জার্মানিতে ডানপন্থি উত্থানের আশঙ্কা
Published: 3rd, February 2025 GMT
জার্মান রাজনীতিতে টেকটোনিক প্লেট বা পাটাতন বদলে যাচ্ছে। গত সপ্তাহ ছিল গুরুত্বপূর্ণ, যখন দেশটি অনিশ্চয়তার মধ্যে নিমজ্জিত। এ অবস্থা শুধু ২৩ ফেব্রুয়ারি ভঙ্গুর সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল নয়। মূলধারার দলগুলো একে অপরের গলা চেপে ধরে আছে, সেখানে ডানপন্থি অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) উল্লাস করছে। নিয়ন্ত্রণকারী নেটওয়ার্ক বা ফায়ারওয়াল চরম ডানপন্থিদের বিরুদ্ধে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর থেকে বহাল, তবে এতে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতার পর্বে ঢুকে পড়তে পারে। এ সবই বিরোধীদলীয় নেতা ফ্রেডরিখ মার্জের লক্ষণীয় ভুলের মাশুল, যিনি জার্মানির পরবর্তী চ্যান্সেলর হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে থাকা এবং মধ্য-ডান ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটস (সিডিইউ) নেতা।
কিন্তু আমরা এখানে কীভাবে এলাম? মার্জ একজন পুরোনো ধাঁচের খ্রিষ্টান ডেমোক্র্যাট, যিনি ইউরোপ ও বাজারপন্থি, ন্যাটোর সমর্থক। তিনি জনতুষ্টিবাদী নন; জাতীয়তাবাদী বা ধর্মান্ধও নন। তবুও মধ্য-বাম প্রতিযোগিতাকে ব্ল্যাকমেইল করা এবং এএফডিকে ছাড়িয়ে যাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টায় তিনি তাঁর নেতৃত্বের যোগ্যতা ও বিশ্বস্ততার ব্যাপারে প্রচারণা চালিয়েছেন। এএফডির ভোটে তিনি কখনও চ্যান্সেলর নির্বাচিত হবেন না– এ বিষয়ে তাঁর প্রতিশ্রুতি কী? এটা বোঝা গুরুত্বপূর্ণ, সিডিইউ এবং এর ব্যাভারিয়ান সিস্টার পার্টি, ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন (সিএসইউ) পশ্চিমা গণতন্ত্রে অন্যদের মতো সাধারণ রক্ষণশীল বা মধ্য-ডান দল নয়।
জার্মান খ্রিষ্টান ডেমোক্র্যাটদের উত্থান ঘটেছিল তাদের ব্যর্থ ওয়েমার পূর্বসূরিদের ধুলা থেকে, এই বুর্জোয়া-জাতীয়তাবাদী দল হয় নাৎসিদের অবমূল্যায়ন করেছিল অথবা সমর্থন দিয়েছিল। সিডিইউর প্রথম নেতা ও বুন্দেস রিপাবলিকের প্রথম দীর্ঘকালীন চ্যান্সেলর কনরাড অ্যাডেনাউয়ার অত্যন্ত রক্ষণশীল, কিন্তু ফ্যাসিবাদবিরোধী এবং দলটির গণতন্ত্রবিরোধী ঝোঁক থেকে সরে এসেছিলেন। সত্য, তিনি তাঁর দলে অনেক পুরোনো নাৎসিকেও একত্রিত করেছিলেন। কিন্তু এটি ঘটেছে তার প্রবৃত্তির কারণে, যেখানে সাবেক সহযাত্রীদের পুনরায় মাথা ঝালিয়ে দিয়ে আগের পথে ধাবিত করা যেতে পারে। অ্যাডেনাউয়ার পার্লামেন্টে গণতন্ত্রবিরোধী শক্তির সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতা গঠনের কথা কখনোই ভাবেননি।
তাই, সিডিইউ জার্মানির গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা বলা ভুল যে, ক্ষতিকর মানুষদের ঠেকাতে তাঁর দলে কোনো সুরক্ষা দেয়াল বা এ বিষয়ে কার্যকর কোনো নীতি ছিল। যারা হলোকাস্টকে অস্বীকার বা প্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা করে, তাদের ব্যাপারে সীমারেখা টানতে চেষ্টা করলেও দলটি দীর্ঘকাল সব ধরনের রক্ষণশীলদের আশ্রয় দিয়েছে। সিডিইউ জার্মানির ডানপন্থি বাহিনীকে আর ধারণ করতে বা প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না– এমন সম্ভাবনা ভীতিজনক।
নাৎসিদের অতীতের অপরাধের কারণে মুখোমুখি করতে ঐকমত্যের বিষয়টি মৌলিক– এ ব্যাপারে প্রায় প্রতিদিন এএফডি জার্মান ‘স্মরণ আচার’ নিয়ে প্রশ্ন তোলে। উদ্বেগজনক, সম্প্রতি তারা এই প্রচেষ্টার শক্তিশালী একটি অংশীদার খুঁজে পেয়েছে। ২৫ জানুয়ারি এএফডির প্রচারাভিযানের এক ভিডিও ভাষণে দেখা গেছে, ইলন মাস্ক উপস্থিতদের ‘অতীতের অপরাধের প্রতি খুব বেশি মনোযোগী’ হয়ে সীমাবদ্ধ না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি আউশভিৎসের স্বাধীনতার ৮০তম বার্ষিক উদযাপনের মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে এ বক্তৃতা দিয়েছিলেন। ‘সামনে এগিয়ে যাওয়া’র জন্য তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে দলীয় কর্মীরা তাঁর ব্যাপক প্রশংসা করেন।
মার্জ ও তাঁর দলের মূলধারার বড় অংশের এ ধরনের সংশোধনবাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। শুক্রবারের বিতর্কের সময় নেতৃস্থানীয় সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা তাঁর বিরুদ্ধে চরম সমালোচনা করেন– ‘আপনি নরকের দরজা খুলে দিয়েছেন।’ চরম ডানপন্থিকে সরকারে আনার জন্য তাঁর কোনো কালো নকশা নেই। যখন তিনি তাদের সংকোচন, অধঃপতন ও প্রান্তিকীকরণের কথা তুলে ধরেন, তখন তিনি সততারই পরিচয় দেন। কিন্তু এটিকে আরও বিস্ময়কর করে তোলে, যখন তিনি নিজেকে এমন এক অবস্থানে নিয়ে যান, যেখানে তিনি সেই শক্তিগুলোর ওপর নির্ভর করেন, যা তিনি প্রান্তিক করতে চান।
গত সপ্তাহে জার্মানির মূলধারার দলগুলো দেখিয়েছে, তারা একসঙ্গে কাজ করতে পারবে না। পারস্পরিক দোষারোপ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, নির্বাচনের পরে সমঝোতা খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। জার্মান প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ব্যবস্থায় জোট গঠনের প্রস্তুতি অপরিহার্য।
আর যদি মূলধারার দলগুলোর মধ্যে জোটের আলোচনা ব্যর্থ হয়, তাহলে জার্মানি অনানুষ্ঠানিকভাবে অতি ডানপন্থিদের দ্বারা একটি রক্ষণশীল সংখ্যালঘু সরকারের দিকে অগ্রসর হতে পারে। এটি কেবল জার্মানি নয়, পুরো মহাদেশের জন্য অস্থিতিশীল হবে।
জর্গ লাউ: জার্মান সাপ্তাহিক ‘ডাই জেইট’-এর আন্তর্জাতিক সংবাদদাতা; দ্য গার্ডিয়ান থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সংস্কারের আগে নির্বাচনে জোর দেওয়া ছিল ১/১১ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভুল
১৯৯০ সালে কিছু প্রতিশ্রুতি দিয়ে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ। আর গণতন্ত্রের উল্টোপথে যাত্রা ঠেকাতে প্রয়োজন ছিল কিছু উল্লেখযোগ্য সংস্কার। সে সময় সংস্কারে জোর না দিয়ে নির্বাচন ও নির্বাচনের সময়সীমায় গুরুত্ব দেওয়া ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভুল বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপ–রাষ্ট্রদূত জন এফ ড্যানিলোভিচ।
আজ শনিবার সকালে রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক আলোচনায় তিনি এ মন্তব্য করেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস) বিআইআইএসএস’এ ‘নতুন ভোরের পথে ঢাকা: গণঅভ্যুত্থানের পরবর্তী বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নতুন গতিপথ’ শীর্ষক ওই আলোচনার আয়োজন করে। সিজিএস আয়োজিত সংলাপে অংশ নেন বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপ রাষ্ট্রদূত জন এফ ড্যানিলোভিচ। সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমানের সঞ্চালনায় আলোচনা অনুষ্ঠানের শুরুতে স্বাগত বক্তব্য দেন সংস্থার চেয়ারম্যান মুনিরা খান। এরপর সঞ্চালকের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন সাবেক দুই জ্যেষ্ঠ মার্কিন কূটনীতিক। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে অতিথিদের প্রশ্নের উত্তর দেন তারা।
সাবেক দুই জ্যেষ্ঠ মার্কিন কূটনীতিক বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতি তাদের দেশের দীর্ঘস্থায়ী প্রতিশ্রুতি নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেছেন। তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে সমর্থন করতে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের ভূমিকা এবং নীতিগত দৃষ্টিভঙ্গির ওপর আলোকপাত করেন। অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন বিদেশি মিশনের কূটনীতিক, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী নেতা, আন্তর্জাতিক, উন্নয়ন সংস্থা, নাগরিক সমাজের সদস্য, গণমাধ্যমকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন।
কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে প্রশ্ন করলে জন এফ ড্যানিলোভিচ বলেন, অবশ্যই ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ভুল পক্ষে ছিল। তবে এরপর থেকে একটি ধারাবাহিক নীতি নিয়ে চলেছে।
২০০৭–০৮ যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা জটিল ভূমিকা পালন করেছিল, সে সময়ে কূটনীতিকরা কিভাবে কাজ করে– জানতে চাইলে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ২০০৭–০৮ সালে বড় ভুল করেছিল। আমি সে সময়ে বাংলাদেশে দায়িত্বে ছিলাম না। তবে আমি এটি বলতে পারি তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত বা অন্য কোনো মার্কিন কূটনীতিক ১/১১ এর পেছনে দায়ী নয়। আর কোনো গোপন কফি গ্রুপে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে কেউ বাংলাদেশিদের নির্দেশনা দেয়নি কি করতে হবে।
জন এফ ড্যানিলোভিচ বলেন, তবে সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের গতিপথ নিয়ে অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। সে সময়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রত্যাশার কথা জানিয়েছিল, যে প্রত্যাশা তৎকালীন সরকার, সামরিক বাহিনী এবং সুশীল সমাজের ছিল।
তিনি বলেন, ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রতিশ্রুতি ছিল, তা লাইন বিচ্যুত হয়েছিল। আর বাংলাদেশকে সঠিক পথে আনতে কিছু মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। আমরা সংস্কারকে সহযোগিতা করেছিলাম। আমরা তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সমর্থন করেছিলাম। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগে ছিলাম।
১/১১-এর বিশ্লেষণে জন এফ ড্যানিলোভিচ বলেন, পরিস্থিতির কারণে আমাদের বোঝাপড়ার ঘাটতি ছিল। আমাদের অনেকের কথা শোনার দরকার ছিল। কিন্তু আমরা তাদের কথা শুনিনি। বরং যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকে আর্মির জেনারেল ও ব্রিগেডিয়ারদের কথায় বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ কি চেয়েছিল, তাতে গুরুত্ব দেয়নি। আমরা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বললেও আর্মিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। এ কারণেই হয়তো যুক্তরাষ্ট্র যে রকম প্রত্যাশা করেছিল বাংলাদেশ সে ধারায় যেতে পারেনি।
তিনি বলেন, আরও একটি ভুল ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। সেটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে নির্বাচন ও নির্বাচনের সময়সীমাতে বেশি জোর দিয়েছিল। নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ, কারণ যে সরকার নির্বাচিত নয়, এমন সরকার দীর্ঘ সময় শাসন করতে পারে না। তবে সে সময়ে উল্লেখযোগ্য সংস্কার প্রয়োজন ছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার অগ্রাধিকার সংস্কারের চেষ্টা করেছিল। তবে যখন এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে সে সরকারের এডেন্ডা হচ্ছে নির্বাচন এবং ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর থেকে প্রভাব হাড়িয়েছে।
জন এফ ড্যানিলোভিচ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সে সরকারের চুক্তি হয়েছিল গোপনে। ফলে আমরা জানি না সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কি দরকষাকষি হয়েছিল। তখন আমরা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। আমাদের ধারণা ছিল, আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা তাদের শিক্ষা পেয়েছেন এবং সংস্কারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাজগুলোকে এগিয়ে নেবে। তবে আমাদের ধারণা ভুল ছিল এবং যা বলেছিল তা বিশ্বাস করেছিলাম। আর বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে অবনতি হতে দেখেছি, যার ফলে ২০২৪ এর জুলাই–আগস্ট হয়েছে। এ সময়ে অতীতের ভুল থেকে ভবিষ্যতের শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেন তিনি।