ট্রাম্প আবারও মার্কিন প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। প্রথম দিন থেকেই তাঁর অভিবাসনবিরোধী নীতিগুলো কার্যকর করতে শুরু করেছেন। ঘোষণা করেছেন ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’। সুগম করেছেন লক্ষাধিক অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেওয়ার পথ। একই সঙ্গে বাতিল করেছেন সিবিপি ওয়ান নামে একটি অ্যাপ বাতিল। অ্যাপটি দিয়ে মেক্সিকো থেকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অবৈধ অভিবাসীদের আইনি আবেদন করা যেত।

অ্যাপটি বাতিল হওয়ার ফলে আনুমানিক ২ লাখ ৭০ হাজার মানুষ এখন মেক্সিকোর ভেতর আটকা পড়েছেন। এই মানুষদের দুর্ভোগ শুধু এখানেই শেষ নয়। মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশ পাড়ি দেওয়ার সময় তাঁরা সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র ও দুর্নীতিগ্রস্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে নির্যাতনের শিকার হন। ট্রাম্পের এই কঠোর নীতির ফলে মেক্সিকোর অপরাধী গোষ্ঠী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্নীতিগ্রস্ত সদস্যদের ফায়দা লোটার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

ট্রাম্প ক্ষমতায় ফেরার এক সপ্তাহ পর আমি মেক্সিকোর উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী শহর সিউদাদ হুয়ারেজে পৌঁছাই। সেখানে এক ভেনেজুয়েলান আশ্রয়প্রার্থী জানান, যুক্তরাষ্ট্রে চোরাই পথে প্রবেশের জন্য পাচারকারীরা এখন ১০ হাজার ডলার করে নিচ্ছে।

এই শহরে ২০২৩ সালের এপ্রিলে একটি অভিবাসী আটক কেন্দ্রে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪০ জন প্রাণ হারান। সে সময় মেক্সিকোর অভিবাসন কর্তৃপক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের অভিবাসনবিরোধী নীতির প্রতি সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে অভিবাসীদের কঠোরভাবে দমন করছিল। বাইডেন আসলে ট্রাম্পের চেয়েও বেশি মানুষকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কার করেছিলেন।

সীমান্তের উভয় দিক থেকেই এখন শহরে নতুন মানুষের ঢল নামছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ বিশাল সাদা তাঁবু তৈরি করেছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত অভিবাসীদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দেওয়া হবে।

আমি সিউদাদ হুয়ারেজের কেন্দ্রস্থলে আশ্রয়প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। এক মধ্যবয়স্ক মেক্সিকান ব্যক্তির সঙ্গে দেখা হলো। তিনি এক দশকের বেশি আগে অ্যারিজোনা থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। তিনি জানালেন, যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় তিনি ম্যাকডোনাল্ডস ও বার্গার কিংয়ে কাজ করতেন। অতিরিক্ত আয়ের জন্য অন্যের বাড়িঘর পরিষ্কার করতেন। একদিন খাবার কিনতে বের হলে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে একটি ভূগর্ভস্থ কারাগারে আটকে রাখে। তিন মাস সূর্যের আলো না দেখে বন্দিত্বের পর তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়। মেক্সিকোতে ফেরত পাঠানোর সময় তাঁকে বিশেষ চশমা দেওয়া হয়, যা সূর্যালোক থেকে চোখকে রক্ষা করতে পারে।

‘আমেরিকান স্বপ্ন আসলে লোকে যেমন ভাবে, অত বড় কিছু নয়। ওখানে কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। ওরা চায় না আমরা তাদের ওখানে যাই।’

মেক্সিকোতে ফিরে তিনি সিউদাদ হুয়ারেজে অবস্থিত একটি মার্কিন মালিকানাধীন ‘মাকুইলাদোরা’ কারখানায় কাজ নেন। ‘মাকুইলাদোরা’ বলতে এমন কারখানাগুলো বোঝায়, যেখানে মার্কিন কোম্পানিগুলো মেক্সিকোর সীমান্তের ওপারে স্বল্প মজুরিতে শ্রমিক নিয়োগ করে। এতে কর পরিশোধ করতে হয় না। শ্রমিকদের অধিকারের তোয়াক্কা করা হয় না। সম্প্রতি তিনি এই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ, কোম্পানির দিন দিন বাড়তে থাকা কাজের চাপে তিন মেয়ের যত্ন নেওয়ার সময় পাচ্ছিলেন না।

সিউদাদ হুয়ারেজ যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ‘মুক্তবাণিজ্যের’ ধ্বংসাত্মক প্রভাবের এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠেছে। ১৯৯৪ সালে উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (নাফটা) স্বাক্ষরের পর মেক্সিকোর কৃষি খাত ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে হাজার হাজার কৃষক তাঁদের জমি ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ছুটতে বাধ্য হন। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি মেক্সিকোর সাধারণ মানুষের দারিদ্র্য ও দুর্দশার জন্য দায়ী। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতিই মেক্সিকোর এই অভিবাসনের জন্য দায়ী।

২০০৬ সালে শুরু হওয়া কথিত ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ সফল করতে বিপুলসংখ্যক মেক্সিকান সেনা ও পুলিশ সিউদাদ হুয়ারেজে মোতায়েন করা হয়। শহরটি দ্রুত বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর সহিংস নগরীতে পরিণত হয়। এই সহিংসতার প্রকৃত কারণ মেক্সিকোর সংঘবদ্ধ অপরাধী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার লড়াই নয়। কারণ, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরাই সরাসরি মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ২০২৪ সালে শহরটিতে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা এক হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

সিউদাদ হুয়ারেজে যাঁর সঙ্গে এরপর কথা বলি, তিনি ছিলেন এক বয়স্ক মেক্সিকান নারী। সীমান্ত পার হয়ে আসা গাড়ির সামনে সাহায্যের জন্য বসেছিলেন। তাঁর ঘরভাড়ার সময় হয়ে গেছে। গতকাল পুরো দিনে তিনি মাত্র আট ডলার ভিক্ষা পেয়েছেন।

কিন্তু এরপরই তিনি সাবলীল ইংরেজিতে জানালেন যে তিনিও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। যদিও তাঁর কাছে বৈধ গ্রিনকার্ড ছিল। তাঁর ৩৪ বছর বয়সী কন্যাকে ৯ বছর আগে সিউদাদ হুয়ারেজেই গুলি করে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছিল।

সীমানাপ্রাচীর মনে করিয়ে দিচ্ছিল, একজন মার্কিন নাগরিক হিসেবে আমার চলাচলের স্বাধীনতা কতটা সহজ। অথচ যাঁদের জীবন এই দেয়ালের ওপারে নির্ভর করছে, তাঁদের জন্য সেটি কেবলই এক দুর্ভেদ্য বাধা। এক চৌরাস্তায় গুয়াতেমালার এক নারী ও তাঁর ছোট মেয়ের দেখা পাই। তাঁরা ক্যান্ডি বিক্রি করছিলেন। মা বললেন, তাঁরা তিন মাস ধরে এখানে আছেন। সিবিপি ওয়ান অ্যাপ বাতিল হওয়ার পর কী করা যায়, সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।

আশ্রয়কেন্দ্রগুলো ধ্বংসপ্রায় ছোট ছোট ঘর। প্রায় সীমানাপ্রাচীরের ছায়ায় অবস্থিত। তবে অন্তত ধুলা আর হিমেল হাওয়া থেকে কিছুটা আশ্রয় দিচ্ছিল। এক ভেনেজুয়েলান তরুণের সঙ্গে কথা বলে ইভানজেলিক পরিচালিত একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ঢোকার অনুমতি পেলাম। তরুণটি সাত মাস ধরে মেক্সিকোতে অপেক্ষা করছে। কিছুদিন আগে সিবিপি ওয়ানে সাক্ষাতের তারিখ পেয়েছিল। সেটা এখন বাতিল হয়ে গেছে।

আশ্রয়কেন্দ্রের ভেতরে বেশ কিছু ভেনেজুয়েলান পরিবার ছিল। শিশুরা খালি পায়ে ও পাতলা পোশাকে ঘুরছিল। অথচ আমি গরম কোট আর স্কার্ফ পরেও ঠান্ডায় কাঁপছিলাম। এক ত্রিশোর্ধ্ব ভেনেজুয়েলান ব্যক্তি স্বীকার করলেন, সিবিপি ওয়ান বাতিলের পর পুরো পরিস্থিতি আর সহ্য করা যাচ্ছে না। তিনি বললেন, ‘এ যেন একটা নদী সাঁতরে পার হওয়ার পরই আরেক পাড়ে গিয়ে ডুবে মরার মতো!’ মেক্সিকোতে অবস্থানের সময়ই তাঁকে চারবার অপহরণচেষ্টার শিকার হতে হয়েছে। সেই চেষ্টা করেছে যৌথভাবে মেক্সিকোর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও অপরাধী চক্র।

বাইরে বেরিয়ে দেখি, দুই ভেনেজুয়েলান যুবক। একটা দোকানের সামনে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন পরিষ্কার করছিলেন। তাঁদের সরঞ্জাম ভেঙে যাওয়ায় কাজ করা বন্ধ হয়ে গেছে। এদিকে পুলিশ এসে ঘুষ দাবি করছে। আমি তাঁদের নতুন সরঞ্জাম কিনে দেওয়ার প্রস্তাব দিই। বাজারের দিকে রওনা হই আমরা।

এক যুবক জানালেন, তাঁকে ইতিমধ্যে দুবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। তিনি তাঁর ফোনে ব্রুকলিন ব্রিজের ওপর তোলা হাস্যোজ্জ্বল একটি ছবি দেখালেন। বললেন, ‘আমেরিকান স্বপ্ন আসলে লোকে যেমন ভাবে, অত বড় কিছু নয়। ওখানে কেউ আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চায় না। ওরা চায় না আমরা তাদের ওখানে যাই।’

অন্য যুবক সেই কথায় একমত হলেন—শুধু টাকার জন্য বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই। তাঁরা এখনো নিশ্চিত নন—মেক্সিকো সিটিতে ফিরে যাওয়া উচিত, নাকি সিউদাদ হুয়ারেজে থেকেই গাড়ির কাচ পরিষ্কার করে জীবিকা নির্বাহ করা যায়? অথবা হয়তো আরও একবার সীমান্ত পেরোনোর চেষ্টা করা যেতে পারে।

তাঁদের জীবনের সংকট শুরু হয়ে গেছে তখনই, যখন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নীতি তাঁদের দেশগুলোতে দুর্দশার বীজ বপন করেছে। এখন এই তরুণেরা কোথায় যাবেন, জানেন না।

বেলেন ফারনান্দেজ আল–জাজিরার কলাম লেখক

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ জাভেদ হুসেন

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ষ ক র কর র জন য কর ছ ন র সময় অবস থ অপর ধ

এছাড়াও পড়ুন:

আর্জেন্টিনা থেকে এল ৫০ হাজার ২০০ টন গম

আন্তর্জাতিক উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে আর্জেন্টিনা থেকে আমদানি করা ৫০ হাজার ২০০ টন গম নিয়ে একটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় আজ বুধবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ৩০ হাজার ১২০ টন চট্টগ্রাম বন্দরে এবং ২০ হাজার ৮০ টন গম মোংলা বন্দরে খালাস করা হবে।

এর মধ্যেই চট্টগ্রাম বন্দরে গম খালাসের কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ