টেলিভিশন সম্প্রচারের সংকট ও সম্ভাবনা
Published: 3rd, February 2025 GMT
যারা বলেন, সামাজিক মাধ্যমের দাপটে প্রচলিত টেলিভিশন মাধ্যম তার আকর্ষণ হারিয়েছে, তারা যে ভুল বলছেন, এমনটা নয়। আবার যারা টেলিভিশন কোনোদিনই তার আকর্ষণ হারাবে না; বড়জোর এর ফর্ম পাল্টাতে পারে বলে মনে করেন, তারাও ভুল বলছেন না। তাহলে সংকটটা কোথায়, আর কীভাবেই বা টেলিভিশন এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আগের শক্তিমত্তায় আবির্ভূত হবে– সে এক প্রশ্ন বটে।
টেলিভিশন ঘরে বসে দেখার মাধ্যম থেকে বের হয়ে এসে এর পোর্টাবিলিটি বা ‘মোবিলিটি’ নিশ্চিত করে সংকটের শুরুটা মোকাবিলা করতে হবে। ভেবে দেখুন, বিশ্বের গতি এবং মানুষের জীবনে ব্যস্ততা বেড়েছে।
এমন অবস্থায় একটি স্থির স্ক্রিনে মানুষ টেলিভিশন দেখবে কেন? এটা অন্যভাবে বলা যায়। যদি ফেসবুক, টুইটার বা ইউটিউব আর যেখানে-সেখানে দেখা যাচ্ছে না এবং সেসব উপভোগ করতে আপনাকে ঘরে যেতে হচ্ছে, তাহলে কি আপনি এখনকার মতো সামাজিক মাধ্যমে বুঁদ হয়ে থাকবেন?
আগামী দিনের বাস্তবতা
দিন যতই গড়াচ্ছে ততই বাড়ছে মানুষের ‘মোবিলিটি’। সঙ্গে বাড়ছে মানুষের প্রত্যাহিক চাহিদা ও বিনোদনের সহজে বহনযোগ্য মাধ্যম বা ‘মোবিলিটি’। ফোনের ‘মোবিলিটি’ বেড়েছে; তার সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহার অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারহীন, ওয়াইফাইযুক্ত।
টেলিভিশনে অ্যান্টেনার যুগ সেই কবে শেষ হয়েছে। সম্প্রতি টেলিভিশন সংযোগও তারহীন বিনোদনে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে ভূমি থেকে ভূমিতে প্রক্ষেপণযোগ্য টেলিভিশন সিগন্যাল তথা টেরিস্ট্রিয়াল বলি, তা প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। এখন টেলিভিশন সিগন্যাল প্রেরণ ও গ্রহণের মাধ্যম হয়ে উঠেছে স্যাটেলাইট। কিন্তু সেটাও বেশি দিন টিকবে না। কেননা মহাকাশ স্যাটেলাইটের ভিড়ে ভারাক্রান্ত; অন্যদিকে স্যাটেলাইট বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে মহাসাগর। দুটিই পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা ও পরিবেশের জন্য অনুকূল নয়।
মাধ্যমের মহামিলন
নিকট ভবিষ্যতে টেলিভিশন, রেডিও, সংবাদপত্র ও নিউজ পোর্টাল আলাদা কোনো সত্তা থাকবে না। টিকে থাকার তাগিদে সবই জোট বাঁধবে। এটাকে ‘মিডিয়া কনভারজেন্স’ বলা যেতে পারে।
টেলিভিশন সম্প্রচার ও গ্রাহক যন্ত্রে যুক্ত হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এর পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে মানুষের টেলিভিশন দেখার অভিজ্ঞতা আমূল বদলে যাবে। আপনি চিন্তাই করতে পারবেন না, টেলিভিশন কতখানি মিথস্ক্রিয়াসম্পন্ন একটি সুপারমিডিয়ায় পরিণত হবে! সুপারমিডিয়ার ধারণা এ রকম–
১.
২. টেলিভিশন স্টেশন ও যন্ত্রের সঙ্গে চ্যাট করা সম্ভব হবে। এমনকি ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো টেলিভিশনের সঙ্গে কথা বলা যাবে।
৩. বৈশ্বিক টেলিভিশন চ্যানেল দেখার ক্ষেত্রে ভাষাগত কোনো প্রতিবন্ধকতা আর থাকবে না। যে কোনো ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠান পছন্দমতো ভাষায় রূপান্তর টেলিভিশনই করে দেবে।
৪. টেলিভিশন সংবাদে সত্যতা যাচাইয়ের ক্ষেত্রে একটি বিপ্লব সাধিত হবে। কোন সংবাদ কতটা সত্য অথবা কতটা মিথ্যা, সেটা যাচাই টেলিভিশনই করে দেবে। উদাহরণস্বরূপ বলে দেবে, এই সংবাদটি ১০০ ভাগ সত্য, অথবা সংবাদটি অসত্যতার সম্ভাবনা ৪০ ভাগ বা ৭০ ভাগ– এ রকম।
৫. অন্যের কনটেন্ট চুরি করার প্রবণতা টেলিভিশন নিজেই ঠেকিয়ে দেবে। এ ক্ষেত্রে মেধাস্বত্ব নিয়ে মারামারির বড় একটা সমাধান হবে এখানেই।
৬. টিভি সেট আপনি ও আপনার অনুমোদিত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ চালাতে পারবে না। শিশু ও অপ্রাপ্তবয়স্কদের পক্ষে বড়দের অনুষ্ঠান আর দেখা সম্ভব হবে না। সে সুযোগই থাকবে না টেলিভিশনে। টেলিভিশনে এই প্রযুক্তিতে ঠিক ঠিক তাকে চিনে নিয়ে তার জন্য একটু সাজুয্যপূর্ণ অনুষ্ঠানমালা সাজিয়ে দেবে।
আরও কিছু চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার ক্ষেত্র
একদিকে প্রযুক্তির উৎকর্ষ, অন্যদিকে সর্বব্যাপিতা টেলিভিশন সিস্টেমকে যেমন অনেক সম্ভাবনা এনে দেবে, তেমনি দেখা দেবে নানা চ্যালেঞ্জ। এখনই সব বলা না গেলেও মোটা দাগে এর কয়েকটি আলোকপাত করা যেতে পারে।
১. মেটা ডেটা ও আইওটির ব্যবহার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে টেলিভিশন সম্প্রচারেও যুক্ত হবে ডেটা ও ইন্টারনেট অব থিংস। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এ দুটি টুল টেলিভিশনকে অনেক সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে। যেমন, টেলিভিশন কি আইটি প্রোডাক্ট, নাকি ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোডাক্ট? এ ছাড়া মেটা ডেটা ও আইওটির ব্যবহার নিয়ে আইওপির স্বত্ব অংশীদারিত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরির আশঙ্কা রয়েছে।
২. টেলিভিশনের মালিকানা ও লাইসেন্স সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও টেলিভিশন মাধ্যম তো প্রায় একই ধরনের কাজ করে থাকে। তাহলে টেলিভিশন সম্প্রচারের জন্য লাইসেন্স নিতে হবে কেন? আগামী কয়েক দশকে যখন টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে কয়েক গুণ হবে, তখনই এ দাবি আরও জোরালো হবে। অন্যদিকে, বৈশ্বিক কর্তৃত্ববাদী সরকার ব্যবস্থা টেলিভিশন সম্প্রচারের উন্মুক্ত স্বাধীনতা দেবে না। সুতরাং, দেশে দেশে দ্বন্দ্বের একটা জায়গা থাকছেই।
৩. আউটসোর্সিং সমস্যা: টেলিভিশন কনটেন্ট দিন দিন আউটসোর্সিংনির্ভর হয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে অনেক টিভি চ্যানেল শুধু সম্প্রচার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টিকে থাকবে। এ অবস্থায় কনটেন্টের দায় নিরূপণ ও নিয়ন্ত্রণ করা একটি অসাধ্য কাজ হয়ে যাবে। সরকারের কনটেন্ট মনিটরিংও অসম্ভব হয়ে পড়বে।
৪. পাবলিক সার্ভিস টিভি: বাণিজ্যিক টিভির দাপটে এখনই সরকারি টিভি অনেকটা কোণঠাসা। ভবিষ্যতে পাবলিক সার্ভিস টিভি যেমন আরও জৌলুস হারাবে, তেমনি দর্শকপ্রিয়তা হারাবে। এমন অবস্থায় শুধু ভর্তুকি দিয়ে পাবলিক সার্ভিস টেলিভিশন চালানো কঠিন হয়ে যাবে। এক সময় অস্তিত্ব সংকটে পড়বে জনগণের পয়সায় পরিচালিত টিভি সার্ভিস।
সব মিলে একদিকে নতুন সম্ভাবনা, অন্যদিকে নতুন সংকট। অনেকে হয়তো পুরোনো টেলিভিশন, অনুষ্ঠান ও সম্প্রচারের নস্টালজিয়ায় ভুগবেন। তবে প্রচলিত ধারায় টেলিভিশন সম্প্রচার বা মেইন স্ট্রিম টিভি কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে না– এ কথা বিশ্বাস করে টেলিভিশন শুভানুধ্যায়ীরা আপাতত স্বস্তিতে থাকতে পারেন।
জাহিদুল ইসলাম: বার্তা সম্পাদক, বাংলাদেশ টেলিভিশন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কনট ন ট
এছাড়াও পড়ুন:
অনলাইনে ‘আউটসোর্সিং’ কাজ দেওয়ার কথা বলে করতেন প্রতারণা
কখনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টেলিগ্রামে বিজ্ঞাপন দিয়ে অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের কাজ শেখান তাঁরা। আবার কখনো ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা সেজে লোকজনকে বিভিন্ন অনলাইন আউটসোর্সিং কাজ দেওয়ার নামে টাকা হাতিয়ে নেন। এভাবে প্রতারণার অভিযোগে একটি চক্রের দুই সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গতকাল রোববার ঢাকার লালবাগ এলাকা থেকে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। আজ সোমবার সিআইডি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানিয়েছে।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন সুকান্ত বিশ্বাস (২৪) ও মানব বৈদ্য (২৩)। এ সময় তাঁদের কাছ থেকে অপরাধমূলক কাজে ব্যবহৃত ছয়টি মুঠোফোন ও ১৪টি সিম জব্দ করা হয়।
সিআইডি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, গ্রেপ্তার প্রতারক চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন সিমগুলো ব্যবহার করে প্রতারণা করে আসছিলেন। তাঁরা সিম নম্বরগুলো বন্ধ করে সেগুলো থেকে ওটিপি গ্রহণ করে নতুন হোয়াটসঅ্যাপ চালু করে ব্যবহার করেন। সেসব অ্যাকাউন্ট থেকে পুলিশসহ সরকারি বিভিন্ন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি পরিচয়ে প্রতারণাসহ লোকজনকে বিভিন্ন অনলাইন আউটসোর্সিং কাজ দেওয়ার নামে অর্থ গ্রহণ করতেন। এ বিষয়ে পল্টন থানায় নিয়মিত মামলা হয়েছে। সেই মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।