জুলাই আন্দোলনে আহতরা রাজধানীর শ্যামলী সড়ক ছেড়ে দিয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় অভিমুখে যাত্রা করেছেন। রোববার সন্ধ্যা ৬টার দিকে আগারগাঁও ও শ্যামলী সড়ক ছেড়ে দেন তারা। এরপর ৭টার দিকে আগারগাঁও হাসপাতাল এলাকা থেকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় অভিমুখে রওনা দেন তারা। 

এর আগে শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় আগারগাঁও জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের (নিটোর বা পঙ্গু হাসপাতাল) এবং জাতীয় চক্ষু ইনস্টিটিউট হাসপাতালের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন আহতরা। সেখানে সারা রাত থেকে পরে রোববার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শ্যামলী মিরপুর রোড অবরোধ করে স্বীকৃতি ও পুনর্বাসনের দাবি জানান জুলাই আন্দোলনে আহতরা।

জুলাই আন্দোলনে আহতরা বলেন, আমাদের ন্যায্য দাবিতে গত ২৪ ঘণ্টা ধরে রাস্তায় আন্দোলন করছি। আমরা অসুস্থ মানুষ, তবুও রাস্তায় নেমে নিজেদের অধিকারের জন্য সরকারের কাছে আকুতি-মিনতি করতে হচ্ছে। এরপরও সরকারের কাছ থেকে কোনও সাড়া পাচ্ছি না। সড়ক অবরোধ করায় অনেক সাধারণ মানুষের ভোগান্তি এবং ক্ষতি হচ্ছে। এমনটা বিবেচনায় আমরা সড়ক ছেড়ে দিয়েছি। এখন সরকার থেকে আমাদের যে ম্যাজেমেন্ট ইনফরমেশন সার্ভিস (এমআইএস) বা যাচাই-বাছাই সার্টিফিকেট কপি দেয়া হয়েছে, সেটা নিয়ে আমরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে যাচ্ছি। সেখানে আমরা একটা ফায়সালা চাই।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ল ই গণহত য আহত

এছাড়াও পড়ুন:

গণঅভ্যুত্থানকারীদের বিক্ষোভ ও সরকারের মনোযোগ

আড়াই মাসের ব্যবধানে আবারও রাজপথে নেমেছেন জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহতরা। সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে শনিবার আগারগাঁওয়ের জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল প্রাঙ্গণ থেকে দ্বিতীয় দফায় আন্দোলন শুরু করেন তারা। রোববার মধ্যরাতে তারা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নেন। পত্রিকার খবর, ‘দায়িত্বরত সেনাসদস্যরা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনিও তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেন (সমকাল, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।

এর আগে ১৩ নভেম্বর আহত ব্যক্তিদের দেখতে পঙ্গু হাসপাতালে যান স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম। সবার সঙ্গে দেখা করেননি– এ অভিযোগে তাঁর গাড়ি আটকে আহত ব্যক্তিরা বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেন। সেদিন গভীর রাতে সরকারের চার উপদেষ্টা ও একজন বিশেষ সহকারী সেখানে গিয়ে আহতদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের হাসপাতালে ফিরিয়ে নেন। পরদিন সচিবালয়ে এক বৈঠকে আহতদের সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের আশ্বাস দেয় সরকার। সেই ঘটনার আড়াই মাস পর আবারও মধ্যরাতে আহত ব্যক্তিদের বিক্ষোভ। অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গিয়ে দাবি জানিয়েছেন, ৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সরকার বৈঠক না করলে তারা রাজপথে অবস্থান ও অনশন কর্মসূচি দেবেন। শহীদ পরিবারগুলোর কোনো খোঁজ সরকার নিচ্ছে না বলেই তারা আন্দোলনের ঘোষণা দিতে যাচ্ছেন। 

বলা যায়, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবারের সদস্যরা ও আহত ব্যক্তিরা সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ। কেন হচ্ছে এই ঘটনা? যে মানুষগুলোর অসীম সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে জাতির কাঁধ থেকে নেমে যেতে বাধ্য হলো দমবন্ধ করা স্বৈরাচারী শাসন; যাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে স্বয়ং অন্তর্বর্তী সরকার; সেইসব হতাহতের প্রতি দায়িত্ব পালনে সরকার কেন ব্যর্থ হচ্ছে?
যমুনার সামনে বিক্ষোভরত আহত ব্যক্তিদের শান্ত করতে গিয়ে হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘আহতদের সুচিকিৎসা দিতে পারে নাই, এটা সরকারের ব্যর্থতা। এ জন্য সরকারের আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি দায়ী, সচিবরা দায়ী, আমলারা দায়ী। যারা আহত হয়েছেন, তাদের আমরা সুচিকিৎসা দিতে পারি নাই, এ জন্য আমি নিজে ব্যথিত’ (সমকাল, ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
মধ্যরাতে হাসনাত যখন এ কথা বলছেন, রোববারই দিনের বেলা অবশ্য স্বাস্থ্য উপদেষ্টা সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা এ পর্যন্ত ৩০ জনকে সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছেন। আহতদের চিকিৎসায় বিদেশি চিকিৎসকও আনা হয়েছে। বিদেশে চিকিৎসায় এ পর্যন্ত ১৬ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। আরও খরচ হবে।

১৬ কোটি টাকা! গণঅভ্যুত্থানে প্রায় ৩০ হাজার গুরুতর আহতের চিকিৎসায় এই টাকার হিসাব জানানো চোখে লাগে– মাননীয় উপদেষ্টা। তা-ও ঘটনার ছয় মাস পর। এ পর্যন্ত অনেক কথা আমরা শুনেছি। জুলাই ফাউন্ডেশন, শতকোটি টাকার ফান্ড গঠিত হচ্ছে মর্মে সংবাদও জেনেছি; কিন্তু প্রকৃত তহবিলের অবস্থা আমরা জানতে পারি না। মাঝখান দিয়ে জুলাই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম পদত্যাগ করে জানিয়েছেন, অন্যত্র ব্যস্ত থাকায় এই দায়িত্ব পালন সম্ভব হচ্ছে না। 
শহীদ পরিবারের সদস্যদের আর্থিক বিপর্যস্ততার বিবরণ আমরা জেনেছি পত্রিকার পাতা থেকে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে রেখে পিতার অকালপ্রয়াণ, স্ত্রী পথে বসেছেন; তাদের দেখবার কেউ নেই। তারা প্রেস ক্লাবে কেঁদে কেঁদে সাহায্য চাইছেন, গণতন্ত্র অভিমুখী দেশের কাছে এই তাদের প্রাপ্য? হায়! 

২.
না, ঘটনাটিকে সরলভাবে দেখবার কোনো উপায় নেই। সরকারকে নানা পক্ষ থেকে উপর্যুপরি আন্দোলনের চাপে রাখা হচ্ছে, এটি সত্য। এ-ও সত্য, যে ভঙ্গুর অর্থনীতি সরকারের কাঁধে রেখে আওয়ামী লীগ দেশ ছেড়েছে, তার সমাধান সত্যিই কঠিন। রয়েছে গণতন্ত্রের জন্য বহু প্রত্যাশা ও চাপ। সরকার ১১টি কমিটি তৈরি করে সংস্কার কর্মসূচির কাজ পরিচালনা করছে। দেশের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা শোচনীয়।
এসবই বাস্তবতা। সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু গত পনের বছরের দুঃশাসন ও হিংস্রতার অবসান করলেন যারা, তারা কেন অগ্রাধিকার পেলেন না– এটা প্রশ্ন ও উদ্বেগ অবশ্যই তৈরি করে। আমরা বুঝতে পারি, সরকারের কাজে পরিকল্পনা ও শৃঙ্খলার অভাব রয়েছে। সকল শহীদ ও আহত ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ডেটাও এখন পর্যন্ত সরকার তৈরি করতে পারেনি। এটি অমার্জনীয় ব্যর্থতা। জানা যায়, গণঅভ্যুত্থানে ১৫৫৮ জন শহীদ ও ৩০ হাজার আহত ব্যক্তি– সরকারের পক্ষে এর পুরো তালিকা তৈরি খুব কঠিন কাজ? আহত ব্যক্তিরা কে কোথায় চিকিৎসাধীন, কার পুনর্বাসনে কত লাগবে– এটি যেমন সহজেই বের করা সম্ভব; একইভাবে সম্ভব শহীদ পরিবারের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সংগ্রহ করে পুনর্বাসন কার্যক্রম শুরু। পারিবারিক রেশন, সঞ্চয়পত্র সুবিধা, প্রয়োজনে চাকরির ব্যবস্থা; সরকারের একটি সেল– সব মিলিয়ে ৫০ হাজারের মতো মানুষের জন্য শৃঙ্খলা মেনে ব্যবস্থা করতে পারছে না। এটা বিস্ময়কর। একই সঙ্গে দুঃখদায়ী ও উদ্বেগজনক।

৩.
এই নিষ্ক্রিয়-নির্লিপ্ততা ও ব্যর্থতায় বোঝা যায়, সরকার তার কাজে অগ্রাধিকার সাব্যস্ত করতে পারছে না। কোনো কোনো উপদেষ্টা ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতি নিয়ে দেশের বিগত সরকারের মন্ত্রীদের মতো প্রচুর কথা বলছেন। কাজের পরিধি অপরিসীম করতে নেই। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক না করতে পারলে অভীষ্টে পৌঁছানো কঠিন। 

অবশ্যই দেশের গণতন্ত্র সংহত ও অবারিত করতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু তা বাস্তবসম্মত ও যথোপযুক্ত হতে হবে। ৩০০ আসনের সংসদকে ৫০০ আসনে পুনর্বিন্যস্ত করে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করবার পরামর্শ দিচ্ছেন অনেকে। দেশের পর্যুদস্ত অর্থনীতিতে আরও ২০০ এমপির বিলাসী জীবনের ব্যয়ভার নিরীহ জনগণের কাঁধেই চাপবে। এই উচ্চাভিলাষ আপাতত স্থগিত রেখে প্রচলিত নির্বাচনী কাঠামোয় কোন প্রক্রিয়ায় যে কোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নিতে পারেন, তার বিহিত জরুরি। নির্বাচন মানেই টাকার খেলা– এটি যে কোনো মূল্যে বন্ধ রেখে, যারা এ কাজ করবে তাদের জন্য যথাযথ কঠিন শাস্তির আইন প্রয়োগ করে, সকলের জন্য নির্বাচনকে অবারিত করতে হবে। দেশকে চার প্রদেশে বিভক্ত করে ক্ষমতার যে বিকেন্দ্রীকরণের চিন্তা করা হচ্ছে, সেটিও একই রকম উচ্চাভিলাষ ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণই হবে। যে বিভাগগুলো করা হয়েছে, তা কতটা কার্যকর হয়েছে, সেদিকে তাকালেই বোঝা যায়; আমলারা খরচ বাড়ানোর জন্য নিত্য রাস্তা বের করেন!

গণঅভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রত্যাশিত সহায়তা পাচ্ছেন না বলে অনেকে বলছেন। সরকারকে আমলা-নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে দ্রুত পদেক্ষপ নিতে হবে। নতুন সময় ও নতুন বাস্তবতাকে সবার আগে প্রাধান্য দিতে হবে। সরকারের গন্তব্যও সুনির্দিষ্ট করতে হবে। যতটুকু সময় সামনে আছে, তার পুরো সদ্ব্যবহার করে দেশের গণতান্ত্রিক ও আইনি কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এই মস্ত আয়োজনের মূল যে যোদ্ধা– গণঅভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে সহযোগিতা ও পুনর্বাসনের স্থায়ী ব্যবস্থা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। গণঅভ্যুত্থানের রক্তাক্ত স্মৃতির প্রতি জাতীয় কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে দ্রুত এটি বাস্তবায়নের বিকল্প নেই। মধ্যরাতে আহতদের বিক্ষোভে উত্তপ্ত রাজপথ ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন– গণঅভ্যুত্থানের মাত্র ছয় মাসের মাথায় এই ঘটনা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
 
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গণঅভ্যুত্থানকারীদের বিক্ষোভ ও সরকারের মনোযোগ
  • ন্যূনতম সংস্কার ছাড়া ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি হবে না: জামায়াত আমির
  • ভোটাধিকার হারিয়ে যাওয়ার কারণেই গণঅভ্যুত্থানের অবতারণা: ইসি সানাউল্লাহ
  • দাবি পূরণের আশ্বাসে গভীর রাতে যমুনা থেকে সরলেন আহতরা
  • দাবি পূরণের আশ্বাস পেয়ে যমুনা থেকে সরলেন আহতরা
  • আহতদের সুচিকিৎসা দিতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা: হাসনাত আবদুল্লাহ
  • ব্যারিকেড ভেঙে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে জুলাইয়ের আহতদের অবস্থান
  • পুলিশের বাধার মুখে আবারও সড়কে অবস্থান গণঅভ্যুত্থানে আহতদের
  • সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত আহত আন্দোলনকারীদের আল্টিমেটাম