ঢাকা কলেজ দুই শতাব্দীর ঐতিহ্য বিসর্জন দেবে কেন?
Published: 3rd, February 2025 GMT
অবশেষে ঢাকা কলেজসহ সাত কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হলেও বিতর্ক যেন ‘শেষ হয়েও হইল না শেষ’। সরকার সাত কলেজের ব্যাপারে যে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেছে, তারা একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে। ইতোমধ্যে ‘জুলাই ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের কথাও সংবাদ মাধ্যমে এসেছে। অন্যদিকে সাত কলেজের অন্যতম তিতুমীর নিজেই বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার ব্যাপারে আন্দোলন করছে। প্রশ্ন হলো, ঢাকা কলেজের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানকেও নবীন ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ হতে হবে কেন?
ঢাকা কলেজ নানা দিক থেকেই স্বতন্ত্র। এটাকে বলা হয় ‘উপমহাদেশের প্রথম আধুনিক কলেজ’। ১৮৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা কলেজ ১৮৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও ‘সিনিয়র’। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়ও ঢাকা কলেজের ছিল অবিস্মরণীয় অবদান। ঢাকা কলেজের ভূমি, ক্যাম্পাস, হোস্টেল, অবকাঠামো, বইপত্র না পেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাও সহজ হতো না। দুই শতাব্দীর ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অন্যের ক্রোড়ে না বসে ‘ঢাকা কলেজ’ হিসেবে মাথা উঁচু করে থাকাই তো গৌরবময়!
ঢাকা কলেজকে ২০১৭ সালে যেভাবে তাড়াহুড়ো করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছিল, সেটা কতটা সংগত ছিল– সেই প্রশ্ন দেরিতে হলেও তোলা যায়। প্রশ্নটা শুধু ঐতিহ্যের নয়, একই সঙ্গে ব্যবহারিকও। এটা ঠিক, ঢাকা কলেজসহ অধিভুক্ত সাত কলেজ আগে জাতীয় বিশ্ববিদালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে যাওয়ার পর কলেজগুলোতে সময় অনুযায়ী পরীক্ষা না হওয়া, ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা, শিক্ষক সংকট, গবেষণাগার ও অবকাঠামোগত সমস্যা ইত্যাদি সংকট দেখা যায়।
এসব সংকট নিরসনের দাবিতে কয়েক বছর ধরেই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিল। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা তাদের জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় গঠনের দাবি উপস্থাপন করলে অন্তর্বর্তী সরকার সেই লক্ষ্যে কমিটি গঠন করে। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর বলতে গেলে এই কমিটিই কলেজগুলোর অভিভাবক।
ঢাকা কলেজসহ সাত কলেজ যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে গেছে, সে জন্য বিকল্প দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে– প্রথমত, স্বতন্ত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় করা, যার অধীনে থাকবে সাতটি কলেজ। দ্বিতীয়টি হলো, প্রতিটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা। কিন্তু ঢাকা কলেজের মতো ঐতিহ্যবাহী কলেজগুলো তার ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা রক্ষা করতে পারে আরেকটি বিকল্পের মাধ্যমে।
ভারতের ‘ডিমড ইউনিভার্সিটির’ কথা আমরা জানি। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে ৭ নভেম্বর ‘দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যার শিরোনাম ‘স্বতন্ত্র পরিচয়ে’ সাত কলেজ, নাকি বিশ্ববিদ্যালয় হবে? ‘ডিমড ইউনিভার্সিটি’ বলা যায় একটি স্ট্যাটাসের নাম। সেগুলো পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয় নয়। যেমন– ঢাকা কলেজের নাম ঢাকা কলেজই থাকবে; কিন্তু সেটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অনুমোদিত ‘ডিমড ইউনিভার্সিটি’র অধিভুক্ত হবে। অর্থাৎ এটি হবে স্বতন্ত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেটি ইউজিসি সরাসরি পরিচালনা করবে। কলেজগুলোর স্বায়ত্তশাসন তাদের মানসম্মত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পারে। তবে কলেজগুলোকে সেভাবে তদারকি করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যেমনি স্বায়ত্তশাসন দেবে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের মানসম্মত পড়াশোনা নিশ্চিত করতে নিয়মিত মনিটর ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করবে। কারণ ভারতেও মানহীনতার কারণে উল্লেখযোগ্য ‘ডিমড ইউনিভার্সিটি’ বন্ধের দাবি উঠেছে।
‘ডিমড ইউনিভার্সিটি’ হলে ঢাকা কলেজ নিজ নামেই থাকবে। কিন্তু সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে পরিচালিত হবে, যেখানে শিক্ষা ও গবেষণার মান গুরুত্ব পাবে। তার মানে, কলেজগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই সব কর্মকাণ্ড পরিচালিত হবে। ইউজিসির নিয়ম অনুসারে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো তাদের ব্যবস্থাপনা হবে। শিক্ষক সংকট নিরসন, আবাসিক সংকট দূরীকরণ, ল্যাব ও অন্যান্য সমস্যা দূর করতে হবে। হঠাৎ এমন বিশ্ববিদ্যালয় হলে, অর্থাৎ কলেজগুলো এভাবে স্বায়ত্তশাসিত হলে আপাতত শিক্ষক সংকট দূরীকরণে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কিংবা পেশাজীবীদের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। বাস্তব ক্ষেত্রের পেশাজীবীরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ পেলে ‘ইন্ডাস্ট্রি একাডেমিয়া কোলাবরেশন’ সহজ হবে। বর্তমান শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরা সেখানে থাকবেন; কিন্তু ইউজিসির নীতিমালার আলোকে তাদের গবেষণামুখী করা অসম্ভব হবে না। যুক্তরাজ্যের রাসেল গ্রুপও বিশ্বখ্যাত। এর অধীনে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোও নিজ নিজ নামে পরিচালিত হয় এবং রাসেল গ্রুপের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিংয়ে শীর্ষ পর্যায়ে থাকে।
এর আগে আমি লিখেছি, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় করার ক্ষেত্রে ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে (সমকাল, ২০ নভেম্বর ২০২৪)। তা ছাড়া বাস্তব কারণেই সব কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা সম্ভব নয়। অথচ এটি কলেজ হিসেবে স্বায়ত্তশাসন পেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই মানসম্মত হয়ে উঠতে পারে। দেশের কোনো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুঃখজনক চিত্র আমরা দেখছি, যেখানে শিক্ষক ও অবকাঠামোগত সংকট বিরাজমান। তার তুলনায় ঐতিহ্যবাহী অনেক কলেজ স্বতন্ত্র পরিচয় পেলে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় আরও ভালো অবদান রাখতে পারে।
এক সময় ঢাকা কলেজের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানগুলো অন্তত উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যে ধরনের ফল করত, তা এখন অদৃশ্য। যে কারণে মেধাবী শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় ভর্তির ক্ষেত্রে এগুলোর অগ্রাধিকার থাকে না। এ কলেজগুলোর ঐতিহ্য স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে ফিরে আসতে পারে। বলা বাহুল্য, গোটা উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে এক ধরনের সংকট বিদ্যমান। বিশেষ করে গত দেড় দশকে উচ্চশিক্ষার অনেক সম্প্রসারণ হয়েছে সত্য; কিন্তু কতটা পরিকল্পিত– তা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন আছে। সম্প্রসারণের অনেক ক্ষেত্রে গুণমানের চেয়ে পরিমাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো যেন পরিণত হয়েছে শিক্ষিত বেকার তৈরির কারখানায়।
ঢাকা কলেজসহ সাত কলেজ নিয়ে যেহেতু নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে, এই সুযোগে মান নিশ্চিতে পুরো উচ্চশিক্ষা নিয়েই ভাবা দরকার। উচ্চশিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিতে নেতৃত্ব দিতে ইউজিসিকে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর যথাযথ তদারকি ও মূল্যায়নে এর কোনো বিকল্প নেই।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স বতন ত র পর চ ল ত স ত কল জ কল জ র ইউজ স সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
পদত্যাগ করতে পারেন বিশেষ সহকারী অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম
পদত্যাগ করতে পারেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা) অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম। সরকারের চাওয়া অনুযায়ী তিনি পদত্যাগ করতে পারেন বলে একটি সূত্রে জানা গেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, আজ সোমবার আমিনুল ইসলাম পদত্যাগ করতে পারেন বলে তাঁরা শুনেছেন।
তবে আজ এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম কিছু বলতে রাজি হননি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। এরপর গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
গত প্রায় সাত মাসে কয়েক দফায় উপদেষ্টা পরিষদে রদবদল ও নতুন নিয়োগ হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টাসহ অন্তর্বর্তী সরকারে এখন উপদেষ্টা ২৩ জন। তাঁদের মধ্যে গত বুধবার অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিয়েছেন। তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন। এত দিন শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এখন কেবল পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করছেন।
এর আগে গত নভেম্বরে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনজনকে বিশেষ সহকারী নিয়োগ দেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। এই তিন বিশেষ সহকারী স্বরাষ্ট্র, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সহযোগিতা করছেন। এই তিনজনের মধ্যে শিক্ষার দায়িত্বে থাকা অধ্যাপক এম আমিনুল ইসলাম পদত্যাগ করতে পারেন।
আরও পড়ুনপ্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিন বিশেষ সহকারী নিয়োগ১০ নভেম্বর ২০২৪