‘এলো ঐ বনান্তে পাগল বসন্ত/বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে/চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।।/বাঁশীতে বাজায় সে বিধুর/পরজ বসন্তের সুর/পাণ্ডু কপোলে জাগে রঙ নব অনুরাগে/রাঙা হ’ল ধূসর দিগন্ত।।’/–কাজী নজরুল ইসলাম
শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে উষ্ণতার পরশ নিয়ে ঋতুরাজ বসন্তের আগমন ঘটতে এই তো কয়েকটা দিন বাকি। গাছের শুকনো পাতা ঝরে গিয়ে ডালে ডালে নতুন কচি পাতা আর বাহারি ফুলের সমারোহ। চারপাশে ভ্রমরের গুঞ্জন আর কোকিলের মধুর সুরে প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে দরজায় কড়া নাড়ছে বসন্ত।
বসন্ত শুধু প্রকৃতির পরিবর্তন নয়; এটি মানুষের মনে এক নতুন উদ্দীপনা জাগায়। বাংলা সংস্কৃতিতে বসন্ত বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। একই সঙ্গে উদযাপিত হয় বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবস, যা বাঙালির আবেগ-অনুভূতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় যান্ত্রিক এ জীবনে বহু সংস্কৃতি হারিয়ে গেলেও বসন্ত উৎসব বাঙালি হৃদয়ের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে।
বসন্তের আবির্ভাবে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনেও নবজাগরণ আনে। এ লক্ষ্যে মনকে রাঙিয়ে দিতে দেশীয় ফ্যাশন হাউসগুলোয় লেগেছে বসন্তের আমেজ। প্রতিবারের মতো এবারও প্রতিষ্ঠানগুলো এনেছে নারীর জন্য শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, লং কুর্তি, রেগুলার কুর্তি, কাফতান, টপস, টিউনিক, টপস-স্কার্টের বিশাল সংগ্রহ। পাশাপাশি ছেলেদের জন্য রেগুলার ও ফিটেড পাঞ্জাবি, শার্ট, কটি। শিশুর জন্যও নানা ধরনের পোশাক নিয়ে এসেছে ব্র্যান্ডগুলো।
রঙের বাহার: বিশ্বরঙ, কে ক্রাফট, রঙ বাংলাদেশ, লা রিভ, নিপুণ, অঞ্জন’স, সাতকাহনসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পোশাকের মোটিফ ও ডিজাইনে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বসন্ত ও ভালোবাসার রং। পোশাকে প্রাধান্য পেয়েছে হলুদ, বাসন্তী, কমলা, মেরুন, রেড, অফ হোয়াইট, জাভা গ্রিন, মাস্টার্ড ইয়েলো, নিওন লাইম ও কলাপাতা রঙের বাহার।
দেশের অন্যতম ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘বিশ্বরঙ’-এর ডিজাইনার বিপ্লব সাহা বলেন, ‘শীতের পরেই যেহেতু বসন্তের আগমন ঘটে, এ কারণে প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে মনকে রাঙিয়ে তুলতে আমরা বরাবরের মতো এই বসন্তেও প্রকৃতি এবং ফুলের সৌন্দর্যের মোটিফে পোশাক ডিজাইন করেছি। বসন্তের রঙিন ফুলের মতো আমাদের পোশাকেও রয়েছে বিভিন্ন রঙের সমারোহ। এখানে হলুদ ও বাসন্তী রংকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, বসন্ত উৎসব বাঙালির এমন একটা উৎসব, যা কোনো নির্দিষ্ট বয়সে আটকে থাকে না। শিশু থেকে বৃদ্ধ– সবার হৃদয়েই এ উৎসবের আমেজ নাড়া দিয়ে যায়। এ কারণে ‘বিশ্বরঙ’-এ সব বয়সীর জন্যই রয়েছে বসন্তের পোশাক। তিনি জানান, সুতি কাপড়ে কাজের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে টাই-ডাই, ব্লক, অ্যাপলিক, কাটওয়ার্ক, স্ক্রিন প্রিন্ট, হ্যান্ডপেইন্ট, বাটিক, ভেজিটেবল ডাই, কারচুপি, হ্যান্ড এমব্রয়ডারি, মেশিন এমব্রয়ডারি ইত্যাদি।
ফ্যাশন হাউস ‘কে ক্রাফট’-এ সমসাময়িক মোটিফ ও প্রিন্টের পাশাপাশি এবার প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বিশেষভাবে বাছাই করা ডিজাইন, প্যাটার্ন ও রংকে, যা বসন্ত উৎসব এবং ভালোবাসা দিবস দুটি উৎসবকেই সমানতালে ফুটিয়ে তুলবে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী খালেদ মাহমুদ খান জানান, শীতের শেষে প্রকৃতিতে মিষ্টি ফাল্গুনী হাওয়া যেমন থাকে, তেমনি থাকে সঙ্গে হালকা গরমের ছোঁয়া। তাই সময়োপযোগী সুতি কাপড়কেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ‘কে ক্রাফট’-এর এবারের বসন্ত আয়োজনে। তাঁর মতে দিনে পোশাক নির্বাচনে সুতির পোশাক সবচেয়ে উপযোগী হবে। তা ছাড়া সন্ধ্যার পর সুতির পাশাপাশি জর্জেট, সিল্ক অথবা হাফ সিল্কের পোশাক বেছে নেওয়া যেতে পারে। হলুদ কিংবা কমলার পাশাপাশি পোশাকের ক্ষেত্রে উৎসবের এ দিনে বেছে নিতে পারেন কে ক্রাফটের লাল, ম্যাজেন্টা, অফ হোয়াইট, মেরি গোল্ড, পার্পল, ভায়োলেট, ল্যাভেন্ডার, স্যালমন রেড, পিচ, ব্রিক রেড, নীল, ফরেস্ট গ্রিন রঙের পোশাক। আবার এই দিনে যেহেতু ভালোবাসা দিবস, এ জন্য পরা যেতে পারে পছন্দের লাল রং অথবা নীল পোশাক।
প্রতিবছরের মতো বসন্তের আয়োজনে ফ্যাশন হাউস ‘রঙ বাংলাদেশ’ও ফ্যাশনপ্রিয় মানুষকে রাঙিয়ে দিতে প্রস্তুত নতুন ডিজাইনের বৈচিত্র্যময় পোশাক নিয়ে।
প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী ও ডিজাইনার সৌমিক দাস জানান, দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক মেলবন্ধনের প্রচেষ্টায় বসন্ত উৎসবের পোশাক ডিজাইনে এবার তারা থিম হিসেবে ব্যবহার করেছেন ‘আমেরিকান নেটিভ পটারি’ বা আমেরিকান আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন নকশা। এর মাধ্যমে এবার বসন্ত উৎসবের পোশাকে এসেছে ভিন্নতা।
তিনি আরও জানান, ব্যতিক্রমী নকশার পাশাপাশি ফেব্রিক্সেও আছে বৈচিত্র্য। হাফ সিল্ক, কটন, জ্যাকার্ট কটন, মারসালাইস কটন এবং স্লাব ভিস্কস কাপড়ে কমলা, গাঢ় হলুদ, হালকা হলুদ, অলিভ আর সাদা রঙের ব্যবহার। একই সঙ্গে আরাম, টেকসই ও ডিজাইনের সমন্বয়ে ‘রঙ বাংলাদেশ’-এর বসন্তের পোশাকে আনা হয়েছে ভিন্নতা।
রঙ বাংলাদেশের সাবব্র্যান্ড ওয়েস্ট রঙ এবং রঙ জুনিয়রের পোশাকেও রয়েছে বসন্তের আমেজ। পাশাপাশি পরিবারের সবার জন্য রয়েছে একই ধরনের ম্যাচিং পোশাক।
ফাল্গুন ও ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে ফ্যাশন ব্র্যান্ড ‘লা রিভ’ নিয়ে এসেছে নতুন সব কালেকশন। ক্যাজুয়াল ওয়্যারের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানটির সংগ্রহে থাকছে ইউনিক সব পার্টি স্টাইল। উৎসবের এই দিনে পরার জন্য কাফতান-কাট টিউনিক, ফ্লেয়ার্ড শ্রাগের মতো ইউনিক সব ডিজাইন যোগ করেছে লা রিভ। ছেলেদের জন্য রয়েছে ট্রেন্ডি পাঞ্জাবি, শার্ট, টি-শার্ট, পোলো শার্ট, ফরমাল শার্ট ও বেস্ট-ফিট বটমসের মতো পোশাকের সমাহার।
বসন্ত ও ভালোবাসা দিবসে নিজের ও প্রিয়জনের জন্য পছন্দের পোশাকটি কিনতে পারেন দেশীয় সব ফ্যাশন হাউস থেকে। চাইলে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক, সীমান্ত স্কয়ার, টোকিও স্কয়ার, শ্যামলী স্কয়ার, মৌচাক মার্কেট, রাপা প্লাজা, জেনেটিক প্লাজাসহ বিভিন্ন মার্কেট থেকেও কিনতে পারেন পছন্দের পোশাক। যারা একটু স্বল্প বাজেটের মধ্যে কেনাকাটা করতে চাইছেন তারা চলে যেতে পারেন নিউমার্কেট, গাউছিয়া, কৃষি মার্কেট, রামপুরা সুপারমার্কেটসহ আপনার আশপাশের কাছের মার্কেটে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বসন ত উৎসব বসন ত র উৎসব র র জন য
এছাড়াও পড়ুন:
ফের নিজের তৈরি বিমানে উড়লেন জুলহাস, যমুনাপাড়ে উৎসবের আমেজ
ফের নিজের তৈরি বিমানে আকাশে উড়েছেন ইলেকট্রিক মিস্ত্রি জুলহাস মোল্লা (২৮)। রবিবার (৯ মার্চ) দুপুর ১টার দিকে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার জাফরগঞ্জে যমুনার পাড়ে নিজের তৈরি বিমানে আকাশে উড়েন তিনি।
এ সময় বাংলাদেশ বিমানের অবসরপ্রাপ্ত পাইলট ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল ফারুকসহ সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে, গত সোমবার (৩ মার্চ) পরীক্ষামূলক প্রথম ওড়েন তিনি।
জুলহাসের তৈরি বিমানে আকাশে উড়া দেখতে রবিবার সকাল থেকে হাজারো মানুষ যমুনার পাড়ে ভিড় করেন। লোকে লোকারণ্য যমুনাপাড়ে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।
টাঙ্গাইলের নাগরপুর থেকে লোকমান রহমান ছেলে রোরহানকে নিয়ে এসেছেন জুলহাসের বিমান দেখতে। তিনি বলেন, ‘‘জুলহাসের তৈরি বিমান টিভিতে দেখার পর ছেলে সামনে থেকে দেখার বায়না ধরেছে। ছেলের আবদার পূরণে আজ সকালে যমুনার পাড়ে ছুটে আসি। বিমানটি সামনে থেকে দেখতে পেরে বোরহান খুবই খুশি।’’
মানিকগঞ্জ শহরের উত্তর সেওতা থেকে এসেছেন জুয়েল আহমেদ। তিনি বলেন, ‘‘ইচ্ছা এবং চেষ্টা থাকলে অনেক কঠিন কাজও সম্ভব। সেটাই প্রমাণ করেছেন মানিকগঞ্জের এক তরুণ। তিনি নিজের চেষ্টা ও পরিশ্রমে বিমান তৈরি করেছেন। শুধু তাই নয়, নিজেই সেটি সফলভাবে আকাশে উড়িয়েছেন।’’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জুলহাস মোল্লার বাড়ি মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার তেওতা ইউনিয়নের ষাইটঘর তেওতা গ্রামে। জুলহাসের বাবা জলিল মোল্লার গ্রামের বাড়ি ছিল জেলার দৌলতপুর উপজেলার বাঘুটিয়া এলাকায়।
নদীভাঙনের কারণে বর্তমানে তারা শিবালয় উপজেলার ষাইটঘর তেওতা এলাকায় পরিবারসহ বসবাস করেন। ছয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে জুলহাস পঞ্চম। তিনি জিয়নপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন। পরে অর্থাভাবে আর পড়তে পারেননি। পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি জুলহাস ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। ছুটিতে বাড়িতে এসে তৈরি করেছেন বিমানটি।
জুলহাস মোল্লা জানান, তিন বছর গবেষণা এবং এক বছর সময় লেগেছে বিমানটি তৈরি করতে। অ্যালুমিনিয়াম ও লোহা দিয়ে বিমানটির অবকাঠামো তৈরি। পানির পাম্পের ‘সেভেন হর্স পাওয়ারের’ ইঞ্জিন ব্যবহার করেছেন।
তিনি বলেন, ‘‘বিমানটি পরীক্ষামূলকভাবে প্রশিক্ষণের জন্য তৈরি করা হয়েছে। তবে, সরকারি অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি বাণিজ্যিকভাবে তৈরি করা যেতে পারে। বিমানটি ৫০ ফুট ওপরে উড়তে পারে।’’
বাংলাদেশ বিমানের অবসরপ্রাপ্ত পাইলট ক্যাপ্টেন আব্দুল্লাহ আল ফারুক বলেন, ‘‘জুলহাসের বিমানটি তৈরিতে যে গবেষণা হয়েছে, তা কীভাবে আরো উন্নয়ন ঘটানো যায় সে বিষয়ে সবাই কাজ করব। সেই সঙ্গে তার একাডেমিক রিসোর্স ও কারিগরি যেসব সহযোগিতা প্রয়োজন, সে বিষয়ে আমরা সহযোগিতা করব।’’
ঢাকা/চন্দন/রাজীব