ট্রাম্পের সরকারে ইলন মাস্কের এত ক্ষমতা কি বিপদের
Published: 5th, February 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ওপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেছেন ইলন মাস্ক। বিশ্বের শীর্ষ এই ধনীর হাতে নজিরবিহীনভাবে ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার বংশোদ্ভূত মাস্ক মার্কিন সরকারি কোষাগারে পাওনা মেটানোর ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। এটি লাখো কোটি ডলারের ব্যবস্থাপনা করে।
মাস্ক একাই যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডি বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি সংস্থাটির দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে বের করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করেছেন তিনি।
‘ইলন মাস্কের এই দখলদারির চেষ্টা...টিকবে না।’সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেন
মাস্ক এমন একজন ব্যক্তি, যিনি সব সময় অনির্বাচিত আমলাদের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করতে পছন্দ করেন। কিন্তু এখন তিনি নিজেই প্রায় কোনো রকম জবাবদিহি ছাড়া ট্রাম্পের সরকার ছোট করে আনার প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
গত সোমবার ওভাল অফিসে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে ট্রাম্প বিষয়টিকে হালকা করে দেখার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অনুমোদন ছাড়া ইলন মাস্ক কিছুই করতে পারেন না, করবেনও না।’
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘যেখানে যথাযথ হবে, সেখানে আমরা তাঁকে অনুমোদন দেব। যেখানে যথাযথ হবে না, সেখানে দেব না।’
মাস্কের উদ্দেশ ট্রাম্প বলেন, ‘তিনি সব কথা জানান। এ ব্যাপারে তিনি খুবই একনিষ্ঠ। আমি তাঁর তারিফ করি।’
ট্রাম্পের সরকারে মাস্কের ক্ষমতা প্রায় অসীম বলে মনে হচ্ছে। ফলে ডেমোক্র্যাটরা মাস্ক ও ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অসাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখলের অভিযোগ তুলেছেন।
ইলন মাস্ক এমন একজন ব্যক্তি, যিনি সব সময় অনির্বাচিত আমলাদের বিরুদ্ধে কড়া সমালোচনা করতে পছন্দ করেন। কিন্তু এখন তিনি নিজেই প্রায় কোনো রকম জবাবদিহি ছাড়া ট্রাম্পের মার্কিন সরকারকে সংকুচিত করার প্রচেষ্টাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।এখন পর্যন্ত মাস্ককে ফেডারেল কর্মী বা সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে নিবন্ধিত করা হয়নি। যদিও মার্কিন গণমাধ্যম জানিয়েছে, তাঁকে এখন ‘বিশেষ সরকারি কর্মচারী’ হিসেবে নিবন্ধিত করা হয়েছে।
সমালোচকেরা মনে করিয়ে দেন, ট্রাম্পের এবারের নির্বাচনী প্রচারাভিযানে সবচেয়ে বড় দাতা ছিলেন মাস্ক। ট্রাম্পের নির্বাচনী সভা-সমাবেশ ও প্রচারের জন্য মাস্ক প্রায় ২৫ কোটি ডলার দিয়েছেন।
এর বাইরে আরও একটি বিষয় আছে। আর তা হলো, মাস্কের কোম্পানিগুলোর সঙ্গে মার্কিন সরকারের বিশাল চুক্তি রয়েছে।
শুরুতে মাস্কের নেতৃত্বাধীন সরকারি দক্ষতা বিভাগের (ডিওজিই) ওয়েবসাইটে একটি আদুরে কুকুরের কার্টুন খচিত ছিল। কিন্তু পরে এর বদলে সেখানে জায়গা নেয় সোনালি বৃত্তে আঁকা একটি ডলারের প্রতীক। বোঝাই যাচ্ছে, মনোযোগটা কোথায় থাকবে।
মাস্কের সরকারি দক্ষতা বিভাগের দলটি তাঁর নিজের কোম্পানির লোকদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে। তাঁরা নাটকীয়ভাবে মার্কিন সরকারি কোষাগারের পাওনা মেটানোর ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদ দখল করেছেন। তাঁরা ফেডারেল কর্মীদের ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ নিয়ে পদত্যাগ করানোর একটি উদ্যোগে সহায়তা করছেন। একটি অভিযান চালাতে সাহায্য করছেন। আর এ কাজ করা হয়েছে একটি ই–মেইলের মাধ্যমে। ই–মেইলটি মাস্ক টুইটার কিনে নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির কর্মীদের কাছে পাঠানো একটি ই–মেইলের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। টুইটারের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির নাম বদলে ‘এক্স’ রাখেন মাস্ক।
এক্সে একটি লাইভ চ্যাটে মাস্ক ব্যক্তিগতভাবে ঘোষণা করেছিলেন, ইউএসএআইডি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটিকে ‘অপরাধী সংস্থা’ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি।
মাস্ক ও তাঁর সহযোগীদের লাগামহীন মনোভাব নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মাস্কের সহযোগীরা ইউএসএআইডির গোপন তথ্য রাখা সুরক্ষিত একটি কক্ষে প্রবেশাধিকার দাবি করার পর থেকে নাটকীয়ভাবে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
সাম্প্রতিক বিতর্কের পর আরেকটি ঘটনা আবার সামনে এসেছে। মাস্ক রকেট উৎক্ষেপণের ক্ষেত্রে ফেডারেল এভিয়েশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তদারকির সমালোচনা করার পর ট্রাম্পের অভিষেকের দিনই সংস্থাটির প্রধানকে তাঁর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এর কয়েক দিন পর ওয়াশিংটনে এক ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার পর ট্রাম্পকে সংস্থাটির নতুন প্রধান নিয়োগের জন্য তাড়াহুড়ো করতে হয়েছে।
ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের দিন মাস্কের হাত উঁচু করে স্যালুট দেওয়া নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তা সাম্প্রতিক বিতর্ককে আরও উসকে দিয়েছে।
ট্রাম্প জোর দিয়ে বলেছেন, ‘যদি কোনো সংঘাত হয়, তবে আমরা তাঁকে এর ধারেকাছে ঘেঁষতে দেব না।’ কিন্তু এ কথা বলেও তিনি সমালোচকদের শান্ত করতে পারেননি।
ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আশ্চর্যজনকভাবে নীরব ছিল ডেমোক্র্যাটরা। কিন্তু মাস্কের সবশেষ পদক্ষেপের সূত্র ধরে তাঁরা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন।
ডেমোক্র্যাট সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন বলেছেন, মাস্ককে কেউ নির্বাচিত করেনি।
মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের ওয়েজ অ্যান্ড মিনস কমিটির ডেমোক্র্যাটরা একটি জরুরি বৈঠক ডেকেছেন। এ বৈঠকের আলোচ্য বিষয়গুলোর মধ্যে মাস্ককে নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কও একটি।
কংগ্রেস অনুমোদিত তহবিলের ওপর প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা প্রয়োগের অসাংবিধানিক প্রচেষ্টার জন্য ডিওজিইর তীব্র সমালোচনা করেছেন ডেমোক্র্যাটরা।
সিনেটের সংখ্যালঘু দল ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতা চাক শুমার বলেছেন, ‘বিষয়টি একটি বাঘকে পোষা প্রাণীর চিড়িয়াখানায় ঢুকতে দিয়ে ভালো কিছুর প্রত্যাশা করার মতো।’
ইউএসএআইডির কর্মীদের এক বিক্ষোভে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সিনেটর ক্রিস ভ্যান হোলেন বলেছেন, ‘ইলন মাস্কের এই দখলদারির চেষ্টা...টিকবে না।’
তবে ট্রাম্প ও মাস্কের মতো দুজন মানুষের অহম হোয়াইট হাউসের একই চৌহদ্দিতে পাশাপাশি বেশি দিন টিকে থাকে কি না, তা ওয়াশিংটন নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ম র ক ন সরক র ইলন ম স ক র সরক র কর ছ ন ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
ইউএসএআইডি-এর রাজনীতি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইউএস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ইউএসএআইডি)-এর বিরুদ্ধে হতবাক করা প্রচারণা বা যুদ্ধকৌশল সংস্থাটিকে ‘বিশ্বের বৃহত্তম দাতা’ হিসেবে পরিচিত এ সংস্থাটিকে ধ্বংস করেছে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহায়তা ও মানবিক সহায়তা ব্যবস্থা উদ্ধার করতে সচেষ্ট কর্মীদের মরিয়া করে তুলেছে। এটা অস্বীকার করা যায় না, এই সহায়তা শিল্পের ওপর লাখ লাখ মানুষের জীবন নির্ভর করে।
এটা বলা যায়, ‘উন্নয়ন’-এর মূল বিষয় সবসময় তার প্রবক্তাদের দাবির তুলনায় অনেক কম মানবতাবাদী ছিল। প্রকৃতপক্ষে, সাহায্যের পুরো উদ্যোগটি ভূরাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং বিশ্বব্যাপী বৈষম্য দূর করার পরিবর্তে সম্পদ আহরণ ও জমানোর উপায়ে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক দিনগুলোতে ইউএসএআইডির সমাপ্তির পর এই বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতনভাবে বা অচেতনভাবে ব্যাপারটি দিন দিন পরিষ্কার হচ্ছে।
উদাহরণস্বরূপ, ‘যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃস্থানীয় মানবিক ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে এবং তাদের বার্তা প্রচার করে যে সংস্থা সেই, ইন্টারঅ্যাকশন জারি করা একটি বিবৃতির কথা বলা যায়। সেখানে লেখা হয়েছে, এই সংস্থাগুলো ‘জীবন বাঁচাতে এবং বিশ্বব্যাপী মার্কিন স্বার্থ এগিয়ে নিতে অক্লান্ত পরিশ্রম করে’। এতে যুক্ত করা হয়েছিল, ইউএসএআইডির ওপর হামলার মধ্য দিয়ে ‘যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক নেতৃত্বকে সমর্থন করে এমন কর্মসূচি স্থগিত করেছে এবং বিপজ্জনক শূন্যতা তৈরি করেছে, যা চীন ও আমাদের প্রতিপক্ষরা দ্রুত পূরণ করবে।’
পশ্চিমা মানবতাবাদ শুধু পথ হারায়নি। এটি শুরু থেকেই পশ্চিমা উপনিবেশবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৮৪-১৮৮৫ বার্লিন সম্মেলন ইউরোপের আফ্রিকা বিজয়ের মঞ্চ তৈরি করেছিল, যা একটি মানবিক ঘটনা হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। যদিও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠন প্রকল্পগুলো ভেঙে পড়ায় ইউরোপে সংঘাতের বর্বর পরিণতি মোকাবিলা করতে প্রথম মানবিক সংস্থাগুলো গঠন করা হয়েছিল। অনেকে সে সময় গ্লোবাল সাউথে জোরালো ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, যেখানে তারা সক্রিয়ভাবে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে সমর্থন করেছিল।
এই সহায়তা শিল্প কার্যত ঔপনিবেশিক ‘সভ্যতা গড়ে তোলার মিশন’ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। অন্যের সম্পদ হস্তগত করার আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে ভালোর মুখোশ পরিয়ে দেওয়া এবং বাস্তবে এই পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ না করেই এর সবচেয়ে খারাপ দিকগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে দেখানোর চেষ্টা করে। যদি কিছু ঘটে, তাহলে দুটির মধ্যে একটি জৈবিক সম্পর্ক রয়েছে। আন্তর্জাতিক তহবিল সহায়তা
নিষ্কাশনমূলক বৈশ্বিক বাণিজ্য ও শাসন ব্যবস্থার বৈধতা দেয়, যা ফলস্বরূপ এমন পরিণতি নিয়ে আসে, যা তহবিল সংস্থাগুলোর অস্তিত্বের বৈধতা নিশ্চিত করে।
ফলস্বরূপ, আজ তহবিল ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বিস্তার সত্ত্বেও বর্ণবাদী বৈশ্বিক ব্যবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি এবং তা বিভিন্ন জাতির মধ্যে গভীর বৈষম্যভিত্তিক সম্পর্ক তুলে ধরে। ইউএস কংগ্রেসের বাজেট অফিসের ১৯৯৭ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বৈদেশিক সাহায্য সর্বোত্তমভাবে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও মানব কল্যাণের উন্নতিতে গৌণ ভূমিকা পালন করে। এমনকি ‘যে পরিবেশে সেই তহবিল ব্যবহার করা হয় এবং যে শর্তে এটি দেওয়া হয়, তার ওপর ভিত্তি করে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।’
পশ্চিমা সাহায্য তহবিল শূন্য হয়ে পড়া নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক হবে। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল কিছু মানুষ কষ্ট পাবে এবং অনেকে মারাও যাবে। তবে বিশ্ব যেমন তেমনটাই আমাদের তুলে ধরা উচিত, আমরা যেমনটি চাই তেমনটি নয়।
এর ফলে এমন এক বিশ্ব সৃষ্টি হবে, যেখানে সাহায্যকে বিশ্বব্যাপী অন্যায়ের আবরণ হতে দেওয়া হবে না। আর তহবিলের অবসানকে ‘উন্নয়ন’-এর সমাপ্তি হিসেবেও দেখা উচিত। আমাদের এমন এক পদ্ধতি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে, যা সত্যই একটি মানবতাবাদী ব্যবস্থাকে দৃশ্যমান করে তুলবে।
প্যাট্রিক গাথারা: দ্য নিউ হিউম্যানিটারিয়ানে অন্তর্ভুক্তিমূলক গল্প বলার সিনিয়র সম্পাদক