সাত কলেজ: জনতুষ্টি নয়, বাস্তবসম্মত সমাধান
Published: 2nd, February 2025 GMT
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা এক দীর্ঘমেয়াদি সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত সাতটি সরকারি কলেজ নিয়ে চলমান অস্থিরতা এ সংকটের অন্যতম প্রতিফলন। সাতটি কলেজকে ঢাবির অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত প্রথম থেকেই বিতর্কিত ছিল। এ কলেজগুলো আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকলেও ২০১৭ সালে এক নীতিগত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে হঠাৎ ঢাবির অধীনে আনা হয়। কিন্তু কোনো সুস্পষ্ট প্রশাসনিক বা একাডেমিক পরিকল্পনা ছাড়াই নেওয়া এ সিদ্ধান্ত খুব দ্রুত সমস্যা তৈরি করে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বহন করলেও তারা ঢাবির মূলধারার শিক্ষার্থীদের মতো কোনো সুযোগ-সুবিধা পাননি এবং সমাজেও তাদের মর্যাদায় কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বঞ্চনাবোধ ও পরিচয় সংকট তৈরি হয়েছে, যা একাডেমিক
সমস্যার পাশাপাশি তাদের মানসিক ভঙ্গুরতারও কারণ।
সাত কলেজ নিয়ে সমস্যার সমাধানে অনেকে কলেজগুলোকে পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার প্রস্তাব দিয়েছেন। আবার কেউ বলছেন, একটি ফেডারেটিভ বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করা যেতে পারে, যা ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের মডেলের অনুরূপ হবে। কিন্তু এসব প্রস্তাব বাস্তবতা বিবর্জিত। কারণ এগুলো উচ্চশিক্ষার কাঠামোগত দুর্বলতাগুলো উপেক্ষা করে কেবল একটি কাগুজে সমাধান হাজির করছে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে বড় সংকট শিক্ষার মানের অভাব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবকাঠামো, গবেষণা সুবিধা, দক্ষ শিক্ষক ও কার্যকর প্রশাসনিক কাঠামোর অভাবই এই সমস্যার মূল কারণ। ঢাবিসহ দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পিছিয়ে আছে। এ পরিস্থিতিতে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করলে শিক্ষার মানোন্নয়ন না হয়ে বরং আরও অবনতি ঘটবে।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে শিক্ষার মান বাড়িয়ে তুলবে না। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য দক্ষ প্রশাসন, গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল, সর্বোপরি মানসম্পন্ন অভিজ্ঞ শিক্ষক প্রয়োজন, যা বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় চরমভাবে অনুপস্থিত। সাতটি পৃথক বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করলে সাতটি নতুন প্রশাসনিক কাঠামো, নতুন শিক্ষক ও কর্মকর্তার নিয়োগ এবং নতুন অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে, যা বর্তমান শিক্ষা বাজেটের সীমাবদ্ধতা ও মানসম্পন্ন অভিজ্ঞ শিক্ষকের অপ্রতুলতার কারণে প্রায় অসম্ভব।
এ ছাড়া এটি এক বিপজ্জনক সংক্রামক ‘ডমিনো প্রভাব’-এর দৃষ্টান্ত তৈরি করবে। যদি সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়, তাহলে দেশের অন্যান্য বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী কলেজের শিক্ষার্থীরাও একই দাবিতে আন্দোলনে নামবে। ফলে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা কাঠামো আরও ভেঙে পড়বে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে শিক্ষার মান আরও নিম্নমুখী হবে।
অনেকে মনে করেন, ফেডারেটিভ বিশ্ববিদ্যালয় মডেল এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। বাস্তবে এটি আরও জটিলতা তৈরি করবে। অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ বা ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের মতো প্রতিষ্ঠান শত শত বছরের স্বশাসন, বিকেন্দ্রীকরণ ও আর্থিক স্বনির্ভরতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতায় স্বায়ত্তশাসিত একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর অভাব, সরকারি তহবিলের ওপর নির্ভরতা এবং দুর্বল প্রশাসনিক দক্ষতা থাকায়, এমন একটি মডেল কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব ও স্বপ্নবিলাস।
কলেজগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই বর্তমান শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের চাহিদার ভিত্তিতে নেওয়া উচিত নয়। কারণ, তারা এই কাঠামোর স্বল্পমেয়াদি সুবিধাভোগী হলেও দীর্ঘমেয়াদি রূপান্তরের ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা সীমিত। শিক্ষার্থীরা কয়েক বছরের মধ্যে ডিগ্রি সম্পন্ন করে বেরিয়ে যাবে। অনেক শিক্ষক বিসিএস প্রশাসনিক কাঠামোর অংশ হওয়ায় একাডেমিক গবেষণা ও শিক্ষা উন্নয়নের পরিবর্তে চাকরির নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক সুবিধার দিকেই বেশি গুরুত্ব দেন। শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিকোণ মূলত তাৎক্ষণিক সমস্যাগুলোর সমাধানে সীমাবদ্ধ। কিন্তু উচ্চশিক্ষার কাঠামোগত পরিবর্তন কেবল তাৎক্ষণিক স্বার্থের ভিত্তিতে নির্ধারিত হওয়া উচিত নয়।
জেলায়-জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মতো জনতুষ্টিমূলক, অদূরদর্শী ও আবেগপ্রসূত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কারণে জাতিকে অপরিসীম মূল্য দিতে হচ্ছে। সুতরাং এ ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত কেবল বর্তমান শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের দাবির ভিত্তিতে হওয়া উচিত নয়। বরং এটি নির্ধারিত হওয়া উচিত শিক্ষানীতি নির্ধারক, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনাবিদদের দ্বারা।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করার পরিবর্তে সাত কলেজকে ফের উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ফিরিয়ে আনা উচিত। বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম বড় সমস্যা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগেই শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীয় একাডেমিক দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। বিশ্লেষণধর্মী চিন্তা ও একাডেমিক লেখার দক্ষতার অভাব দেশের বিদ্যমান উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে অন্যতম প্রধান বাধা।
অন্যান্য পুরোনো বিভাগীয় কলেজের মতো সাত কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার সুনাম আমাদের সবার জানা। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এনে যখন এসব কলেজে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম সংযোজন করা হয়, তখন থেকেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের মানের ওপর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। কারণ এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই এসব কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের প্রতি এক ধরনের বৈষম্যের বীজ বোনা হয়। অতএব সাত কলেজকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে ফিরিয়ে আনলে একটি সুসংগঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যেখানে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের আগেই প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করতে পারবে। তবে এই পরিবর্তন হঠাৎ চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
বর্তমানে সাত কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্নভাবে তাদের ডিগ্রি সম্পন্ন করার যে অঙ্গীকার ঢাবি করেছে, এর যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি যাতে তারা কোনো অনিশ্চয়তার শিকার না হয়। তবে ভবিষ্যতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামোগত পরিবর্তনের জন্য ধাপে ধাপে নতুন ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হবে, যাতে পরিবর্তনটি ক্রমশ বাস্তবায়িত হয় এবং শিক্ষার্থীরা আকস্মিক সিদ্ধান্তের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
এ ধরনের পরিবর্তন কার্যকর করতে হলে শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে এবং নতুন ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার সুযোগ প্রদান করতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিকসহ মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাদান পদ্ধতিতে দক্ষতা অর্জনের জন্য কলেজের শিক্ষকদের পাশাপাশি স্কুল শিক্ষকদেরও পুনঃপ্রশিক্ষণ দেওয়া হলে শিক্ষার মান আরও উন্নত হবে। এটি শিক্ষকদের জন্য যেমন পেশাগত মানোন্নয়নের সুযোগ তৈরি করবে, তেমনি নিশ্চিত করবে শিক্ষার্থীদের জন্যও উচ্চমানের শিক্ষা।
সাত কলেজ নিয়ে সংকট শুধু সাত কলেজের নয়। এটি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। দেশে প্রায় প্রতিটি জেলায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রবণতা ইতোমধ্যে শিক্ষার গুণ-মানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার দীর্ঘমেয়াদি উন্নতির জন্য প্রয়োজন বাস্তবসম্মত ও সুসংগঠিত পরিকল্পনা। সাময়িক জনতুষ্টিমূলক সমাধানের পথে না গিয়ে মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত এবং সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করাই হবে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য টেকসই সমাধান। শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি, প্রশাসনিক দক্ষতার উন্নয়ন এবং শিক্ষার্থীদের একাডেমিক সাফল্য নিশ্চিত করাই হবে সবচেয়ে কার্যকর পথ।
যদি উচ্চশিক্ষার কাঠামোগত সমস্যাগুলো নিরসন করা না হয়, তাহলে এই সংকট বারবার ফিরে আসবে, যা শুধু শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থিতিশীলতা এবং দেশের সামগ্রিক উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকেও আরও অনিশ্চিত করে তুলবে। এ কারণে এখনই সংকটের মূল কারণ চিহ্নিত করে দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি, যাতে উচ্চশিক্ষার উন্নয়ন কেবল সংখ্যা বৃদ্ধির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে প্রকৃত মানোন্নয়নের দিকে অগ্রসর হয়।
ড.
huda@du.ac.bd
ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী: সহযোগী অধ্যাপক, শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
sazzadhsiddiqui@du.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স ত কল জ র ক ঠ ম গত ম ন ন নয়ন ক র যকর প শ ক ষকদ র ব যবস থ র স ত কল জ এক ড ম ক সমস য র র জন য কল জ র র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
‘পরিবারতন্ত্র’ উচ্ছেদের রাজনীতি কতটা বাস্তবসম্মত
আমি যখন অস্ট্রেলিয়ায় পড়তে গিয়েছিলাম, তখন মেলবোর্ন শহরের বাইরে একটু গ্রামীণ পরিবেশে একটি বাসায় ভাড়া থাকতাম। সেই বাসার মালিক ছিলেন বেশ ধনী একজন লোক; তাঁর সম্ভবত ৮ থেকে ১০টি বাড়ি ছিল। তাঁর একটাই মেয়ে ছিল, যাকে তিনি তখনই তাঁর উত্তরাধিকার হিসেবে একটি বাড়ি দিয়েছিলেন।
একদিন আমি ‘বাঙালি স্বভাব’ অনুযায়ী লোকটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘আপনি কি আপনার সব সম্পত্তি মেয়েকে দিয়ে যাবেন?’ তিনি হেসে বলেছিলেন, ‘না, সব দেব না। আমাদের দেশে এটা ঠিক নয়। এখানে সন্তানেরা নিজেরাই গড়ে ওঠে। সরকার আর সমাজ তাদের পাশে থাকে। তাই সবকিছু সন্তানের নামে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এরপরও কেউ যদি নিজের সব সম্পদ সন্তানদের দিতে চায়, তখন আমরা তাকে নেতিবাচকভাবে দেখি।’
এমন দৃষ্টিভঙ্গি শুধু অস্ট্রেলিয়ার নয়, আমেরিকা–ইউরোপেও দেখা যায়। বিল গেটস, ওয়ারেন বাফেট, ইলন মাস্কদের মতো ধনী ব্যক্তিরাও ঘোষণা দিয়েছেন, তাঁদের সম্পদের বড় অংশ ‘জনকল্যাণে’ দান করবেন। কারণ, তাঁদের বিশ্বাস, বেশি সম্পত্তি সন্তানের দায়িত্ববোধ নষ্ট করে দেয়।
এসব দেশ বৃদ্ধদের পেনশন, চিকিৎসা দেয়; বেকারদের ভাতা দেয়। তাই বাবা-মায়েদের সন্তাননির্ভর হয়ে থাকতে হয় না। এই চিন্তাভাবনা এক দিনে আসেনি। সমাজকাঠামো আর রাষ্ট্রের ভূমিকা পাল্টে যাওয়ার মধ্য দিয়েই এসব পরিবর্তন এসেছে।
এ অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবতে বাধ্য করল, বাংলাদেশে তো পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। আমাদের সমাজে পরিবার মানে শুধু আত্মীয়তা নয়, এটি জীবনের নিরাপত্তা, আশ্রয় ও শেষ ভরসার জায়গা। বাবা-মায়েরা তাঁদের জমি, টাকাপয়সা, সঞ্চয়—সবকিছু সন্তানের হাতে তুলে দেন। তাঁরা মনে করেন, সন্তানই তাঁদের বার্ধক্যের শেষ ভরসা, চিকিৎসা পাওয়ার নিশ্চয়তা ও সামাজিক মর্যাদার ভিত্তি। ফলে সন্তানদের যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়া ও পরবর্তী সময়ে তাদেরই সব সম্পদ দিয়ে দেওয়া আমাদের সমাজে একধরনের ‘নিয়ম’ হয়ে গেছে।
আরও পড়ুনরাজনৈতিক দলগুলোর কোনো অনুশোচনা নেই কেন২১ মার্চ ২০২৫পরিবার, অভ্যাস ও সামাজিক পুঁজিএই পরিবারনির্ভরতা কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নেই, এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব আমাদের সমাজকাঠামো ও ক্ষমতার বিন্যাসেও পড়েছে। বিষয়টি বুঝতে আমরা ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক পিয়েরে বোর্দিওর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা ‘হেবিটাস’ ও ‘সোশ্যাল ক্যাপিটাল’ প্রসঙ্গিকভাবে ব্যবহার করতে পারি।
হ্যাবিটাস বলতে বোঝায় এমন একধরনের স্বভাব বা মানসিকতা, যা গড়ে ওঠে পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রভাবে। আমরা কীভাবে চিন্তা করি, স্বপ্ন দেখি বা সিদ্ধান্ত নিই, সবই এ অভ্যাসের অংশ। মাইক্রোফিনান্স অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্ট: উইমেন ডেবট ইন বাংলাদেশ বইয়ে লামিয়া করিম দেখিয়েছেন, কীভাবে গ্রামের নারীরা পরিবার ও সমাজের চাপে এমনভাবে গড়ে ওঠে, যেখানে তারা নিজের কথা বলার সুযোগই পায় না। এ অভ্যাসই তাদের আত্মবিশ্বাস বা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাকে আটকে রাখে।
■ বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, সেখানে পরিবারই হয়ে ওঠে নিরাপত্তা, উপায় ও স্বীকৃতির প্রধান উৎস। ■ পরিবারতন্ত্র সামাজিক কাঠামোরই একটি বহিঃপ্রকাশ, যেখানে মানুষ পরিবারকে জীবনের ভরসা হিসেবে দেখে এবং সেই ভরসা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। ■ আমাদের সমাজে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার ধারণা এমনভাবে গঠিত হয়েছে, যেখানে পরিবার মানেই নেতৃত্বের বৈধতা; রক্তের সম্পর্ক মানেই অধিকার। এসব ধারণা এখনো আমাদের সমাজের প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।অন্যদিকে সোশ্যাল ক্যাপিটাল হলো এমন একধরনের শক্তি, যা আমরা সামাজিক সম্পর্ক, পরিচিতি ও যোগাযোগের মাধ্যমে অর্জন করি। ‘মাইগ্রেশন এজ আ লিভিংহুড স্ট্র্যাটেজি অব দ্য পুওর’ গবেষণায় এ ধারণা ব্যবহার করেছেন অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি দেখিয়েছেন, বিদেশে থাকা আত্মীয়ের মাধ্যমে অনেকেই সহজে অভিবাসন করতে পারে, যেটা অন্যদের পক্ষে সম্ভব নয়।
তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কীভাবে একটি পরিবার অভিবাসনের অভিজ্ঞতা, যোগাযোগ আর মানসিকতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তর করে। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, পরিবারে কীভাবে হ্যাবিটাস ও সোশ্যাল ক্যাপিটাল একসঙ্গে কাজ করে।
‘ইয়ুথ, পভার্টি অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট’ গবেষণায় প্রায় একই রকমই ব্যাখ্যা দিয়েছেন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেছেন, অনেক তরুণের চাকরি পাওয়া বা সুযোগ তৈরি হওয়া নির্ভর করে কে তার চাচা বা মামা, অর্থাৎ তার পরিচিতি বা সম্পর্ক কেমন, সে বিষয়ের ওপর। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটাই সোশ্যাল ক্যাপিটালের একটি বাস্তব রূপ।
বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে রাষ্ট্র নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ, সেখানে পরিবারই হয়ে ওঠে নিরাপত্তা, উপায় ও স্বীকৃতির প্রধান উৎস। এই পারিবারিক অভ্যাস ও সম্পর্কের শক্তি যখন রাজনীতির ভেতর ঢুকে পড়ে, তখন সেটাকে অভিহিত করা হয় ‘পরিবারতন্ত্র’ বলে।
রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রকে শুধু কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের সমস্যা বললে ভুল হবে। এটি আমাদের সামাজিক কাঠামোরই একটি বহিঃপ্রকাশ, যেখানে মানুষ পরিবারকে জীবনের ভরসা হিসেবে দেখে এবং সেই ভরসা পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
রাজনীতির বাইরেও পরিবারতন্ত্রপারিবারিক প্রভাব বা ‘আধিপত্য’ কেবল রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে সীমাবদ্ধ থাকে না; বাংলাদেশে ব্যবসা, শিক্ষা ও উন্নয়ন খাতেও এর স্পষ্ট প্রভাব দেখা যায়। অনেক এনজিও (বেসরকারি সংস্থা), এমনকি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হয় পরিবারভিত্তিক বোর্ড দ্বারা, যেখানে সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের সদস্যরাই।
এসব ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত দক্ষতার চেয়ে সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে যোগ্যতা নয়, আত্মীয়তাই হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মূল মাপকাঠি। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেও একই প্রবণতা লক্ষণীয়; পারিবারিক মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোয় পেশাদার ব্যবস্থাপনার চেয়ে পরিবারভিত্তিক সিদ্ধান্ত বেশি গুরুত্ব পায়।
বাংলাদেশে পরিবারতন্ত্রের গভীর শিকড় কেবল রাজনীতি বা অর্থনীতিতে নয়, এটি আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় চর্চার মধ্যেও গেঁথে আছে। উপমহাদেশের সুলতানি, মোগল বা নবাবি আমলে নেতৃত্ব ছিল সম্পূর্ণরূপে বংশানুক্রমিক ও পরিবারকেন্দ্রিক। সেই আমলে শাসকের সন্তান বা আত্মীয়রাই নেতৃত্বে আসার অধিকার দাবি করতেন।
এ ধরনের শাসনব্যবস্থা আমাদের সমাজে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার ধারণাকে এমনভাবে গঠন করেছে, যেখানে পরিবার মানেই নেতৃত্বের বৈধতা; রক্তের সম্পর্ক মানেই অধিকার। এসব ধারণা এখনো আমাদের সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে।
এ মনস্তত্ত্ব ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক চর্চার ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আমাদের দেশে বহু স্থানে পীর-মাজার সংস্কৃতি প্রচলিত। এসব ক্ষেত্রে একজন পীরের মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে বা পরিবারের সদস্যরাই পীরের আসনে বসেন এবং অনুসারীরা তা মেনে নেন।
এগুলো কোনো ধর্মীয় বিধান নয়, বরং একটি সামাজিক রীতি বা সাংস্কৃতিক অনুশীলন যা আমাদের পরিবারকেন্দ্রিক নেতৃত্বের মানসিকতা ও স্বীকৃতির দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় বহন করে। এমন রীতি বা চর্চা সমাজে দীর্ঘদিন চলতে থাকলে সেটি সাংস্কৃতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম তা অবলম্বন করে। এটি প্রমাণ করে যে আমাদের মানসিক গঠন এমনভাবে তৈরি হয়েছে, যেখানে নেতৃত্ব মানেই পারিবারিক উত্তরাধিকার।
আরও পড়ুনক্ষমতাপ্রত্যাশীরা নতুন প্রতিদ্বন্দ্বী দেখতে চায় না২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫পরিবারতন্ত্র: একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতাপরিবারতন্ত্র কেবল দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সমস্যা নয়; বরং এটি একটি বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতা, যা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান। যদিও এর রূপ, পরিসর ও প্রভাব দেশের সামাজিক কাঠামো, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে, তবু সামগ্রিকভাবে দেখা যায়, রাজনৈতিক পরিবারগুলোর ক্ষমতায় থাকার প্রবণতা অনেক দেশের রাজনৈতিক জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বুশ, কেনেডি ও ক্লিনটন পরিবারের মতো প্রভাবশালী পরিবারগুলো দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতির মূল স্রোতে সক্রিয়। এমনকি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছেলে ব্যারন ট্রাম্পকে সম্প্রতি রিপাবলিকান পার্টির জাতীয় সম্মেলনের জন্য প্রতিনিধি হিসেবে বাছাই করা হয়েছিল, যদিও পরে তিনি নিজেই সরে দাঁড়ান। অনেকের মতে, তাঁকে ভবিষ্যতে বড় কোনো রাজনৈতিক দায়িত্বের জন্য তৈরি করা হতে পারে।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো তাঁর বাবা পিয়েরে ট্রুডোর রাজনৈতিক উত্তরসূরি হিসেবে দেশ পরিচালনা করেছেন। ইউরোপের দেশ বেলজিয়ামের রাজনীতিতেও পরিবারতন্ত্রের উপস্থিতি দেখা যায়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সংসদ সদস্যদের প্রায় ১০ শতাংশের বাবা বা মা আগে সংসদ সদস্য ছিলেন। এটা ‘রাজনৈতিক উত্তরাধিকার’ ধারণার প্রমাণ বহন করে। যদিও ইউরোপে এ ধরনের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম, তারপরও এটি একেবারে অনুপস্থিত নয় (দ্য ব্রাসেলস টাইমস, ২০২০)।
জাপানে পরিবারতন্ত্রের একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ রয়েছে। এখানে রাজনৈতিক পরিবারগুলো ‘জিবান’ (স্থানীয় ভিত্তি), ‘কানবান’ (পরিবারের নাম ও খ্যাতি) এবং ‘কাবান’ (অর্থনৈতিক সহায়তা) নামের তিনটি মূলধনের ওপর নির্ভর করে। জাপানের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের প্রায় ৩০ শতাংশ সদস্যই উত্তরাধিকারসূত্রে রাজনীতিতে এসেছেন; আর শাসক দল এলডিপির প্রায় ৪০ শতাংশ সদস্যই কোনো না কোনো রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান (দ্য ডিপ্লোম্যাট, ২০১৭ এবং ইস্ট এশিয়া ফোরাম, ২০২৩)।
লক্ষণীয় হলো, এসব দেশ শক্তিশালী নির্বাচনব্যবস্থা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সক্রিয় নাগরিক সমাজ এ ধরনের পরিবারতান্ত্রিক প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণে রাখে; পরিবারতন্ত্র থাকলেও সেটি একচ্ছত্র ক্ষমতায় রূপ নেয় না।
আমার এই লেখার মূল বক্তব্য হচ্ছে, পরিবারতন্ত্র শুধু একটা দলের সমস্যা নয়, এটা আমাদের সমাজের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক বাস্তবতার অংশ। প্রয়াত ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন একাধিক টক শো ও পত্রিকায় বলেছিলেন, পারিবারিক রাজনীতি আসলে আমাদের সমাজের রাজনৈতিক দলবদ্ধতার প্রতিচ্ছবি। তাঁর মতে, যদি জনগণ একে মেনে নেয়, তাহলে সেটাও একধরণের গণতন্ত্রের প্রকাশ হতে পারে (চ্যানেল আই টক শো)।
অন্যদিকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রীয়াজ বাংলাদেশ: আ পলিটিক্যাল হিস্ট্রি সিন্স ইনডিপেনডেন্স বইয়ে দেখিয়েছেন, কীভাবে ব্যক্তি ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি ধীরে ধীরে গণতন্ত্রকে ক্ষয় করে। তিনি এটাও বলেছেন, এ সমস্যা আসলে সমাজ থেকেই আসে; দলীয় আনুগত্য, পৃষ্ঠপোষকতা ও নেতাকে নিয়ে ‘নায়কতান্ত্রিক’ সংস্কৃতিই এর মূল শিকড়।
দ্য পলিটিকস অব দ্য গভর্নড বইয়ে ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক পার্থ চ্যাটার্জি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে জনগণ অনেক সময় নেতাকে পরিবারের একজন বড় মানুষের মতো ভাবেন, যিনি সুরক্ষা দেন, সিদ্ধান্ত নেন এবং যাঁর প্রতি ভক্তি তৈরি হয়। ফলে নেতৃত্বের ক্ষেত্রে যোগ্যতা নয়, সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় প্রধান মানদণ্ড।
এ রকম বাস্তবতায় ‘রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র নিপাত যাক’ কেবল একটি স্লোগান হয়েই থাকবে, যদি না আমরা বুঝতে পারি এটি একটি গভীর সাংস্কৃতিক ও কাঠামোগত বাস্তবতার প্রতিফলন। তবে এর মানে এই নয় যে কোনো রাজনৈতিক পরিবার থেকে কেউ রাজনীতিতে এলে তাঁকে অগ্রাহ্য করতে হবে।
বরং প্রশ্ন হওয়া উচিত, সেই ব্যক্তি কি যোগ্য? তিনি কি সংগঠক হিসেবে দক্ষ? জনগণ কি তার ওপর আস্থা রাখে? যদি এসব প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হয়, তবে তাঁকে বাধা না দিয়ে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া উচিত কাঠামোগত পরিবর্তনের দিকে; যেখানে থাকবে জবাবদিহি, অংশগ্রহণ ও কার্যকর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।
পরিবারতন্ত্রকে শুধু ক্ষমতাধর পরিবারের সমস্যা হিসেবে না দেখে সমাজকাঠামোর অন্তর্নিহিত রূপ হিসেবে বোঝা জরুরি। কেবল স্লোগান, ক্ষোভ, আবেগ কিংবা বাইরে থেকে চাপিয়ে দেওয়া ব্যবস্থার মাধ্যমে কোনো পরিবর্তন আসবে না। পরিবর্তন আসতে পারে শিক্ষা, বিকল্প নেতৃত্ব তৈরি, সামাজিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও নাগরিক সচেতনতার মধ্য দিয়ে; ধাপে ধাপে, ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে এগুলো করতে হবে।
●মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়