারা বলেছিল, কেন আমাদের না? এটি ছিল বাংলাদেশে গার্মেন্ট শিল্পের সূচনা।’

ইউনূস বলেন, ‘এটি ছিল প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের একটি যাত্রা। এখন দেশের তৃতীয় প্রজন্ম উঠে আসছে।’

স্বাস্থ্য খাত উন্নয়নে যুক্তরাজ্যের সহায়তা কামনা

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে যুক্তরাজ্যকে আরও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন ইউনূস। গতকাল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় যুক্তরাজ্যের বাণিজ্য দূত ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন। বৈঠকে উভয় পক্ষ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও গভীর করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে।

বাংলাদেশে দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর ঘাটতির কথা তুলে ধরে ড. ইউনূস বলেন, ‘আমাদের বর্তমানে নার্সের সংকট রয়েছে। নার্সিং শুধু জাতীয় সমস্যা নয়। এটি একটি বৈশ্বিক প্রয়োজন। আমরা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য আরও নার্সকে প্রশিক্ষণ দিতে চাই।’

যুক্তরাজ্যকে সহায়তার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য কার্যক্রম প্রায় অকার্যকর। এখানে যুক্তরাজ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

আরেকটি সম্ভাবনাময় খাত হলো ওষুধ শিল্প। আমরা অনুরোধ করছি, পেটেন্ট তুলে নেওয়ার পক্ষে অবস্থান নিন। এতে প্রতিটি দেশ সাশ্রয়ী টিকা উৎপাদন করতে পারবে।’
উভয় পক্ষ শিক্ষা, টেক্সটাইল শিল্প, প্রতিরক্ষা, উড়োজাহাজ চলাচলসহ কৌশলগত সহযোগিতার আরও বিস্তৃত ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করে। ব্যারোনেস উইন্টারটন বর্তমান সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি যুক্তরাজ্য সরকারের সমর্থন জানান। তিনি বাংলাদেশের সাংবিধানিক সংস্কার কর্মসূচির প্রধান আলী রীয়াজের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করল হোলসিম গ্রুপ

হোলসিম গ্রুপের নির্বাহী কমিটির সদস্য এবং এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলের প্রধান মার্টিন ক্রিগনার গতকাল ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বৈঠকে দেশের সিমেন্ট খাতের ব্যবহার প্রবণতা, শিল্পটির পরিবেশগত প্রভাব এবং বাংলাদেশের বাজারে হোলসিমের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। ক্রিগনার বাংলাদেশের বাজারে দীর্ঘ মেয়াদে থাকার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন।

হোলসিম গ্রুপ হলো লাফার্জহোলসিম বাংলাদেশের মূল কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি সুনামগঞ্জের ছাতকে কারখানা পরিচালনা করছে। দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ব্যবসা করছে।

বাংলাদেশে হোলসিমের সিইও ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইকবাল চৌধুরী জানান, প্রতিষ্ঠানটি সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘অ্যাগ্রিগেটস’ চালু করেছে, যা দেশের শত শত মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে সহায়তা করবে।

অধ্যাপক ইউনূস ছাতকের লাফার্জ কারখানায় পুনর্ব্যবহারের অযোগ্য প্লাস্টিক (নন-রিসাইকেবল) ব্যবহারের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে জানতে চান। হোলসিম আশ্বস্ত করে– এই জ্বালানির ব্যবহার কার্বন নির্গমন ঘটাবে না।

বৈঠকে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, এসডিজি-বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং প্রেস সচিব শফিকুল আলম উপস্থিত ছিলেন।

সম্পর্ক জোরদার করতে চায় ইন্ডিটেক্স

স্পেনের শীর্ষস্থানীয় পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইন্ডিটেক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অস্কার গার্সিয়া ম্যাসেইরাস গতকাল ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বৈঠকে উভয় পক্ষ পারস্পরিক আগ্রহের বিষয় নিয়ে আলোচনা করে।

ইন্ডিটেক্স বিশ্বের বৃহত্তম ফাস্ট ফ্যাশন গ্রুপ, যার মালিকানায় রয়েছে জারা, বারশকা এবং মিসিমো ডাটের মতো ব্র্যান্ড।

বাংলাদেশকে ইন্ডিটেক্সের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সোর্সিং হাব হিসেবে অভিহিত করে অংশীদারিত্ব আরও গভীর করার আগ্রহ জানান ম্যাসেইরাস। তিনি ঘোষণা দেন, চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের সঙ্গে চুক্তি সই করা হয়েছে। এর মাধ্যমে পোশাক কারখানার ৫০ নারী কর্মীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার ব্যয় বহন করবে ইন্ডিটেক্স। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্প্যানিশ ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে ‘ইন্ডিটেক্স চেয়ার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলেও জানান ম্যাসেইরাস।

বাংলাদেশের পোশাক শ্রমিকদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা খাতে আরও বেশি বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান ইউনূস। বৈঠকে উপস্থিত ইন্ডিটেক্স কর্মকর্তারা জানান, শিগগির প্রতিষ্ঠানটি সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে এয়ার-কার্গো পরিবহন শুরু করবে।

তরুণ উদ্যোক্তা এক্সপো উদ্বোধন

বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘তরুণ উদ্যোক্তা এক্সপো ২০২৫’ গতকাল উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা। এই এক্সপোর লক্ষ্য হলো, তরুণ প্রজন্মের উদ্যোক্তা মানসিকতাকে তুলে ধরা এবং উদীয়মান উদ্যোগগুলোর সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ স্থাপন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ