‘জুলাই ঘোষণা’ ও ফিরে দেখা রাজনীতি
Published: 3rd, February 2025 GMT
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির খসড়া ঘোষণাপত্র ইতোমধ্যে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত। গত ১৬ জানুয়ারি ‘জুলাই ঘোষণা’ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের আহ্বানে সর্বদলীয় এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের আগে একটি খসড়া জুলাই ঘোষণা দলগুলোকে পাঠানো হয়। এ দুটি ঘোষণাপত্রের প্রধান কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রসঙ্গে
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তান মূলত পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি গোষ্ঠীর কাঁচামাল এবং পুঁজি সংগ্রহের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এই শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। যার প্রথম প্রকাশ ঘটে বরকত, সালাম, রফিক, জব্বারের রক্তস্নাত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয় হয়। এর পর বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছেষট্টির ৬ দফা আন্দোলন এবং ১১ দফার ভিত্তিতে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিপুল বিজয় পায়। ১৯৭১ সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ছিল এসব গণআন্দোলনের স্বাভাবিক পরিণতি। এই মুক্তিযুদ্ধে জাতির একটি অতি ক্ষুদ্র অংশ রাজাকার, আলবদর বাহিনী যেমন ন্যক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছে, তেমন লাখো-কোটি জনগণ অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করেছে। কিন্তু এই গৌরব আওয়ামী লীগ একা আত্মসাৎ করতে গিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর এ দেশে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে যে পুঁজিবাদী রাষ্ট্র গঠিত হলো, তা প্রথম দিন থেকেই শোষণ, জুলুম, অত্যাচার ও স্বেচ্ছাচারিতার দিকে পা বাড়াল। সর্বশেষ ১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানকে কবরস্থ করে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর ১৯৮২ সাল পর্যন্ত একের পর এক ক্যু, পাল্টা ক্যু চলতে থাকে এবং সর্বশেষ নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক এরশাদ ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হন। এরপর আওয়ামী লীগ, বিএনপি-জামায়াত এ দুটি সরকারই দেশকে কোনো স্থায়িত্ব দিতে পারেনি। উপরন্তু সংবিধানে একের পর এক সংশোধনী এনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব এবং একের পর এক জনবিরোধী নীতি কার্যকর করেছে। সর্বশেষ ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগ এই শোষণ-জুলুম-অত্যাচার-বাকস্বাধীনতা হরণকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গেছে। ২০১৪, ’১৮ ও ’২৪ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করে আওয়ামী লীগ তার বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে। জুলাই ঘোষণার মধ্যে ইতিহাসের বর্ণনায় এই উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো বাদ পড়েছে।
বাহাত্তরের সংবিধান প্রসঙ্গে
জুলাই ঘোষণাপত্রে তারা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রবাসী সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকেই বাংলাদেশের সংবিধানের যথার্থ ভিত্তি হিসেবে ধরছেন। অথচ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ও ১৯৭২ সালের সংবিধানের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে শেখ মুজিবকে সব রকম প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁর হাতে বিপুল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক সাম্য, মৌলিক মানবাধিকার, স্বাধীনতা ও সুবিচার– এই শব্দগুলোতে লাখো কোটি জনতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায় আওয়ামী লীগ সেগুলোকে বাহাত্তরের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। এই সংবিধান প্রণয়নের আগে ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভায় জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রকে মুজিববাদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এটাকে কেন্দ্র করে এই প্রশ্ন এখন এসেছে যে, এই সংবিধানের ভাবাদর্শগত ভিত্তি হলো মুজিববাদ। তবে জেনে রাখা উচিত, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে বুর্জোয়ারা সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারী স্বাধীনতা, এক মানুষ-এক ভোট– এসব প্রগতিশীল ধারণা নিয়ে এসেছিল। এর পর থেকে সব বুর্জোয়া রাষ্ট্রই তাদের সংবিধানকে এই ধারণাগুলোর ওপর দাঁড় করায়। ১৯৭২ সালের ১৪ এপ্রিল সন্তোষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটি সভায় এক প্রস্তাব গৃহীত হয়– ‘.
বাহাত্তরের সংবিধানের প্রগতিশীল ইতিবাচক দিকগুলোকে অক্ষত রেখে মূলত কাঠামোগত দিকটি সংস্কার করা উচিত। একই সঙ্গে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজ– এই ছয়টি মৌলিক অধিকারকে ‘মৌলিক অধিকার’ অধ্যায়ে সংযুক্ত করা উচিত এবং মূলনীতি ও মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে রচিত অধিকারগুলোকে আইন দ্বারা বলবৎযোগ্য করা উচিত।
ঘোষণাপত্র দুটির মধ্যে পার্থক্য
সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের অংশগ্রহণে সরকার গঠন, ‘ডিকলোনাইজড ট্রুথ অ্যান্ড হিলিং কমিশন’-এর প্রস্তাবনা, সেনাশাসন-রাষ্ট্রীয় পুঁজি-বৃহৎ ব্যবসায়ী-আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রস্তাবনা– এসব ছাত্রদের দেওয়া ঘোষণায় থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সরকারের দেওয়া খসড়া ঘোষণায় নেই।
গণঅভ্যুত্থান প্রসঙ্গে
আওয়ামী লীগের গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব জাগরণ এই গণঅভ্যুত্থান। দেড় হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছেন এই আন্দোলনে। আহত হয়েছেন ২৫ হাজারের বেশি মানুষ। এই গণঅভ্যুত্থান থেকে ফ্যাসিবাদ ধ্বংসের স্লোগান উঠেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের পতন মানেই ফ্যাসিবাদের পতন নয়। ফ্যাসিবাদ কোনো দল আনে না। ফ্যাসিবাদ আনে একটি ব্যবস্থা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তীকালে উন্নত কিংবা অনুন্নত সব দেশেই ফ্যাসিবাদী প্রবণতা দেখা যায়। ফলে এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিলোপ ঘটেনি; ফ্যাসিবাদ পিছু হটেছে মাত্র।
১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, এর পর ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পেরিয়ে আবার ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থান এবং এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনা। তাই সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সংগঠন, সর্বোপরি নাগরিক সমাজের সুচিন্তিত মতামত নিয়ে ঐকমত্যের মাধ্যমেই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা উচিত।
মাসুদ রানা: সমন্বয়ক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী ফোরাম, বাসদ (মার্ক্সবাদী)
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র গণঅভ য ত থ ন র জন ত ক সরক র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
বইমেলায় আফরোজা খাতুনের ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’
অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পাওয়া যাচ্ছে আফরোজা খাতুনের বই ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’। বইটি মেলায় এনেছে শোভা প্রকাশ। প্রচ্ছদ করেছেন আদনান আহমেদ রিজন। বইমেলার ৩ নম্বর প্যাভিলিয়নে পাওয়া যাচ্ছে বইটি।
বইটির মুদ্রিত মূল্য ৩৭৫ টাকা। বইমেলায় ২৫ শতাংশ ছাড়ে ২৮০ টাকায় পাওয়া যাবে এটি।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যুগান্তকারী অধ্যায়। ছাত্র-জনতার অদম্য শক্তি, গণতন্ত্রের জন্য লড়াই এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে এই অভ্যুত্থান। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ, সরকারবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা, গণমানুষের অংশগ্রহণ এ ঘটনাকে অনন্য করে তুলেছে।
আরো পড়ুন:
বইমেলার দ্বিতীয় দিনে ১৩ নতুন বই প্রকাশিত
বইমেলায় ‘সেরা লেখক’ স্বীকৃতির আয়োজনের প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার
‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ বইয়ে গণঅভ্যুত্থানের ধারণা, ইতিহাস, পটভূমি, টাইমলাইন এবং তার পরিণতির বিস্তৃত চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে উঠে এসেছে আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, সুশীলসমাজের ভূমিকা, ছাত্র-জনতার অগ্রণী ভূমিকা এবং সাধারণ জনগণের দৃঢ় প্রতিরোধ। বইটির অন্যতম দিক হলো— এতে জুলাই গণঅভ্যুত্থান-২০২৪ এর শহীদদের গেজেট সংযুক্ত করা হয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূলে ছিল রাজনৈতিক দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মানের ক্রমাবনতি। নানাবিধ বৈষম্য এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের অভাব জনগণের ক্ষোভকে তীব্র করে তোলে।
বইয়ে দেখানো হয়েছে, কীভাবে জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য রাস্তায় নেমে আসে। উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রশ্ন—কেন রাষ্ট্রীয় কাঠামো এত দুর্বল হয়ে পড়েছিল যে, জনগণকে এমন গণঅভ্যুত্থানর দিকে এগিয়ে যেতে হলো?
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তরুণসমাজের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষিত তরুণ-তরুণীরা তাদের সোচ্চার কণ্ঠ, প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সাহায্যে আন্দোলনকে সুসংহত করেছিল। তারা নেতৃত্ব দিয়েছিল এমন এক আন্দোলনে, যেখানে প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষ একত্র হয়েছিল।
এছাড়াও বইয়ে রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া, প্রশাসনিক দমন-পীড়ন এবং গণমাধ্যমের ভূমিকা বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বইটি কেবল ইতিহাস নয়; এটি একটি প্রামাণ্য দলিল। এতে ব্যবহৃত হয়েছে সরাসরি অংশগ্রহণকারীদের অনেকের বক্তব্য, সংবাদ প্রতিবেদন এবং সমসাময়িক গবেষণার তথ্য।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যখন মানুষ একত্রিত হয়, তাদের চাহিদা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগঠিত হয়, তখন ক্ষমতার কাঠামো কেঁপে ওঠে।
আফরোজা খাতুনের ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ বইটি শুধু ঘটনার প্রামাণ্য বিবরণ নয়; এটি ভবিষ্যতের জন্য একটি শিক্ষা। এতে প্রজন্মের কাছে একটি বার্তা রয়েছে—মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য, স্বাধীনতার জন্য এবং ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রাম সব সময় প্রাসঙ্গিক।
ঢাকা/রফিক