আড়াই মাসের ব্যবধানে আবারও রাজপথে নেমেছেন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহতরা। সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে শনিবার আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে দ্বিতীয় দফায় আন্দোলন শুরু করেন তারা। রোববার মধ্যরাতে তারা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন। পত্রিকার খবর, ‘দায়িত্বরত সেনাসদস্যরা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনিও তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন (সমকাল, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।

এর আগে ১৩ নভেম্বর আহত ব্যক্তিদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। সবার সঙ্গে দেখা করেননি– এ অভিযোগে তাঁর গাড়ি আটকে আহত ব্যক্তিরা বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেন। সেদিন গভীর রাতে সরকারের চার উপদেষ্টা ও একজন বিশেষ সহকারী সেখানে গিয়ে আহতদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের হাসপাতালে ফিরিয়ে নেন। পরদিন সচিবালয়ে এক বৈঠকে আহতদের সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের আশ্বাস দেয় সরকার। সেই ঘটনার আড়াই মাস পর আবারও মধ্যরাতে আহত ব্যক্তিদের বিক্ষোভ। অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে দাবি জানিয়েছেন, ৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সরকার বৈঠক না করলে তারা রাজপথে অবস্থান ও অনশন কর্মসূচি দেবেন। শহীদ পরিবারগুলোর কোনো খোঁজ সরকার নিচ্ছে না বলেই তারা আন্দোলনের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। 

বলা যায়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও আহত ব্যক্তিরা সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ। কেন হচ্ছে এই ঘটনা? যে মানুষগুলোর অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে জাতির কাঁধ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হলো দমবন্ধ করা স্বৈরাচারী শাসন; যাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে স্বয়ং অন্তর্বর্তী সরকার; সেইসব হতাহতের প্রতি দায়িত্ব পালনে সরকার কেন ব্যর্থ হচ্ছে?
যমুনার সামনে বিক্ষোভরত আহত ব্যক্তিদের শান্ত করতে গিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘আহতদের সুচিকিৎসা দিতে পারে নাই, এটা সরকারের ব্যর্থতা। এ জন্য সরকারের আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি দায়ী, সচিবরা দায়ী, আমলারা দায়ী। যারা আহত হয়েছেন, তাদের আমরা সুচিকিৎসা দিতে পারি নাই, এ জন্য আমি নিজে ব্যথিত’ (সমকাল, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
মধ্যরাতে হাসনাত যখন এ কথা বলছেন, রোববারই দিনের বেলা অবশ্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা এ পর্যন্ত ৩০ জনকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছেন। আহতদের চিকিৎসায় বিদেশি চিকিৎসকও আনা হয়েছে। বিদেশে চিকিৎসায় এ পর্যন্ত ১৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আরও খরচ হবে।

১৬ কোটি টাকা! গণঅভ্যুত্থানে প্রায় ৩০ হাজার গুরুতর আহতের চিকিৎসায় এই টাকার হিসাব জানানো চোখে লাগে– মাননীয় উপদেষ্টা। তা-ও ঘটনার ছয় মাস পর। এ পর্যন্ত অনেক কথা আমরা শুনেছি। জুলাই ফাউন্ডেশন, শতকোটি টাকার ফান্ড গঠিত হচ্ছে মর্মে সংবাদও জেনেছি; কিন্তু প্রকৃত তহবিলের অবস্থা আমরা জানতে পারি না। মাঝখান দিয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম পদত্যাগ করে জানিয়েছেন, অন্যত্র ব্যস্ত থাকায় এই দায়িত্ব পালন সম্ভব হচ্ছে না। 
শহীদ পরিবারের সদস্যদের আর্থিক বিপর্যস্ততার বিবরণ আমরা জেনেছি পত্রিকার পাতা থেকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রেখে পিতার অকালপ্রয়াণ, স্ত্রী পথে বসেছেন; তাদের দেখবার কেউ নেই। তারা প্রেস ক্লাবে কেঁদে কেঁদে সাহায্য চাইছেন, গণতন্ত্র অভিমুখী দেশের কাছে এই তাদের প্রাপ্য? হায়! 

২.


না, ঘটনাটিকে সরলভাবে দেখবার কোনো উপায় নেই। সরকারকে নানা পক্ষ থেকে উপর্যুপরি আন্দোলনের চাপে রাখা হচ্ছে, এটি সত্য। এ-ও সত্য, যে ভঙ্গুর অর্থনীতি সরকারের কাঁধে রেখে আওয়ামী লীগ দেশ ছেড়েছে, তার সমাধান সত্যিই কঠিন। রয়েছে গণতন্ত্রের জন্য বহু প্রত্যাশা ও চাপ। সরকার ১১টি কমিটি তৈরি করে সংস্কার কর্মসূচির কাজ পরিচালনা করছে। দেশের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা শোচনীয়।
এসবই বাস্তবতা। সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু গত পনের বছরের দুঃশাসন ও হিংস্রতার অবসান করলেন যারা, তারা কেন অগ্রাধিকার পেলেন না– এটা প্রশ্ন ও উদ্বেগ অবশ্যই তৈরি করে। আমরা বুঝতে পারি, সরকারের কাজে পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলার অভাব রয়েছে। সকল শহীদ ও আহত ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ডেটাও এখন পর্যন্ত সরকার তৈরি করতে পারেনি। এটি অমার্জনীয় ব্যর্থতা। জানা যায়, গণঅভ্যুত্থানে ১৫৫৮ জন শহীদ ও ৩০ হাজার আহত ব্যক্তি– সরকারের পক্ষে এর পুরো তালিকা তৈরি খুব কঠিন কাজ? আহত ব্যক্তিরা কে কোথায় চিকিৎসাধীন, কার পুনর্বাসনে কত লাগবে– এটি যেমন সহজেই বের করা সম্ভব; একইভাবে সম্ভব শহীদ পরিবারের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু। পারিবারিক রেশন, সঞ্চয়পত্র সুবিধা, প্রয়োজনে চাকরির ব্যবস্থা; সরকারের একটি সেল– সব মিলিয়ে ৫০ হাজারের মতো মানুষের জন্য শৃঙ্খলা মেনে ব্যবস্থা করতে পারছে না। এটা বিস্ময়কর। একই সঙ্গে দুঃখদায়ী ও উদ্বেগজনক।

৩.
এই নিষ্ক্রিয়-নির্লিপ্ততা ও ব্যর্থতায় বোঝা যায়, সরকার তার কাজে অগ্রাধিকার সাব্যস্ত করতে পারছে না। কোনো কোনো উপদেষ্টা ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে দেশের বিগত সরকারের মন্ত্রীদের মতো প্রচুর কথা বলছেন। কাজের পরিধি অপরিসীম করতে নেই। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক না করতে পারলে অভীষ্টে পৌঁছানো কঠিন। 

অবশ্যই দেশের গণতন্ত্র সংহত ও অবারিত করতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু তা বাস্তবসম্মত ও যথোপযুক্ত হতে হবে। ৩০০ আসনের সংসদকে ৫০০ আসনে পুনর্বিন্যস্ত করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করবার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। দেশের পর্যুদস্ত অর্থনীতিতে আরও ২০০ এমপির বিলাসী জীবনের ব্যয়ভার নিরীহ জনগণের কাঁধেই চাপবে। এই উচ্চাভিলাষ আপাতত স্থগিত রেখে প্রচলিত নির্বাচনী কাঠামোয় কোন প্রক্রিয়ায় যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিতে পারেন, তার বিহিত জরুরি। নির্বাচন মানেই টাকার খেলা– এটি যে কোনো মূল্যে বন্ধ রেখে, যারা এ কাজ করবে তাদের জন্য যথাযথ কঠিন শাস্তির আইন প্রয়োগ করে, সকলের জন্য নির্বাচনকে অবারিত করতে হবে। দেশকে চার প্রদেশে বিভক্ত করে ক্ষমতার যে বিকেন্দ্রীকরণের চিন্তা করা হচ্ছে, সেটিও একই রকম উচ্চাভিলাষ ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণই হবে। যে বিভাগগুলো করা হয়েছে, তা কতটা কার্যকর হয়েছে, সেদিকে তাকালেই বোঝা যায়; আমলারা খরচ বাড়ানোর জন্য নিত্য রাস্তা বের করেন!

গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রত্যাশিত সহায়তা পাচ্ছেন না বলে অনেকে বলছেন। সরকারকে আমলা-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে দ্রুত পদেক্ষপ নিতে হবে। নতুন সময় ও নতুন বাস্তবতাকে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে। সরকারের গন্তব্যও সুনির্দিষ্ট করতে হবে। যতটুকু সময় সামনে আছে, তার পুরো সদ্ব্যবহার করে দেশের গণতান্ত্রিক ও আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এই মস্ত আয়োজনের মূল যে যোদ্ধা– গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের স্থায়ী ব্যবস্থা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। গণঅভ্যুত্থানের রক্তাক্ত স্মৃতির প্রতি জাতীয় কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে দ্রুত এটি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। মধ্যরাতে আহতদের বিক্ষোভে উত্তপ্ত রাজপথ ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন– গণঅভ্যুত্থানের মাত্র ছয় মাসের মাথায় এই ঘটনা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
 
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: গণঅভ য ত থ ন গণঅভ য ত থ ন ব যবস থ উপদ ষ ট সরক র র আহতদ র র জন য ত করত ও আহত অবস থ

এছাড়াও পড়ুন:

সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির পথরেখা

বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রদের মধ্য থেকেই দাবি করা হয়েছিল, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করা হোক। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পরও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে ছাত্রদের মধ্য থেকেই। এর বহু আগে থেকেও ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করা হয়েছিল। তবে সমগ্র ছাত্রসমাজ দলমত নির্বিশেষে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করেছে, তা বলা যাবে না। ছাত্রদের মধ্যে সহিংস ঘটনা বা লেজুড়বৃত্তি রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বা অনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন চরম আকারে পরিলক্ষিত হয় কিংবা সাধারণ জনমনে একশ্রেণি ছাত্রের প্রতি চরম ঘৃণার উদ্রেক হয়, তখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিও সামনে চলে আসে। এটি সত্য, শাসকগোষ্ঠীর অনুসৃত বা অঙ্গসংগঠন বা সহযোগী ছাত্র সংগঠনের অপকীর্তির কারণেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি এসেছে বারবার। 

ছাত্র রাজনীতির একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। উনিশ শতকের সত্তর দশকের গোড়ার দিকে এ ভূখণ্ডে ছাত্র রাজনীতি সংগঠিত হতে শুরু করে। ভারতীয়দের মধ্যে সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের স্বার্থে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় নিখিল বঙ্গ ছাত্র সমিতি। এর আগেও পাশ্চাত্য শিক্ষায় প্রচলিত ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে ইয়ং বেঙ্গলের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলন ইতিহাসে সাক্ষী হয়ে আছে। ১৯৩২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শহীদুল্লাহর নেতৃত্ব গড়ে তোলা হয় নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি। তবে বিশ শতকের প্রথম দিকেই ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন ও অসহযোগ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতির প্রাসঙ্গিকতা বাড়তে থাকে। ছাত্র রাজনীতি শুধু শিক্ষা সংক্রান্ত দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। ইতিহাসের সেই গড়ে ওঠা ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র রাজনীতির ধারাবাহিকতাই আজকের স্বৈরাচারবিরোধী ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান।

আমাদের ছাত্র রাজনীতি কলুষিত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতির মধ্যে শিক্ষাগত মান কমেছে। কমেছে নিষ্ঠা, মানবিকতা ও আদর্শবাদিতা। ভীষণভাবে কমেছে আদর্শবাদিতার অব্যাহত চর্চা। স্বার্থবাদিতা ও সুবিধাবাদিতা বিশালভাবে আশ্রয় নিয়েছে ছাত্র রাজনীতির মধ্যে। ছাত্র রাজনীতিকে খুবরে খুবরে খাচ্ছে দিন দিন। গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা প্রায় উঠেই যাচ্ছে। বেড়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, স্বার্থবাদিতা, টেন্ডারবাজি, হিংসাপরায়ণতা ও সহিংসতা। স্বাধীনতার পর থেকেই ছাত্র রাজনীতির এসব নেতিবাচক দিক ক্রমবিকশিত হলেও বেশ কয়েক বছর হলো চরম আকার ধারণ করেছে। অনেক ক্ষেত্রে শাসকগোষ্ঠীগুলোর প্রচ্ছন্ন ছত্রছায়ায়ই ঘটেছে এসব অপকীর্তি। জনগণের অনাস্থা গ্রথিত হতে হতে ক্রমশ ঘনীভূত হয়েছে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে সে কারণেই। এ দাবিও নতুন নয়। বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি উঠেছে। রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থায় বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেও অনেকে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করে আসছেন। বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়ার অশুভ শক্তি ঘোলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মাঝে মধ্যেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি নিয়ে সামনে আসে। সাদা চোখে দেখলে এ দাবি মোটেই অমূলক নয়। তবে বিষয়টিকে বিশ্লেষণাত্বক দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখা প্রয়োজন। 


ছাত্র রাজনীতি মানে হচ্ছে, ছাত্রদের স্বার্থ নিয়ে কথা বলা। ছাত্ররা শিক্ষা গ্রহণ করবে, মেধা চর্চা করবে, মেধার বিকাশ ঘটাবে, গবেষণায় মনোনিবেশ করবে, মুক্তভাবে কথা বলবে, শিক্ষাসংক্রান্ত ন্যায়সংগত দাবি তুলবে, অধিকারের কথা বলবে, সামাজিক ন্যায়বিচারের কথা বলবে, সুশাসনের কথা বলবে, সমাজ প্রগতির পক্ষে সাংস্কৃতিক চর্চা করবে, প্রচার করবে, পরমতসহিষ্ণু হবে, ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারী সম্পর্ক স্থাপিত হবে, সংগঠিত হবে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করবে, নেতৃত্বের বিকাশ ঘটাবে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক চর্চা ও সংগঠিত করা ছাত্রদের দায়িত্বের বাইরে রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে লেজুড়বৃত্তি ও ছাত্র রাজনীতি এক বিষয় নয়। লেজুড়বৃত্তি ও অন্যান্য নেতিবাচক বিষয় ছাত্র রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়িত করে, কলুষিত করে। এগুলো বন্ধ করতে হবে। শাসকগোষ্ঠীর ইচ্ছার ওপরেই নির্ভর করছে ছাত্র রাজনীতিকে কলুষমুক্ত করা। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিবাচক ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য। লেজুড়বৃত্তি পরিহার করে ছাত্রদের সংগঠিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। 


অন্যদিকে আইন করে এ রকম ছাত্র রাজনীতি বন্ধ থাকলে কালক্রমে মেধাচর্চা বা মেধার বিকাশও রুদ্ধ হতে পারে। মেধার পরিসীমাও সীমাবদ্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। ছাত্ররা পাঠ্যক্রমের আওতার মধ্যেই হাবুডুবু খাবে। মেধাশূন্য হয়ে যেতে পারে জাতি। জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে যেতে পারে কালক্রমে। মনে রাখতে হবে ছাত্রনেতৃত্বের মধ্য থেকেই সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বেরিয়ে আসে। গ্রাম-শহরে সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নে ছাত্রনেতৃত্বের অপরিসীম ভূমিকাকে আমরা অবমূল্যায়ন করতে পারি না। আমরা সবাই জানি, ১৯৫২, ১৯৬২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০ ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে রাজনৈতিক ছাত্রনেতৃত্বের ভূমিকাই ছিল অগ্রগণ্য। এই অভ্যুত্থানগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সামান্য ইতিহাসটুকু আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও সংস্কৃতি বিনির্মাণে ছাত্র রাজনীতির বিরাজমান ঐতিহাসিক ভূমিকা। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির চর্চার মধ্য দিয়েই তা সম্ভব হয়েছে। শাসকগোষ্ঠীর হীন শ্যেনদৃষ্টি না পড়লে হয়তো ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবিই উত্থাপিত হতো না। 


সে জন্য সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সেই ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্ব সবার। সব বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের। সমাজের সব প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতিক, সুশীল ব্যক্তি, পেশাজীবী, সাংবাদিক, ছাত্রনেতৃত্বসহ সবার ঐকমত্যের ভিত্তিতে সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির জন্য গ্রহণযোগ্য বিধিমালা ও প্রয়োগবিধি প্রণয়ন করতে হবে। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির স্বার্থে ব্যাপক মানুষের মধ্যে প্রণীত বিধিমালা ব্যাপক প্রচার করতে হবে। ছাত্র ও জনগণের মধ্যে সুস্থ মনোভাব প্রস্তুত করতে হবে। জনগণের মধ্যেও সুস্থ মনোভাব প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে ছাত্র রাজনীতির হারানো ঐতিহ্য ও গৌরব ফিরিয়ে আনা সবারই কর্তব্য। সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠার পক্ষে এ দেশেই সংগ্রাম চলছে অব্যাহতভাবে। সংগ্রামের ধারা আরও বিকশিত হোক। আমরা সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতি চাই। 


সিরাজুমমুনীর: জাতীয় পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গণঅভ্যুত্থান কখনোই আইন মেনে চলে না, বরং আইন ভাঙার মাধ্যমেই শুরু হয়: ফরহাদ মজহার
  • ‘সংবিধান’ নামে শেখ হাসিনার ভূত এখনো রয়ে গেছে: ফরহাদ মজহার 
  • সিদ্ধিরগঞ্জে বাস চাপায় অটোরিকশা উল্টে আহত ৬
  • সিদ্ধিরগঞ্জে বাস চাপায় অটোরিকশা উলটে আহত ৬
  • সংস্কৃতির শাক দিয়ে উগ্রবাদের মাছ ঢাকা যায় না
  • রূপগঞ্জে ইসরায়েলি পণ্য বয়কটের ডাক গ্রীণ ইউনিভার্সিটির
  • সুস্থ ধারার ছাত্র রাজনীতির পথরেখা