ইউএসএআইডির অর্থায়ন পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের প্রস্তুতি
Published: 4th, February 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওকে সোমবার ‘ইউনাইটেড স্টেটস এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট-ইউএসএআইডির ‘ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক’ নিযুক্ত করেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম দাতা সংস্থাটির দায়িত্ব নিয়েই তিনি বলেছেন, ‘আমরা আমেরিকান জনগণের স্বার্থ রক্ষার পাশাপাশি তাদের করের অর্থের যাতে অপচয় না হয়, সেটা নিশ্চিত করব।’
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে মঙ্গলবার এক বার্তায় আরও বলা হয়েছে, ইউএসএআইডি বিদেশে আমেরিকার স্বার্থকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মূল লক্ষ্য থেকে সরে এসেছে। এখন এটা স্পষ্ট, সংস্থাটির তহবিলের উল্লেখযোগ্য অংশ যুক্তরাষ্ট্রের মূল জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
উল্লেখ্য, ট্রাম্প প্রশাসন এ বছরের জানুয়ারিতে ক্ষমতায় আসার পর ইউএসএআইডির কার্যকলাপ আরও ভালোভাবে বোঝা ও সংস্থার কার্যকলাপের ওপর ট্রাম্প সরকারের নীতি প্রতিফলনের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসেবে সংস্থাটির অর্থায়নে বিশ্বের শতাধিক দেশে পরিচালিত প্রকল্পগুলো তিন মাসের জন্য স্থগিত করেছে। রুবিও বাড়তি দায়িত্ব নিয়েই মার্কিন কংগ্রেসকে জানিয়েছেন, ইউএসএআইডির বৈদেশিক সহায়তা কার্যক্রম পর্যালোচনার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডা বাস্তবায়নে জোর দেওয়া হবে।
সমকালের পাঠকরা ৩ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ‘ট্রাম্পের আদেশের বড় ধাক্কা বাংলাদেশে, ঝুঁকিতে লাখো মানুষ’ শীর্ষক প্রধান সংবাদটি পড়েছেন। সেখানে ইউএসএআইডির অর্থায়নের প্রেক্ষাপট ও খাতগুলো এবং অর্থায়ন বন্ধ হলে বাংলাদেশের এনজিও খাত ও সরকারি প্রকল্পগুলো কী ধরনের সমস্যায় পড়তে পারে, তার বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আমি সে আলোচনায় যাব না। বরং এই নিবন্ধে ইউএসএআইডি নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসনের পদক্ষেপের কারণ, রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের করণীয় ও প্রস্তুতি বিষয়ে আলোকপাত করব।
স্বীকার্য, ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত কার্যক্রম তিন মাসের জন্য বন্ধ হওয়ায় বাংলাদেশের বিশেষত এনজিওতে কর্মরত অনেকের মনে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের চাকরি হারানোসহ স্বাস্থ্য খাত বড় সংকটে পড়তে পারে বলে সমকালের প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আগের মেয়াদে ইউএসএআইডি নিয়ে মাথা ঘামাননি বললেই চলে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ধারাবাহিকতায় ট্রাম্পের মেয়াদেও ইউএসএআইডি গতানুগতিকভাবে চলেছে।
এবার যখন ট্রাম্প প্রশাসন ইউএসএআইডির তহবিলের উল্লেখযোগ্য অংশ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করছে এবং কার্যক্রম স্থগিতের মাধ্যমে যাচাই-বাছাই করে দেখতে চাইছে, তখন বিষয়টি হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সরকারকে এই জায়গা বিশেষভাবে খতিয়ে দেখতে হবে। আমেরিকা যাতে আগের চেয়েও বেশি অনুদান দেয়, সেটা নিশ্চিত করতে এখনই কাজে নামতে হবে।
প্রশ্ন হলো– ট্রাম্প প্রশাসন গত মেয়াদে ইউএসএইডের কার্যক্রম পর্যালোচনা করেনি; এবার কেন করছে। এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে সংস্থাটির সর্বশেষ প্রশাসক সামান্থা পাওয়ারের জীবনী ও কর্ম এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন ১ হাজার ৩৫৮ দিনের কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা ও পর্যবেক্ষণে।
ইউএসএআইডির ঐতিহ্য হলো, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে নতুন কেউ আসার সঙ্গে সঙ্গে ইউএসএআইডির প্রশাসক পদেও পরিবর্তন আসে। ১৯৬১ সালে ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট জন এফ.
ইউএসএআইডির খণ্ড ও পূর্ণকালীন মিলিয়ে মোট ২৬ জন প্রশাসক ছিলেন। তাদের মধ্যে ১৯তম প্রশাসক সামান্থা জেন পাওয়ার একদম ভিন্ন। তাঁর সময়ে ইউএসএআইডিতে নীতি সংক্রান্ত ও খুঁটিনাটি যত পরিবর্তন হয়েছে, তা সংস্থাটির ৬৪ বছরের ইতিহাসে ঘটেনি। তিনি ঘুমের সময় ছাড়া পুরো সময়টা কাজে ব্যস্ত থাকতেন। এই দায়িত্ব পালনকালে তিনি মার্কিন প্রশাসনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন; যার শুরুটা হয়েছিল ওবামার সময়ে এবং বাইডেন প্রশাসনেও তা বাড়তে থাকে। তিনি ইউএসএআইডির কার্যক্রম ও অর্থায়নে নানা মাত্রা যোগ করার পাশাপাশি আমেরিকার আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অভূতপূর্ব সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি ইউএসএআইডির কার্যক্রমের স্থানীয়করণ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা সম্পর্কিত নীতি কাঠামো তৈরি করেন। তাঁর সময়ে এলজিবিটিকিউআই কার্যক্রম বিস্তৃত হয়। ফলে সামান্থা পাওয়ারের নেতৃত্বাধীন সময়ের ইউএসএআইডির তিনটি অগ্রাধিকার– বেশি সহজলভ্য, ন্যায়সংগত ও সাড়ামূলক কার্যক্রম পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করা ট্রাম্প প্রশাসনের প্রায় অবশ্যাম্ভাবী।
ডেমোক্র্যাট পার্টির সদস্য সামান্থা পাওয়ার ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ইয়েল ও হার্ভার্ড শিক্ষিত সামান্থা তৎকালীন সিনেটর বারাক ওবামার সিনিয়র অ্যাডভাইজার ছিলেন। এর পর যেসব গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব লাভ করেন, তার মধ্যে আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের দায়িত্বও ছিল।
জাতিসংঘে রাষ্ট্রদূত থাকা অবস্থায় সামান্থা ধর্মীয় স্বাধীনতা, নারী অধিকার, এলজিবিটিকিউআই অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সোচ্চার থাকার পাশাপাশি বিদেশে নৃশংসতার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের বড় সমর্থক হিসেবে পরিচিত। লিবিয়াতে বারাক ওবামার সামরিক অভিযানে তাঁর ভূমিকা ছিল। আইরিশ-আমেরিকান সামান্থা কর্মজীবন শুরু করেছিলেন সাংবাদিক হিসেবে; পুলিৎজার পুরস্কারও পেয়েছেন।
কেউ যদি বুঝতে চান, ট্রাম্পের দিকনির্দেশনায় আগামী তিন মাস মার্কো রুবিওর নেতৃত্বে ইউএসএআইডির কার্যক্রম পর্যালোচনায় কী হতে পারে, তাহলে গত চার বছরে সামান্থা পাওয়ারের নেতৃত্বে ইউএসএআইডির কার্যক্রম দেখতে হবে। ট্রাম্প ক্ষমতালাভের পরপরই যেসব নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন, সেগুলোকেও একত্রভাবে দেখতে হবে। বিশেষত বিদেশনীতি সংক্রান্ত আদেশগুলো।
বাংলাদেশে ইউএসএআইডির অর্থায়ন সম্পূর্ণ বন্ধ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, ওয়াশিংটনের জন্য ঢাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। আগের মেয়াদে ট্রাম্প প্রশাসন কী ধরনের প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে, সেগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে দেশটির বর্তমান পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বোঝা সম্ভব, আগামীতে ইউএসএআইডি কোথায় কতটা অর্থায়ন করবে। এখন পর্যন্ত যতটুকু বোঝা যাচ্ছে, তাতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষির কিছু প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ হতে পারে; কিন্তু নতুন অনেক প্রকল্পে অর্থায়ন হবে। আমার মতে, সামগ্রিকভাবে ইউএসএআইডির অর্থায়ন বাড়বে বাংলাদেশে। কারণ বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে আমেরিকান জনগণের বন্ধন সম্প্রসারণে ট্রাম্প প্রশাসন আগের মেয়াদের চেয়ে বেশি অগ্রসর হবে।
মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পরর ষ ট র প রকল প পর য ল
এছাড়াও পড়ুন:
ইউএসএআইডি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন: ইলন মাস্ক
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বন্ধু বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির কড়া সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ইউএসএআইডি একটি সন্ত্রাসী সংগঠন।
সোমবার কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার অনলাইন প্রতিবেদনে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
এর আগে গতকাল গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ইউএসএআইডির ওয়েবসাইট বন্ধ দেখা যাচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, সংস্থাটিরকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়ন্ত্রণে আনার পরিকল্পনা করছে ট্রাম্প প্রশাসন। এরপরেই মাস্ক এমন মন্তব্য করলেন।
ইলন মাস্ক বলেছেন, মার্কিন জনগণের করের অর্থ দিয়ে জৈব অস্ত্র গবেষণায় অর্থায়ন করেছে ইউএসএআইডি। সেইসঙ্গে সংস্থাটি প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর জন্য অর্থ ব্যয় করেছে। তাই সময় হয়েছে সংস্থাটির মরে যাওয়ার।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনটি পোস্ট শেয়ার করেছেন মাস্ক। সেখানে তিনি বলেছেন, আপনারা জানেন কী, ইউএসএআইডি আপনাদের করের অর্থে জৈব অস্ত্র গবেষণায় অর্থায়ন করেছে। এর মধ্যে কোভিড-১৯ এর মতো জীবাণুও অন্তর্ভুক্ত, যার কারণে কয়েক কোটি মানুষ মারা গেছেন।
এ ছাড়া মাইক বেঞ্জের একটি টুইট শেয়ার করে ইলন মাস্ক বলেন, প্রোপাগান্ডা প্রচারের জন্য ইউএসএআইডি গণমাধ্যমগুলোকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দিয়েছে। এরপর আরেকটি টুইটে তিনি ঘোষণা করেন, ইউএসএআইডির মৃত্যু হওয়াই উচিত।
এর আগে গত শনিবার ইউএসএআইডির ওয়েবসাইটে প্রবেশ করার চেষ্টা করলে সেখানে ‘সার্ভার আইপি ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি’ বলে একটি বার্তা ভেসে উঠছে।
গত সপ্তাহে ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তা বন্ধের নির্দেশ দেয়। ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী কয়েক বিলিয়ন ডলারের এ ধরনের বৈদেশিক সহায়তা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং করদাতাদের অর্থের অপচয় কি না, তা নিশ্চিত হতে পর্যালোচনা করে দেখা হবে।