দুর্নী‌তির মাধ‌্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও ব্যাংকে অস্বাভা‌বিক লেন‌দেনের অভিযোগে ফেঁসে যা‌চ্ছেন আওয়ামী লী‌গের প্রেসি‌ডিয়াম সদস‌্য, সা‌বেক মন্ত্রী শাজাহান খান, তার স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগম, ছে‌লে আসিবুর রহমান ও ঐশী খান। অভিযোগের সত‌্যতা পে‌য়ে শাজাহান খান, তার স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগম, ছে‌লে আসিবুর রহমান‌কে পৃথক তিন‌টি মামলার সিদ্ধান্ত ‌নি‌য়ে‌ছে দুর্নী‌তি দমন ক‌মিশন। একই অভিযোগে শাজাহান খানের, তার স্ত্রী ঐশী খানের সম্প‌দের হিসাব বিবরণী চে‌য়ে নো‌টিশ দে‌বে সংস্থা‌টি।

রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) দুদ‌কের মহাপ‌রিচালক আক্তার হো‌সেন এ তথ‌্য জানান।

দুদক জানায়, সা‌বেকমন্ত্রী শাজাহান খান, পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক অসৎ উদ্দেশ্যে অসাধু উপায়ে অর্জিত জ্ঞাত আয়ের উৎসের সাথে সঙ্গতিবিহীন ১১,৩৬,৫১,৫৫৫ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জনপূর্বক দখলে রেখে এবং তার নামে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খুলে উক্ত প্রতিষ্ঠান এবং নিজ নামে মোট ৯টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে সন্দেহজনকভাবে ৮৬, ৬৯,৩২,৭৬৯ টাকা লেনদেন করায় তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা; মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায় একটি মামলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

আরো পড়ুন:

সাতক্ষীরার সাবেক সিভিল সার্জনসহ ২ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

সাবেক এমপি ধীরেন্দ্র দেবনাথ ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

শাজাহান খানের স্ত্রী সৈয়দা রোকেয়া বেগম, স্বামীর ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরস্পর যোগসাজসে ৪,৪৭,১৯,৮৪৬ টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জনপূর্বক দখলে রাখায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা তৎসহ দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় পৃথক একটি মামলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মামলায় শাজাহান খানকেও আসা‌মি করা হ‌চ্ছে।

শাজাহান খানের ছে‌লে আসিবুর রহমান তার পিতা শাজাহান খান পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরস্পর যোগসাজসে ৯,৮৯,০৬,০৬৫ টাকা মূল্যের জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের মালিকানা অর্জন ও দখলে রাখায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারা, দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারা তৎসহ দণ্ডবিধি ১০৯ ধারায় ধারায় পৃথক একটি মামলা রুজুর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। মামলায় শাজাহান খানকেও আসা‌মি করা হ‌চ্ছে।

অন‌্যদি‌কে, শাজাহান খানের মে‌য়ে ঐশী খানের বিরু‌দ্ধেও অবৈধ সম্প‌দ অর্জ‌নের অভিযোগ র‌য়ে‌ছে। দুদ‌কের অনুসন্ধা‌নে তার জ্ঞাত আয়ের উৎস বর্হিভূত ১,৭১,১৮,০৯২ টাকার সম্পদের মালিকানা অর্জন এবং তার নামে ও বেনামে আরো সম্পদ থাকার তথ‌্য পে‌য়ে তা‌কে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৬(১) ধারা অনুযায়ী সম্পদ বিবরণী দাখিলের আদেশ জারির সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/এসবি

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ঞ ত আয় ত হয় ছ দমন ক

এছাড়াও পড়ুন:

স্বর্ণকুমারী দেবীর কাহাকে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা

স্বর্ণকুমারী দেবী আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী ঔপন্যাসিক। তার জন্ম জোড়াসাঁকো ঠাকুর পরিবারে ২৮ অগাস্ট, ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে। বাঙালির আধুনিক সমাজ বিনির্মাণের পুরোধা ঠাকুর পরিবারের রীতি অনুযায়ী তিনি নারী মহলের গৃহশিক্ষক অযোধ্যানাথ পাকড়াশীর কাছে শিক্ষা লাভ করেন। বারো বছর বয়সে জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে বিয়ের পর তার জীবন থেকে পর্দা প্রথার অবসান ঘটে। মাত্র আটাশ বছর বয়সে তিনি ভারতী সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। ‘বালক’ নামক কিশোর পত্রিকা প্রতিষ্ঠাও তার উল্লেখযোগ্য কীর্তি। (সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম ২০০৩ : ৪২৭)। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে বিজ্ঞান আলোচনার সূত্রপাত করা, প্রথম অপেরা লেখা, বিধবা ও দরিদ্র নারীদের সাহায্যার্থে ‘সখী সমিতি’ সংগঠন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি তার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তার নবকাহিনী (১৮৭৭) বাঙালি মহিলাদের লিখিত প্রথম ছোটগল্পের বই। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেস অধিবেশনের প্রকাশ্য জনসভায় যোগদানকারী অন্যতম মহিলা তিনি। পরে কংগ্রেসের কাজে নিয়মিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। স্বদেশী দ্রব্যের প্রচারে তিনি সখী সমিতির উদ্যোগে বেথুন স্কুল ভবনে মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। স্বর্ণকুমারী দেবী রচিত প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ (১৮৭৬)। তার অন্যান্য উপন্যাস মেবার রাজ (১৮৭৭), ছিন্ন মুকুল (১৮৭৯), মালতী (১৮৮০), হুগলির ইমাম বাড়ি (১৮৮৮), বিদ্রোহ (১৮৯০), কাহাকে (১৮৯৮), বিচিত্রা (১৯২০), স্বপ্নবাণী (১৯২১) ও মিলনরাত্রি (১৯২৫)। নাটক, কবিতা ও সঙ্গীত রচনাতেও তিনি প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন। ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণের ফলেই তার এই সর্বব্যাপ্ত প্রতিভা প্রকাশের সুযোগ পেয়েছিল বলে গবেষকদের ধারণা। অথচ এই নারী প্রতিভাকে ব্যক্তি পরিচয়ে পরিচিত না করে মুহম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান রচিত বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (আধুনিক যুগ) গ্রন্থে স্বর্ণকুমারী দেবীর পরিচিতিতে তিনি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠা ভগিনী এটিই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। (মুহম্মদ আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান ১৩৮১ বঙ্গাব্দ : ৩০২)। 

কাজী দীন মুহম্মদ তার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (৩য় খÐ)-এ স্বর্ণকুমারী দেবীর আলোচনায় তাকে রবীন্দ্রনাথের অগ্রজা বলে পরিচয় দিয়েছেন। (কাজী দীন মুহম্মদ ১৯৬৮ : ২৪৬)।  যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বেই তিনি উপন্যাস রচনা আরম্ভ করেছিলেন।

স্বর্ণকুমারী দেবী ১৩২১ বঙ্গাব্দে প্রবাসী পত্রিকার পাঠক-পাঠিকাদের বিচারে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ লেখিকা হিসেবে কামিনী রায়ের সঙ্গে যুগ্মভাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। (সুদক্ষিণা ঘোষ ২০০৮ : ৩৯)। তার সময়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র। স্বর্ণকুমারীর লেখা তার অনুজের কাছে কীভাবে গৃহীত হয়েছিল সেটি কৌতূহলের বিষয়। গবেষক সুদক্ষিণা ঘোষের মতে অগ্রজার সাহিত্যসৃষ্টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশংসা অর্জন করতে পারেনি কখনো। ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে লেখা এই চিঠিটা ছাড়াও রোটেনস্টাইনকে এক তারিখবিহীন চিঠিতে তিনি লিখেছেন—
She is one of those unfortunate beings who has more ambition than abilities. But just enough talent to keep her mediocrity alive for a short period. Her weakness has been taken advantage of buy some unscrupulous literary agents in london and she had stories translated and published. I have given her no encouragement but I have not been successful in making her see things in their proper light. (চিত্রা দেবী ১৩৯০ বঙ্গাব্দ: ৪৮)

অনুমিত হয় স্বর্ণকুমারী দেবীর কাহাকে উপন্যাসের অনুবাদ An unfinished song প্রকাশিত হবার পর রবীন্দ্রনাথের এই সমালোচনা। তবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরূপ সমালোচনা সত্তে¡ও এই গ্রন্থটি দেশি— বিদেশি পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। (সুদক্ষিণা ঘোষ ২০১৭: ৩৬-৩৭)

স্বর্ণকুমারী দেবীর প্রথম উপন্যাস দীপনির্বাণ প্রকাশিত হয় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দুর্গেশনন্দিনী (১৮৬০) প্রকাশের মাত্র ১১ বছর পর। স্বর্ণকুমারীর উপন্যাসের সবচেয়ে বড় বিষয় তিনি প্রেমকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনায় সীমাবদ্ধ থাকেননি। সম্পর্কের টানাপড়েনে তিনি জীবনের বৈচিত্র্য খুঁজে ফিরেছেন। জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা দুটোই তার উপন্যাসে সমাদৃত হয়েছে। একদিকে রক্তসম্পর্কিত ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা ও কর্তব্য, অন্য দিকে প্রণয়প্রার্থী পুরুষটিকে না পাওয়া এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে ছিন্নমুকুল উপন্যাসের নায়িকা কনক ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। হৃদয়ের রক্তক্ষরণে আহত এই নায়িকার মধ্য দিয়ে সমাজের সব নারীর অন্তর্দহনের কথা বলেছেন লেখক। 

স্নেহলতা কিংবা পালিত উপন্যাসে পুরুষের প্রেম ও প্রতারণার শিকার নারীকেই জীবনের অন্তিম পরিণতির সিদ্ধান্ত বেছে নিতে হয়েছে। বিধবা-বিবাহ কিংবা বিধবা-প্রেম এই একই ছকে বাংলা উপন্যাসে প্রসিদ্ধ উপন্যাস রয়েছে। কিন্তু নারী হিসেবে স্বর্ণকুমারী দেবীর দৃষ্টিভঙ্গির স্বাতন্ত্র্য লক্ষযোগ্য। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিষবৃক্ষ উপন্যাসে কুন্দনন্দিনীকে বিষপানে আত্মহত্যা করতে হয়েছে আর কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসে রোহিণীকে গোবিন্দলালের বন্দুকের গুলিতে প্রাণ হারাতে হয়েছে। পুরুষের পদস্খলনের মর্মান্তিক পরিণতি হলো নারীর মৃত্যু— বঙ্কিমচন্দ্র এভাবেই সমাজসত্য আর শিল্পসত্যকে পৃথক করে দিয়েছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিনোদিনী কিংবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কিরণময়ী কেউই সমাজকে অস্বীকারের স্পর্ধা দেখায়নি। যৌবনে কাশীবাসী হওয়া কিংবা মানসিক ভারসাম্য হারানো পুরুষ ঔপন্যাসিক কর্তৃক তাদের জন্য নির্ধারিত পরিণতি। ছিন্নমুকুল উপন্যাসে জগৎবাবুর বাড়িতে আশ্রিত অকাল বিধবা স্নেহলতার প্রতি জগৎবাবুর বিপত্মীক পুত্র চারুর সাময়িক আকর্ষণ ঘটে। পরে চারু নিজের ভুল বুঝতে পেরে কুমারী মেয়েকে বিয়ে করে ভুল শোধরায়। নিজেকে ত্রুটিমুক্ত প্রমাণ করতে হিন্দুধর্মের বিশুদ্ধতার বুলি আওড়ায়। পুরুষ সমাজের সুবিধাভোগী মানসিকতার সমালোচনা ও ব্যঙ্গ করে স্বর্ণকুমারী লিখেছেন :
সে (চারু) এখন ঘোরতর আর্য। [...] হিন্দুয়ানীর পক্ষে প্রবন্ধ লিখিয়া দেশের হিতসাধনে তাহার বিরাম নাই। তাহার সমস্ত প্রবন্ধেরই প্রধান মর্ম এই, বিধবাবিবাহের মতো অনার্য গর্হিত কার্য আর নাই। ইহার পক্ষে যাহার মুখ হইতে একটি বাক্য নির্গত হয়- তাহাকে সমাজচ্যুত করা উচিত। (স্বর্ণকুমারী দেবী ২০০২ : ৫৫)
চারুর সাময়িক উন্মাদনার কারণে স্নেহলতাকে আশ্রয়হীন হতে হয় আর এতে প্রধান ভূমিকা রাখে চারুর মা। চারুর সকল সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজেছেন লেখক অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার মধ্যে। 

কনক অথবা স্নেহলতা চরিত্রটি রক্তের বন্ধন কিংবা রক্ত সম্পর্কহীন বন্ধনের সংকটে আত্মঘাতী হয়েছে। বাঙালি নারীর ‘বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না।’ নারীর সহিষ্ণুতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তারা। কাহাকে উপন্যাসে মৃণালিনী ওরফে মনি তার ব্যতিক্রম, পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাধারায় এক সরব প্রতিবাদ। এই উপন্যাসের কাহিনির ছকে কোনো অভিনবত্ব নেই। মনি তার পাঠশালার সঙ্গি ছটুকে ভালোবেসেছিল। তার মুখে শোনা একটি গান মনির হৃদয়ের মনিকোঠায় সযতেœ সংরক্ষিত ছিল। যৌবনে বিলেত ফেরৎ ব্যারিস্টার রমানাথের সঙ্গে মনির আলাপ হয় তার দিদির বাড়ির টেনিস পার্টিতে। তার মুখে শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত গানটি শুনে মনি ও রমানাথের সম্পর্কের পরিণতি বিয়ের চিন্তার দিকে গড়িয়েছে। সেই সময় মনি জানতে পারে রমানাথের সঙ্গে এক বিদেশিনীর বিবাহের অঙ্গীকার ছিল। এ কারণে রমানাথকে বিয়ে করতে মনি অস্বীকার করে এবং বিলাত ফেরৎ ডাক্তার বোসের [যে মনির বাল্যকালের সঙ্গী ছোটু] সঙ্গে মনি শুভ পরিণয়ে আবদ্ধ হয়। কাহাকে উপন্যাসের গুরুত্ব উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে নয় বরং চরিত্রের প্রথাবহির্ভূত আচরণে। কাহাকের নায়িকা মনি এখানে অকপটে নিজের প্রেম ও বিয়ের উপাখ্যান বর্ণনা করেছে এবং এর মাধ্যমে ভেঙ্গে দিয়েছে লজ্জাবতী নারীর ছকটি। (হুমায়ুন আজাদ ১৯৯৩ : ২৯৭)।

সেই সময়ে একজন কুমারী নারী অভিভাবক নির্বাচিত পাত্রে সম্মতি প্রদান ব্যতীত অন্য কিছু ভাবনায় আনতে পারত না। কিন্তু স্বর্ণকুমারী উনিশ শতকের নারী মনির মাধ্যমে আধুনিকা মেয়ের স্বনির্বাচিত পাত্রে বিবাহের বাসনা দেখিয়ে পিতৃতান্ত্রিক সভ্যতার নিয়ম বহির্ভূত আচরণের দুঃসাহস দেখিয়েছিলেন। পুরুষের গড়া সতীত্বের সংস্কারে তার বিশ্বাস নেই। তাই মনি চরিত্রটি নিঃসংকোচে বলেছে, পুরুষকে সে স্বামী হিসেবে কল্পনা করে ভালোবাসে না এবং কোনো পুরুষকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে এমন নিশ্চয়তাও দিতে পারে না, যে এটি তার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা। মনি রমানাথকে বিয়ে করতে অস্বীকৃত হলে প্রথাগত সমাজের অনুসারী যারা তারা তাকে পাগল কিংবা অদ্ভুত জীব ভেবেছে। তার দিদি তাকে ভয় দেখিয়েছে ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়ে ভেঙ্গে গেলে হিন্দু মেয়ের কি পরিণতি হয় তা অবহিত করে। বিয়ের বাজারে রমানাথ উঁচু দরের পাত্র, তাই অভিভাবক ও কুমারী মেয়েদের কাছে সে আকাঙ্ক্ষিত। মনি তার সঙ্গে বিবাহে সম্মত না হলে অনেকেই তাকে স্বেচ্ছায় মেয়ে দেবে। মনির নামে মিথ্যা অপবাদ দিলে সমাজে সেই কলঙ্কিত হবে। মনি আশ্চর্য নির্লিপ্ততায় তার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে যে, পুরুষ যদি বিয়ের জন্য সতী নারী চায় তবে নারীরও অধিকার আছে একজন সৎ পুরুষ পাবার। রমানাথ যখন তাকে জানায় তাকে বিয়ে না করলে মনির অসুবিধা হবে, তখন মনিও নির্দ্বিধায় বলেছে যে সুবিধার জন্য সে বিয়ে করতে চায় না। উনিশ শতকের শেষের হলেও আগামী শতাব্দীর প্রতিনিধিত্বকারী মনি চরিত্রটি নিঃসন্দেহে রেডিক্যাল।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার অগ্রজার লেখায় পাঠক যেমন চায় তেমন Reality--র অভাব বোধ করেছিলেন। (চিত্রা দেবী ১৩৯০ বঙ্গাব্দ : ৪৮)। কাহাকে উপন্যাস প্রকাশের ৩১ বছর পর প্রকাশিত হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নব ধারার উপন্যাস শেষের কবিতা (১৯২৯)। শেষের কবিতা উপন্যাসের কাহিনির সঙ্গে কাহাকের মিল অনস্বীকার্য। বিলাত ফেরৎ ব্যারিস্টার অমিত রায় শিলং পাহাড়ে এসে লাবণ্য দেবীর প্রেমে পড়ে। প্রেমের পরিণতি বিবাহের দিন ক্ষণ স্থির হলে লাবণ্য জানতে পারে বিলাতে অমিত কেতকী নামের একটি মেয়েকে বিয়ের কথা দিয়েছিল। তাই কেতকীর আবির্ভাবে লাবণ্য সরে দাঁড়ায়। অমিত কেতকী ও লাবণ্য তার বাবার ছাত্র শোভনলালের সঙ্গে পরিণয়ে আবদ্ধ হয়।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লাবণ্য চরিত্রটিকে পাঠক প্রিয় করে তুলেছেন। লাবণ্যের বাবা অবনীশ দত্ত পশ্চিমি কলেজের অধ্যাপক। মেয়েকে প্রাচীন কালের সাহিত্য থেকে বর্তমানের বানার্ড শ’ পর্যন্ত এমনভাবে পড়িয়েছেন যেন স্বামী ভক্তির বদলে পাণ্ডিত্যের সঙ্গে তার গাঁঠছড়া বাঁধা থাকে। পিতৃপ্রদত্ত সম্পত্তির বদলে লাবণ্য স্বাধীনভাবে উপার্জনের মাধ্যমে নিজের জীবন অতিবাহিত করতে চেয়েছে। শোভনলালের প্রেম বরাবর তার কাছে উপেক্ষিত রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই লাবণ্যকে একেবারে ‘নারী জাতীয়’ করে উপস্থিত করেছেন। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০০৪ : ৫৬৪)। অমিতের প্রেমে লাবণ্য টেবিলের ওপর নুয়ে পড়ে দুই হাতের মধ্যে মুখ রেখে কেঁদেছে। স্থিতধী, জ্ঞান গরিমা সম্পন্ন, অধিক শিক্ষিত লাবণ্যর উক্তি পুরুষ পাঠককে এক ধরনের আত্মতৃপ্তি দেয় :
ক. [...] আমি তো ভেবে পাই নে, আমার চেয়ে ভালোবাসতে পারে পৃথিবীতে এমন কেউ আছে। ভালোবাসায় আমি যে মরতে পারি। এতদিন যা ছিলুম সব যে আমার লুপ্ত হয়ে গেছে। এখন থেকে আমার আর এক আরম্ভ, এ আরম্ভের শেষ নেই। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০০৪: ৫২৯)
         খ. মিতা, ত্বমসি মম জীবনং, ত্বমসি মম ভূষণং,
     ত্বমসি মম ভব জলধিরত্মম। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০০৪: ৫৩৫)
সবল নারীকে অধিকৃত করার মধ্যে পুরুষের আত্মতৃপ্তি অধিক। লাবণ্যকে জয় করতে অমিতের যে আত্মদান তা তুচ্ছ নয়, কিন্তু কেতকীকে আংটি পরানোর সাত বছর পর লাবণ্যকে অমিত রায় আংটি পরিয়ে কেতকী কিংবা লাবণ্য দুজনেরই নারীত্বের অপমান করেছে। কাহাকে উপন্যাসে মনিকে তার দিদি বোঝানোর চেষ্টা করেছে হয়তো বিলেতি মেয়েটিই ছলনা দ্বারা রমানাথকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মনি সহানুভূতি প্রকাশ করেছে রমানাথের বাকদত্তা মেয়েটির জন্য। লাবণ্যও স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করেছে তবে সেটি মনির মত ধারালো কণ্ঠে না। অমিতকে আংটি ফেরত দিয়ে তাদের অন্তরের সম্পর্কের দায়কে সে অস্বীকার করেছে। আর অমিত যখন কেতকীকে গ্রহণ করেছে কেতকী অমিতের পছন্দ অনুযায়ী নিজেকে বদলে নিয়েছে। এনামেল করা মুখ, উগ্র সাজ, ফিনফিনে শান্তিপুরী শাড়ি পরা কেটি বাইরের রঙটি খসিয়ে ফেলে অমিতের বাহুবন্ধনে ধরা পড়েছে, প্রথাগত বাঙালি লজ্জাবতী ললনার আদলে। কেতকী তার স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়েছে ‘বিবাহ’ নামক প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য। আর অমিত চেয়েছে সমস্ত জীবন দিয়ে তাকে বোঝাতে যে, সে তাকে কোথাও ফাঁকি দিচ্ছে না। ঘরে গৃহিণী বাইরে প্রণয়িনী- প্রথাগত পুরুষতন্ত্র নারীকে বিভিন্ন রূপ কিংবা আদলে সাজিয়েছে নিজের বাসনা চরিতার্থ করতে। লক্ষী কিংবা উর্বশী, ফুলদানিতে সাজানো ফুল অথবা বুনো ফুল দুটোর স্বাদই পুরুষ গ্রহণ করতে চায়। কিন্তু পুরুষের সব রূপই নারীর পূজনীয় হতে হবে এটাই পিতৃতন্ত্রের ছক। তাই লাবণ্য শেষের কবিতাতে বলছে :
    
তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান

 গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ২০০৪ : ৫৬৫)

নারীর এমন স্বীকারোক্তি স্বর্ণকুমারী দেবীর উপন্যাসে অনুপস্থিত। নারী ও পুরুষের জগৎ ভিন্ন, তাদের অভিজ্ঞতা ভিন্ন, দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন, এমনকি প্রকাশের ভঙ্গিও ভিন্ন। এভাবে নারীর সাহিত্য পুরুষের সাহিত্য থেকে পৃথক হয়ে যায়। 

স্বর্ণকুমারী দেবী সময়ের সঙ্গে নিজের অগ্রবর্তী চিন্তাধারা কিংবা লিখনশৈলীরও পরিবর্তন ঘটিয়েছিলেন। প্রথম পর্বে তাঁর রচনার স্টাইলে বঙ্কিমচন্দ্র কিংবা রমেশচন্দ্র দত্তের প্রভাব ছিল। ১ম পর্বে তিনি পুরুষ ঔপন্যাসিকদের ‘লক্ষ্মী’ আদর্শের আদলে গড়েছেন ছিন্নমুকুল উপন্যাসের কনককে বা স্নেহলতা উপন্যাসের স্নেহলতা চরিত্রকে। ২য় পর্বে কাহাকে উপন্যাসে মনি স্বাধীনভাবে জীবনসঙ্গী নির্বাচন করে আধুনিক নারীর পথে নিজেকে এক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। বিংশ শতাব্দীতে এসে স্বর্ণকুমারী দেবী তার ত্রয়ী উপন্যাস বিচিত্রা (১৯২০), স্বপ্নবানী (১৯২১) ও মিলনরাত্রি (১৯২৫) উপন্যাসে নিজ সামর্থ্যে উজ্জ্বল এক বীর নারীর চিত্র এঁকেছেন। সমাজকর্মী স্বর্ণকুমারী তার মানস প্রতিমাকে মূর্ত করেছেন জ্যোতির্ময়ী চরিত্রটির মাধ্যমে। বাল্যকাল থেকেই গৃহ শিক্ষকের কাছে জ্যোতির্ময়ী পরাধীন স্বদেশে ইংরজদের প্রভুত্ব, অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের কাহিনি শুনে এসেছে। এ থেকে পরিত্রাণের পথও খুঁজেছে সে। তাই বিদ্যালয়ের শিক্ষার পাশাপাশি নারীর শারীরিক শিক্ষার জন্য ব্যায়াম প্রতিষ্ঠানের কথা ভেবেছে। প্রসাদপুরে রাজকুমারী জ্যোতির্ময়ী গড়ে তুলেছে ব্যায়ামাগার ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। উপন্যাসের তিনটি খণ্ডে স্বদেশ সাধনা সুসংবদ্ধ রূপ লাভ করেছে। যৌবনে উপনীত হলে তার জীবনে এসেছে স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ যুবক শরৎকুমার। পেশায় সে ডাক্তার। নিজের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির চেয়ে স্বদেশের হিত সাধনার পথ প্রাপ্তিই তাদেরকে এক করেছে। গৃহিণী, বধূ কিংবা মাতৃত্বে এই নারী তার সার্থকতা খোঁজেনি। ব্যক্তিপ্রেমের চেয়ে তার কাছে বড় হয়ে উঠেছে স্বদেশপ্রেম। প্রথাবদ্ধ ভূমিকায় জীবনযাপনের চেয়ে সে নিজেকে পরিপূর্ণ বোধ করেছে স্বদেশের সেবা করে।   

স্বর্ণকুমারী দেবী তার সম্পাদিত ভারতী পত্রিকাতে প্রথম পশ্চিমী নারীবাদ ও নারীআন্দোলনের কথা বলেছিলেন। (সুতপা ভট্টাচার্য ২০০০ : ১৩৯)। বর্তমানে স্ত্রী লিঙ্গ নিয়ে যে বাদানুবাদ ভারতী পত্রিকাতে একশো বছর আগেই তার সূচনা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর সবার সঙ্গেই স্বর্ণকুমারী বিতর্কের জড়িয়েছেন প্রবন্ধের মাধ্যমে। সমতার ভিত্তিতে নারী পুরুষের সম্পর্ককে স্থাপনের প্রচেষ্টা ছিল স্বর্ণকুমারীর। তাঁর উপন্যাস সাহিত্যেও তিনি পরিণত পর্বে তেমন নারীর চিত্রই রূপায়ন করেছেন। নারীকে তিনি সামগ্রিক ভূমিকাতে দেখতে চেয়েছিলেন যেখানে ব্যক্তির চেয়ে সমষ্টির আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়োজন নারীকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। স্বর্ণকুমারী দেবী সেই অগ্রগামী নারীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে তাঁর উপন্যাসে।

তথ্যসূত্র:
আব্দুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান (১৩৮১ বঙ্গাব্দ), বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, বইঘর, চট্টগ্রাম 
কাজী দীন মুহম্মদ (১৯৬৮), বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস (৩য় খণ্ড), স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা
চিত্রা দেবী (১৩৯০ বঙ্গাব্দ), ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২০০৪), ‘শেষের কবিতা’, রবীন্দ্র রচনাবলী (৫ম খণ্ড), ঐতিহ্য, ঢাকা
স্বর্ণকুমারী দেবী (২০০২), ‘স্নেহহলতা’, স্বর্ণকুমারী দেবীর গ্রন্থাবলী, গ্রন্থালয় প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা 
সুতপা ভট্টাচার্য (২০০০), মেয়েলী পাঠ, পুস্তক বিপণি, কলকাতা
সুমনা দাস সুর (২০০৮), ‘অবরোধবাসিনী থেকে সবলা : নারী ঔপন্যাসিকের চোখে 
নারীর আত্মপরিচয়ের সন্ধান’, নারীবিশ্ব, (সম্পাদক : পুলক চন্দ), কলকাতা
সুদক্ষিণা ঘোষ (২০০৮), মেয়েদের উপন্যাসে মেয়েদের কথা, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা
(২০১৭), ‘স্বর্ণকুমারী দেবী : প্রথম দিনের ঊষা’, কোরক সাহিত্য পত্রিকা, বইমেলা সংখ্যা, (সম্পাদক : তাপস ভৌমিক), বইমেলা সংখ্যা, কলকাতা
সেলিনা হোসেন ও নূরুল ইসলাম [সম্পাদিত] (২০০৩), চরিতাভিধান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা 
হুমায়ুন আজাদ (১৯৯৩), ‘উনিশ শতকের বাংলা সাহিত্য’, বাংলাদেশের ইতিহাস (৩য় খণ্ড), এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা ১৯৯৩ 

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • স্বর্ণকুমারী দেবীর কাহাকে ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষের কবিতা