বাংলাদেশ ব্যাংকের মহানিরাপত্তা এলাকার কয়েন ভল্টে অর্থ-সম্পদ জমা রাখার ব্যক্তিগত সব লকার ফ্রিজ করা হয়েছে। ওই সব বিশেষ লকারে গোপনে অপ্রদর্শিত বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ জমা রয়েছে বলে মনে করছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এ লকারগুলো। তারা ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়ম, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত সম্পদ লকারে রেখেছেন, যা দুদক আইন পরিপন্থি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোনোভাবেই যাতে লকার থেকে অর্থ-সম্পদ সরিয়ে নিতে না পারেন, সে জন্য সব লকার ফ্রিজ করার অনুরোধ জানিয়ে গত রোববার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন দুদক পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামান।
ওই চিঠিতে বলা হয়, গত ৩০ জানুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান ড.
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গভর্নরকে দেওয়া দুদকের চিঠি ও অর্থ উপদেষ্টার সম্মতি থাকায় ভল্টের সব লকারের সম্পদ ফ্রিজ করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে এর মালিকরা তাদের লকার থেকে কোনো ধরনের অর্থ-সম্পদ সরিয়ে নিতে পারবেন না।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই সব লকার খোলা ও লকারে থাকা অর্থ-সম্পদের তালিকা তৈরির অনুমতির জন্য গতকাল সোমবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ ও সিনিয়র স্পেশাল জজের কাছে আবেদন জমা দিয়েছে দুদক। বিকেলে আবেদনটি জমা দেওয়ায় গতকালই এ-সংক্রান্ত আদেশ দেওয়া সম্ভব হয়নি। আজ মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত আদেশ দেওয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আদালতের আদেশ পাওয়ার পর ওই সব লকার খোলা, অর্থ-সম্পদ গণনা ও তালিকা তৈরির জন্য একজন ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত করার জন্য দু-এক দিনের মধ্যে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন জমা দেবে দুদক।
জানা গেছে, দুদক পরিচালক কাজী সায়েমুজ্জামানের নেতৃত্বে একটি বিশেষ অনুসন্ধান দল বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওই সব বিশেষ লকারের সম্পদ অনুসন্ধান করছে। ওই দল গত ২৫ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরীর (এস কে সুর) ঢাকার বাসায় অভিযান চালিয়ে আলমারির নিচে বিশেষ কায়দায় রাখা নগদ ১৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা উদ্ধার করে। ওই অভিযান থেকেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকে থাকা লকারগুলোর সন্ধান মেলে। পরে এস কে সুরের লকার খুলে দেশি-বিদেশি মুদ্রা, স্বর্ণালংকারসহ ৪ কোটি ৬৯ লাখ টাকার সম্পদ পাওয়া যায়, যা তাঁর নিয়মিত আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়নি।
দুদকের চিঠিতে আরও বলা হয়, তল্লাশিকালে লকার-সংক্রান্ত রেজিস্টার পরীক্ষা করে দেখা যায় সেখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান ও অবসরপ্রাপ্ত অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীর সিলগালা লকার পাওয়া যায়। ওই সব লকারের ভেতর সিলগালা কোটায় অপ্রদর্শিত সম্পদ থাকার অবকাশ রয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন, অর্থ পাচারসহ বিভিন্ন অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে ভল্টে রক্ষিত কর্মকর্তাদের বিশেষ লকার খুলে রক্ষিত মালামাল যাতে কেউ নিতে না পারে, তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
প্রাণ দিয়ে সহযোদ্ধাদের বাঁচান শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের
পশ্চিম পাকিস্তানের হায়দ্রাবাদের কর্মস্থল থেকে ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ ছুটিতে ঢাকার বাড়িতে আসেন ৪০ ফিল্ড আর্টলারি রেজিমেন্টের টগবগে তরুণ সেনা অফিসার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। ১৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম এসে খালাতো বোন মোর্শেদা জুলিয়াকে কোর্ট ম্যারেজ করে আবার ফিরে যান ঢাকায়। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনারা নিরস্ত্র বাঙালিদের হত্যার নৃশংস ঘটনায় তরুণ এ সেনা কর্মকর্তার মনে জ্বলে ওঠে ঘৃণা আর প্রতিশোধের আগুন। ২৭ মার্চ ঢাকা থেকে চলে যান চট্টগ্রামে। সেখান থেকে ২ এপ্রিল পার্বত্য চট্টগ্রামের ভারত সীমান্তবর্তী মহকুমা শহর রামগড়ে আসেন।
তেজোদীপ্ত বাংলার বীর সেনানী ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে রামগড় হাই স্কুল মাঠে চলতে থাকে যুব প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। রামগড়ের একমাত্র সেনা অফিসার কাদের স্থানীয় ইপিআরের সুবেদার মফিজুল বারী, হাবিলদার আবুল কাশেমসহ কয়েকজন ইনস্ট্রাক্টর এবং স্বল্পসংখ্যক অস্ত্র নিয়ে পরিচালনা করেন গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ। এর মধ্যে মেজর জিয়াউর রহমানও এসে পৌঁছেন রামগড়ে। তিনি এসে চালু করেন মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
রামগড় আসার পর ক্যাপ্টেন কাদের সর্বপ্রথম অপারেশন পরিচালনা করেন ফেনীর শুভপুর এলাকায়। রণকৌশলের আবশ্যকীয়তায় তিনি পরিকল্পনা নিয়ে ইপিআরের হাবিলদার কাশেমের প্লাটুনসহ মীরেরসরাইর জোরারগঞ্জে স্থাপন করেন প্রতিরক্ষা ঘাঁটি। রাঙামাটি শহরে পাকবাহিনীর বড় সমাবেশের খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন কাদের তাঁর গ্রুপ নিয়ে বন্দুক ভাঙ্গা নামক এক দ্বীপের মতো স্থানে অবস্থান নেন। এখানে ২১ এপ্রিল দুই লঞ্চ বোঝাই পাক সেনাদল হঠাৎ আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বে যুদ্ধ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছাত্র শওকত ও অন্য সদস্যরা শত্রুদের ওপর বৃষ্টির মতো গুলি চালায়। ঘণ্টাব্যাপী চলা এ প্রচণ্ড যুদ্ধে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকজন হতাহত হওয়ার পর তারা পিছু হটে। বন্দুক ভাঙ্গায় দুই দিন অবস্থানের পর মেজর শওকতের নির্দেশ পেয়ে ২৪ এপ্রিল তিনি গ্রুপ নিয়ে রওনা হন মহালছড়ির উদ্দেশে। মহালছড়ি যাওয়ার পথে বুড়িঘাট এলাকায় শত্রুপক্ষের অতর্কিত আক্রমণের শিকার হন ক্যাপ্টেন কাদের এবং তাঁর দুই সহযোদ্ধা হাবিলদার সায়ীদ ও হাবিলদার তাহের। এই তিনজন তিনটি এলএমজি নিয়ে প্রবল আক্রমণ চালান পাকস্তানি বাহিনীর ওপর। এখানেও শত্রুরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে যায়। এভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক প্রচণ্ড হামলার মুখে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে স্থল আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বিমান ও হেলিকপ্টারের সাহায্যে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য অবস্থান ও ঘাঁটির ওপর প্রবল হামলা।
এ অবস্থায় পার্বত্য এলাকায় পূর্ব ট্রেনিংহীন মুক্তিযোদ্ধারা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়েন। রসদ এবং গোলাবারুদ সংকট দেখা দেয় তাদের। এই প্রতিকূল ও দুর্বল মুহূর্তে ২৭ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে পাকবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য (১৩৬ জন) এবং একটি মিজো ব্যাটালিয়নকে (১০০০ জন) সঙ্গে নিয়ে আক্রমণ চালায় মহালছড়িতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। মেজর মীর শওকত এবং চন্দ্রঘোনা পেপার মিলের প্রকৌশলী ইসহাকের নেতৃত্বে ওই সময় আক্রমণ প্রতিহত করা হচ্ছিল। এর মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের আরও এক কোম্পানি সৈন্য এখানে নামিয়ে দিয়ে যায়। দুই পক্ষের প্রচণ্ড এ যুদ্ধের মধ্যে বেলা ৩টায় ক্যাপ্টেন কাদেরের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটি মহালছড়ি এসে পৌঁছে। অসীম সাহস আর সুদক্ষ যুদ্ধ কৌশল গ্রহণ করে তরুণ সেনা অফিসার কাদের সঙ্গীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন শত্রু মোকাবিলায়। তাদের এ সম্মিলিত কঠিন প্রতিরোধের মুখে মিজো বাহিনী প্রথম অবস্থায় পিছু হটলেও এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনা এবং তাদের সহযোগী মিজো ও চাকমা মুজাহিদরা মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য করে বেপরোয়া গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে যায়। ৩-৪ গুণ অধিক সংখ্যক শত্রুপক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রায় চারপাশ ঘিরে ফেলে। চরম এ বিপজ্জনক অবস্থায় সহযোদ্ধারা পশ্চাৎপসরণের পরামর্শ দেন ক্যাপ্টেন কাদেরকে। কিন্তু অকুতোভয় সহযোদ্ধা ছাত্র শওকত, ফারুক এবং দুই ইপিআর সৈনিককে সঙ্গে নিয়ে তিনটি এলএমজির অবিরাম গুলিবৃষ্টি কোণঠাসা করে ফেলে শত্রুদের। এই চরম মুহূর্তে হঠাৎ শত্রুর অস্ত্রের কয়েকটি গুলি এসে বিঁধে তাঁর ডান বগলের কয়েক ইঞ্চি নিচে এবং পেটের বাম পাশে। গুলিবৃষ্টির মধ্যেই গুরুতর আহত কাদেরকে বহন করে একটু নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসেন শওকত, ফারুক ও ইপিআরের ড্রাইভার আব্বাস।
সেখান থেকে জিপ গাড়িতে রামগড়ে আসার পথে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন এ তরুণ বীরযোদ্ধা। তখনও তাঁর বিয়ের মেহেদির রং হাত থেকে মুছে যায়নি। ওইদিন শেষ বিকেলে সহযোদ্ধা ফারুক, শওকত ও আব্বাস বীর শহীদের মরদেহ নিয়ে আসেন রামগড়ে। পরে রামগড় কেন্দ্রীয় কবরস্থানে পূর্ণ সামরিক ও ধর্মীয় মর্যাদায় তাঁকে দাফন করা হয়।
ক্যাপ্টেন কাদেরের দুঃসাহসিক অবস্থান ও ভূমিকার কারণে মেজর শওকতের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীর কমপক্ষে ৫০০ সদস্য নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ওইদিন রক্ষা পেয়েছিল। ওই ভয়াবহ যুদ্ধে মিজো ব্যাটালিয়নের ৪০০ সৈন্য এবং পাকবাহিনীর কমান্ডো কোম্পানির ৪০ জনের মতো সৈনিক হতাহত হয়। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ ও গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালে সরকার ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরকে মরণোত্তর ‘বীরউত্তম’ উপাধিতে ভূষিত করে।
লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জের টিওরী গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও সাহিত্যিক ড. এম আব্দুল কাদের এবং রওশন আরা বেগমের আট পুত্রের মধ্যে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদেরসহ পাঁচজনই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। তাদের মধ্যে রেজাউল কাদের, সিরাজুল কাদের ও এমদাদুল কাদের যুদ্ধ শেষে মায়ের কোলে ফিরে এলেও শহীদ হন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ও ঢাকা ডেন্টাল কলেজের ছাত্র আহসানুল কাদের মামুন। তবে শহীদ আহসানুল কাদেরের সমাধি আজও খুঁজে পাননি বলে জানান তাঁর ভাই অবসরপ্রাপ্ত সচিব ও রাষ্ট্রদূত ড. আফসারুল কাদের এবং অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের।
নিজাম উদ্দিন লাভলু: সাংবাদিক