স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নিহতে গ্রেপ্তার ৩
Published: 2nd, February 2025 GMT
নাঙ্গলকোটে বিএনপির দু’পক্ষের সংঘর্ষে হেসাখাল ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সেলিম উদ্দিন ভূঁইয়া নিহতের ঘটনায় ৩৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়েছে। গতকাল রোববার মামলাটি করেন নিহত সেলিম ভূঁইয়ার বড় ভাই আব্দুর রহিম।
হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গত শনিবার রাতে যুবদলের তিন নেতাকে আটক করেছে পুলিশ। তারা হলেন– বটতলী ইউনিয়ন যুবদল নেতা কাশীপুর গ্রামের ফারুক হোসেন, নাঙ্গলকোট পৌরসভার গোত্রশাল গ্রামের আফসার ও মোহাম্মদ হেলাল। রোববার তাদের গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। একই দিন ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ। বিকেল ৩টার দিকে স্থানীয় দায়েমছাতি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।
এর আগে শনিবার দুপুরে বাঙ্গড্ডা বাদশাহ মিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ মাঠে বাঙ্গড্ডা ইউনিয়ন যুবদলের কর্মী সম্মেলন হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপি নির্বাহী কমিটির সদস্য মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়া। এই পক্ষের লোকজন মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা নিয়ে যাওয়ার সময় সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল গফুর ভূঁইয়ার অনুসারীদের সঙ্গে বাঙ্গড্ডা পশ্চিম বাজারে সংঘর্ষ বেধে যায়। সংঘর্ষে গুরুতর আহত সেলিম ভূঁইয়াকে উদ্ধার করে নাঙ্গলকোট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে মৃত্যু হয়। পরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
সংঘর্ষের বিষয়ে বিএনপি নেতা মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়া কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন।
তবে সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল গফুর ভূঁইয়া দাবি করেন, কাকৈরতলায় তাঁর সমাবেশে যাওয়ার পথে মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়ার উপস্থিতিতে হামলার ঘটনা ঘটে।
হত্যা মামলার আসামিরা হলেন– বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মোবাশ্বের আলম ভূঁইয়া, সাবেক উপজেলা বিএনপির নেতা কামাল হোসেন মজুমদার, পৌর যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মহিন, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম, সদস্য সচিব কামরুজ্জামান টিটু, যুগ্ম আহ্বায়ক মোদাচ্ছের হোসেন লিটন, আবদুল মমিন, পৌরসভা যুবদলের আহ্বায়ক নূরুল আফসার সজল, সদস্য সচিব কামাল হোসেন, পৌরসভা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ, উপজেলা ছাত্রদল নেতা আলী হোসেন টিপু, কিনারা গ্রামের আনোয়ার হোসেন ভূঁইয়া, বাঙ্গড্ডা গ্রামের গিয়াস উদ্দিন, শাহ নেওয়াজ, উপজেলা যুবদলের সদস্য ফারুক হোসেন কুতুব, ফারুক মোল্লা, নাঙ্গলকোট উপজেলা যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইউসুফ কমিশনার, বাঙ্গড্ডা গ্রামের সোহাগ, জহির, বাঙ্গড্ডা ইউনিয়ন বিএনপি সাবেক সদস্য সচিব আব্দুল মতিন, সাবেক আহ্বায়ক শাহ আলম, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক সদস্য মিজানুর রহমান, পৌরসভা ছাত্রদল নেতা আব্দুল্লাহ পারভেজ, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মাসুদ, হরিপুর গ্রামের পারভেজ, জামাল হোসেন, উপজেলা যুবদলের সদস্য রফিকুল ইসলাম খোকন, পৌরসভা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নূর মোহাম্মদ ডলি, বেতাগাঁও গ্রামের ইকবাল, পৌরসভা যুবদলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হাজী সেলিম, বেতাগাঁও গ্রামের আলমগীর, মাধবপুর গ্রামের আনোয়ার মাহমুদ মিলন, শালুকিয়া গ্রামের রাসেল মাহমুদ, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ-জলবায়ুবিষয়ক সম্পাদক আবদুর রহিম সুজন, উপজেলা যুবদলের সদস্য মোবারক হোসেন।
নাঙ্গলকোট থানার ওসি এ কে ফজলুল হক বলেন, বিএনপির দুই পক্ষের সংঘর্ষে একজন নিহতের ঘটনায় ৩৯ জনের নামে মামলা হয়েছে। অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়েছে ৪০ জনকে। তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম ব শ ব র আলম ভ য বদল র স ন ঙ গলক ট সদস য ম ব এনপ র র সদস য দল র স স ঘর ষ দল ন ত উপজ ল র ঘটন প রসভ
এছাড়াও পড়ুন:
কৃষকের ফসল গেল, জীবনও গেল...
সাইফুল শেখের পরিবারকে দেখতে আমরা মুজিবনগর ভবেরপাড়া গ্রামে যাই। এক জীর্ণ মাটির ঘর। কৃষক সাইফুল শেখ কয়েক দিন আগেই চাষে লোকসান আর ঋণের ভার সইতে না পেরে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
মা রমেসা খাতুন হাহাকার করে কেঁদে উঠলেন– ‘আমার ছেইলে, আমার পাখি তো আর নাই রে বাবু!’ পক্ষাঘাতগ্রস্ত, চলাফেরায় অক্ষম সাইফুল শেখের স্ত্রী হতবিহ্বল সোনাভানু একবার কথা বলেন আবার চুপ হয়ে যান। পেঁয়াজ, কচু চাষ করে, বর্গার গরু-ছাগল পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন সাইফুল শেখ। কন্যা রোজেফাকে খুব আগ্রহে পড়াশোনায় উৎসাহ দিতেন। বিষপানের দু’দিন আগে তাকেই বলছিলেন ধারদেনা, লোকসান আর হতাশার কথা।
২৫ মার্চ প্রতিদিনের মতো মাঠে গিয়েছিলেন তিনি। বিকেলে বাড়ি ফিরেই হঠাৎ বমি করে ফেলেন। বমি থেকে অস্বাভাবিক গন্ধ পেয়ে জানতে চাইলে কচুক্ষেতে ব্যবহার্য বিষ পান করেছেন বলে জানান তিনি। দু’দিন ধরে এই হাসপাতাল ওই হাসপাতাল করেও শেষ রক্ষা হয়নি। ২৭ মার্চ চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান কৃষক সাইফুল শেখ।
তাঁর স্ত্রী, মা ও মেয়ে এখন আর কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। শোক বড়; হঠাৎ ফাঁকা হয়ে যাওয়া সংসারটাও বড়। তার চেয়েও বড় আগামীকালের ভাতের দুশ্চিন্তা। একদিকে পরিবারের চরম অনিরাপত্তা, অন্যদিকে ক্ষুদ্রঋণ, সারের ডিলার, বর্গার জমি আর মুদি দোকানের ঋণের মতো নানাবিধ চাপ। বর্গা জমি, ধারে সার, কীটনাশক, ছত্রাকনাশকের ব্যবস্থা, ঋণ নিয়ে শ্রমিকের মজুরি, চাষ-সেচের খরচ, ফসল ওঠা পর্যন্ত সংসার চালাতে বিবিধ ধারদেনা, তারপর ফসলের দাম না পাওয়া, ঋণ পরিশোধের চাপ– এগুলো আমাদের প্রান্তিক কৃষকের জন্য চক্রাকারে চলতে থাকে। আমরা যখন সাইফুল শেখের বাড়ি থেকে ফিরছি, তখন জানা গেল রাজশাহীর বাঘায় আরও একজন কৃষক চলন্ত ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনিও ঋণের দায় ও লোকসানের চাপে ছিলেন।
এসব মৃত্যু কেবল এক ব্যক্তির নয়, বরং একটি কাঠামোর ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। যেখানে কৃষকের ঋণের হিসাব মেলে না, সেখানে ফসল ফলানো মানেই অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। লোকসানের ধসেই ভেঙে পড়েছে সাইফুল শেখের গোটা পৃথিবী; সঙ্গে তাঁর পরিবারের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। কথাটি শুনতে হয়তো পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির জন্য এক রকমের স্বার্থপরতাই শোনায়, কিন্তু বাংলাদেশের বহু প্রান্তিক পরিবারের পরম্পরায় পরিবারের প্রধান পুরুষের ওপরে সবার এই নির্ভরতা সত্য। অপরিবর্তনীয় সত্য হলো, এই বাড়ির বাকি প্রত্যেক সদস্যই নারী। মা রমেসা বেগম কিংবা রোজেফা খাতুন যেভাবে বলতে পেরেছেন সাইফুল শেখ কী খেতে পছন্দ করতেন, কখন কাজে যেতেন, কখন ফিরতেন; সেভাবে বলতে পারেননি বর্গার এক বিঘা জমিটুকু ঠিক কত টাকায় বর্গা নেওয়া। তাদের না বোঝার আছে নিজের জমির খতিয়ান। না চেনেন বর্গা জমির মালিককে; না আছে কৃষিঋণের ভাষা বোঝার জ্ঞান; না আছে বাজারে দরদাম বোঝার সুযোগ। নারী হয়ে, গরিব হয়ে, প্রান্তিক গ্রামে থেকে তারা তিন গুণ ভঙ্গুর হয়ে পড়েছেন এই দুনিয়ার চোখে। তাদের দিন ও রাত এখন শুধুই শোক আর সংগ্রামের নাম।
আমাদের জানার ছিল, সাইফুল শেখ কেন আত্মহত্যা করলেন? কিন্তু ভবেরপাড়া থেকে ফিরে এসে আমাদের আজকের প্রশ্ন, আসলে সাইফুল শেখকে আমরা কেন বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাতে পারিনি? ফসলের দাম ওঠানামা করে। জীবনও কি তা-ই করবে? সাইফুল শেখ কি আর কখনও ফিরবেন? তিনি জীবিকার জন্য কৃষিকাজ করছিলেন, নাকি অনিশ্চিত মূল্য তাঁর আত্মহত্যার জন্য জমি প্রস্তুত করছিলেন! লোকসান হলে কৃষক মরে। লাভ তাহলে কার ঘরে যায়?
আমার স্মৃতিতে একটা কোদাল আর একটি ছবি পড়ে আছে সাইফুল শেখের বাড়ি। কেউ আর সেই কোদাল নিয়ে ক্ষেতে বেরোবে না; ছেলেকে ক্ষেত থেকে ফিরে আসতে দেখে রমেসা খাতুন বলে উঠবেন না– ‘বাবা আইছো?’ রাষ্ট্র এই শূন্যতা, অসহায়ত্ব বোঝে কিনা; জানি না। তবে এই গল্প কেবল সাইফুল শেখের গল্প নয়; এটি আমাদের কৃষকের গল্প। একটি দেশের আত্মার ক্ষয় হয়ে যাওয়ার গল্প।
এখন সিদ্ধান্ত আমাদের। আমরা কী শুনতে চাই? আত্মহত্যায় কৃষকের মৃত্যুর খবর? রোজেফা, রমেসা, সোনাভানুদের হাহাকার! নাকি কৃষক বাঁচাতে, দেশের কৃষি বাঁচাতে কৃষকের চাওয়া?
দুর্দশা বা দরকারের কথা কে শুনবে; কৃষক কোথায় বলবে? সেই পথ কি আমরা তৈরি করছি?
উম্মে সালমা: উন্নয়নকর্মী
ummesalmapopi@gmail.com