প্রশাসন সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে দেখা করলেন তরুণ কর্মকর্তারা
Published: 5th, February 2025 GMT
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনার খবরে বিসিএস ৩০ থেকে ৪১ ব্যাচ পর্যন্ত কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ। তারা বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের সঙ্গে দেখা করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
গত ২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনে প্রশাসন ক্যাডারের নবীন কর্মকর্তারা জড়ো হয়। এ সময় প্রশাসন ক্যাডারের নবীন কর্মকর্তারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন এবং এই সিদ্ধান্ত তাদের প্রতি অবিচার বলে তুলে ধরেন।
ব্রিটিশ ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবেই উপসচিব পদে মূলত প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারাই কাজ করে থাকেন। এ বিষয়ে করা রিট উচ্চ আদালতে আইনি লড়াই শেষে রায় দেয় আপিল বিভাগ। ২০১০ সালের ২৪ মে আদালতের চূড়ান্ত আদেশে উপসচিব পদে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে ৭৫ শতাংশ নিয়োগ বৈধ ঘোষণা করে।
প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তারা বলেন, আদালতের রায় উপেক্ষা করে এ ধরণের সুপারিশের প্রস্তাব একদিকে আদালত অবমাননার শামিল অপরদিকে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে দুর্বল করার শামিল। পাশাপাশি এই সুপারিশ নবীন কর্মকর্তাদের জন্য বৈষম্যমূলক। এই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে প্রশাসনে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়তে পারে এবং রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা দুর্বল হতে পারে বলেও আশংকা ব্যক্ত করেন তারা।
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের সচিব বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নজরুল ইসলাম, অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার শরফ উদ্দিন আহমদ চৌধুরীসহ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সরকারের নীতি বাস্তবায়নের সঙ্গে জড়িত ‘কোর’ অফিসগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা কাজ করেন। এই সুপারিশের ফলে প্রশাসনের নবীন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি প্রায় ৪০ শতাংশ কমে যাবে। প্রশাসন যেহেতু সরকারের নীতি বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করে, সেহেতু মনোবলহীন প্রশাসনব্যবস্থা রাষ্ট্রব্যবস্থা দুর্বল হওয়ার নামান্তর হবে।
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা ধৈর্য্য ধরে নবীন কর্মকর্তাদের কথা শোনেন এবং তাদের বক্তব্য সরকারের উচ্চমহলে তুলে ধরার আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে রিপোর্ট আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া ও কার্যক্রম গ্রহণের আশ্বাস দেন।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গাড়িবিলাস
সোমবার প্রকাশিত সমকালের শীর্ষ প্রতিবেদনমতে, এ পর্যন্ত সরকারিভাবে সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা নিয়ে গাড়ি কিনেছেন ৪ হাজার ২০০ আমলা। এ সত্ত্বেও বেশির ভাগ কর্মকর্তা অবৈধভাবে সরকারি গাড়ি ব্যবহার করছেন। এতে প্রতি মাসে চালক, রক্ষণাবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক খরচ হচ্ছে ২১ কোটি টাকা। সে হিসাবে বার্ষিক খরচ দাঁড়ায় ২৫২ কোটি টাকা।
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সচিবদের জন্য গাড়ি ক্রয়ে সুদমুক্ত ঋণ সুবিধা চালু করে। মূলত আমলাদের বাগে আনতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের জন্য নানা সুবিধার বন্দোবস্ত করেছিলেন। এটি ছিল তারই ধারাবাহিকতা। প্রতিবেদনে সাবেক এক সচিব এ নীতিকে ঘুষ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। যখন গণঅভ্যুত্থানের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারের উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ ওঠে, তখন তা অত্যন্ত বেদনা ও হতাশার।
প্রতিবেদনমতে, উপদেষ্টাদের কারও কারও বিরুদ্ধে তিন-চারটি গাড়ি ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম দুটি গাড়ি ব্যবহার করছেন। তাঁর জন্য চালক বরাদ্দ রয়েছে ৩ জন। অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ একাই ব্যবহার করছেন তিনটি গাড়ি। এভাবে অনেকেই একাধিক গাড়ি ব্যবহার করছেন, যা আইন ও নৈতিকতার পরিপন্থি।
অর্থ সচিব, খাদ্য সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব এবং তাদের পিএস বেআইনিভাবে আলাদা গাড়ি ব্যবহার করছেন। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব ও উপসচিবদের বিরুদ্ধেও এ অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া পরিবারের জন্য রেখেছেন আলাদা যানবাহন।
একটি মিথ্যা হাজার মিথ্যার জন্ম দেয়। তেমনিভাবে একটি অসৎ পন্থা আরও বহু অসততার দিকে ঠেলে দেয়। এ কারণে পরিবহন পুল থেকে সচিবদের জন্য গাড়ি সরবরাহ নীতি বন্ধ হওয়ার পরও বিভিন্ন অজুহাতে মন্ত্রণালয়গুলো গাড়ি কেনা বাড়িয়েছে। সুতরাং, প্রত্যাশিতভাবে আওয়ামী সরকার গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে সুদমুক্ত যে ঋণ সুবিধা চালু করেছিল, তা রাষ্ট্রীয় তহবিল তছরুপের পথ প্রশস্ত করেছে। অর্থাৎ সদিচ্ছা ও স্বচ্ছতা না থাকায় একটি দুর্নীতি অন্যান্য দুর্নীতির পথ উন্মুক্ত করেছে। এই তো, ২০১৭ সাল থেকে উপসচিবদেরও একই ঋণ সুবিধা দেওয়া শুরু হয়। প্রতিবেদনমতে, শুরুতে গাড়ি কিনতে ২০ লাখ এবং চালক, তেল বাবদ ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালে গাড়ি বাবদ ৩০ লাখ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে ৫০ হাজার টাকা বাড়ানো হয়।
গবেষক ও সাবেক আমলা আকবর আলি খান ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ গ্রন্থে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতিকে ‘সামগ্রিক কাঠামোগত’ সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, এ ধরনের দুর্নীতি নিরন্তর প্রতিক্রিয়া বা চেইন রিঅ্যাকশন সৃষ্টি করে। ‘এক ধরনের দুর্নীতি অন্য ধরনের দুর্নীতির জন্ম দেয়, এক খাত হতে দুর্নীতি অন্য খাতে সংক্রমিত হয়।’ সচিবদের পর উপসচিবদের ঋণ সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর এ মন্তব্য প্রযোজ্য।
বাংলাদেশ এখন পাঁচ দশকের রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও দু্র্নীতির কবলে নিমজ্জিত। কাঠামোগত দুর্নীতির কারণে পুরো ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। এ পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটাতে হলে আমাদের দরকার নতুন রাজনৈতিক কাঠামো, যা ‘শুয়রের বাচ্চাদের’ অর্থনীতি থেকে বেরিয়ে আসবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমেই এসব জঞ্জাল মুক্ত করা সম্ভব। তবে সেই আশা এখনও বহুদূর।
আমলা ও উপদেষ্টাদের গাড়িবিলাস নিয়ে যে প্রতিবেদন দেখা যাচ্ছে, তা স্পষ্টত গণভ্যুত্থানের ‘স্পিরিট’-এর পরিপন্থি। ইতোমধ্যে কয়েকটি বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সমালোচনা উঠলে সরকার তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করেছে। আশা করি, গাড়ি বরাদ্দে যেসব অব্যবস্থাপনা রয়ে গেছে, সেগুলোর শিগগিরই নিরসন হবে।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
Iftekarulbd@gmail.com