বিআরটিএর মাহাবুবের হাতে ‘জাদুর চেরাগ’
Published: 4th, February 2025 GMT
সরদার মাহাবুবুর রহমান। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষে (বিআরটিএ) ক্যাশিয়ার হিসেবে যোগ দেন। তখন তাঁর বেতন ছিল সাকল্যে দেড় হাজার টাকা। দুই ধাপ পদোন্নতি পেয়ে ২০২৩ সালে উপপরিচালক (ডিডি, অর্থ) হন তিনি। এখন তাঁর বেতন প্রায় ৭০ হাজার টাকা। সরকারি এই কর্মকর্তা ঢাকায় গড়েছেন বহুতল ভবন, ফ্ল্যাট। কিনেছেন গাড়ি। গোপালগঞ্জ জেলা শহরে নির্মাণ করছেন ১৪ তলা ভবন।
মাহাবুবুর রহমানের পুরো চাকরিজীবনের হিসাব করলে দেখা যায়, তিনি বেতন পেয়েছেন সর্বোচ্চ ৮৫ লাখ টাকা। অন্যদিকে তাঁর প্রয়াত কৃষক বাবা কিছু আবাদি জমি রেখে গেছেন, সেগুলো সেভাবেই আছে। এমন পরিস্থিতিতে তাঁর বিপুল সম্পদের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
মাহাবুবুর রহমানের গ্রামের বাড়ি নড়াইলের কালিয়া উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামে। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া আবাদি জমিজমা এখন পর্যন্ত বিক্রি করেননি মাহাবুবুর রহমান বা তাঁর শরিকরা। তাঁর স্ত্রী মিন্নি বেগম গৃহিণী। তিন ছেলেমেয়ে এখনও শিক্ষার্থী। শ্বশুরবাড়ি থেকেও বড় ধরনের আর্থিক সুবিধা পাওয়ার সুযোগ নেই। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, অনিয়ম-দুর্নীতির অর্থ দিয়েই গড়েছেন এসব সম্পদ।
বিআরটিএর একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জেলা ও সার্কেল অফিসগুলোর জন্য বার্ষিক বরাদ্দ হয়। কোন অফিস কত বরাদ্দ পাবে তা নির্ধারণ করতেন মাহাবুবুর রহমান। একক ক্ষমতা ছিল তাঁর হাতে। বাজেট বাড়িয়ে দিয়ে সংশ্লিষ্ট সার্কেল থেকে মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন তিনি। কেনাকাটার ভাউচার পাস করাতেও কমিশন দিতে হতো তাঁকে। এ ছাড়া বিআরটিএর বেসরকারি ভেন্ডর প্রতিষ্ঠানের বিল পাস করাতে উৎকোচ নিতেন। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর বাজেট সংক্রান্ত কমিটি হওয়ায় বর্তমানে তাঁর ক্ষমতা অনেকটা খর্ব হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাহাবুবের বাবা আব্দুর রাশেদ সরদার প্রায় ৩০ বছর আগে মারা গেছেন। তারা দুই ভাই ও দুই বোন। ডুমুরিয়া গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার ছয়জনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাহাবুবের বাবা রাশেদ সরদার কৃষিকাজ করতেন। তিনি চাষাবাদের যে জমিজমা রেখে গেছেন, তা ছেলেমেয়েরা বিক্রি করেননি। পৈতৃক টিনের বাড়ি ছিল। সেটি ভেঙে এখন একতলা বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।
ঢাকা উদ্যানে বহুতল ভবন
মোহাম্মদপুর থানাধীন ঢাকা উদ্যানে মাহবুবুর রহমানের একটি বহুতল ভবন রয়েছে। ব্লক-এ। রোড-২। বাড়ি নম্বর-২১। আটতলা অট্টালিকা। ছাদের ওপরে অর্ধেকাংশে আরও একটি ফ্ল্যাট করা হয়েছে। সে হিসাবে বাড়িটি সাড়ে আটতলা। নিচতলায় তিনটি দোকান ঘর ভাড়া দেওয়া আছে। বাড়িটির ম্যানেজারের দায়িত্বে রয়েছেন আরজু মিয়া।
ভাড়াটিয়া কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছে ৭-৮ বছর আগে। মাহবুবুর রহমান সেখানে কখনোই বাস করেননি। প্রতি তলায় দুটি করে ইউনিট। সব ক’টিতে ভাড়াটিয়া রয়েছে।
কর্নার প্লটের ভবনটির বাইরের অংশে রং করা নেই। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, সাধারণত বাইরের দিকে চাকচিক্য থাকলে মানুষের মনে ভবন ও মালিক সম্পর্কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। সেটা এড়াতে রং করা হয়নি।
গোপালগঞ্জে নির্মাণাধীন ১৪ তলা ভবন
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাহাবুবুর রহমান ২০১৪ সালে গোপালগঞ্জ জেলা শহরের থানাপাড়া জামে মসজিদের পাশে ৬৫ লাখ টাকায় স্ত্রীর নামে সাড়ে ৬ শতাংশ জমি কেনেন। বছর দুয়েক আগে সেখানে ১৪ তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেন মাহাবুব।
সম্প্রতি সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের ৯ তলা পর্যন্ত উঠেছে। বাইরের অংশের প্লাস্টারের কাজ চলছে। ভবনের প্রতিটি তলায় তিন ইউনিট। নির্মাণ শ্রমিকরা বলেন, তারা বাড়িটির মালিক হিসেবে মাহাবুবুর রহমানকেই জানেন। তিনি ঢাকায় সরকারি বড় কর্মকর্তা। মাঝেমধ্যে ছুটির দিনে নির্মাণকাজ দেখতে এখানে আসেন। নির্দেশনা দেন। তাঁর নির্দেশনায় কাজ এগিয়ে চলছে।
ছয় মাসের মধ্যে ভবনটি বসবাসের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে বলে জানান শ্রমিকরা। ভবন নির্মাণে প্রতি বর্গফুটে অন্তত ২ হাজার ৩০০ টাকা ব্যয় হবে।
মাহাবুবুর রহমানের শ্বশুরবাড়ি গোপালগঞ্জে। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, মাহাবুবের শ্বশুর প্রয়াত মোহাম্মদ আলী পুলিশের কর্মকর্তা ছিলেন। নব্বই দশকে তিনি অবসরে যান। এরপর গোপালগঞ্জ শহরের মিয়াপাড়ায় জমি কিনে ছাপড়া ঘর তুলে বসবাস করতেন। সাত মেয়ে ও চার ছেলে নিয়ে দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। শহরে মুদি ব্যবসা করেছেন। ভিটে জমি ছাড়া তাঁর কোনো সম্পদ ছিল না। মিন্নির স্বামীর টাকায় জমি কেনার পর বাড়ি তৈরি করা হচ্ছে।
রাজধানীর মিরপুরে ফ্ল্যাট
অনুসন্ধানে জানা যায়, মাহাবুবুর রহমান একসময় মিরপুরের উত্তর টোলারবাগে পরিবার নিয়ে থাকতেন। গত ২৯ জানুয়ারি দুপুরে উত্তর টোলারবাগের ১৯/সি-২ নম্বর ভবনে গিয়ে এর সত্যতা মেলে। ভবনের ব্যবস্থাপক আতাউর রহমান জানান, একই হোল্ডিংয়ে পাশাপাশি দুটি ছয়তলা ভবন। প্রথম ভবনের ৩/এ ফ্ল্যাটের মালিক মাহবুবুর রহমান। ফ্ল্যাটের আয়তন আনুমানিক ১২০০ বর্গফুট। ২০১০ সালে ভবন নির্মিত হয়। ওই সময়ই ফ্ল্যাটটি কেনেন মাহাবুব। সেখানেই বসবাস করতেন। তবে প্রায় ১০ বছর আগে ফ্ল্যাটটি ভাড়া দিয়ে পরিবার নিয়ে উত্তরায় চলে যান। বর্তমানে ধানমন্ডি এলাকার ফ্ল্যাটে থাকেন।
সরকারি চালক চালান ব্যক্তিগত গাড়ি
মাহাবুবুর রহমানের একটি প্রাইভেটকার রয়েছে। পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করেন। তবে ব্যক্তিগত চালক রাখেননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট একজন জানান, মাহাবুবুর রহমানের সরকারি গাড়ির চালক সেলিমকে দিয়ে ওই গাড়ি চালানো হয়। মাহাবুবুর রহমান সরকারি গাড়িতে সকালে অফিসে আসেন, ছুটি হয় বিকেলে। এই সময়ের মধ্যে পরিবারের সদস্যদের কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হলে তিনি চালক সেলিমকে ধানমন্ডির বাসায় পাঠিয়ে দেন প্রাইভেটকার ড্রাইভিং করার জন্য।
জানতে চাইলে মাহাবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ‘আমার যা সম্পদ রয়েছে সব আয়কর ফাইলে ওঠানো আছে।’ এই সম্পদ কি চাকরির টাকায় করেছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘ব্যাংক ঋণ নিয়ে ঢাকা উদ্যানের বাড়ি করেছি। এখন ভাড়া থেকে ঋণ শোধ করছি।’
মাহাবুবের সম্পদের বিবরণ শোনার পর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড.
তিনি বলেন, যোগসাজশমূলক দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতা ব্যবহার করে সম্পদ গড়েছেন। তাঁকে অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি যাদের যোগসাজশে, সুরক্ষায় এই সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদেরও একইভাবে সম্পদের হিসাব নিয়ে যথাযথ প্রক্রিয়া সাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনতে হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ব আরট ম হ ব ব র রহম ন র গ প লগঞ জ ব আরট এ পর য য় পর ব র করত ন ভবন র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
২০২৬ সালের বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঘোষণা
গাজীপুরের টঙ্গীতে ৫৮তম বিশ্ব ইজতেমার প্রথম পর্বের সমাপ্তি হয়েছে। বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টা ২৭ মিনিটে প্রথম পর্বের দ্বিতীয় ধাপের আখেরি মোনাজাত শেষ হয়। আখেরি মোনাজাতের পরপরই ইজতেমার বয়ান মঞ্চ থেকে ২০২৬ সালের দুই ধাপের বিশ্ব ইজতেমার তারিখ ঘোষণা করা হয়।
ঘোষণা মতে, ২০২৬ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ৪ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম ধাপ এবং ৯ জানুয়ারি থেকে ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপের বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে।
বুধবার বেলা ১২টা ২৭ মিনিট মোনাজাত শেষে মওলানা যোবায়ের সাহেব এ ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, “শুরায়ি নেজামের অধীনে ওলামায়ে কেরামে তত্ত্বাবধানে ২০২৬ সালের টঙ্গী বিশ্ব ইজতেমা দুই ধাপে অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপের ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে ২, ৩ ও ৪ জানুয়ারি। ৪ দিন বিরতি দিয়ে দ্বিতীয় ধাপ অনুষ্ঠিত হবে ৯, ১০ ও ১১ জানুয়ারি।”
এদিকে দ্বিতীয় ধাপে ১৯ মিনিটব্যাপী চলা মোনাজাতে বিশ্ব মুসলিম উম্মাহর শান্তি, সমৃদ্ধি ও কল্যাণ কামনা করা হয়। এ সময় লাখো মুসল্লির আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন ধ্বনিতে তুরাগতীর মুখরিত হয়ে ওঠে। মোনাজাত শেষে বাড়ির পথে রওয়ানা দিয়েছেন মুসল্লি ও সাধারণ মানুষ।
এর আগে, বাদ ফজর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ভাই ফারুক সাহেব। এরপর হেদায়েতি বয়ান করেন ভারতের মাওলানা আব্দুর রহমান। এ সময় যারা চিল্লার জন্য বের হবেন, তারা জামাতে গিয়ে কী আমল করবেন এবং মহল্লায় যারা এখান থেকে ফিরে যাচ্ছেন তারা নিজ এলাকায় গিয়ে কী আমল করবেন তার দিকনির্দেশনামূলক বয়ান করা হয়।
এদিকে, আখেরি মোনাজাত শেষে সাধারণ মানুষের নির্বিঘ্নে বাড়ি ফেরা ও সফরে বের হওয়া মুসুল্লিদের নিরাপদ যাত্রা নিশ্চিতে টঙ্গী স্টেশনে ১১টি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৩০ জানুয়ারি বাদ মাগরিব টঙ্গীর তুরাগ নদের তীরে ভারতের মাওলানা ইব্রাহিম দেওলার আম বয়ানের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ইজতেমার ৫৮তম জমায়েত শুরু হয়। এবার ইজতেমার প্রথম পর্ব হয়েছে দুই ধাপে। এর মধ্যে, ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত হয় প্রথম ধাপের ইজতেমা। এ ধাপে অংশগ্রহণ করেন ৪১ জেলা ও ঢাকার একাংশের মানুষ। এরপর ৩ থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি হয় দ্বিতীয় ধাপের ইজতেমা। এই ধাপে অংশগ্রহণ করেন ২২ জেলা ও ঢাকার বাকি অংশের মানুষ। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমা হবে ১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
ঢাকা/রেজাউল/ইমন