বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেছেন, পাহাড়িরা যেমন শান্তি চায়, আমরাও তেমন শান্তি চাই। শান্তি আসবে আলোচনার মাধ্যমে, সংঘাতের মাধ্যমে শান্তি আসে না। পাহাড়ি জনগোষ্ঠী যেমন নিরাপত্তা চায়, পাহাড়ে বসবাসকারী সাধারণ মানুষও তাদের কাছে নিরাপত্তা চায়। পার্বত্য অঞ্চলে শুধুমাত্র পাহাড়ি থাকবে অন্য জাতিগোষ্ঠী থাকবে না এমন চিন্তা পাহাড়িদের করা ঠিক না। পার্বত্য অঞ্চলের সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা হবে।

রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম: উত্তরণের রাজনৈতিক ভাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় তিনি এমন মন্তব্য করেন।

এ সময় তিনি বলেন, “ভারত যেমন চায় আমরা তাদের সেভেন সিস্টার্স নিয়ে আলোচনা না করি। আমরাও তেমন চাই পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে ভারত যেন আলোচনা না করে। আমাদের সমস্যা আমরা সমাধান করব।”

আরো পড়ুন:

সাতক্ষীরায় বিএনপির কমিটি বাতিলের দাবিতে মশাল মিছিল

হাসিনা ভালো হয়নি, ভারত থেকেও দুষ্টুমি করছেন: ফখরুল  

আলোচনায় সভায় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য শফিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, “পার্বত্যঞ্চলে যারা বসবাস করে তারাও আমাদের দেশের নাগরিক। তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য কয়েকটি দেশ ষড়যন্ত্র করছে। পাহাড়ের নাগরিকরাও নগরের মানুষের মতো একই সুবিধা পাবে। মানুষে মানুষে কোনো বিভেদ থাকবে না।”

আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা.

মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খানসহ প্রমুখ।

ঢাকা/রায়হান/ফিরোজ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

পররাষ্ট্রনীতির পুনর্বিন্যাস অনিবার্য

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থান শুধু দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কাঠামোকেই নাড়া দেয়নি, বরং পররাষ্ট্রনীতি ও কূটনৈতিক কৌশলেও নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। দীর্ঘদিন ধরে চলা ঐতিহ্য ও প্রথাগত কূটনৈতিক অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে সরকার এখন আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রকৃত মিত্র ও প্রতিপক্ষকে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে নতুন মানদণ্ড নির্ধারণ করেছে। এই পরিবর্তন অতীতের পরনির্ভরশীল পররাষ্ট্রনীতি থেকে বেরিয়ে আসার স্পষ্ট ইঙ্গিত। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশকে জাতীয় মর্যাদা, আত্মসম্মান ও বৈশ্বিক পরিসরে সমান অবস্থান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নতুন কৌশল গ্রহণ করার।
স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ নীতির ভিত্তিতে তার কূটনীতি পরিচালনা করে এসেছে। এটি তাত্ত্বিকভাবে মহৎ শোনালেও বাস্তবে সব সময় তা যে কার্যকর হয়নি, ২০২৪ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুধু বন্ধুত্ব ও সৌহার্দ্যের ভিত্তিতে চলে না। বরং এটি স্বার্থ, ক্ষমতার ভারসাম্য এবং কৌশলগত অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। ফলে বিশ্বপরিসরে টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশকেও বাস্তববাদী ও কৌশলগত পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে, যা জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।

কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রনীতিতে কিছু দেশের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। উদাহরণ হিসেবে ভারতের সঙ্গে একতরফা ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট চুক্তির কথা বলা যায়। ক্ষমতাচ্যুত সরকার ও তার পৃষ্ঠপোষক অর্থনীতিবিদরা দাবি করেছিলেন, এসব চুক্তির ফলে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরের মতো বাণিজ্যিক হাব হয়ে উঠবে। বাস্তবে দেখা গেছে, এতে বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের লাভই বেশি। 
গণঅভ্যুত্থানের পর জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে মূল্যায়ন করে সরকার এখন কূটনৈতিক অবস্থান পুনর্মূল্যায়নে বাধ্য হচ্ছে। তাই সামনে চলে এসেছে নতুন পররাষ্ট্রনীতির প্রয়োজনীয়তা। নীতিগতভাবে ও তাত্ত্বিক দিক থেকেও একটি রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও জাতীয় স্বার্থের প্রতিফলন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মূল ভিত্তি ছিল আত্মমর্যাদা, সার্বভৌমত্ব ও মানবিক মর্যাদা। কিন্তু গত কয়েক দশকে আমাদের কূটনীতি ক্রমেই আন্তর্জাতিক শক্তির কাছে নতিস্বীকারের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান সেই ভুলগুলোর দিকে দৃষ্টি ফেরানোর সুযোগ এনে দিয়েছে। এখন বাংলাদেশকে এমন পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হবে, যেখানে জাতীয় মর্যাদা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনো আপস হবে না। সেদিকে এগোনোর সময় তাই লক্ষ্য রাখতে হবে কিছু বিষয়।
প্রথমত, মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করাই হতে হবে নতুন কূটনৈতিক কৌশলের মূলনীতি। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী বিভিন্ন দেশে শ্রমিক, পেশাজীবী ও উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করছে। তাদের অধিকার, সুরক্ষা এবং মর্যাদা নিশ্চিত করতে কূটনৈতিক উদ্যোগকে আরও সক্রিয় করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে অবশ্যই সমান মর্যাদা বজায় রাখতে হবে। বিশ্বপরিসরে নতজানু ভঙ্গির বদলে শক্তিশালী ও আত্মপ্রত্যয়ী জাতি হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে হবে।

তৃতীয়ত, গণঅভ্যুত্থান শিখিয়েছে জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। কেবল সরকারের অভ্যন্তরীণ নীতি নয়; জনগণের মতামত বিদেশনীতি নির্ধারণে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা-ও দেখিয়ে দিয়েছে। অতীতে বিদেশি শক্তির সঙ্গে চুক্তি করার সময় জনমতের গুরুত্ব খুব বেশি দেওয়া হয়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনা স্পষ্ট করেছে, জনগণের চাওয়াকে উপেক্ষা করা হলে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। ভবিষ্যতে সরকার যদি পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে, তাহলে রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বেড়ে যেতে পারে– এ কথা বলাই বাহুল্য।
বর্তমান সরকার বুঝতে পারছে, শুধু বড় দেশগুলোর সমর্থনে টিকে থাকা সম্ভব নয়। ভারত, যুক্তরাষ্ট্র বা অন্য কোনো শক্তিধর রাষ্ট্র কাকে সমর্থন করবে, তা তাদের নিজস্ব স্বার্থে নির্ধারিত হয়। অতীতে দেখা গেছে, প্রয়োজন পড়লে আন্তর্জাতিক মিত্ররাও নিজেদের স্বার্থে সম্পর্কের হিসাবনিকাশ বদলে ফেলে। তাই বাংলাদেশকে নিজের কৌশল নিজেকেই ঠিক করতে হবে, যেখানে জনগণের ইচ্ছা হবে প্রধান বিবেচ্য।

পররাষ্ট্রনীতিতে কৌশলগত পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। চীন ১৯৭৮ সালে অর্থনৈতিক উন্মুক্ততা গ্রহণ করে; তুরস্ক একুশ শতকের গোড়ায় বহুমুখী কূটনীতির দিকে ঝুঁকেছিল; ফ্রান্স ১৯৬৬ সালে ন্যাটো থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিয়ে সার্বভৌম পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করেছিল।
বাংলাদেশ এতদিন ধরে নির্দিষ্ট কিছু দেশের ওপর অতিরিক্ত নির্ভর করে চলছিল। এই নির্ভরশীলতা শুধু অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিকভাবেও ছিল। ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশকে অনেক সময় বাধ্য হয়ে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে, যা নিজের স্বার্থের পরিপন্থি। কিন্তু এখন সময় এসেছে এই পুরোনো ধাঁচের নীতি থেকে বেরিয়ে এসে শক্তিশালী ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি গড়ে তোলার।
জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী, সব দেশই সমান মর্যাদার অধিকারী। জাতিসংঘ সনদের অনুচ্ছেদ ১(২) ও ২(১) অনুযায়ী এটি স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কে সমান মর্যাদা পাওয়ার দাবিদার। অতএব, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হওয়া উচিত এমন, যেখানে আমরা কারও তল্পিবাহক হয়ে থাকব না, বরং বিশ্বমঞ্চে সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত করব। সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে কোনো আপস নয়।

পররাষ্ট্রনীতির এই পরিবর্তনের জন্য শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন, যারা আন্তর্জাতিক চাপের কাছে মাথা নত করবে না। বর্তমানে সরকার তার অবস্থান স্পষ্ট করতে শুরু করেছে যে, কেবল ক্ষমতায় থাকার জন্য বিদেশি শক্তির আশীর্বাদ কামনা তাদের চরিত্র নয়। বরং তারা জনগণের স্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।
এই কৌশলগত পরিবর্তন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে আরও দৃঢ় অবস্থান নিতে সাহায্য করবে। কূটনীতির ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থান নিতে হলে শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্ব নয়, কূটনীতিকদেরও নতুনভাবে প্রশিক্ষিত করতে হবে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমাদের প্রতিনিধিত্ব এমন হতে হবে, যেখানে আমরা অন্যদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল নই, বরং সমান শর্তে আলোচনা করতে পারি।
বাংলাদেশকে অবশ্যই তার পুরোনো পররাষ্ট্রনীতি ঝেড়ে ফেলে, আত্মমর্যাদা ও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন কূটনৈতিক কৌশল গ্রহণ করতে হবে। সময় এসেছে, যখন বাংলাদেশকে বিদেশি শক্তির দিকে তাকিয়ে না থেকে, নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় শক্ত অবস্থান নিতে হবে। 
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান কেবল সরকারের জন্য নয়, কূটনীতির ক্ষেত্রেও এক শিক্ষণীয় অধ্যায় তৈরি করেছে। এখন প্রয়োজন সেই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে শক্তিশালী, আত্মনির্ভরশীল ও সম্মানজনক  একটি পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন।

আলাউদ্দিন মোহাম্মদ: যুগ্ম সদস্য সচিব, এনসিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ