জানুয়ারিতে এল ২১৮ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স
Published: 2nd, February 2025 GMT
চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ২১৮ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। আগের বছরের একই মাসের তুলনায় যা ৭ কোটি ২০ লাখ বা ৩ দশমিক ৪০ শতাংশ বেশি। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে বেশি এসেছে ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। রেমিট্যান্সের পাশাপাশি রপ্তানিতে ভালো প্রবৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার কিছুটা স্বস্তিতে রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। আবার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আগের মতো না কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের আশপাশে রয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই–জানুয়ারি সময়ে প্রবাসীরা এক হাজার ৫৯৬ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল এক হাজার ২৯১ কোটি ডলার। এই হিসেবে প্রথম ৭ মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৩০৫ কোটি ডলার বা ২৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। এর আগের মাস গত ডিসেম্বরে কোনো একক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল। ডিসেম্বরে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ ছিল ২৬৪ কোটি ডলার। এর আগে কোনো একক মাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স এসেছিল করোনার মধ্যে ২০২০ সালের জুলাইতে। ওই মাসে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল ২৬০ কোটি ডলার। মূলত বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে ওই সময়ে হুন্ডি চাহিদা তলানিতে নামায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স বাড়ছিল।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকার পতনের পর থেকে রেমিট্যান্সসহ বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বৃদ্ধির প্রধান কারণ হুন্ডি চাহিদা কমেছে। বাণিজ্যের আড়ালে কিম্বা দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ যারা দেশের বাইরে পাঠাতো তাদের বেশিরভাগই এখন দৌড়ের ওপরে আছে। ভোগ্যপণ্যসহ বিভিন্ন আমদানিতে কম মূল্য দেখিয়ে এলসি খোলার প্রবণতা কমেছে। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে অর্থ পাচারে কড়াকড়ি করছে সরকার। আবার ঋণ জালিয়াতি, রাজস্ব ফাঁকি, অর্থপাচারসহ বিভিন্ন অনিয়মে অভিযুক্ত ১০টি গ্রুপের অনিয়ম তদন্তে যৌথ টিম কাজ করছে। নতুন করে পাচারের সুযোগ তো দূরে থাক, উল্টো আগে পাচার করা অর্থ দেশে আনার চেষ্টা চলছে। এসব কারণে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত ৫ মাসে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ১৩ শতাংশ।
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
গ্যাসে দুই দফা ভ্যাট, পেট্রোবাংলার বকেয়া ১৮ হাজার কোটি টাকা
টাকার অভাবে গ্যাস সরবরাহের বিল নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। অথচ একই গ্যাসে পেট্রোবাংলার কাছ থেকে দুবার শুল্ক-কর নিচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এতে এনবিআরের কাছে বকেয়া বাড়ছে সংস্থাটির। লোকসান ঠেকাতে এখন আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও কর প্রত্যাহার চায় তারা।
আর্থিক ঘাটতি কমাতে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে পেট্রোবাংলা। এটি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। প্রস্তাব অনুসারে দাম বাড়ানো হলে তিন হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় হবে পেট্রোবাংলার। অথচ আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট-কর প্রত্যাহার হলে ৭ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারে পেট্রোবাংলা। প্রতি ইউনিট গ্যাসের আমদানি মূল্য ১৪ ডলার এবং প্রতি ডলার ১২৩ টাকা ধরে বছরে ১০০ কার্গো (জাহাজ) আমদানির বিপরীতে এ পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হিসাব করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা।
পেট্রোবাংলা বলছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির সময় তাদের ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ অগ্রিম কর দিতে হয়। অন্যদিকে গ্রাহক পর্যায়ে বিক্রির সময় ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ২ শতাংশ উৎসে কর দিতে হচ্ছে। এর বাইরে পেট্রোবাংলাকে এলএনজি মার্জিনের বিল পরিশোধের সময় গ্যাস বিতরণ সংস্থার কাছ থেকে ৫ শতাংশ উৎসে কর কাটা হচ্ছে। এভাবে বাড়তি রাজস্ব আদায় করে পেট্রোবাংলাকে আবার ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। যদিও শুধু আমদানি পর্যায়ে ১৭ শতাংশ ভ্যাট ও কর প্রত্যাহার করা হলে ভর্তুকির তেমন প্রয়োজন হবে না পেট্রোবাংলার।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ও কর বাবদ পেট্রোবাংলার কাছে এনবিআরের বকেয়া পাওনা জমেছে ১৭ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। এলএনজি কিনতে সরকারের কাছ থেকে পেট্রোবাংলাকে নিয়মিত ভর্তুকি নিতে হচ্ছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে পেট্রোবাংলার জন্য ভর্তুকি বরাদ্দ আছে ছয় হাজার কোটি টাকা। চাহিদামতো এলএনজি আমদানি করা হলে ভর্তুকি লাগবে দ্বিগুণের বেশি। অথচ মাত্র ৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়িয়েছে জ্বালানি বিভাগ। বর্তমানে এলএনজির বিল ছাড়া অন্য কোনো দায় পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না; কিন্তু এনবিআরের কাছে বিপুল দেনা বকেয়া থাকায় এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে পেট্রোবাংলা তথা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
পেট্রোবাংলার একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বকেয়ার কারণে আস্থা হারাচ্ছে এলএনজি সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানি। তারা দরপত্রে এখন বাড়তি দাম প্রস্তাব করছে। বাজারের চেয়ে বেশি দাম প্রস্তাব করায় একাধিক দরপত্র বাতিল করতে হয়েছে। ভ্যাট প্রত্যাহার করা না হলে ভর্তুকি বাড়াতে হবে। এ ছাড়া চাহিদামতো এলএনজি আমদানি করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হবে, লোডশেডিং বাড়বে।
পেট্রোবাংলা বলছে, আমদানি করা পণ্যে সাধারণত দুই পর্যায়ে ভ্যাট নেয় এনবিআর; কিন্তু পণ্যের দাম পরিবর্তিত হয়, মানে ভ্যালু অ্যাডিশন (মূল্য সংযোজন) হয়। যে টাকায় আমদানি করা হয়, তার চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হয় গ্রাহকের কাছে। গ্যাসের ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টো। বেশি দামে আমদানি করে কম দামে বিক্রি করতে হয়। তাই দুই পর্যায়ে ভ্যাট ও তিন পর্যায়ে আয়কর পরিশোধ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমদানি পর্যায়ে কমানো হলেও গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাস বিক্রি থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব পাবে এনবিআর।
এলএনজির ভ্যাট নিয়ে শিগগিরই এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এরপর এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, উপদেষ্টা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়সূত্র জানিয়েছে, আমদানি পর্যায়ে ভ্যাট ও কর প্রত্যাহার নিয়ে এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করেছে পেট্রোবাংলা। এনবিআর আপত্তি না করলেও এটি বাতিলে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এরপর জ্বালানি বিভাগের সঙ্গেও আলোচনা করেছে পেট্রোবাংলা। প্রত্যাহার চাওয়ার সিদ্ধান্ত নীতিগতভাবে অনুমোদন করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা। এরপর গত মাসে এনবিআরের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছে পেট্রোবাংলা। ৯ মার্চ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টার সঙ্গে এনবিআরের একটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, এলএনজির ভ্যাট নিয়ে শিগগিরই এনবিআরের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। এরপর এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
২০১৮ সাল থেকে এলএনজি আমদানি করে সরকার। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীন কাতার ও ওমান থেকে নিয়মিত এলএনজি কেনা হয়। এর বাইরে চাহিদা অনুসারে খোলাবাজার থেকেও এলএনজি আমদানি করা হয়। উচ্চ দামে এলএনজি কিনে দেশে উৎপাদিত গ্যাসের সঙ্গে মিশ্রণ করে আট শ্রেণির ভোক্তার কাছে সরবরাহ করা হয়। দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমতে থাকায় এলএনজি আমদানি বাড়াতে হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম ঊর্ধ্বমুখী। আবার ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হচ্ছে নিয়মিত। এতে পেট্রোবাংলার খরচ বাড়ছে।
বর্তমানে প্রতি ইউনিট গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলার খরচ হচ্ছে ২৯ টাকা ৩৯ পয়সা। আর তারা এটি বিক্রি করে পাচ্ছে ২২ টাকা ৮৭ পয়সা। সে জন্য লোকসান মেটাতে প্রতিবছর সরকারের কাছ থেকে ভর্তুকি নেয় তারা। ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ হাজার কোটি, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ হাজার ৩৩২ কোটি ও সর্বশেষ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৬ হাজার ৩৫ কোটি টাকা ভর্তুকি নিয়েছে তারা। তবে চলতি ২০২৪–২৫ অর্থবছরে ভর্তুকির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। তাই খরচ কমাতে নানা উপায় খুঁজছে পেট্রোবাংলা। এলএনজি আমদানির লক্ষ্যমাত্রাও কমিয়ে আনা হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, শুধু এলএনজি নয়, অন্য পেট্রোলিয়াম পণ্যের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। এনবিআর রাজস্ব আয়ের সহজ সুযোগ হারাতে চায় না। ভর্তুকি ও বাড়তি দামের ক্ষতিকর দিকটি তাদের বিবেচনার বিষয় নয়; কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় এটি বিবেচনা করতে পারে। বিভিন্ন পর্যায়ে ভ্যাট আরোপের দায় উচ্চমূল্যে জ্বালানি কিনে ভোক্তাকে শোধ করতে হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলটরি কমিশনের (বিইআরসি) মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় ভ্যাট প্রত্যাহার করে জ্বালানির মূল্য সমন্বয়ের সূত্র তৈরি করা উচিত।