মাত্র তিন দফা বৈঠকের পরই সরকার আর বিরোধী দলের সংলাপ ভেঙে গেল। এতে কেউ বিস্মিত হয়েছে বলে মনে হয় না। দুই পক্ষের মধ্যে আস্থার অভাব! কোনো সমাধানের জন্য তারা প্রস্তুত ছিল কি না, তা–ও একটা বড় প্রশ্ন। সংলাপ শুরু হলো ডিসেম্বরে। পিটিআইয়ের মূল দাবি ছিল দুজন কমিশনার নিয়োগ আর দলের বন্দী কর্মীদের মুক্তি। শাসক জোট রাজি হলো না। সংলাপ ভেঙে গেল।

সরকারের সত্যিই যদি বিরোধীদের প্রতি কোনো অভিযোগ থাকে, তা প্রমাণের তো উপায় আছে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ উপস্থাপনের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো নিরপেক্ষ ও বৈধ পদ্ধতিতে সত্য উদ্‌ঘাটনের জন্য বিচারিক কমিশন গঠন করা। তবে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) যে সংলাপ স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নিল, তার তাৎক্ষণিক কারণ ছিল তাদের ঘনিষ্ঠ মিত্র ও আলোচনাসংক্রান্ত কমিটির মুখপাত্র, সুন্নি ইত্তেহাদ কাউন্সিলের নেতা হামিদ রাজার বাড়িতে চালানো অভিযান।

তবু পিটিআইয়ের অবস্থান ছিল সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। যদি সরকার নিরপেক্ষ তদন্তের জন্য দুটি কমিশন গঠনের ঘোষণা দিত। এই শর্তে দলটি আলোচনার দরজা খোলা রেখেছিল। তবে দলীয় নেতা ইমরান খান সরকারের এই অনীহাকে ‘প্রতারণা’ বলে অভিহিত করেছেন।

সম্প্রতি মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার সাইবার অপরাধ আইনে পরিবর্তন প্রস্তাব করছে। এখন অনলাইনে বক্তৃতা দিলেও তা অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যাবে। স্বভাবসুলভভাবে, সরকার এই সংশোধনীগুলো সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই ঢেলে দিয়েছে। তখন বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা চিৎকার করছিলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। সংশোধিত আইনে, অনলাইনে কেউ মিথ্যা সংবাদ ছড়ালে তিন বছর পর্যন্ত কারাবাস হতে পারে। এমনিতে পাকিস্তানে অনলাইনে পদে পদে বাধা। 

সরকার ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া পরিচালনায় আগের বেসামরিক সরকারগুলোর চেয়েও কঠোর ভূমিকা পালন করেছে। কোন বিষয়গুলো সম্প্রচার করা যাবে না এবং কারা অতিথি হিসেবে আমন্ত্রিত হতে পারবেন, তা নিয়ে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।

বিরোধীদলীয় নেতাদের সংবাদ প্রচার এবং উপস্থাপন নিয়েও ‘পরামর্শ’ প্রদান করা হচ্ছে। এই সব সংশোধনী নিয়ে ব্যাপক প্রতিবাদ হচ্ছে। করছে বিরোধী দল, গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো। পিটিআইসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল সংসদে এই সংশোধনীর নিন্দা জানিয়েছে। আওয়ামী ন্যাশনাল পার্টি একে ‘দমনমূলক আইন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।

নতুন আইন পাস হওয়ার পর সাংবাদিকেরা জাতীয় পরিষদ ও সিনেট থেকে ওয়াকআউট করেন। সাংবাদিক সংগঠনগুলো দেশব্যাপী রাস্তায় নেমে একে কালো আইন এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত হিসেবে অভিহিত করে বিক্ষোভ করেছে। পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশন বলেছে, এই আইন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সমালোচনা দমনে রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক এবং ভিন্নমতাবলম্বীদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করতে পারে। সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়গুলোতে এটিকে ‘নিষেধাজ্ঞামূলক আদেশ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না।

সরকারের বিতর্কিত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে এই সাইবার অপরাধ আইন সংশোধনী আর তার আগে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে দুর্বল করা ২৬তম সাংবিধানিক সংশোধনীর অনুমোদন পাকিস্তানকে আরও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের দিকে ঠেলে দেওয়ারই ইঙ্গিত দেয়। এসব পদক্ষেপ বিরোধী দলকে আরও দূরে ঠেলে আলোচনার সম্ভাবনা কঠিন করে দিয়েছে।

সংঘাতপূর্ণ রাজনীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য বিশাল ক্ষতির কারণ হবে। সরকার বাজেট ঘাটতি কমানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সীমিতভাবে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা অর্জন করেছে। কিন্তু তা এসেছে আইএমএফের ঋণ প্যাকেজ দিয়ে।

এই স্থিতিশীলতা অত্যন্ত নাজুক। একে টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ। তার চেয়েও বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো স্থিতিশীলতা থেকে বৃদ্ধি ও বিনিয়োগের পথে এগিয়ে যাওয়া। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিল ১ শতাংশের কম। বিনিয়োগ ইতিমধ্যে ইতিহাসের সবচেয়ে নিচে নেমে গেছে। তার ওপরে খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তানে সন্ত্রাসী ও উগ্রপন্থী সহিংসতা বেড়েছে। 

এ বিষয়গুলোর প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ। সেই ভিত্তিতে সরকার ও বিরোধী দল, বিশেষত ক্ষমতাসীন জোটকে তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে হবে। নমনীয়তা দেখাতে হবে। দেশের স্বার্থে একটি কার্যকর সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য উভয় পক্ষেরই দায়িত্বশীল ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন।

মালিহা লোধি সাবেক রাষ্ট্রদূত 

ডন থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ জাভেদ হুসেন

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক র জন য সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

চবিতে ধর্ষণবিরোধী মিছিলে নারী শিক্ষার্থীকে ‘ভুয়া’ বলে হট্টগোল 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) ধর্ষণবিরোধী সমাবেশে হট্টগোলের ঘটনা ঘটেছে। রোববার রাত আটটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট এলাকায় এ হট্টগোল হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরকে সমালোচনা করে বক্তব্য দেওয়া নিয়ে এ ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত শিক্ষার্থীরা জানান, সারাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও ধর্ষণের প্রতিবাদে প্রথমে বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছিল একদল শিক্ষার্থী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন ফেসবুকে এটির প্রচারণা চালান। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে জিরো পয়েন্টে এটি হওয়ার কথা ছিল। অন্যদিকে চলমান হেনস্তা ও ধর্ষণের শাস্তি ফাঁসির দাবিতে সাড়ে ছয়টার মশাল মিছিলের ডাক দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা।

ছাত্রীদের এই মিছিলটি বিজয় চব্বিশ হলের (সাবেক জননেত্রী শেখ হাসিনা হল) সামনে থেকে শুরু হয়। পরে তারা প্রীতিলতা ও নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরী হল (সাবেক বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল) ঘুরে প্রীতিলতা হল সংলগ্ন জামাল নজরুল ইসলাম সড়কে আসে। আর ছাত্রদের মিছিলটিও জিরো পয়েন্ট থেকে শুরু করে কাটা পাহাড় সড়ক হয়ে জামাল নজরুল ইসলাম সড়কে আসে। সেখান থেকে ছাত্র ও ছাত্রীদের মিছিলটি এক হয়ে দক্ষিণ ক্যাম্পাস ঘুরে আবার জিরো পয়েন্ট এলাকায় পৌঁছায়। সেখানে সমাবেশ হয়। এতে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা বক্তব্য দিচ্ছিলেন। এই বক্তব্য দেওয়া নিয়েই সেখানে হট্টগোল হয়। 

শিক্ষার্থীরা জানান, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নয় ছাত্রীর বহিষ্কার নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা চলছে। বহিষ্কৃত ওই ৯ ছাত্রীর একজন ছিলেন সুমাইয়া শিকদার। তিনি সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার এক পর্যায়ে হট্টগোল শুরু হয়। সুমাইয়া শিকদার তার বক্তব্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের নারীদের নিয়ে কুরুচিপূর্ণ ফেসবুক পোস্ট নিয়ে সমালোচনা করেছিলেন। 

এই সমালোচনার জেরে সমাবেশে অবস্থানকারী একটি অংশ ভুয়া ভুয়া বলে স্লোগান দেন। পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ উপস্থিত অন্য শিক্ষার্থীরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।

জানতে চাইলে সমাবেশে থাকা ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী আরমান হোসেন বলেন, সুমাইয়া শিকদার বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী। তাই তার বক্তব্য দেওয়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে কয়েকজন। আবার এটা ছিল এই ধর্ষণবিরোধী কর্মসূচি। সারাদেশে নারীদের নিরাপত্তার দাবিতে এই কর্মসূচি ছিল। এটি আমাদের ক্যাম্পাসের বিষয় ছিল না। এখানে একটা গোষ্ঠী ক্যাম্পাসের বিষয়গুলো এনেছে বলে আরেকটা গোষ্ঠী এর প্রতিবাদ করেছে।

এ বিষয়ে সুমাইয়া শিকদার বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর ছাত্রীদের হানি ট্র্যাপার বলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। একজন প্রক্টর নারীদের ইঙ্গিত করে এই ধরনের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে আমি বিষয়টি বলতে যাচ্ছিলাম। তবে কথা শেষ করার আগেই একদল ইচ্ছাকৃভাবে হট্টগোল করেছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ